সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন
এমনে এমনে—আছে মেলে যায় কতো দিন!
জুলেখার বাপে মরছে হেই—আর বছর আষাঢ় মাসের পয়লা দিগে। তার বাদে বচ্ছর ঘুইরা, আরেক আষাঢ় মাসও গেছে গা কবে! দিনে দিনে কেমনে দিন যায়! জুলেখার বাপের অমুন আঁতকা মরোন দেইক্ষা সগল গেরামবাসীয়ে ডরাইছে যতো, তার অধিক পাইছে বেদনা! তাগো সগলের অন্তর সগল সোম খালি চিপ্পা চিপ্পা আফসোস করতে থাকছে!
এইর আগে দেওভোগ গেরামের কেউ কোনোদিন এমুন জলজ্যান্ত সয়সুস্থ মানুষরে চক্ষের সামোনে তগনগদ দাপাইয়া মরতে দেখে নাই। ওলা বিবির দয়া আইলেও তো এক-দুই দিন টেমাইয়া টোমাইয়া জিন্দা থাকে বিমারি! শীতলা বিবিও তো নেয় কয়দিন ভোগান্তি দিয়াই। গেরামের সগল বুড়া মাইনষেই যায় নানান পদের অসুখের জ্বালা সহ্য কইরা কইরা। বিছনায় পড়া থাকে তারা বহুত দিন। শেষমেশ কঠিন-রকম জান-কান্দানির আজাব পাইতে পাইতে মরে একেকজোন। কেউই তো জুলেখার বাপের লাহান এমতে যায় না! এমতে তো কেউই যায় নাইক্কা!
শইল্লে যার কোনোরকম বিমার নাই; পুরা যেয় নীরোগী, ভালা মানুষ—এমুন চক্ষের পলকে সেই মানুষটার দম গেলো গো! জিন্দিগি তাইলে কী! এই আছে এই নাই! দমটুক যাইতে তাইলে কতোখোন!
তাইলে কথায় যে কয়, ইল্লায় বালাই দূর, বাহানায় মউত; সেই কথা তো মিছা না!
তাইলে তো এমুন যেকোনো একটা নাই-ছুতা, কোনোরকম একটা বাহানা খালি লাগে দমটুক যাইতে! এই যেমুন জুলেখার বাপে গেলো গা! কেমুন আচরিত মরোন মরলো বেটাটায়! বিশ্বাস হয়? কেউর বিশ্বাস হইতে চায় না!
সেয় কী সোন্দর খাইতাছিলো দুগা খুদ ভাজা দিয়া নারিকেল-কোঁড়া! আজরাইলে তারে খাওন শেষ করোনেরও ফুরসতখান দিলো না!
সানকি খালিও হয় নাই, তার আগেই গেলো গা দমখান!
কী খাইতে খাইতে মরলো? না, দুগা খুদ ভাজা। এমুন নিদুষী জিনিসে নি এমনে মউতরে টাইন্না আনতে পারে!
কই, একই খাওন তো জুলেখার মায়ও খাইলো! আগেপিছে কইরা তো খায় নাই। খাইলো একই জিনিস, খাইলো একই সোমে। হের কিছুই হইলো না, আর ওদিগে তার লগের-জোনের জানই কবজ হইয়া গেলো! হায় হায় হায়! এমনে তাইলে মউতে আহে! এমুন যেকোনো নাই—উছিলা দিয়াই আহে!
গেরামের মুরুব্বি বেটারা ইমাম হুজুরের লগে বইয়া খোনে খোনে খালি এই পেঁচালই পাড়ছে সংবচ্ছর। তারা পারতে জুলেখাগো বাইত পাও দেয় নাই। সেই বাইত একটা কোনো পুরুষপোলা নাই! তারা কার কাছে যাইবো!
