৩৭০ অনুচ্ছেদ
কাশ্মীরে কী ঘটেছে, কেন তা তাৎপর্যপূর্ণ
স্বাধীনতার সাত দশক পর জম্মু ও কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসন ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছে ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) নেতৃত্বাধীন ভারত সরকার। নিজেদের এমন সিদ্ধান্তের পক্ষে নানা যুক্তিও দিচ্ছে সরকার। বিবিসির এক প্রতিবেদনে জম্মু ও কাশ্মীর ইস্যুতে কেন এমন ঘটনা ঘটল এবং কেন এ ঘটনা গুরুত্বপূর্ণ, সে বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে।
কাশ্মীর কেন বিতর্কিত?
হিমালয়ভিত্তিক পার্বত্য অঞ্চল কাশ্মীরকে ভারত ও পাকিস্তান দুদেশই নিজেদের বলে দাবি করে। একসময় এ অঞ্চলটির নাম ছিল জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্য। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার সময়টায় ব্রিটিশ রাজের অধীনে থেকে একজন রাজা অঞ্চলটি শাসন করতেন। এর পর ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসন শেষ হয়ে যখন ভারতবর্ষ পাকিস্তান ও ভারতে বিভক্ত হলো, তখন ভারতের সঙ্গে থেকে যায় জম্মু ও কাশ্মীর।
এরপর অঞ্চলটির দখলদারিত্ব নিয়ে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে ভারত ও পাকিস্তান। এ অঞ্চলের দুটি আলাদা অংশ নিজেদের অধীনে নিয়ে যুদ্ধবিরতিতে যায় দেশ দুটি। টানা হয় ভারত-পাকিস্তান সীমান্তরেখা ‘লাইন অব কন্ট্রোল’।
ভারত-নিয়ন্ত্রিত জম্মু ও কাশ্মীরে ৩০ বছর ধরে চলছে ভারতের অধীনতাবিরোধীদের সঙ্গে প্রশাসনের সংঘাত-সংঘর্ষ।
কী ঘটেছে কাশ্মীরে?
কাশ্মীরে কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে, তার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছিল এ মাসের শুরু থেকেই। হঠাৎ করেই এ অঞ্চলে মোতায়েন করা হয় কয়েক হাজার ভারতীয় সেনা, বন্ধ করে দেওয়া হয় অমরনাথ তীর্থযাত্রা। এলাকা ছাড়তে বলা হয় পর্যটকদের। পাশাপাশি বন্ধ ঘোষণা করা হয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম। টেলিফোন ও ইন্টারনেট সেবাও বন্ধ করে রাখা হয়। আঞ্চলিক রাজনৈতিক নেতাদের গৃহবন্দি করে রাখা হয়।
কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে আলোচনায় উঠে আসে ভারত সরকারের সংবিধানের ৩৫-ক অনুচ্ছেদ বাতিলের সম্ভাব্য পরিকল্পনা। এ অনুচ্ছেদের বলে জম্মু-কাশ্মীরের জনগণ কিছু বিশেষ সুবিধা ভোগ করতেন।
এরপরই সবাইকে হতভম্ব করে দিয়ে সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদের প্রায় সবটুকু রদ করার ঘোষণা দেয় ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদের অংশ হলো অনুচ্ছেদ ৩৫-ক। এই অনুচ্ছেদের বলেই স্বাধীনতার ৭০ বছর ধরে ভারতের সঙ্গে এক জটিল সম্পর্কে জুড়ে ছিল কাশ্মীর।
৩৭০ অনুচ্ছেদের তাৎপর্য কতটুকু?
ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদে জম্মু ও কাশ্মীরকে একটি নির্দিষ্ট পর্যায় পর্যন্ত স্বায়ত্তশাসনের ক্ষমতা দেওয়া ছিল। এর ফলে নিজস্ব পতাকা ও আইন প্রণয়ন করার ক্ষমতা ছিল স্থানীয় প্রশাসনের। আর কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে ছিল পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষাবিষয়ক এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা।
এর ফলে জন্মু ও কাশ্মীরের জনগণ-সংশ্লিষ্ট আইনকানুন বানানোর ক্ষমতা ছিল স্থানীয় প্রশাসনের হাতে। পাশাপাশি এ অঞ্চলের সম্পদের মালিকানা ও মৌলিক অধিকার বিষয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাও ছিল স্থানীয় প্রশাসনের অধীনে। ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের কোনো নাগরিক জম্মু-কাশ্মীরের কোনো সম্পত্তি ক্রয় করতে পারতেন না কিংবা সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে পারতেন না।
এই ৩৭০ অনুচ্ছেদের সুবাদে কাশ্মীরের স্থায়ী বাসিন্দারাই শুধু সেখানে বৈধভাবে জমি কিনতে পারতেন, সরকারি চাকরি করার সুযোগ পেতেন এবং সেখানে ব্যবসা পরিচালনা করতে পারতেন।
ওই অনুচ্ছেদ বিলোপের বিষয়টি কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপির পুরোনো রাজনৈতিক এজেন্ডাগুলোর একটি। কিন্তু এ সিদ্ধান্তের ফলে সেখানে তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এখন জম্মু ও কাশ্মীর ‘ইউনিয়ন টেরিটরি’ বা কেন্দ্রীয়ভাবে শাসিত রাজ্য হিসেবে পরিচালিত হবে। আর লাদাখ কেন্দ্রশাসিত তৃতীয় একটি এলাকা হিসেবে বিবেচিত হবে।
কেন মোদি সরকারের এমন পদক্ষেপ?
