মুশফিক শিখেছেন, মুশফিক জিতেছেন
পায়ে চোট, দৌড়াচ্ছিলেন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। তবু হার মেনে নিতে রাজি নন। মুশফিকুর রহিম যেন প্রায়শ্চিত্তের ধ্যানে মগ্ন এক ঋষি। প্রায়শ্চিত্ত কীসের? সবাই ভুললেও মুশফিক তো ভোলেন না। ভুলতে পারেন না।
সেদিনও মুশফিক ছিলেন, ম্যাচ জিতে উল্লাসে ভাসতে পারতেন সেদিনও। সেদিনের ম্যাচটা যেন হুবহু মিলে গিয়েছিল এই ম্যাচের সাথে। ব্যাঙ্গালুরুতে ভারতের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বাংলাদেশকে জেতাতে পারেননি মুশফিক। তবে প্রেমাদাসায় দলকে জিতিয়ে গর্জাতে গর্জাতে মাঠ ছেড়েছেন নায়ক হয়েই।
এক রানের বুক ফেটে যাওয়া পরাজয়টার সাথে অবশ্য এই ম্যাচটা মেলানো নিয়ে একটা তর্ক থাকবেই। কথা উঠতেই পারে। কোথায় বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে তাদের মাঠেই জয়ের সম্ভাবনা, আর কোথায় নিদাহাস ট্রফির ম্যাচ? তুলনার দোষে দুষ্ট হওয়ার দরকারটা আপাতত নেই।
ব্যাঙ্গালুরুতে সেদিন এক ওভারে লাগত ১১ রান। শেষ তিন বলে প্রয়োজন এক রান- প্রায় বছর দুয়েক আগের সেই বাংলাদেশ-ভারত রণে বাংলাদেশের জয় পাওয়ার হিসাবটা ছিল এমনই। ক্রিকেটে জয়ের জন্য এর চেয়ে সহজ সমীকরণ বোধ হয় আর হয় না।
ওভারের দুই বাউন্ডারিই কি মুশফিককে ফুঁসলে দিল! ম্যাচ জয়ের আগেই করে বসলেন উল্লাস। বলকে হাঁকিয়েই জয় পেতে চাইলেন মুশফিক। জিততে চাইলেন সীমানা পার করেই। হার্দিক পান্ডিয়ার বলে এক স্লগ সুইপে বলটা যখন ভাসে হাওয়ায়, মুশফিকের সাথে বাংলাদেশও তখন অপেক্ষায় ম্যাচ জিতে নেওয়ার। শেরে বাংলা হলে নিশ্চিত সেদিন মাঠে পড়ে যেত পিনপতন নীরবতা। স্বাগতিকদের মাঠ বলেই পুরো মাঠের উল্লাসটা বেড়ে গেল দ্বিগুণ।
শিখর ধাওয়ান লুফে নিলেন মুশফিকের ক্যাচ। একটু আগেই ‘অগ্রিম’ উদযাপনে ব্যস্ত বাংলাদেশ উইকেটরক্ষক ফিরলেন মাথা হেঁট করেই। ঠিক পরের বলেই মাহমুদউল্লাহও সাজঘরের রাস্তায়। ভাগ্যের হেরফের তো ছিলই, সাথে স্নায়ুর চাপটা ঠিকঠাক সামলাতে না পারার দরুন জয় রয়ে গিয়েছিল অধরাই। হৃদয়ে রক্তক্ষরণ নিয়েই বিরাট কোহলিদের উল্লাসটা চেয়ে চেয়ে সেদিন দেখেছিলেন সাকিব-তামিমরা। সাথে দেখেছে পুরো দেশ।
অতীত তো অতীতই। সে বেদনার হোক, হোক আনন্দের। সব ভুলে চোখ রাখা যাক একখানে, শেখার জায়গাতে। শনিবার মুশফিক যখন মাঠে নামছেন তামিম ইকবাল আর লিটন দাসের দারুণ শুরুতে জয়ের স্বপ্নরা উঁকিঝুঁকি দিচ্ছিল একটু একটু করে। সৌম্য সরকারকে নিয়ে মুশফিক সেই স্বপ্নদের দিলেন দাঁড়াবার ভিত।
হয়তো জিতে যাওয়া যাবে এমন সমীকরণ দাঁড় করিয়ে ফিরেছেন সৌম্য। ‘ওই তো মঞ্জিল, ছুঁয়ে দেওয়া যায়’- মঞ্চ তৈরি করে বিদায় নিলেন মাহমুদউল্লাহও। সাব্বিরকে নিয়ে জয়ের বন্দরে ভিড়তে প্রস্তুত অর্ধশতক তুলে নেওয়া মুশফিক। তখনই আলসেমির মূল্য দিয়ে রানআউটের ফাঁদে পড়ে শূন্য হাতে ফিরলেন সাব্বির। ডানহাতি এই মারকুটে ব্যাটসম্যান শেষ কয়েক ম্যাচেই ব্যর্থ নিজের নামের প্রতি সুবিচার করতে।
আবারও কি এক বুক যন্ত্রণার পরাজয়? তীরে এসে তরী ডোবানোর পুরোনো গল্পের নতুন মঞ্চায়ন? কলম্বো থেকে ঢাকা- প্রশ্ন একটাই।
অনেকক্ষণ ধরেই খোঁড়াচ্ছিলেন মুশফিক। সবার ভয় যদি আর দৌড়াতেই না পারেন! যদি বের হয়ে যেতে হয় মাঠ থেকে! সেই ভয়কে তুড়িতে উড়িয়ে নুয়ান প্রদীপের বলে বিশাল এক ছয় হাঁকিয়ে জয়ের কুপিতে আবারও কেরোসিনটা দিলেন সেই মুশফিকই।
শেষ ওভারে প্রয়োজন ছিল ৯ রান। প্রথম বলে দৌড়ে দুই রান, পরের বলেই বাউন্ডারি। তৃতীয় বলে ফের দুই রানে ব্যাঙ্গালুরু আবারও ভেসে উঠল স্কোরকার্ডে।
তিন বলে রান দরকার এক!
না সেদিনের ভুলটা আর করলেন না মুশফিক। থিসারা পেরেরাকে মিড উইকেটে ঠেলেই প্রেমাদাসাকে করে দিলেন বাকরুদ্ধ। যেন শ্মশানের নিঃস্তব্ধতা নেমে এলো ৩০ হাজার দর্শকে বোঝাই কলম্বোর মাঠটাতে। ব্যাঙ্গালুরুর আক্ষেপটা মুশফিক দাফন করলেন ‘নাগিন’ নাচে। জানালেন সবাইকে তিনি ভুল থেকে শিখেছেন। তাই তো জিতেছেন, জিতিয়েছেন দলকে।