সেই বাড়িতে পুরা বচ্ছরই ঠেকার কামে যাইতে হইলে গেছে খালি ইমাম হুজুরে। গেছে জুলেখার মায়েরে নানান ঠেকার কামের বিধান দিতে। সেইসোম মংলার মায়ও বওয়া থাকছে অই বাড়িতে।
আর গেছে ইসুফ মিয়ায়। সেয় যাইতেই পারে, কারণ তার মায় গেরামের সর্বলোকের সামোনে জুলেখার মায়ের বিপদ-বালাই-মুসিবত সব গইচ্ছা নিছে। তারে সেয় ধর্ম-বইন ডাকছে। জুলেখার মায়ের ঠেকা কামে তাইলে ধর্ম বইন-পুত হইয়া সেয় না যাইবো নাকি?
ওদিগে গেরামের মাতারিগো কথা ভিন্ন। তারা সগলতে গেছে। পুরাটা বচ্ছর দেওভোগের মা-চাচিরা জুলেখাগো বাইত যাইতে কিছু মাত্র আলস্যি করে নাই। হেরা যেয় যেমনে পারে, যখন তখন জুলেখাগো বাড়িত গেছে। গিয়া তারা জুলেখার মায়েরে বুঝ দিবো কী; অই আচানক মরণ নিয়া নিজেরা নিজেরাই কথা কইয়া ফুরাইতে পারে নাই। মউতের অমুন আচুইক্কা খাসলত তাগো সগলতেরে প্রতিটা দিন তাজ্জুব বানাইতে থাকছে। তাজ্জুব হইতে হইতে তারা একেক জোনে অস্থির হইয়া গেছে!
অস্থিরও হইছে, আবার আফসোসের তুফানও ছুটাইছে। তাগো তুফানের ঝাপটা খাইতে খাইতে প্রতিটা দিন জুলেখার মায়ে হরদিশা হইয়া গেছে। সেয় মোখ দিয়া আর কোনো আওয়াজ বাইর করোনের ফাঁকখানও পায় নাই। জুলেখার মায় বোবা মোখে খালি নিজের রং-জ্বলা, পুরান ত্যানা ত্যানা আঞ্চলখান দিয়া চক্ষের পানি মোছছে। বিধির খেইল নিয়া আর তার কিছু কওয়ার নাই!
তয়, মা-চাচিরা কেউই নাদান বাপের জন্ম না! তারে মোখে বেহিসাব আফসোস করছে ঠিক, কিন্তু চুপেচাপে জুলেখার মাওয়ের হাতে তার সগলতেই নানান কিছু গুইজ্জা দিছে হিসাব মতোনই। নাইলে এই রাঁড়ি মাতারি চলবো কেমনে! জুলেখার বাপের ক্ষেতি-খোলা বলতে তো আছিলো এই এট্টুক কয়খান জমিন। তার তেনে সংবচ্ছরের খোরাকী আহেনি? আহে না।
আউজকা এই ঘোর দুষ্কালে, সেই ক্ষেত কয়খানরে যে নিজে নিজে আধি-বর্গা দেওনের বেবস্থা করবো জুলেখার মাওয়ে, সেই খ্যামতা তার নাই। না সেয় বর্গা দেওনের নিয়ম-রীতিরে স্পষ্টরকম বোঝে, না সেয় সেই কামখান করোনের কোনো সাহস পায়!
কেমনে কী করতে হয়, তার কিছুই জুলেখার মাওয়ের বুঝে আহে না। এই সগল বিষয়-কর্ম সগলটা সোম করছে জুলেখার বাপে। সেয় জুলেখার মায়রে এই আধি-বর্গা কী ক্ষেতিখোলার বিষয়ে একখান কথাও কোনোকালে কয় নাই; কী কিছু হোনায়ও নাই। তাইলে আউজকা এমুন আঁতকার উপরে জুলেখার মায় সেই বিষয়খান নিয়া লড়াচড়ি করোনের সাহোস-শক্তিখান পাইবো কি আসমান তেনে?
