সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন
![](https://ntvbd.com/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2015/02/11/photo-1423647467.jpg)
ঠাকুরনী দিদি আসে সেই কোন বিয়ান বেলায়, কিন্তু কথার পিঠে কথা বলতে বলতে সেয় কেমুন তালছাড়া হয়ে যায় সেদিন। তার আর বেলার হিসাব থাকে না! বাড়িতে যাওয়ার কথাও স্মরণে আসে না। তারে ঘেরাও দিয়া বসে আছে গেরামের আরো আরো মাতারি। তারাও বহুত কথার ঘোরে পইড়া যায় সেইদিন, বেলা দুপুর না সন্ধ্যা-সেইটা তাগোও নজরে আসে না। উঠানে পিঁড়ি-পাতা দিয়া বসা সকলে য্যান অইদিন নিজেগো ঘরসংসার, দিনদুনিয়া- সকলকিছুরে ভোলা দিছিলো!
এমনে এমনে বিয়ান গিয়া- বেলাখানা, শেষে, কখন আইসা খাড়ায় দুই পহরের কাছে - একজনও বলতে পারে না।! তারপর একসময়, রইদের তেজটা যখন খোনে খোনে আইসা চান্দিতে থাপ্পড় মারতে থাকে, তখন আচমকা তাগো খেয়ালটা হয়! ওরে সর্বনাশরে! বিয়ান তো আর বিয়ানে নাই। তাগো হইছে কি! ঘরসংসার পানিতে ফালাইয়া তারা সগলতে মিল্লা করতাছে কি! দেখো দেখি, কতো বেইল হইয়া গেছে! তাগো একজোনেরও নি কোনো হুঁশ আছে!
ঠাকুরনী দিদির অন্তর ধড়ফড়াইয়া ওঠে! করতাছে কি সেয়! বাড়িঘরের কথা যেমুন তেমুন, বৌদিদির কথা ইস্তক য্যান তার আর মনে নাই! এমুন কথার নিশায় পাইছে তারে! মোখে আগুন এমুন কথা কওনের! ওদিগে বৌদিদিয়ে একলা কি না কি করতাছে! না জানি কেমুন বেতালা হইতাছে! একদণ্ড একলা থাকলে যেয় বেদিশা হইয়া যায়, তারেই কিনা সেয় একলা ফালাইয়া থুইছে এই এতোখানি বেইল ধইরা! কী না জানি যাতনা পাইতাছে সেয়! আর, সংসারের কোটা-বাছা-রান্ধার তো কোনো খবরই হয় নাই অহনও! আজকা তারে কোন শনিতে ভর করছে ! ঠাকুরনী দিদিয়ে তরাতরি মেলা দেয় বাড়ির দিগে।
তার পিছে পিছে হাঁটা ধরে গেরামের আরো দুইজনে। তাগো হাত অহন আজাইর আছে। ঘরে কোনো কামকাইজ নাই। তারা এহন গিয়া জমিদারবৌদিদির সামোনে বসা দিয়া থাকতে পারবো শান্তিহালে। গপসপও করতে পারবো। ঠাকুরনী দিদিরে তাইলে আর বৌদিদিরে নিয়া উতলা থাকতে হইবো না। সেয় নিজ বুঝমতো কাজকাম সামলানি দিবো নে একদিগে, ওদিগে তারা দুইজোনে দেখবো নে বৌদিদিরে। ডরাডরির বিষয় যা আছিলো, তারে তো দিছে ঠাকুরনী দিদিয়ে খোলাসা কইরা। আর কিয়ের ডর! ডর নাই।
পিছে পিছে তাগো আসতে দেইক্ষা ঠাকুরনী দিদির আত্মায় য্যান পানি পায়। যাইতে যাইতে ভিতরে ভিতরে তার বড়ো বেতালা লাগতাছিলো। একলা হাতে সে রান্ধন ঘর সামলাইবো না বৌদিদিরে আগলাইবো! কোনটা থুইয়া কোনটা করবো সেয়! বেদিশা হইয়া সে জপতে থাকে দয়ালরে। দয়াল তুমি জানো! তুমি না করাইলে আমার সাধ্যি নাই কিছু করি, দয়াল!
পাড়ার কাউরে লগে আসতে কয় নাই সে। কেমনে বলে! লোকেরও তো রান্ধন-খাওন আছে। ভালামন্দ নানা কর্ম আছে। এই দোপোরের বেলায়, সেইসব ফালাইয়া কাউরে আসতে কয় কেমনে সেয়! তার অন্তর তা করতে তারে সায় দেয় নাই। মনের ভাবনা মনে নিয়া সেয় একলাই মেলা দেয় নিজের কপালের ভোগ সামলাইতে!
