ট্রাম্প বদলাননি, বদলে গেছেন ভোটাররাই!
মাত্র কয়েক মাস আগেই চিত্রটা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। প্রথমে তো রিপাবলিকান প্রার্থী হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের যোগ্যতার প্রশ্নই তুলেছিলেন অনেকেই। কিন্তু নির্বাচনের ঠিক আগের মুহূর্তে এসে তাঁরাই বলছেন, ট্রাম্প বদলাননি, বদলে গেছেন ভোটাররাই! কী মন্ত্রবলে বদলে গেল বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশটির ভোটের চালচিত্র- দেখে নিই একনজরে।
ট্রাম্প যখন রিপাবলিকানদের হয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থিতার স্বপ্ন দেখা শুরু করলেন, সে সময়ে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন প্রভাবশালী মার্কিন সিনেটর টেড ক্রুজ, ফ্লোরিডার সিনেটর মার্কো রুবিওর মতো বাঘা বাঘা রিপাবলিকান। ছিলেন আরো অনেক প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। এঁদের সরিয়ে ট্রাম্প যে মনোনয়ন পাবেন, একসময় সেটাই ছিল অকল্পনীয়।
কিন্তু ১৩ মাসের মনোনয়নযুদ্ধ শেষে দেখা গেল গোটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের ভোটে সবার ওপরে আছে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নাম। তাও একেবারে ভূমিধস বিজয় নিয়ে।
২০১৪ সালের এপ্রিলে যখন ‘প্রায় অরাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব’ ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজের প্রার্থিতা ঘোষণা করেছিলেন, তখন তিনি যে শেষ পর্যন্ত প্রার্থী নির্বাচিত হতে পারবেন, তা ভাবেনি কেউই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের সবগুলো অঙ্গরাজ্যের প্রাইমারি ও ককাসে সব মিলিয়ে এই ট্রাম্পই ১৭২৫ জন রিপাবলিকান প্রতিনিধির সমর্থন পেয়েছেন। অথচ প্রার্থিতা নিশ্চিত করতে তাঁর প্রয়োজন ছিল ১২৩৭ জনের সমর্থন। তাঁর বিপরীতে টেড ক্রুজ পেয়েছিলেন ৪৭৫, কাসিচ ১২০ ও মার্কো রুবিও পেয়েছিলেন ১১৪ জন প্রতিনিধির সমর্থন।
এমন জয়ে প্রার্থিতা নিশ্চিতের পরও মূল নির্বাচনের ফলাফলটা একপেশে হবে বলেই ঢালাও মন্তব্য করে দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্ব সংবাদমাধ্যম। কারণ তাঁর বিপরীতে যে ছিলেন মার্কিন রাজনীতির অন্যতম আলোচিত ব্যক্তিত্ব সাবেক ফার্স্টলেডি ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন! স্বাভাবিকভাবেই ডেমোক্রেট প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনের দিকেই সমর্থনের পাল্লা ভারী ছিল।
যার ছাপ দেখা গেছে নির্বাচনী প্রচারণা শুরুর পরেও। প্রথম ও দ্বিতীয় প্রেসিডেনসিয়াল বিতর্কে হিলারির ক্ষুরধার যুক্তি, শাণিত আক্রমণের কাছে একেবারে নাস্তানাবুদ ট্রাম্প। এর প্রভাব পড়েছিল নির্বাচনের জরিপেও। প্রথম প্রেসিডেনসিয়াল বিতর্কের আগে হিলারি ও ট্রাম্পের পক্ষে জনমত জরিপের ফলাফল ছিল- হিলারি ৫৬ : ট্রাম্প ৩৯।
এর ওপর একের পর এক অসংবেদনশীল ও বিতর্কিত মন্তব্য করে আস্তে আস্তে যেন ভোটের রাজনীতি থেকেই দূরে সরে যাচ্ছিলেন ট্রাম্প। গত জুলাইয়ে মনোনয়নের পর নির্বাচনী প্রচারের সময়টায় এমন অনেক কিছুই হয়েছে, যা হয়নি আগে কখনো।
