মিয়ানমারে সেনাবাহিনী পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে : যুক্তরাষ্ট্র
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে রোহিঙ্গাদের ওপর পরিচালিত মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর হত্যা-নির্যাতনকে ‘সুপরিকল্পিত ও সংঘবদ্ধ নৃশংসতা’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
গতকাল সোমবার প্রকাশিত প্রতিবেদনটিতে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের সংখ্যালঘু মুসলমান রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর দেশটির সেনাবাহিনীর অভিযান চলাকালে সংঘটিত হত্যা, গণধর্ষণ ও নির্যাতন বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অনুসন্ধান তুলে ধরা হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা এখন থেকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে ২০ পাতার ওই প্রতিবেদনটির ভিত্তিতে পদক্ষেপ নেবেন। বিশেষ করে মিয়ানমারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের ক্ষেত্রেও এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। প্রতিবেদন প্রকাশের পর এখন মিয়ানমারের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের পক্ষ থেকে নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হতে পারে।
তবে প্রতিবেদনটিতে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হত্যা-নির্যাতনকে ‘গণহত্যা’ বা ‘মানবতাবিরোধী অপরাধ’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি কর্মকর্তাদের সূত্রের বরাতে রয়টার্স জানিয়েছে, একে ‘গণহত্যা’ বা ‘মানবতাবিরোধী অপরাধ’ বলা হবে কি না, এ নিয়ে সরকারের অভ্যন্তরে ব্যাপক বিতর্ক হয়েছে এবং এ জন্যই প্রতিবেদনটি প্রকাশে প্রায় এক মাস দেরি হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘প্রাপ্ত জরিপে দেখা যায়, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সাম্প্রতিক সহিংসতা ছিল চরম পর্যায়ের, বৃহৎ-পরিসরে, বড় একটা অঞ্চলজুড়ে ছড়িয়ে পড়া, জনগণের মধ্যে ভয়ভীতি ছড়িয়ে তাদের ভিটেমাটি থেকে বিতাড়িত করার আয়োজন।’ এতে আরো বলা হয়, ‘সেনাবাহিনীর অভিযানের ধরন বলে দিচ্ছে, এটি সুপরিকল্পিত এবং সংঘবদ্ধ।’
প্রতিবেদনটিতে জানানো হয়, জরিপে অংশ নেওয়া প্রায় ৮০ শতাংশ রোহিঙ্গা সরাসরি হত্যাকাণ্ড দেখেছেন এবং হত্যাকারীদের বেশিরভাগই পুলিশ বা সেনাসদস্য।
চোখের সামনে শিশু-কিশোরদের হত্যা, নিরস্ত্র মানুষকে গুলি করা, জীবন্ত কবর দেওয়া, গণকবরে পুঁতে ফেলা এবং নারী ধর্ষণের মতো রোমহর্ষক ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন পালিয়ে বেঁচে আসা রোহিঙ্গাদের অনেকেই। অহরহ ধর্ষণের ঘটনার পাশাপাশি মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সদস্যরা অনেক সময় প্রকাশ্যেই রোহিঙ্গা নারীদের ধর্ষণ করেছে বলে তারা জানায়।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, একজন প্রত্যক্ষদর্শী জানায়, চারজন রোহিঙ্গা নারীকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় এবং তাদের গাছের সঙ্গে দড়ি দিয়ে বেঁধে টানা তিন দিন উপর্যুপরি ধর্ষণ করা হয় এবং পরে তাদের আধমরা অবস্থায় পাওয়া যায়।
সোমবার পরক্ষণেই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ ওয়াশিংটনভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা পাবলিক ইন্টারন্যাশনাল ল অ্যান্ড পলিসি গ্রুপও একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সংস্থাটি জানায়, তারা ভুক্তভোগী রোহিঙ্গাদের সাক্ষাৎকার ও মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতনের তথ্যপ্রমাণ সংবলিত ১৫ হাজার পৃষ্ঠার নথি এই প্রতিবেদন তৈরিতে কাজে লাগিয়েছে।
২০১৭ সালের জুলাইয়ে রোহিঙ্গাদের একটি উগ্রপন্থী সংগঠন মিয়ানমারের নিরাপত্তারক্ষীদের ওপর হামলা চালালে দেশটির সেনাবাহিনী স্থানীয় বৌদ্ধদের সঙ্গে নিয়ে রোহিঙ্গাদের ওপর অভিযান চালায়। অভিযানে সহস্রাধিক রোহিঙ্গা সদস্যের প্রাণহানি ঘটেছে বলে মানবাধিকার সংগঠনগুলো জানিয়েছে।
মিয়ানমারের সেনাপ্রধান এবং পাঁচ জেনারেলকে আন্তর্জাতিক আইনে বিচারের আওতায় আনার আহ্বান জানিয়ে জাতিসংঘের প্রকাশিত প্রতিবেদনের এক মাসের মাথায় যুক্তরাষ্ট্র তাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে তুলনামূলক কম গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে এ প্রতিবেদন প্রকাশ করল। জাতিসংঘ তাদের প্রতিবেদনে অবশ্য মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ‘গণহত্যার অভিপ্রায়ের’ অভিযোগ এনেছিল।
তবে শুধু ‘জাতিগত নিধন’ না বলে একে ‘গণহত্যা’ বললে যুক্তরাষ্ট্রকে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আরো কঠোর ভূমিকা নিতে হতো। ট্রাম্প প্রশাসনের অনেকেই এমন ধারণা পোষণ করছে বলে রয়টার্স জানিয়েছে।
মিয়ানমার বিষয়ে ট্রাম্প প্রশাসনের গা বাঁচানো অবস্থান নেওয়ায় বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন এবং যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কিছু আইনপ্রণেতা সমালোচনায় মুখর ছিলেন। এই প্রতিবেদনের ফলে ট্রাম্প প্রশাসনের প্রতি এ বিষয়ে আরো কঠোর হওয়ার প্রতি চাপ কিছুটা বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ওয়াশিংটন কার্যালয়ের পরিচালক সারাহ মর্গান বলেছেন, ‘বিপুল পরিমাণ ভুক্তভোগীর জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে সহায়তা এবং অর্থবহ জবাবদিহি নিশ্চিত করতে যুক্তরাষ্ট্রের সরকার কতটা আন্তরিক, তা (এই প্রতিবেদনে) স্পষ্ট নয়।’
অন্যদিকে, রোহিঙ্গাদের জোরপূর্বক উচ্ছেদ ও বিতাড়িত করার বিষয়টি যুদ্ধাপরাধ নাকি মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে, তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত গত সপ্তাহে কাজ শুরু করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ একজন কর্মকর্তা রয়টার্সকে নাম না প্রকাশ করার শর্তে আইনগত বিবেচনায় গুরুত্বপূর্ণ পরিভাষা ‘গণহত্যা’ উল্লেখ না করার দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, ‘এটি পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেওর ওপর নির্ভর করছে, তিনি চাইলে পরে এ ধরনের আইনি পরিভাষা ব্যবহার করতে পারেন।’ এমন সম্ভাবনাকেও উড়িয়ে দিচ্ছেন না তিনি।
গতকাল যুক্তরাষ্ট্র রোহিঙ্গাদের জন্য তাদের সহায়তার অর্থের পরিমাণ ১৮৫ মিলিয়ন (১৮ কোটি ৫০ লাখ) ডলার বাড়িয়ে প্রায় দ্বিগুণ করার ঘোষণা দিয়েছে।