এদিগে দেখো দয়ালের কি দয়া! কেমনে সোন্দর দুইজোনের ব্যবস্থা দয়ালে কইরা থুইছে! সেয় নি তার দয়া পাঠাইতে ভোলে কোনো সময়! ঠাকুরনী দিদির চক্ষে পানি আসে। সেই পানি গোপন কইরা খুশি গলায় সে মাতারি দুইজনরে কয়, ‘তয় তরাতরি পাও চলাও গো মা-সগল। তারে দেইক্ষা আইছিলাম আন্নিক করতে, সেইটা শেষ কইরা বৌদিদিয়ে না জানি আমারে কি বিছরান বিছরাইতাছে!’
চৈত মাইস্যা দিন। ঠাকুরবাড়ি যাইতে পোথের এমুড়া-ওমুড়া আকন্দ ঝোপ। তার বাগুনী ফুলের উপরে চৈতমাইস্যা দুপুইরা রইদ ঝুইপ্পা পড়ছে! সেই ফুলের থোক্কায় থোক্কায় কালা কালা ভোমরারা এই ওড়ে এই বয় আর আওয়াজ করে- ভোম ভোম ভোম! তরাতরি যাইতে যাইতেও সেই রায়ত দুই মাতারি থমকানি দিয়া খাড়া হয়ে যায়! রইদের তাতে মাটি হইয়া রইছে য্যান তাওয়া। থির মতোন পাও পাতোন যায় না। লড়ালড়ি কইরা হাঁটতে থাকলে তাও চলোন যায়, কিন্তু সেই তপ্তমাটিতে খাড়া থাকা কঠিন। পাও তাপোড়া তাপোড়া হইয়া যাইতে থাকে।
তাও তারা না খাড়াইড়া পারে না। ভোমর যে গুপ্তকথা কইয়া যায় মানুষরে, এইটা তারা চিরজন্ম ভইরা জানে। সেই কারণে ভোমরা দেখলে, খাড়োনের বিধি আছে তাগো গেরামে। এহন সেই ভোমরারে একেবারে অগ্রাহ্যি কইরা ঠাকুরনী দিদির লগে ছোটে কেমনে তারা! না না! অগ্রাহ্যি করোন যাইবো না। তাগো খাড়োন লাগবোই।
যাউক গা ঠাকুরনীদিদি আগে আগে,তারা আইতাছে পিছে। এই মোনে কইরা মাতারি দুইজোনে একটা আকন্দ ঝোপের সামনে খাড়ায়। ভোমরা যেই গুপ্তসংবাদ বলে, তার মর্ম বোঝা সহজ না। সেইটা কেবল বুঝতে পারে সাধু-সন্ন্যাসীয়ে। গৃহস্থলোকে তার কিছুই বোঝে না। কিন্তু বোঝো আর না বোঝো, ভোমরারে হেলা দেখাইও না। এই কইয়া গেছে মুরুব্বিরা। তারা আরো কইয়া গেছে যে; আর কিছু না পারো, আলগোচ্ছে খাড়াইয়া খালি ভোমরার ডাকের ধরনটা খেয়াল কইরো। তাইলেও ভালা-বুরার ইশারাখান ধরতে পারবা। সেই কথা মান্যি কইরা চলতাছে দেওভোগ গোরামের সর্বজনে, কতো কতো জন্ম ধইরা! পোলা বুড়া ছেড়ি মাতারি– কেউ কোনোকালে সেই কথা অমান্যি করছে বলে কেউ শোনে নাই।
যেমুন মাথার উপরে ছনাছনা তপ্ত রইদ, তেমুন পায়ের তলায় খমখমা গরম মাটি। তার মধ্যেই মাতারি দুইজোনে কোনোমতে খাড়ায়। ধেয়ান দিয়া শোনতে থাকে ভোমরাগো ডাক। যুদি এই আওয়াজ টানা গোঙানির মতন হয়, তাইলে সংবাদ আসবো শুভ। যুদি সেই আওয়াজ ছাড়া ছাড়া, থামা থামা হয়; কানে যুদি তারে মিঠা মিঠা, গুনগুন শোনায় – তাইলে জানবা বিষয়টা সুবিধার না। কী সংবাদ আনছো রে ভোমরা? নিঃশ্বাস বন্ধ কইরা কান পাতে দুইজোনে, আর অন্তর তাগো জপতে থাকে- গোঙানি দেও রে ভোমরা, গোঙানি দেও। কিন্তু কিয়ের গোঙানি কিয়ের কি! মাতারি দুইজোন শোনে যে, সকল আকন্দঝোপের ভোমরাই একলগে কী সোন্দর মিঠা আওয়াজ দিতাছে– গুনগুনগুন! গুনগুনগুন!
