ইসলামের আলোকে কোরবানির বর্জ্য ব্যবস্থাপনা
কোরবানি মুসলিম উম্মাহর অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব। বছর ঘুরে দিনটি আসে মানব মনের ভোগের ক্ষুধা আর পাশবিক চেতনাকে মিটিয়ে দিয়ে ত্যাগের মহিমায় উদ্বুদ্ধ করে ভ্রাতৃত্বের প্রেরণায় অনুপ্রাণিত করতে। কিন্তু জীবনের বাস্তবতায় পাশবিকতার লালন আর ত্যাগের শিক্ষার দলনটাই মুখ্য হয়ে দেখা দেয়। যখন কোরবানির পশুর রক্ত, বর্জ্য আর হাড়-হাড্ডি যত্রতত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকার কারণে পচে-গলে দুর্গন্ধ ছড়ায় এবং পরিবেশদূষণ ও বিভিন্ন রোগব্যাধি বিস্তারের কারণ হয়ে দেখা দেয়; কোরবানিদাতা যখন তার কোরবানির পশুর রক্ত আর বর্জ্য পরিবেশ, সমাজ আর জীবনের জন্য কতটা ক্ষতির কারণ হতে পারে সেটা বেমালুম ভুলে থেকে জবাইকৃত পশুর মাংসটা নিয়ে ঘরে ফিরে যায়—তখন তার কোরবানিটা যে ভোগের নেশাকে পূরণের উদ্দেশ্যে, সেটা আর প্রমাণের প্রয়োজন পড়ে না।
কোরবানি হতে হবে একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশে। এরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহর নিকট তোমাদের কোরবানির জন্তুর রক্ত-মাংস কোনো কিছুই পৌঁছায় না, তাঁর নিকট পৌঁছে শুধু তোমাদের অন্তরের তাকওয়াটুকু। এভাবে আল্লাহ পশুগুলোকে তোমাদের অনুগত করে দিয়েছেন যেন তোমরা তোমাদের হেদায়েত দেওয়ার জন্য আল্লাহর বড়ত্ব বর্ণনা করো। আর সৎকর্মশীলদের শুভসংবাদ জানিয়ে দাও।’ (সুরা আল-হজ : ৩৭)
সুতরাং যে কোরবানি জীবন, সমাজ ও পরিবেশের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে ওঠে, তা কখনো আল্লাহর উদ্দেশে নিবেদিত হতে পারে না।
পরিচ্ছন্নতা ইমানের অঙ্গ
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) একটি হাদিস বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ইমানের সত্তরের অধিক শাখা রয়েছে। তার মধ্যে উত্তম শাখাটি হলো ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু’ বলা আর সর্বনিম্ন শাখাটি হলো রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্তু সরিয়ে ফেলা।’ (সহিহ আল-বোখারি, হাদিস : ৯, সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৩৫)
আলোচ্য হাদিস দ্বারা বিষয়টি স্পষ্ট প্রমাণিত হয়, কোরবানির পশুর রক্ত, বর্জ্য পরিষ্কার করা ইমানের দাবি। তা ছাড়া পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন না থাকলে জান্নাতে যাওয়াও সম্ভব নয়। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) একটি হাদিস বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, তোমরা যথাসাধ্য পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকো। কেননা, আল্লাহতায়ালা ইসলামকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ওপর প্রতিষ্ঠা করেছেন। আর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ব্যক্তি ছাড়া কেউই জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।’ (জামে সাগির, হাদিস : ৩০১)
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন রাসুলে করিম (সা.)-কে পরিচ্ছন্ন জীবনযাপনের জন্য বারবার তাগিদ দিয়েছেন। যেমন এরশাদ হয়েছে, ‘আর তোমার পোশাক-পরিচ্ছদকে পবিত্র রাখো। এবং যাবতীয় মলিনতা ও অপবিত্রতা থেকে দূরে থাকো।’ (সুরা আল-মুদ্দাসসির: ৪-৫)
সুতরাং কোরবানির পশুর রক্ত আর বর্জ্য পরিষ্কার করা মুমিন ও মুসলিম পরিচয়ের সার্থকতার জন্যও অপরিহার্য।
করণীয়
ক. কোরবানির পশু জবাইয়ের জন্য বসতবাড়ি থেকে সম্ভাব্য দূরবর্তী কোনো পরিষ্কার স্থান বেছে নিতে হবে।
খ. জবাইয়ের জায়গা ভালো করে পরিষ্কার করে এমন একটি গর্ত খুঁড়ে নিতে হবে, যাতে জবাইকৃত পশুর সম্পূর্ণ রক্ত তাতে জমা হতে পারে।
গ. এমনভাবে জবাই করতে হবে যেন পশুর রক্ত গর্তেই জমা হয়, চতুর্দিকে ছড়িয়ে না পড়ে।
ঘ. জবাইয়ের পরে গর্তটা মাটি দিয়ে এমনভাবে ঢেকে দিতে হবে যেন রক্ত-পচা দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়তে না পারে।
ঙ. পশুর সব বর্জ্য বড় আকারের গর্ত করে তার মধ্যে রেখে মাটিচাপা দিতে হবে। যদি পৌরসভা বা সিটি করপোরেশন এলাকায় হয়, তাহলে নির্দিষ্ট স্থানে সেগুলো রেখে দিতে হবে, যাতে পরিচ্ছন্নকর্মীরা সময়মতো সেগুলো অপসারণ করতে পারেন।
চ. চামড়া ছাড়ানো ও মাংস সংগ্রহের পরে ওই জায়গাটা উত্তমরূপে ধুয়ে ফেলতে হবে এবং যথেষ্ট পরিমাণ ব্লিচিং পাউডার সেখানে ছিটিয়ে দিতে হবে, যাতে জনদুর্ভোগের কারণ না হয়।
লেখক : পেশ ইমাম, রাজশাহী কলেজ কেন্দ্রীয় মসজিদ