ইমাম হুজুরে দশজোনেরে কয়, ‘উপরে আল্লা, নিচে আপনেরা হগলতে আছেন! এই শোক-তাপে ছ্যারা-ভ্যারা বিধবাটার ক্ষেতি-খুতি সামলানি দেওনের পোথ বাতলান। আমাগো সগলতের ঘরেই কইলাম মা-বইন আছে!’
তবে গেরামের বেটারা কোনো কিছু সাব্যস্ত করোনের আগেই ইসুফ মিয়ার মায়ে তার পুতেরে দিয়া হুজুরের কাছে সংবাদ পাঠায় যে, গেরামের দশজোনে সাক্ষী! ইসুফ মিয়ার মায় অহন তেনে আভাগী জুলেখার মাওয়েরে ধর্ম-বইন মানতাছে! সেয় জুলেখার মাওয়ের সগল ভালা-বুরার ভার নিজের উপরে নিতাছে। হুজুরে য্যান তার ইসুফ মিয়ারে খালি দোওয়া করে।
হেরা বড়োমানুষ। তাগো বুঝের উপরে আর কোনো বুঝ নাই! ইসুফ মিয়ার মায়ের কথাখান শুইন্না গেরামের সগলতে কয়, ‘এইটাই সঠিক কাম হইছে! আলা জুলেখার মায়ে খাঁটি দরদখান পাইবো!’
হাতের তাউল্লায় নিয়া দেখোন যায়, এমুন অল্প কয়খান ক্ষেতিখোলার আধি-বর্গার বেবস্থা কইরা দেয় ইসুফ মিয়ার মায়ে।
বর্গা আর কার কাছে দিবো! নিজেরাই বর্গা নেয়। মীমাংসা হয় যে, যতো জীবন জুলেখার মায়ে রাজি থাকবো, ততোকাল এই বর্গদারির কাম করবো ইসুফ মিয়ারা। যখন জুলেখার মাওয়ে অন্য কেউরে দেওনের ইচ্ছা হইবো; তহন সেই মোতাবেক বেবস্থা করোন যাইবো।
সেই মীমাংসার কথা শুইন্না জুলেখার মায়ের চক্ষে আবার পানি ছলাৎ কইরা ওঠে। সেয় ইসুফ মিয়ার মাওয়ের হাত দুইখান জাবড়াইয়া ধইরা কয়, ‘এমুন আর কইয়েন না ভাউজ! এই বিধবার আর দিন কি রাইত কি! আমার মরোন তরি আপনেগো ছেমায় এট্টু থাকতে দিয়েন বুজি!’
‘কী কস এটি জুলেখার মা!’ চক্ষের পানি চক্ষের ভিতরে গুইজ্জা থুইয়া ধামকি দেওনের ভাবখান করে ইসুফ মিয়ার মায়। ‘তরে কইছি না, তুই আমার বইন? আমার ধর্ম-বইন! আমি বাইচ্চা থাকতে তর ভালা-বুরাই দেখোনের দায় উপরে আল্লার নিচে আমার! কইছি না?’
সেই কথা যতোবার শোনে জুলেখার মাওয়ে, ততোবার মাটিতে আছড়াইয়া পইড়া চিক্কুর পাড়া ধরে সেয়। আউজকা যুদি, আউজকা যুদি তার জুলেখায় থাকতো! তাইলে তো মাইয়াটার লগে মাইয়ার জামাইটায়ও থাকতো এই দুক্ষিণীর! তাইলে রাঁড়ি-বেওয়া যাই হইতো মায়ে; তার আর কিয়ের দুক্ষু কিয়ের জ্বালা! কিন্তুক কিছমতে নাই মায়ের কিছমতের জিনিস! তার আঞ্চলের সোনা খোয়ানি গেছে! বিনা দোষে আউজকা তার এই দুর্গতি! এই ছিদ্দত!
