‘বাংলাদেশি’ বৃদ্ধের লাশ নিয়ে বিপাকে আসাম সরকার
ভারতে দুলাল চন্দ্র পাল (৬৫) নামের এক বৃদ্ধকে বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশকারী হিসেবে চিহ্নিত করেছিল দেশটির আসাম রাজ্যের সরকার। এর পরই অসুস্থতাজনিত কারণে রাজ্যের একটি ডিটেনশন ক্যাম্পে তাঁর মৃত্যু হয়। আর এখানেই তৈরি হয়েছে জটিল পরিস্থিতি। এ মৃত্যু মেনে নিতে পারছে না আসামে বসবাসকারী দুলালের পরিবার। মরদেহ নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে তারা। ক্ষোভ প্রকাশ করে দুলালের পরিবার বলছে, মৃত ব্যক্তি যদি বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী হন, তবে তাঁর মরদেহ বাংলাদেশেই পাঠিয়ে দেওয়া উচিত, তাঁদের কাছে হস্তান্তর করে কোনো লাভ নেই।
তবে ওই পরিবারের পক্ষ থেকে আরো জানানো হয়েছে, যদি দুলাল পালকে ভারতীয় নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়, তবেই লাশ নেবেন তাঁরা। আর দুলালের পরিবারকে সমর্থন জানিয়েছেন স্থানীয়রাও।
দুলালের পরিবারের এমন অবস্থানে বিপাকে পড়েছে রাজ্যের বিজেপি সরকার। শেষ পর্যন্ত ম্যাজিস্ট্রেট পর্যায়ে তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, অতিরিক্ত ডেপুটি কমিশনারকে দিয়ে এ ঘটনার তদন্ত করা হবে। এর আগে ওই বৃদ্ধের মৃত্যুর ঘটনায় তদন্তের দাবি জানিয়ে সরকারকে স্মারকলিপি দিয়েছে একটি বাঙালি শিক্ষার্থী সংগঠন।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, আসামের গুয়াহাটির সোনিতপুর জেলার আলিশিঙ্গা গ্রামের বাসিন্দা দুলাল চন্দ্র পাল। ২০১৭ সালের ১১ অক্টোবর থেকেই তেজপুর ডিটেনশন ক্যাম্পে ছিলেন তিনি। কিন্তু গত সেপ্টেম্বর মাসে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। এরপরই তাঁকে ভর্তি করা হয় গুয়াহাটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।
গত রোববার সেখানেই মৃত্যু হয় দুলালের। এর আগে ডায়াবেটিস, কিডনি ও মানসিক রোগেরও চিকিৎসা করা হয় তাঁর। ভারতে অনুপ্রবেশের অভিযোগে দুলালকে গ্রেপ্তারের সময় তিনি মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন ছিলেন বলেও জানা গেছে।
দুলাল চন্দ্র পালের বড় ছেলে আশিস পাল বলেন, ‘রাজনীতিবিদ ও সরকারের শীর্ষ কর্মকর্তারা প্রতিনিয়ত আমাদের বাড়িতে আসছেন এবং মরদেহ নেওয়ার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছেন। কিন্তু আমরা পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছি যে লিখিতভাবে বাবাকে ভারতীয় নাগরিক হিসেবে ঘোষণা দিতে হবে।’
আশিস আরো বলেন, ‘ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল আমার বাবাকে বিদেশি হিসেবে ঘোষণা দেয়। সরকারকে এর সত্যতা খুঁজে বের করতে হবে। কিন্তু সরকার তাঁর মরদেহ আমাদের হাতে তুলে দিতে চাইছে কেন? সরকার বরং আমার বাবার মরদেহ বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিক।’
দুলালের ভাইপো সাধন পালও একই কথা জানান। তিনি বলেন, ‘মঙ্গলবার পুলিশের সদস্যরা আমাদের বাড়ি এসে মরদেহ হস্তান্তর প্রক্রিয়া শুরুর জন্য প্রয়োজনীয় নথিতে স্বাক্ষর করতে বলেন। ওই নথিতে দুলালকে একজন বিদেশি হিসেবে উল্লেখ করা হয়ছিল এবং ঠিকানায় কোনো কিছুর উল্লেখ ছিল না। তিনি যদি অবৈধ বাংলাদেশি নাগরিক হন, সে ক্ষেত্রে তাঁর মরদেহ বাংলাদেশেই পাঠিয়ে দেওয়া উচিত। পুলিশ আমাদের কাছে কেন আসছে?’
সাধন আরো বলেন, ‘আসামে সদ্য প্রকাশিত নাগরিকপঞ্জির (এনআরসি) চূড়ান্ত তালিকায় দুলাল চন্দ্র পালের ছেলে ও পরিবারের সবার নাম আছে। এমনকি ১৯৬০ সাল থেকে জমি সম্পর্কিত নথিও আছে।’
এদিকে গত মঙ্গলবার দুলালের পরিবারের সঙ্গে দেখা করেন আসামের কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট রিপুন ভোরা। তিনি জানান, দুলাল পালকে বিদেশি হিসেবে অভিযোগ করায় তাঁর পরিবারের সদস্যরা সেই মরদেহ নিতে রাজি হচ্ছেন না।
স্থানীয়রাও দাবি করছেন, মরদেহ হস্তান্তরের জন্য চাপ না দিয়ে বিজেপি সরকারের উচিত দুলাল পালের নাগরিকত্বের পরিচয়ের সত্যতা খুঁজে বের করা। আর পাল পরিবারের এই সিদ্ধান্তের পর থেকেই স্থানীয় প্রশাসনও পড়েছে বিপাকে।
সোনিতপুর ডেপুটি কমিশনার মানবেন্দ্র প্রতাপ সিং বলেন, ‘এটা সত্য যে দুলালের মরদেহ নিতে অস্বীকার করেছে তাঁর পরিবার। আমরা আমাদের সাধ্যমতো ওই পরিবারকে বোঝানোর চেষ্টা চালাচ্ছি। কিন্তু তাঁরা তাঁদের অবস্থানে অনড় রয়েছেন।’
মানবেন্দ্র বলেন, ‘পরিবারের সদস্যরা দাবি তুলেছেন যে দুলাল পালকে ভারতীয় নাগরিক হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হলেই তাঁরা মরদেহ হাতে নেবেন। কিন্তু ওই বিষয়টি আমার এখতিয়ারে নেই। কারণ, ফরেন ট্রাইব্যুনালেই তাঁকে বিদেশি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।’
মানবেন্দ্র প্রতাপ আরো বলেন, ‘দুলাল পাল ভারতীয় নাগরিক নন। আমি তাঁর সৎকার করার অনুমতি দিতে পারি না। পরিবারকেই ওই মরদেহ নিতে হবে।’
বিদেশি নাগরিক হিসেবে চিহ্নিত নাগরিকদের রাখার জন্য বর্তমানে আসামে ছয়টি ডিটেনশন ক্যাম্প রয়েছে এবং তার সবকটি রয়েছে কারাগারের মধ্যে। সব মিলিয়ে ওই ক্যাম্পগুলোতে রয়েছে প্রায় এক হাজার ব্যক্তি। সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, ২০১১ থেকে গত কয়েক বছরে ডিটেনশন ক্যাম্পে মৃত্যু হয়েছে ২৬ জনের। এবার শুধু অবৈধ বিদেশি নাগরিকদের জন্য গোয়ালপাড়া জেলার মাটিয়াতে বিশাল আকারে তৈরি হচ্ছে সপ্তম ডিটেনশন সেন্টার।