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল বিজেপি দীর্ঘদিন ধরে সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদের বিরোধিতা করে আসছিল এবং ২০১৯ সালে বিজেপির নির্বাচনী ইশতেহারে তা বাতিলের ব্যাপারটি উল্লেখ ছিল।
বিজেপি কাশ্মীরকে সংযত রাখার ব্যাপারে যুক্তি দিয়েছিল। রাজ্যটিকে ভারতের অন্য অংশগুলোর মতো করার জন্য পদক্ষেপ নেওয়ার ব্যাপারেও বলেছিল বিজেপি। গত এপ্রিল-মের লোকসভা নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়ী হওয়ার পর এমন পদক্ষেপ নেওয়ার ব্যাপারে খুব একটা সময় নেয়নি বিজেপি।
তবে কাশ্মীরিরা মনে করছেন, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলটিতে বাইরের মানুষদের জমি কেনার সুযোগ করে দিয়ে এর ধর্মীয় ব্যবস্থার পরিবর্তন করতে চায় বিজেপি।
মোদি সরকারের সিদ্ধান্তে কী কী বদলে গেল?
৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের ফলে কাশ্মীরের আলাদা কোনো সংবিধান থাকল না। অন্য রাজ্যগুলোর মতো ভারতীয় সংবিধান মেনে চলতে হবে কাশ্মীরকে। এখন ভারতীয় আইনগুলো কাশ্মীরিদের ওপর প্রয়োগ করা হবে। সেইসঙ্গে রাজ্যের বাইরের মানুষ সেখানে জমি কিনতে পারবে। তবে কেন্দ্রীয় সরকারের দাবি, এর ফলে কাশ্মীর আরো উন্নত হবে।
এ ব্যাপারে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ সংসদে বলেন, ‘আমি জম্মু-কাশ্মীরের মানুষকে বলতে চাই, রাজ্যের কতটা ক্ষতি করেছে এই ৩৭০ ও ৩৫-ক অনুচ্ছেদ। এর জন্য রাজ্যে পুরোপুরি গণতন্ত্রকে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। রাজ্যে দুর্নীতি ঢুকে পড়েছিল।’
এর পাশাপাশি জম্মু-কাশ্মীর ও লাদাখকে পৃথক কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল করার প্রস্তাব দেওয়া হয়। এই প্রস্তাবে জানানো হয়, জম্মু-কাশ্মীরে আইনসভা থাকবে, কিন্তু লাদাখে কোনো আইনসভা থাকবে না।
কংগ্রেসের বর্ষীয়ান নেতা পি চিদাম্বরম কেন্দ্রের এমন পদক্ষেপকে ‘সর্বনাশা’ বলে উল্লেখ করেছেন। এর ফলে মারাত্মক পরিণতি হতে পারে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। চিদাম্বরম বলেন, ‘আপনারা ভাবছেন যে বিজয় ছিনিয়ে নিয়েছেন। কিন্তু আপনারা ভুল এবং ইতিহাস প্রমাণ করবে যে আপনারা ভুল ছিলেন। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম জানবে, এই সংসদে এমন একটি ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।’
মোদি সরকারের পদক্ষেপ কতটা বৈধ?
ভারতের সংবিধান অনুযায়ী, কেবল রাজ্য সরকার চুক্তির মাধ্যমে এই ৩৭০ অনুচ্ছেদ পরিবর্তন করতে পারবে। সংবিধান বিশেষজ্ঞ সুভাষ কাশ্যপ বার্তা সংস্থা এএনআইকে জানান, এটি ‘সাংবিধানিকভাবে সঠিক’ এবং এতে কোনো ‘আইনি বা সাংবিধানিক ভুল’ খুঁজে পাওয়া যায়নি।
তবে এতে দ্বিমত পোষণ করেছেন সংবিধান বিশেষজ্ঞ এ জি নুরানি। তিনি বিবিসিকে জানান, এটি একটি ‘অবৈধ’ সিদ্ধান্ত। এবং এর বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে চ্যালেঞ্জ জানানো উচিত।