সৌদি রাজপ্রাসাদের ‘ব্লু ডায়মন্ড’ চুরির রহস্য উন্মোচন!
সৌদি আরবের রাজপ্রাসাদ থেকে ব্লু ডায়মন্ডসহ (নীল হীরা) মূল্যবান অলংকার চুরির ঘটনা কারো অজানা নয়। নতুন খবর হলো, সেই ১৯৮৯ সালে রহস্যজনক এই চুরির পেছনের গল্পটা জানা গেছে।
ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসির এক প্রতিবেদনে জানা যায়, রাজপ্রাসাদের সেই অলংকার চোর থাইল্যান্ডের ক্রিয়াংক্রাই তেচামং। রাজপ্রাসাদের পরিচ্ছন্নতাকর্মী ছিলেন তিনি।
সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে চুরির পেছনের কথা বলেছেন সেই থাই চোর।
সৌদি আরবের বাদশাহ ফাহাদের বড় ছেলে প্রিন্স ফয়সাল তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে তিন মাস অবকাশযাপনের জন্য প্রাসাদ ছাড়েন। আর এই সুযোগটাই কাজে লাগান ক্রিয়াংক্রাই তেচামং।
পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে রাজপ্রাসাদের আনাচে কানাচে কী কী আছে কোনো কিছুই অজানা ছিল না ক্রিয়াংক্রাইয়ের। চোর হিসেবে মোটেই সাদামাটা ছিলেন না ক্রিয়াংক্রাই। আগে থেকেই তাঁর জানা ছিল যুবরাজের চার কিংবা পাঁচটি অলংকারের বাক্স প্রায়ই তালাবদ্ধ থাকত না।
জুয়া খেলার কারণে বেশ ঋণও হয়েছিল ক্রিয়াংক্রাইয়ের। তাই অলংকার চুরির এই সুবর্ণ সুযোগ মোটেও হাতছাড়া করতে চাননি এই থাই চোর।
অলংকার চোর থাইল্যান্ডের ক্রিয়াংক্রাই তেচামং। ছবি : সংগৃহীত
সুযোগ বুঝে এক সন্ধ্যায় এক অজুহাত বের করে প্রাসাদে ঢুকেন তিনি। পরে অপেক্ষা করেন কখন অন্যকর্মীরা প্রাসাদ থেকে বের হবে এবং এই সুযোগে তিনি ঢুকবেন যুবরাজের শোবার ঘরে। যখনই সবাই চলে যায়, ঠিক তখনই তিনি অলংকারগুলো নিজের শরীরে কিছু লুকিয়ে ফেলেন। আর বাকি অলংকারগুলো ভ্যাকুয়াম ক্লিনারের ব্যাগে যেভাবে হোক তিনি রাখেন। প্রায় ২ কোটি মার্কিন ডলার মূল্যের অলংকার চুরি করেন ক্রিয়াংক্রাই। এর মধ্যে সোনার ঘড়ি ও রুবি পাথরও ছিল।
সেই রাতে ক্রিয়াংক্রাই প্রাসাদের গোপন একটা জায়গায় সেই চুরি করা জিনিসগুলো রাখেন, যেখানে কারো দেখার সুযোগ ছিল না। এর এক মাস পর সেই অলংকারগুলো কার্গো ডেলিভারির মাধ্যমে থাইল্যান্ডে পাঠিয়ে দেন।