আগে; জুলেখা হারানি যাওনের পর পর, দুই-তিন বচ্ছর ভইরা, ইসুফ মিয়ার মায়ে সগল সোম ঢোকে ঢোকে জুলেখার মায়েরে কইতো, ‘আল্লার কুদরতের কইলাম কোনো সীমা নাই জানবি! আল্লার রহম নামলে মাইয়া তর ফিরতি আইতে কতোখোন! আল্লারে ডাক জুলেখার মা!’
কিন্তু জুলেখার বাপে মরা ইস্তক, এই একটা বচ্ছর হয়, আর সেই ভরসার কথাখান মোখ দিয়া বাইর হয় না ইসুফ মিয়ার মায়ের! কইতে য্যান দিল কাঁপে তার। মোনে অয়, আর কতো মিছা কথা দিয়া বুঝ দিবো সেয় আভাগীরে! বাইচ্চা থাকলে এতোদিনে আইয়া পড়তো না মাইয়াটায়! ইসুফ মিয়ার মায়ের কইলজাটায় তখন ছ্যাঁত কইরা আগুনে-তাঁতাইন্না ছেনির ছ্যাঁকা লাগে! তার লগে লগে দেখো—নিজ পরানের ভিতরের আরেক গুপ্তি আগুন তারে কেমুন নয়া কইরা দগ্ধানি দিতে থাকে!
তার অন্তর তারে ছি ছি করতে থাকে। কইতে থাকে যে, এই সগল নষ্টের মূলে আছে ইসুফ মিয়ার মায়ে! আর কেউই না!
এত্তা কষ্ট পাইতো এই অভাগী জুলেখার মায়? পাইতো নি? যুদি সেয় পুতের অন্তরের বাঞ্ছাখানরে অমুন এক থাবড়া দিয়া নিভান্তি না দিতো? এত্তা অশান্তি আইতো এমুন, দুই দুইটা ভিটিতে? আইতো না।
এতোদিনে কতো সোন্দর নাতি-নাতকুঁড়ে গুঁড়গুড়াইয়া হাঁটতো এই বাড়ি ওই বাড়িত! সেইটা যে হয় নাই, তার গোড়ায় কে? এই ইসুফ মিয়ার মায়ের টোমরের কারোনে না সব এমনে বরবাদি গেলো? হঁ! তার কারোনেই!
আল্লায় ইসুফ মিয়ার মায়ের সেই টোমর কোনদিনে ভাইঙ্গা দিছে! খোদার বিচার! অহন সেয় ভোগ কইরা চলছে আসমানী আজাব!
এই যে পুতেরে সেয় উঁচা-বাড়িতে বিয়া দিলো, সেই বিয়ায় কোন ফল ফললো?
পুতে দেখলো একদিন শান্তির মুখ? সেই বউ বিছনায় পড়া যে পড়াই! সুতিকায় তার দেহখানরে আর দেহ রাখে নাই! দিনে দিনে কইরা দিছে হাড্ডি-জিরজিরা একটা কাঁকলাস! তার দিগে চোখ পড়লে শইল্লে কাঁটা দেয়!
আহ! এই বউরে অখন তারা রাখেই কেমনে, আর ফালায়ই বা কেমনে! আহ!
পাটা-পুতায় মরিচ বাটলে হাত যেমুন ফাতফাতাইয়া জ্বলতে থাকে, ইসুফ মিয়ার মায়ের দিল তেমুন ফাতাফাতাইয়া জ্বলতাছে আউজকা কতো বচ্ছর! সেই জ্বলুনির সন্ধান জগতের কেটায় জানে? কেউ জানে না!
