গণপিটুনি মানে অন্ধত্বের বরণ
মানুষ বরগুনার ঘটনা ভোলেনি। স্ত্রীর সামনে, তার লড়াইকে উপেক্ষা করে একদল সহিংস তরুণ তাদেরই বয়সী আরেকজনকে কুপিয়ে হত্যা করেছে, কলেজের সামনে দিনদুপুরে। সেই লোমহর্ষক ঘটনা এখনো আলোচিত। কিন্তু এর মধ্যেই নতুন উপদ্রব ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে খুন। খোদ রাজধানীতে সন্তানের জন্য স্কুলের খোঁজ নিতে গিয়ে গণপিটুনিতে মরলেন এক মা। মারা হয়েছে আরো কয়েকজনকে। এক ভয়াবহ পরিস্থিতি।
‘পদ্মা সেতু নির্মাণে মানুষের মাথা লাগবে’ বলে গুজব ছড়ানোর পরিপ্রেক্ষিতে গণপিটুনির এসব ঘটনা ঘটছে বলে পুলিশের ধারণা। শনিবার রাতে পুলিশ সদর দপ্তর এক বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করেছে, ‘গুজব ছড়িয়ে দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করা রাষ্ট্রবিরোধী কাজের শামিল এবং গণপিটুনি দিয়ে মৃত্যু ঘটানো ফৌজদারি অপরাধ।’ কিন্তু রোববার সকালেই খবর এলো, নওগাঁয় গণপিটুনি দেওয়ার সময় পুলিশ ছয়জনকে গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করেছে।
মানুষ কতটা হিংস্র হলে, কতটা জঙ্গি মনোভাবাপন্ন হলে পিটিয়ে একজন মাকে, তারই মতো আরেকজন ভাইকে মেরে ফেলতে পারে, তা এই সভ্য দুনিয়ায় কেউ ভাবতেও পারবে না। কেউ গুজব তুলে দিল, উপস্থিত একদল লোক মিলে তাৎক্ষণিক পরিকল্পনা করে পিটিয়ে মেরে ফেলল এক অভিযুক্তকে।
গণপিটুনির ক্ষেত্রে ক্ষোভ-রোষ-হিংসা কাজ করে। কাজ করে আইনের প্রতি অশ্রদ্ধা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি অনাস্থা। ‘পদ্মা সেতু নির্মাণে মানুষের মাথা লাগবে’—এই হুজুগে ঘটনাগুলো ঘটছে এখন। তবে সামগ্রিকভাবে আমাদের মানতেই হবে, সমাজে অসহিষ্ণুতা বেড়েছে, যার পরিণতিতে এসব ঘটছে।
কোনো ঘটনার বিন্দুবিসর্গ জানেন না, এমন লোকজনও গণপিটুনিতে যোগ দেয়। কোথাও হয়তো পকেটমার সন্দেহে কাউকে মারধর চলছে। সে সময়ে পাশের রাস্তা থেকে যাচ্ছে কোনো একজন। সে কিছু না জেনেশুনেই ওই মারধরে নেমে পড়ছে। আরেকটা হলো টার্গেট করে গণপিটুনি দেওয়া। কারো সঙ্গে শত্রুতা আছে, তাকে বাগে পাওয়া যাচ্ছে না। বাজারে বা লোকসমাগমের স্থলে গুজব রটিয়ে তাকে গণপিটুনিতে মেরে ফেলার সুযোগও কেউ হয়তো নিচ্ছে। কারণ, অনেকে মিলে মারলে ঘটনার দায় কারো একার থাকে না। পুরো বিষয়টাই অজানা থেকে যায়।
এ দেশে গণপিটুনি নতুন নয়। বেশির ভাগ গণপিটুনির শিকারই হলো ছিঁচকে চোর, পকেটমার ও ডাকাত। যুগ যুগ ধরে ছেলেধরা আতঙ্কের কথাও শুনে আসছি। আজ পর্যন্ত কেউ কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য দিয়ে বলতে পারেনি, ছেলেধরা সন্দেহে যাকে মেরে ফেলা হলো সত্যিই সে ছেলেধরা ছিল কি-না।
