সিয়াম কী ও কেন
‘সিয়ামুন’ শব্দটি ‘সাওমুন’-এর বহুবচন। এটি একটি আরবি শব্দ এবং ইসলামের ধর্মীয় পরিভাষাগুলোর অন্যতম। যার আভিধানিক অর্থ বিরত থাকা। আর পারিভাষিক অর্থে সাওম বা সিয়াম বলতে কোনো মুমিন ব্যক্তি মহান আল্লাহর নির্দেশ পালনের নিয়তে তাঁরই নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে সুবহে সাদিক উদিত হওয়ার পূর্ব থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত খাদ্য-পানীয় ও যৌনতা থেকে বিরত থাকাকে বোঝায়। সাওমকে আমরা বাংলা ভাষাভাষী মানুষ রোজা বলে জানি।
আর রোজা শব্দটা বাংলা ভাষায় আগত একটি বিদেশি শব্দ। রোজা ফারসি ভাষা থেকে এসেছে। যেমন—নামাজ, এজলাস, মুনসেফ ইত্যাদি। রোজা ইসলামের মৌলিক পাঁচটি বেনার অন্যতম। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রা.) একটি হাদিস বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, পাঁচটি জিনিসের ওপর ইসলামের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত।
১) এ কথার সাক্ষ্যদান করা যে আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো ইলাহ নেই এবং মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর রাসুল; ২) নামাজ কায়েম করা; ৩) জাকাত আদায় করা; ৪) রমজান মাসে রোজা পালন করা এবং ৫) বাইতুল্লাহ শরিফের হজ আদায় করা। (সহিহ আল-বুখারি, হাদিস : ৭, সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২০, সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ২৬০৯, মুসনাদে হুমাইদি, হাদিস : ৭২০, মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ৪৭৯৮) সাওম বা রোজার রোকন দুটি। যথা : ১) সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত খাদ্য, পানীয় ও যৌনতা থেকে বিরত থাকা। ইরশাদ হয়েছে, অতঃপর তোমরা নিজেদের স্ত্রীদের সঙ্গে সহবাস করো এবং যা কিছু তোমাদের জন্য আল্লাহ দান করেছেন, তা আহরণ করো। আর পানাহার করো যতক্ষণ না রাতের কালো রেখা থেকে ভোরের শুভ্র রেখা স্পষ্ট হয়ে যায়। অতঃপর রোজা পূর্ণ করো রাত পর্যন্ত। (সুরা আল-বাকারা : ১৮৭) ২) নিয়ত করা। এরশাদ হয়েছে, তাদের এ ছাড়া অন্য কোনো নির্দেশ দেওয়া হয়নি যে তারা খাঁটি মনে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর ইবাদত করবে। (সুরা আল-বায়্যিনাহ : ৫)
রোজা আদায়ের জন্য নিয়ত করা জরুরি। নিয়ত ছাড়া সারা দিন খাদ্য, পানীয় ও যৌনতা থেকে বিরত থাকলে সেটা রোজা হিসেবে গণ্য হবে না। ফরজ রোজার জন্য সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়ার আগে নিয়ত করতে হবে। নিয়ত আরবি শব্দটির অর্থ মনের ইচ্ছা। সুতরাং রমজান মাসের ফরজ রোজা আদায়ের জন্য মনে ইচ্ছা পোষণ করাই যথেষ্ট। সে মতে, গভীর রাতে ঘুম থেকে ওঠা, অজু করা, খাবার গ্রহণ করা এসবই তো নিয়তের দ্বারা পরিচালিত হয়।
সুতরাং নিয়ত করতে ভুলে গেছি, রোজা হবে কি না এ জাতীয় প্রশ্ন অবান্তর। তবে যাঁরা রাতে ঘুম না ভাঙার কারণে সূর্য ওঠার পরে জাগ্রত হন, তাঁদের ক্ষেত্রে নিয়তের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। নিয়ত মুখে উচ্চারণ করা মুস্তাহাব। নিয়ত আরবিতে করা জরুরি নয়। তবে যদি কেউ আরবি ভাষা বুঝতে পারেন, তাহলে তিনি আরবিতে নিয়তের উচ্চারণ করতে পারেন। নিয়ত আরবিতে বা বাংলায় করাতে নেকি কম বা বেশি হওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই।
রাসুলুল্লাহ (সা.) মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করার পরে দ্বিতীয় বছর রমজান মাসের রোজা ফরজ করা হয়। এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনের আয়াত নাজিল হয়, রমজান হলো সে মাস, যাতে কোরআন নাজিল করা হয়েছে। মানুষের হেদায়েতের জন্য এবং হক ও বাতিলের মাঝে পার্থক্য নির্ধারণের জন্য। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে মাসটি পাবে, সে তাতে রোজা রাখবে। (সুরা আল-বাকারা : ১৮৫) দ্বিতীয় হিজরি শাবান মাসে আয়াতটি নাজিল হয় এবং ওই বছর থেকেই রাসুলুল্লাহ (সা.) ও সাহাবিগণ রমজানের ফরজ রোজা রাখতে শুরু করেন।
দ্বিতীয় হিজরিতে রমজান মাসের রোজা ফরজ হওয়ার আগে মুসলমানগণ আশুরা, অর্থাৎ মুহররম মাসের ১০ তারিখে রোজা রাখতেন। কারো কারো মতে, রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার আগে আশুরার রোজা ফরজ ছিল। অতঃপর রমজান মাসের রোজা ফরজ হওয়ার পরে আশুরার রোজাকে নফল হিসেবে গণ্য করা হয়। আবার কেউ কেউ বলেছেন, আশুরার রোজা তখনো নফল ছিল। তবে রাসুলুল্লাহ (সা.) এটিকে খুব গুরুত্বসহ আদায় করতেন। হজরত আয়েশা (রা.) একটি হাদিস বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, আশুরা এমন একটি দিন, যাতে কোরাইশরা জাহেলি যুগে রোজা রাখত এবং রাসুলুল্লাহও (সা.) জাহেলি যুগে ওই দিন রোজা রাখতেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনায় হিজরত করার পর তিনি নিজে ওই দিন রোজা রাখতেন এবং অন্যদের রোজা রাখতে বলতেন। অতঃপর যখন রমজান মাসের রোজা ফরজ করা হলো, তখন থেকে আশুরার রোজার বাধ্যবাধকতা বর্জিত হলো। সুতরাং তখন যার ইচ্ছা, সে আশুরার রোজা রাখত আর যার ইচ্ছা আশুরার রোজা বর্জন করত। (সহিহ আল-বোখারি, হাদিস : ২০০২, সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১১২৫, সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ২৪৪২, সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ৭৫৩, মুআত্তা ইমাম মালেক, খণ্ড : ৩, হাদিস : ১০৫২) ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক বিধান, গুনাহ মাফের সীমাহীন সুযোগ আর জান্নাত লাভের মহৎ সোপান হলো সিয়ামে রমজান। তাই প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক মুসলিম নর ও নারীর উচিত মাহে রমজানের সব রোজা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে পালন করা।
লেখক : পেশ ইমাম, রাজশাহী কলেজ কেন্দ্রীয় মসজিদ।