বিতর্কিত বক্তব্য, নারীদের নিয়ে অসংবেদনশীল মন্তব্য ফাঁস। সব মিলিয়ে প্রচারে বেশ পিছিয়েই গিয়েছিলেন ট্রাম্প। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছিল, ভোটের রাজনীতিতে দোদুল্যমান অঙ্গরাজ্য হিসেবে পরিচিত ফ্লোরিডা আর ওহাইয়োতে গিয়ে দুয়োধ্বনি শুনতে হয়েছিল তাঁকে।
এর মধ্যে আবার ট্রাম্পের বিরুদ্ধে নারী হেনস্তা, এমনকি শিশু ধর্ষণের অভিযোগও ওঠে। মার্কিন ফেডারেল কোর্টে ১৯৯৪ সালে ১৩ বছর বয়সী এক শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে মামলা করে ‘ধর্ষিতা’ নিজেই। এ সংবাদ পেয়েই সংবাদমাধ্যম একটুও দেরি না করে জানিয়ে দেয় এর আগে ১৯৯১ সালে ট্রাম্পের সাবেক স্ত্রী ইভানাও বিবাহবিচ্ছেদের সময় ‘ধর্ষণের’ অভিযোগ করেছিলেন।
একদিকে একের পর এর বিতর্কিত মন্তব্য, অন্যদিকে নানা রকম ভয়াবহ অভিযোগ আর ভিডিও ফাঁস। সঙ্গে নিজের অবস্থান থেকে একচুলও না নড়ে ট্রাম্পের ‘অহেতুক গোয়ার্তুমি’। সব মিলিয়ে কট্টর রিপাবলিকান সমর্থকরাও বলতে শুরু করেছিলেন, ‘পাগলের’ হাতে দায়িত্ব দিয়ে দল এবার বিশ বাঁও জলে।
এ পর্যায়ে এসে ট্রাম্পের বিপক্ষে বলতে শুরু করেন বাঘা নেতারাও। একপর্যায়ে পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান দলের প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পকে নির্বাচনী প্রচারণায় সহায়তা না করতে দলের ৭০ জনেরও বেশি নেতা কেন্দ্রীয় কমিটিকে চিঠি দেন। চিঠিতে তাঁরা ট্রাম্পকে দলে ‘বিভেদ সৃষ্টিকারী’ ও ‘অযোগ্য’ প্রার্থী উল্লেখ করে কেন্দ্রীয় কমিটিকে জানান, নভেম্বরের নির্বাচনে তিনি দলকে ডোবাবেন।
কিন্তু নির্বাচনের ঠিক দুদিন আগে এসে ভোজবাজির মতো যেন উল্টে গেছে সমীকরণ। একের পর এক বিতর্কিত মন্তব্য করে নিজের অবস্থান থেকে এক চুলও নমনীয় না হয়ে ভোটের আগমুহূর্তে হিসাব অনেকটাই পাল্টে দিয়েছেন রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প। সিএনএনের শেষ নির্বাচনী জরিপে হিলারি : ৪৬ ট্রাম্প : ৪৪।
এই অবস্থায় দাঁড়িয়ে এ নির্বাচনে ট্রাম্পের প্রায় ‘প্রতিপক্ষ’ হয়ে দাঁড়ানো ওয়াশিংটন পোস্টও খবর প্রকাশ করতে ‘বাধ্য’ হয়েছে- ট্রাম্প বদলাননি, বদলে গেছেন ভোটাররাই!
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কারা এই ভোটার যাঁরা ট্রাম্পের এহেন ভাবমূর্তির পরও তাঁকেই সমর্থন দিচ্ছেন? ওয়াশিংটন পোস্টের খবর অনুযায়ী, ট্রাম্পের প্রধান সমর্থকগোষ্ঠী এখন ‘খাঁটি মার্কিনিরা’। মানে যাঁরা নিজেদের ‘মার্কিন নাগরিক’ বলে দাবি করেন। এই তালিকায় কট্টর রিপাবলিকান ছাড়াও আছেন শ্বেতাঙ্গ এবং কয়েক প্রজন্ম ধরে আমেরিকায় বসবাস করা কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠী।
এ ছাড়া আছেন মার্কিন মুলুকের ব্যবসায়ীরা। ওবামার ব্যবসায়িক নীতিতে যাঁরা নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এই শ্রেণিটি মনে করেন, ডেমোক্রেটদের দুই মেয়াদের শাসনে যুক্তরাষ্ট্রের সবকিছু থমকে আছে। একমাত্র ট্রাম্পই পারেন সবকিছু বদলে দেশকে নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দিতে।