কেমনে সেই ফাতফাতানি নিভবো, কী করলে শান্তি হইবো—সেই পথ বিছরাইয়াই না এমুন বেতালা চলা চলতাছে ইসুফের মায়ে! কিন্তু কিয়ের কী! অন্তরে তার বিচ্ছার কামড় পড়তাছে যে পড়তাছেই।
এইর মিদে আল্লার কী শান! ইসুফ মিয়াগো দুই-দুইটা গাই আগুপিছু কইরা বিয়ানী দেয়। ইসুফ মিয়ার মায়ে মোনে মোনে নিয়তই কইরা থুইছিলো যে, এই দুই গাইয়ের কোনোটায় যুদি বকনা-বাছুর বিয়ায়, তয় সেই বাছুরখানরে সেয় দিবো জুলেখার মায়রে। এমনে এমনে দিলে তো নিবো না। দেওন লাগবো পালনের নাম কইরা।
এই গেরামে যার যখন দরকার পড়ে এমনেই গরু বর্গা দেয়, বর্গা নেয়ও। এমুনই চলতাছে চিরকাল। কোনো ঝামেলার কারণে গরুরে নিজে পালতে না পারলে, কোনো একজোনরে পালতে দেওয়া হয়। তখন সেই গরু পুরা তার নিজের হয় না, আবার একদিগ দিয়া দেখলে সেইটা তার নিজেরই গরু হইয়া যায়।
কেমনে?
গরু বর্গা দেওনের পরে আদি মালিকে আর আইয়া সেই গরুর দিগে একটা ফুঁচকিও দিবো না। কোনো জজ-জিগ্গাসাও করবো না সেই গরুর বিষয়ে। পালো এখন তোমার গরু—নিজের বুঝ মতোন। তয়, সগল সোমেই গাই বিয়াইলে অর্ধেক দুধের ভাগীদার থাকে সেই আসল মালিকে। আর পইল্লা বিয়ানী বাছুরখানও যায় আদি মালিকের ভাগেই। তার বাদে আদি মালিকে যখন চাইবো, যেকোনো বিয়ানীর বাছুর সেয় নিতে গা পারবো।
ইসুফ মিয়ার মায় তো আর অতো হিসাব নিয়া বাছুর বর্গা দিতে যাইতাছে না! সেয় আভাগী মাতারিরে কোনো এক উছিলায় একখান সম্বল গছাইতে চাইতাছে। আভাগীর তো বলতে কিছু নাই। আউজকা, খোদায় না করুক, ইসুফের মাওয়ের যুদি কিছু অইয়া যায়; অরে দেখবো কেটায়? এমনে দিলে তো নিবো না মাতারি। হের ইজ্জতে লাগবো। সেই কারোনে না এমুন গাই বর্গা দেওনের ছুতা!
আর, বর্গা দেওনের পরস্তাবখানও আগে দেওন যাইবো না জুলেখার মায়েরে! শোনলেই নিষেধ জোড়বো। নাই-তাই শত কথা শত বাহানা দিতে থাকবো। তাইলে করোন কী!
বাছুরটারে একবারে জুলেখাগো বাইত আইন্নাই যা কওনের কওন লাগবো!
সেই বুঝ মতোনই একদিন, আঁতকা আইসা ইসুফ মিয়ার মায়ে জুলেখার মায়েরে তাগো বকনা বাছুরখান বর্গা সাধে।
ভাউজে এটি কী কয়! জুলেখার মা-য় আসমান তেনে পড়ে।
সেয় জীবনে নি কোনোদিন গরু ধইরা দেখছে! পালন তো বহুত দূরের কথা! অহন এমুন আঁতকা কিছুর মিদে কিছু না, তারে কইলেই কী সেয় পারবোনি এই কাম করতে! আর, এই গরুর খোরাকিই বা সেয় কেমনে জোগাড় করবো! নিজেরই বোলে কোনোমতে জোটে অখন!
জুলেখার মায় বাছুর ফিরত দেওনের লেইগা বেজাহানি হইয়া যায়। এত্তাবড়ো একখান কাম করোনের খ্যামতা, এমুন একটা জীবের ভার লওনের হ্যাটাম তারে আল্লায় দেয় নাই!