যারা পদ্মা সেতুতে মাথা লাগার গল্পটি ছড়িয়েছে, তাদের হীন উদ্দেশ্য আছে। তারা এই প্রকল্পের বাস্তবায়ন চায় না। নানাভাবে ঠেকাতে না পেরে এখন এই কুসংস্কার ছড়িয়ে সাধারণ জনতাকে উত্তেজিত করছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, মানুষ এই আধুনিক যুগে এসেও এসব বিশ্বাস করে ঝাঁপিয়ে পড়ছে নিরীহ মানুষের ওপর। ছেলেধরা সন্দেহে, চোর বা ডাকাত সন্দেহে অপবাদে গণপিটুনিতে হত্যার প্রকৃত সংখ্যাটি আমাদের ধারণারও বাইরে। পুলিশ-প্রশাসন আছে, এই ভয়ংকর প্রথার অস্তিত্ব নিয়ে তারা অবগতও আছে। কিন্তু শুধু আইনের ভয় দেখিয়ে এই ভ্রান্ত বিশ্বাস, কুসংস্কার দূর করা সম্ভব হচ্ছে না।
সহিংসতা, হিংস্রতাকে আমরা যেন সংস্কৃতি করে ফেলেছি। রাজনীতি সহিংসতাকে প্রশ্রয় দিচ্ছে, দিয়ে চলেছে। কিন্তু শিক্ষিত মানুষের বিশাল এক দলকে দেখেছি সামাজিক মাধ্যমে ক্রসফায়ারের নামে বিচারের বাইরে খুন করে বিচার করাকে উচ্ছ্বাসে সমর্থন জানাচ্ছে। এই মনোভাবের মধ্যেই আছে হিংসার সবচেয়ে বড় সম্ভাবনাময় উৎস। সেখান থেকেই সাধারণ মানুষ গণপিটুনি নামের হাতের সুখে নেমে পড়ছে।
রাজনীতি তো তার দায়িত্ব ভুলেছে সেই কবে। ব্যক্তি বনাম ব্যক্তি, ব্যক্তি বনাম গোষ্ঠী, গোষ্ঠী বনাম গোষ্ঠী, সম্প্রদায় বনাম সম্প্রদায়—এমন সব হিংসা লাগিয়ে রাখার মধ্যেই রাজনীতির লাভ। কিন্তু নাগরিক সমাজ? না, নাগরিক সমাজও তার দায়িত্ব পালন করছে না। রাজনীতি ভোট নামক লাভ-লোকসানের বাইরে যায় না। কিন্তু বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের পথটি তো নাগরিক সমাজকেই দেখাতে হবে। অন্যায় সংস্কার রুখবার প্রতিজ্ঞা যদি নাগরিক সমাজ না দেখিয়ে ক্রসফায়ারে উল্লসিত হয়, তাহলে কুসংস্কার ঠেকাবে কে? শুধু পুলিশি ব্যবস্থায় সমাজকে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়।
সত্যি বলতে কি, কোথায় পৌঁছাচ্ছি আমরা—এটা ভাবলেই বিপন্ন বোধ করি। এই দুর্ভাগ্যের মুখোমুখি কেন আমাদের বারবার দাঁড়াতে হচ্ছে, সেটা ভেবে দেখা দরকার। যে আকাশের তলায় জন্মেছি, যে আকাশের তলায় বড় হলাম, যে আকাশের তলায় সারাটা জীবন কাটালাম, যে আকাশের তলায় আমার সন্তান বেড়ে উঠছে বাংলার সেই আকাশটাকে যেন আমি আর চিনতে পারছি না আজ। জানি না হিংসার সংস্কৃতি এই দেশ থেকে বিদায় নেবে কবে।
লেখক : প্রধান সম্পাদক, জিটিভি ও সারাবাংলা।