বিশ্বরেকর্ডের পথে বাংলাদেশের নাজমুন
চুলে আফ্রিকার স্টাইল—মাথাভরা সোনালি ও বাদামি রঙের অসংখ্য বেণি কাঁধ ও পিঠ ছুঁয়েছে। দেখামাত্র মনে হবে, সদ্য আফ্রিকা অঞ্চল ঘুরে এসেছেন। শারীরিক গড়নে, চেহারায় তার ছাপ। সাজেও। এই মানুষটিই এখন পর্যন্ত লাল-সবুজের পতাকা উড়িয়েছেন বিশ্বের ১২৫টি দেশে! স্বপ্ন সুদূর ছোঁয়ার।
বাবা শখ করে তাঁর নাম রেখেছিলেন সোহাগী। পুরো নাম নাজমুন নাহার। কে জানত, লক্ষ্মীপুরের এই সোহাগীই পৃথিবীর এত দেশে পদধূলি রাখবেন! অবশ্য আরব ঘুরেছিলেন তাঁর দাদা। শৈশবে দাদুর মুখেই ভ্রমণের গল্প শোনা। সেই থেকে মাথায় চাপে ভ্রমণের ভূত। বাকিটা ইতিহাস।
নাজমুন একা পৃথিবীর ১২৫টি দেশ ভ্রমণ করেছেন, কখনো সাহারার মরুভূমি, কখনো বিপদসংকুল আফ্রিকার জঙ্গল, আবার কখনো সমুদ্রের তলদেশে। তাঁর ভ্রমণের ১২৫তম দেশ নাইজেরিয়া।
আফ্রিকার সোয়াজিল্যান্ডের মানুষের সঙ্গে নাজমুন
সোহাগীর স্বপ্ন বাংলাদেশের স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরপূর্তির মধ্যেই জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত ১৯৩টি দেশ ভ্রমণের। আরো স্বপ্ন, স্বাধীনতা না পাওয়া সাতটি দেশ ভ্রমণের। দুইশ দেশে পা রাখলেই পৃথিবীর প্রথম মানবী হিসেবে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে ঠাঁই হবে এই পরিব্রাজকের, জানালেন নাজমুন নিজেই।
২০০০ সালে প্রথম দেশের বাইরে পা রাখেন প্রতিবেশী ভারতে। এরপর এশিয়ার কয়েকটি দেশ ভ্রমণ করেন। ২০০৬ সালে উচ্চশিক্ষার জন্য যান ইউরোপের দেশ সুইডেনে। ভর্তি হন লুন্ড ইউনিভার্সিটিতে। এরপর অবারিত হয় নাজমুনের দিগন্ত। ২০০৭ সালে ফিনল্যান্ড দিয়ে ইউরোপ ভ্রমণ শুরু। এরপর পূর্ব আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকা, ক্যারিবীয় দ্বীপরাষ্ট্র, আরব ও ওশেনিয়া অঞ্চল, পশ্চিম আফ্রিকা—১৮ বছরে ১২৫টি দেশ ভ্রমণ। রেখেছেন প্রতিটি মহাদেশে পা।
চুলে যে আফ্রিকার স্টাইল, তার অর্থ নাজমুন সদ্য আফ্রিকা ঘুরেছেন। পশ্চিম আফ্রিকার মৌরিতানিয়া থেকে সেনেগাল, মালি, গাম্বিয়া, গিনি, গিনি বিসাউ, লাইবেরিয়া, সিয়েরা লিয়নসহ মোট ১৫টি দেশ ভ্রমণ করেছেন সড়কপথে।
পেরুর রংধনু পর্বতে নাজমুন
ভ্রমণ করতে গিয়ে প্রাকৃতিক প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয়েছেন অনেকবার। মৃত্যুর কাছাকাছিও পৌঁছে গিয়েছিলেন, তবে ফিরেছেন বাংলাদেশের সোহাগী। কখনো বরফশীতল পরিবেশ, কখনো উচ্চ উষ্ণতা; কিছুই দমাতে পারেনি তাঁকে। পেরুর ১৪ হাজার ২০০ ফুট উঁচু রেইনবো পর্বত আরোহণের সময় প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট হয়েছিল।