সেয় তার ধর্ম-বইনরে ভেগা ভেগা কইরা মিন্নতি করতে থাকে—বাছুর ফিরত নেওনের লেইগা। ক্যান ভাউজে এমুন দর্দ করে তারে! সেয় তো জুলেখার মায়েরে সগল দিগ দিয়া সামলানি দিয়া যাইতাছে! আর কতো! এতো দর্দ তারে করোনের কাম নাই! পোড়া-কপালির জিন্দিগি যাইতাছে তো একপ্রকারে!
জুলেখার মায়ের ক্ষেত ইসুফ মিয়ারা বর্গা নিছে ঠিক; কিন্তু সেই ক্ষেতের কোনো ফসলের তেনেই তারা যে কিছু মাত্র ভাগ রাখতাছে না, এইটা কি জুলেখার মায় বোঝে না? বোঝে। সেয় স্পষ্ট বোঝে যে, ক্ষেতের সগল ধান আইয়া পড়তাছে এই জুলেখার মায়ের বাড়িত।
সেইখান তেনে ধান যা পাইতাছে জুলেখার মায়ে, সেইটা দিয়া কোনোমতে হইতাছে সাত-আষ্ট মাসের খোরাকি। একলা বিধবার পেটে কতো লাগবো! আর কতোই বা সেয় যাতনা দিবো ইসুফ মিয়ার মায়রে! সেয়ও তো পরের সংসারই করে! সেই কারোনে ভাউজে জিগাইলেও জুলেখার মায় কয়, এই বর্গার ধান দিয়া সংবচ্ছরের খোরাকি হইয়া ভাইস্যা যায় গা!
ধর্ম-বইনেরে এমনে বুঝ দিয়া, অদিগে বাদবাকি মাস কয়টার বেবস্থা সেয় নিজেই কইরা নিছে। আল্লায় জানে, মংলার মায়ে না থাকলে কেমতে সেই বেবস্থা করতো এই রাঁড়ি-বেওয়ায়! মংলার মায়রে দিয়া চুপেচাপে এর বাড়ি তার বাড়ির তেনে ধান আনাইয়া ভাইন্না দেয় জুলেখার মায়। দশ সের চাইল যুদি ভানতে পারে, তয় মজুরি পায় আধাসের।
এমনে এমনে কোনোরকমে হইতাছে তো! একদিন যেই কাহাইল-ছিয়া এই বাড়িতে খালি হাউস মিটানের কামে লাগতো, অখন তারে দিয়া কতো বড়ো ঠেকার কাম সামাল দেওন যাইতাছে! এই কাহাইল-ছিয়া দিয়া শীতকালে খালি পিঠার চাইল কোটতো জুলেখার মায়! ধান ভানোনের তো কোনো কাম পড়ে নাই তাগো, কোনোকালে।
সগল ক্ষেত টেকার উপরে দিয়া দিতো জুলেখার বাপে। নিজেরা খাইতো কিনা চাইল! আউজকা সেই শখের জিনিসখানই দুষ্কালের পেটের ভাত জোগাড়ের কামে দিতাছে! এই কাহাইল-ছিয়া কিনোনের সোমে এই কথা কেটায় মোনে আনতে পারছিলো!
তার বাদে, মংলার মায়ের লগে মিল্লা জুলেখার মায়ে আরেকখান কামেও হাত দিছে। সেয় এই এক বচ্ছর ধইরা ঘইট্টাও দেওনের কর্মও করে। করে চুপেচুপে। পাতরের তেনে, কী এর বাড়ি তার বাড়ির তেনে, গোবর টোকাইয়া আনে মংলার মায়। শুকনার দিনে সেই গোবর দিয়া তারা দোনোজোনে ঘইট্টা দিছে তামানটা সকাল ভইরা।
মংলার মায়ে গরিবের হদ্দ গরিব মাতারি ঠিক, কিন্তু আল্লাপাকে তার দিলে দুনিয়াছাড়া মায়া-মহব্বত দিয়া থুইছে! এই যে গোবরটি সেয় টোকাইয়া আনে একলা হাতে, তার তেনে অর্ধেক ভাগ সেয় কেমুন দিয়া যাইতাছে জুলেখার মায়রে। এট্টুও বেজার হয় না সেয়। এট্টুও মোখ কালা করে না একটা দিন!