এরপরই ক্রিয়াংক্রাই নিজের দেশ থাইল্যান্ডে পালিয়ে যান। এবার নতুন এক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন তিনি; তা হলো, থাই কাস্টমারের কাছ থেকে তিনি কীভাবে অবৈধ অলংকারগুলো উদ্ধার করবেন। কারণ বিদেশ থেকে আমদানি হওয়া সব পণ্য দেশে ঢোকার সময় চেক হয়। ক্রিয়াংক্রাই আগে থেকেই জানতেন, থাই কর্মকর্তাদের ঘুষ নেওয়ার অভ্যাস রয়েছে। এই সুযোগটাই কাজে লাগান ক্রিয়াংক্রাই। একটা খামে মোটা অংকের অর্থ আর একটা চিরকুটে তিনি লেখেন তাঁর আমদানিকৃত পণ্যসম্ভারে অবৈধ পণ্য আছে, এটা না দেখলেই তিনি খুশি হবেন।
ক্রিয়াংক্রাইয়ের এই পরিকল্পনা কাজে লাগে। তবে সে যাত্রায় তিনি বেঁচে গেলেও ১৯৯০ সালের জানুয়ারিতে থাইল্যান্ডের উত্তরের লাম্পাং প্রদেশে তাঁর বাড়ি থেকে থাই পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে।
তবে উদ্ধার হওয়া অলংকারগুলোর মধ্যে ৮০ ভাগই পাওয়া যায়নি। যা পাওয়া যায় তার বেশিরভাগই ছিল নকল। কারণ এরই মধ্যে অলংকারগুলো কালো বাজারে বিক্রি করে দিয়েছিলেন থাই চোর। এর মধ্যে ৫০ ক্যারেটের একটা ডিম্বাকৃতির ‘ব্লু ডায়মন্ড ছিল’।
এই ব্লু ডায়মন্ডটাই বেশি দরকার ছিল সৌদি প্রিন্সের। হীরাটি খোঁজার নির্দেশও দেন তিনি। কিন্তু সেটি আর পাওয়া যায়নি। এই ব্লু ডায়মন্ডের ঘটনা এখনো সুস্পষ্ট নয়। কারণ ক্রিয়াংক্রাইয়ের জেলে শাস্তি হওয়ার পরও এই ব্লু ডায়মন্ড নিয়ে পানি কম ঘোলা হয়নি। শুরু হয় কূটনৈতিক সংকট। এমনকি ঘটে হতাহতের মতো ঘটনা।
১৯৯০ সালের ফেব্রুয়ারিতে ব্যাংককে সৌদি দূতাবাসের ভিসা বিভাগের দুজন কর্মকর্তা থাইল্যান্ডে গাড়ি চালাচ্ছিলেন। তাঁদের গন্তব্য থেকে প্রায় দেড় মাইল দূরে তাঁদের গাড়িতে বন্দুকধারী সন্ত্রাসীরা হামলা করলে তাঁরা নিহত হন।
এর কয়েক সপ্তাহ পর সৌদি ব্যবসায়ী মোহাম্মদ আল রুওয়াইলিকে নিয়ে কী ঘটেছিল তা দেখতে ব্যাংককে পাঠানো হয়। কিন্তু তাঁকেও অপহরণ করা হয় এবং তাঁর মরদেহও খুঁজে পাওয়া যায়নি।
২০১০ সালে ব্যাংককে মার্কিন দূতাবাসের মিশনের উপপ্রধান এক লিখিত বক্তব্যে জানান, তিনজন কূটনীতিককে হত্যার বিষয়টি হিজবুল্লাহর সঙ্গে সৌদি বিরোধের অংশ ছিল।’ সৌদি আরব ও থাইল্যান্ডের এই কূটনৈতিক সমস্যার সমাধান এখনো হয়নি।
আর এ সবকিছুর জন্য ক্ষমা চেয়েছেন সেই থাই চোর ক্রিয়াংক্রাই। ২৮ বছর সাজা শেষে তিনি এখন অনুতপ্ত। ক্রিয়াংক্রাই বলেন, ‘নিজের দেশে সাধারণভাবে আমি বাঁচতে চাই। আমার খুব বেশি টাকার দরকার নেই। আমি আমার পরিবার নিয়ে সুখী থাকতে চাই।’
ব্লু ডায়মন্ডের চেয়ে নিজের জীবন এখন মূল্যবান বলে মনে করছেন ৬১ বছরের ক্রিয়াংক্রাই। কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করবেন বলে জানান তিনি। এটাই তাঁর কাছে এখন প্রকৃত সুখ।