‘ভেবেছিলাম, মৃত্যু সন্নিকটে। মনে হচ্ছিল, শরীর থেকে কী একটা ছেড়ে যাচ্ছে। আমি বসে পড়লাম। গাইড আমাকে বলল, যদি মরে যাই, তাহলে আমার লাশ নিয়ে নিচে যেতে পারবে না। তাঁকে বলেছিলাম, যদি মরেও যাই, বুকে লাল-সবুজের পতাকা নিয়ে মরব,’ বলেন নাজমুন।
এরপর অচেনা ভ্রমণসঙ্গীদের একজন তাঁকে তরল ইনহেলার দেন, হাতে মেখে নাকের কাছে ধরেন। ধীরে ধীরে প্রাণ ফিরে পান নাজমুন।
অগ্ন্যুৎপাতের ফলে সৃষ্ট ‘নীল আগুন’ দর্শনে ইন্দোনেশিয়ার ইজেন কার্টারে নাজমুন
এমন অসংখ্য প্রতিকূলতার গল্প আছে তাঁর ঝুলিতে। চোখের পর্দায় বিশ্বের কত মানুষের চলচ্চিত্র। কত বিচিত্র অভিজ্ঞতা। ২০১৬ ও ২০১৭ সালে টানা ঘুরেছেন ৩৫টি দেশ। গেল বছর সফর করেছেন ৩২টি দেশ। ২০১৮ সালের জুনের প্রথম দিন নাজমুন ১০০ দেশ ভ্রমণের মাইলফলক স্পর্শ করেন।
নাজমুন পৃথিবীর এক দেশ থেকে অন্য দেশে হাজার হাজার মাইল সড়কপথে একা ভ্রমণ করে চলেছেন নিজ দেশের পতাকা হাতে। নারী হিসেবে শতাধিক স্বাধীন দেশ ঘোরার স্বীকৃতিস্বরূপ গাম্বিয়া সরকারের কাছ থেকে পেয়েছেন ‘ফ্ল্যাগ গার্ল’ (পতাকাকন্যা) উপাধি।
মা তাহেরা আমিনকে নিয়ে নাজমুন ঘুরেছেন পৃথিবীর ১৪টি দেশে। মায়ের সঙ্গে করেছেন সুইজারল্যান্ডের আল্পস পর্বত জয়!
কাসপিয়ান সমুদ্রের তীরবর্তী আজারবাইজানের বাকু শহরে নাজমুন
‘আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দময় স্মৃতি মায়ের সঙ্গে। ২০১০ সালে বাবা যখন আমাদের ছেড়ে চলে যান, তখন আমার হঠাৎই মনে আসে—এই যে বাবার সঙ্গে মায়ের ৪০ বছরের সংসারজীবন—আমি পৃথিবীর এত সুন্দর সুন্দর জায়গায় ঘুরছি, আমার মা কি কিছু পাবে না? ২০১১ সালে মাকে সুইডেনে নিয়ে যাই। ইচ্ছে ছিল মায়ের হাত ধরে পৃথিবী ঘুরব। দুই মাস ইউরোপ-আমেরিকায় ঘুরি। সবচেয়ে মধুর স্মৃতি আল্পস পর্বত জয়। মায়ের সঙ্গে আমি মেঘ ছুঁয়েছি, গায়ে মেখেছি—কী যে সেই অনুভূতি! মায়ের মুখ দেখে মনে হয়েছিল, যেন ৪০ বছরের কষ্ট কিছুটা হলেও লাঘব হয়েছে। মায়ের মধ্যেই আমি পৃথিবীকে দেখি। আমেরিকায় মায়ের সঙ্গে চাঁদের মাটিও ছুঁয়েছি,’ বলেন নাজমুন।
বাংলাদেশের পতাকা হাতে নাজমুন শান্তির দূত হিসেবেও কাজ করে যাচ্ছেন বিশ্বের অনেক দেশে। পেশায় গবেষক এ ভ্রমণকন্যা এ পর্যন্ত বিভিন্ন মহাদেশে লক্ষাধিক শিশুকে লাল-সবুজের পতাকার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন।
প্রকৃতির মধ্যেই নিজের ভালোবাসাকে খুঁজে পেয়েছেন নাজমুন নাহার সোহাগী। বিশ্বের প্রতিটি দেশে লাল-সবুজের পতাকা পৌঁছে দেওয়ার দৃঢ় প্রত্যয় তাঁর। জয় হোক শান্তির, জয় হোক ভালোবাসার—অবিরাম গুনগুন করে চলেন বাংলাদেশের পতাকাকন্যা।