আউজকা অবস্থা পড়তি জুলেখার মায়ের, কিন্তু সেয় তো সাব্যস্ত ঘরের বৌ আছিলো! আর, এই গেরামের মাইয়াও তো সেয় না! সেয় এই গেরামের বউ। তাইলে সেয় কোন প্রকারে পাতরে গিয়া, নাইলে এগো তাগো বাড়িত গিয়া গোবর টোকায়? পারে না সেয় অইটা করতে। শরম!
মংলার মায়ে ভালা কইরাই জানে বিষয়খান! সেই কারোনেই মংলার মায়ে একলা হাতে দুইজোনের গোবর টোকায়। তার বাদে নানা প্রকারে গইট্টা দেয় তার দুইজনে। জুলেখাগো ভিটির পুবের নামায় দুনিয়ার গাছ! পচ্চিমে পুষ্কুনীর কিনারেও গাছের লেখাজোকা নাই।
সেই গাছের গোড়ায় গোড়ায় গোল গোল গইট্টা দিয়া থুইছে তারা দোনোজোনে। তামানটা দিন ঠা ঠা রইদ খাইয়া দিনের ঘইট্টা দিনে দিনেই শুকাইছে। তয়, এক হাত লাম্বা শোলার মিদে গোবর চাপোইট্টা দিয়া যেই লাম্বা ঘইট্টাটি বানাইছে তারা, সেটিরে একদিনে শুকানি দেওন যায় নাই। সেগিলিরে দিন দুই রইদ দেওনি লাগছে।
এই সগল জিনিস—অই শুকনা ঘইট্টা—শেষে কই আইন্না গুছাইয়া থুইছে জুলেখার মায়?
থুইছে সেই উত্তরের ভিটির একচালাখানে। সেই একচালা! একদিন, তার খসমে না তারে এই ঘরে বসত করোন সাব্যস্ত করছিলো? কইছিলো না বাড়ির কামলি এমুন একচালায় থাকবো, না কই থাকবো?
দেখো বিধির লীলা! আউজকা সেই বেটায়ই বা কই; আর ছার-কপালি জুলেখার মায়ই বা কই! আরো দেখো, সেই উত্তরের একচালাখানে কে কী রাখে! ঘইট্টা রাখে জুলেখার মায়। পদে পদে গুছানি দিয়া সেয় ঘইট্টা রাখে সেই ঘরে, আর অই সগল কথা অন্তরে লাড়ে-চাড়ে।
বছরের শুকনার দিনে ঘইট্টা নেওনের একটা মানুষও পাওন যায় নাই! তখন তো সগলতের বাড়ির নামায়ই শুকনা পাতা-ঝাড়ের কমাকমতি নাই। কিন্তুক বাইরা মাসে যখন ধুম মেঘ; দিনের পর দিন যখন দেওভোগ গেরাম মেঘের পানিতে ভিজতে ভিজতে তেনা তেনা হইয়া শেষ, তখন গিয়া এই ঘইট্টায় গাহেকের মোখ দেখে। তখন এগো ধুম ধুমা ধুম নিতে থাকে লোকে। সেইসোমে এমুনও গেছে যে, চাইর গইট্টা দিয়া একপোয়া কইরা চাইল নিছে জুলেখার মায়ে!