এ ছাড়া অর্থনৈতিক মন্দা, স্বাস্থ্যনীতিসহ বিভিন্ন কারণে ডেমোক্রেটিক সরকারের বিরুদ্ধে ভোট দেবেন সাধারণ মার্কিনিদের অনেকেই। এঁরা হয়তো ওবামা সরকারের আমলে চাকরি হারিয়েছেন, নয়তো চাকরি পাননি। এঁদের অনেকেই মনে করেন, ডেমোক্রেটদের নিয়ে আর কোনো উন্নয়ন সম্ভব নয়। সত্যিকারের আমেরিকা হতে হলে ট্রাম্পের মতো শক্তিশালী কাউকেই দরকার।
এদিকে ডেমোক্রেটিক প্রশাসনের অভিবাসন তোষণনীতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে অনেকেই আবার ট্রাম্পকে ভোট দেবেন। কারণ শ্রমের বাজারে সস্তায় পাওয়া অভিবাসীদের কারণে মার্কিনিদের অনেকেই কাজ পাচ্ছেন না। এই অসন্তুষ্ট মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীর ভোট প্রভাব ফেলবে এবারের নির্বাচনে।
এ ছাড়া বরাবরের মতোই হিস্পানিক ও বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী ভোট দেবেন রিপাবলিকান ট্রাম্পকে। সম্প্রতি এক জরিপে দেখা গেছে, হিস্পানিকদের মধ্যে ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা বেশি। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের মোট ভোটারের ৩.৭ শতাংশ হিস্পানিক ও অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর ভোটার হয়ে উঠতে পারে ট্রাম্পের ট্রাম্পকার্ড।
এ ছাড়া আরেকটি বিষয়ও নির্বাচনে প্রভাবক হবে বলে মনে করছেন ভোটাররা। আর তা হলো ঐতিহ্যগতভাবেই ডেমোক্রেটদের ভোটদানে অনীহা। ডেমোক্রেটদের অনেকেই হয়তো দলকে সমর্থন করেন কিন্তু ভোট দিতে যান না। এবার ভোট না দেওয়ার এই হার অনেক বেশি হবে বলে আশঙ্কা করছেন সমীক্ষকরা। আর এই ভোট না দেওয়ার প্রবণতাটির শিকার হতে পারে হিলারির ভোটবাক্স।
এ ছাড়া সব সময়ের ডেমোক্রেট ভোটারদের অনেকেই হিলারিকে এখন আর বিশ্বাস করতে পারছেন না। এঁরা ট্রাম্পের সমর্থক নন, কিন্তু হিলারিকেও পছন্দ করেন না। এঁরা অনেকেই আবার যোগ্য প্রার্থী নেই বলে কষ্ট করে ভোটদানে অনাগ্রহের ব্যাপারে প্রচারণা চালাচ্ছেন। এই ‘আরামপ্রিয়’ ডেমোক্রেটরাও হিলারির ক্ষতির কারণ হতে পারেন।
অন্যদিকে ঐতিহ্যগতভাবেই রিপাবলিকানরা তাঁদের প্রার্থীকে ভোট দিতে যান। গত কয়েকটি নির্বাচনে এ ব্যাপারটিকে তাঁরা একরকম উৎসবে পরিণত করে ফেলেছেন। আর রিপাবলিকানদের এই ‘সুঅভ্যাসের’ কারণে উপকৃত হতে পারেন ট্রাম্প।
এ রকমই আরো অনেক নির্বাচনী প্রভাবই আছে- যা এই শেষের দিকে এসে ট্রাম্পের অনুকূলে যাচ্ছে। সঙ্গে জনপ্রিয়তাও বাড়ছে ট্রাম্পের। ফলে একসময়ের একেবারে ‘উড়িয়ে দেওয়া’ এবং ‘প্রেসিডেন্ট হওয়ার যোগ্য নয়’ প্রার্থীটিও বিস্তর ভাবাচ্ছেন হিলারির নির্বাচনী শিবিরকে। পরাজয়ের শঙ্কাও যে একেবারে আসছে না, তাও কিন্তু নয়!
সবকিছু মিলিয়ে এবার যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন উৎসব যে শেষ সময়ে এসে জমে উঠেছে তা স্বীকার করে নিচ্ছেন ট্রাম্পের ঘোর বিরোধীরাও। সব মিলিয়ে এবার ইলেকটরদের জন্য অপেক্ষা। জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে তাঁরা কাকে নির্বাচিত করেন তা স্পষ্ট হয়ে যাবে মার্কিন সময় আগামীকাল বৃহস্পতিবার সকাল ১০টার মধ্যেই।