এমনে এমনে তো একটা বচ্ছর পার কইরা দিলো জুলেখার মায়! আর, অড়শি পড়শিরাও তো কিছু না কিছু দিয়া যাইতাছেই! সগলতের তেনে বেশি যেয় দিতাছে, তারে আবার আউজকা বাছুরখানও দিয়া দেওন লাগবো! ভাউজে এইটা না করুক! জুলেখার মায়রে মাপ দেউক সেয় আলা!
‘নে অইছে-জুলির মা! তরে আর পেখনা করোন লাগবো না!’ ইসুফ মিয়ার মায়ে সেই আগের আমলের লাহান গরিমার ঝামটা মারে, ‘বাছুর তো বাছুর, আমি তো তরে আরেকখান জিনিসও দেওনের নিয়ত কইরা আইছি আউজকা! হেইটা তুই কেমনে ফিরাবি?’
‘আর কী কন ভাউজ! অগো বইন! আর কতো দিবেন আপনে! আমি নি এতো দরদের উপযুক্ত! আল্লার কাছে হাজার শুক্কুর করি বুজি! আপনে যা দিছেন, এইর বেশি আর মাইনষে দিতে পারে না বইন!’ জুলেখার মায়ে কথা কয়, না কান্দে—বোঝা যায় না। কিন্তুক আউজকা ইসুফ মিয়ার মায়ে জুলেখার মায়ের সেই কান্দনের দিগে নজর দেয় না।
বাছুরের দড়ি ধইরা খাড়াইয়া থাকা কামলারে ইসুফ মিয়ার মায় হুকুম দেয় বাছুরখান নিয়া উত্তরের ভিটার জিক্কা গাছের গুঁড়িতে বান্ধতে।
‘গরু পালনের লেইগা তুই ডরাইস না, জুলেখার মা! কামলারাই আইয়া ঠেকার কাম সারানি দিয়া যাইবো!’ বেতোবা চক্ষে চাওন দিয়া থাকা জুলেখার মায়ের সেয় এইমতে বুঝ দেয়।
তার বাদে ইসুফ মিয়ার মায় কামলারে কয়, ‘যা! আলা গিয়া তর মিয়া ভাইরে ক, আমি আইতে কইছি।’
‘অখন আবার পোলাটারে ক্যান ডাক পাড়তাছেন বুজি? উয়ে না আবার বেজার হয়!’ জুলেখার মায় কাচুমাচু মোখে ভাউজরে নিষেধ দিতে থাকে।
‘দেহি না, আমার পোলায় আমার ডাক হোনে কিনা!’ পোলার মায় জব দেয়।
অম্মা! সত্যই তো ইসুফ মিয়ায় আইয়া খাড়া জুলেখাগো উঠানে! দেখো, তখন তার মায়ে কোন কাম করে!
ইসুফ মিয়ায় জুলেখাগো উঠানে আইয়া খাড়াইয়াও সারে না, তার মায়ে তার ডাইন হাতখান নিজের হাতে নেয়। নিয়া, সেইখানরে সেয় জুলেখার মায়ের ডাইন হাতে তুইল্লা দিয়া কয়, ‘আখের আউয়াল সাক্ষী করলাম; আসমান জমিনরে সাক্ষী করলাম, আর উপরে আল্লায় সাক্ষী; আউজকার তেনে ইসুফ মিয়ায় খালি একলা আমার পুত না! তারে আমি তরেও দিলাম! তর ধর্মপুত!’
(চলবে)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ৩৩)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ৩২)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ৩১)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ৩০)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন(কিস্তি ২৯)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ২৮)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ২৭)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন(কিস্তি ২৬)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ২৫)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ২৪)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন(কিস্তি ২৩)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন(কিস্তি ২২)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ২১)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ২০)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১৯)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১৮)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১৭)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১৬)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১৫)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১৪)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১৩)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১২)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১১)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১০)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ৯)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ৮)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (সপ্তম কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (ষষ্ঠ কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (পঞ্চম কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (চতুর্থ কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (তৃতীয় কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (দ্বিতীয় কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (প্রথম কিস্তি)