কী কইলো কী কইলো ভোমরে! তারা একজনে আরেকজনরে জিগায়। ডরে তাগো শরীরে কাঁটা দিতে থাকে, কিন্তু একজনে অন্যজনরে খোলাসা কইরা কিছুই বলে না। এই সেই নানা উল্টাসিধা কথা বলা ধরে। একজনে কয় যে, ঠা ঠা রইদে খাড়াইয়া তার মাথা কিনা তালাগাড়া দিতাছে। এমন সময়ে সেয় কী শোনতে কী শোনছে- সঠিক কইতে পারতাছে না। অন্য জনে কয়, চান্দির রইদ যেমন তেমন-পাওয়ের তলের মাটির তাপে তার পাও পুইড়া দগদগাইতাছে! ভোমরার আওয়াজের দিকে মন দিতে পারে নাইক্কা সেয়, সেই কারণে।
একজনে কয়; তাইলে চল দেহি, তর মাথায় এট্টু পানির ঝাপট দিয়া যেই কামে আইছি সেই কামে যাই। অন্য জনে বলে, তার আগে তর পাও দুইটা এট্টু পানিতে ভিজানের কাম। নাইলে ঠোসকা পড়লে কইলাম বিপদ হইবো! ভোমরার কথা তারা আর মোখেও আনে না।
জমিদারবাড়িতে পুষ্কুনী আছে দুইখান। একটা হইলো বাড়ির দক্ষিণ সীমানায়। মস্তো পুষ্কুনীখান। তার পানির যেমন শোভা, তার পাকা ঘাটলার তেমুন বাহার। সেই পুষ্কুনীর চারিপাশ দিয়া উঁচা পাড়। সেই পাড়ে পাড়ে নানান জাতের গাছগাছালির কোনো সীমাসংখ্যা নাই। অই পুষ্কুনী জমিদারের আহ্লাদের বস্তু আছিলো, আছিলো আদরের জিনিস। সেয় বোলে এই পুষ্কুনীর শান-বান্ধানো ঘাটলায় বইসা জপতপ করতো। এক বসতো সন্ধ্যাকালে, আর বসতো ভোর রাইতে। দেওভোগ গেরামের বৌ-ঝিয়ে তা দেখা তো দূর, কোনো পুরুষ রায়তেও তা চক্ষে দেখে নাই। কারণ, এই পুষ্কুনীর দিগে রায়তকুলের কোনো জনপ্রাণীর যাওনের হুকুম আছিলো না। এখন পুষ্কুনীর জায়গায় পুষ্কুনী পইড়া রইছে, সেইখানে অহনও কোনো মানুষের পাও পড়ে না। অখন লোকে সেইদিগে পাও দেয় না ডরে।
অন্য পুষ্কুনীখান উত্তর সীমানায়, ভিতর বাড়ির পুষ্কুনী সেইটা। ছায়ছোট্ট সেই পুষ্কুনীর উঁচা পাড় দেওয়াল দিয়া ঘেরাও দেওয়া আছে- অই কোন আগের আমল থেকে। লাল পাত্থরে বাঁধাই দেওয়া ঘাটলার এক কিনারে আছে খালি এক বকুল ফুলের গাছ । সংবচ্ছর সেই গাছ ঘাটলা আর সিঁড়িরে ছাওয়া দেয়। জমিদারবাড়ির সকল মা-বৌ-ঝিয়ে বৈশাখ-জষ্ঠি মাইস্যা দিনের সন্ধ্যাকালে সেই ঘাটলায় বইস্যা শরীর শীতল করছে। তবে এখন বহুতদিন হয়, এই ঘাটলায়ও জমিদারবাড়ির কোনো মা-বৌয়ের পাও পড়ে না। জমিদার বৌদিদির এই ঘাটলার কথা য্যান আর মনেও নাই। সেয় অহন কোনো রকম দুইঘটি জল খালি অঙ্গে ঢালে। সেই জলও নিত্যি আনোন লাগে ঠাকুরনী দিদিরেই ।
জমিদারবাড়িতে আইস্যা রায়ত মাতারি দুইজোনে মাথা আর পাও ভিজাইতে কই আর যাইবো! যায় সেই ঘাটলার দিগেই। গিয়া তারা ঘাটলার উপরের চাতালে পাও দিয়াও সারে নাই, তাগো চক্ষে পড়ে এক আচানক বিত্তান্ত। কি? না, কে জানি নামার দিকের সিঁড়িগুলাতে লম্বালম্বি শুয়ে আছে। শরীর তার কাত হয়ে সিঁড়িতে পড়া, কিন্তু পাওয়ের পাতা দুইখানা পানিতে নামানো। পিন্ধনে তার নীলাম্বরী একখান ঢাকাই কাপোড়। ঘোমটা আর আউলা চুলে ঢাকা পড়ে আছে তার মুখ। খালি, পানিতে-ডুবানো পায়ের পাতা দুইখান উদাম।
মা মা মাগ্গো মা! এইটা কি! দুই মাতারি ডরে কাঁপুনি-কাঁপানি খাইতে থাকে। এইসব কি জিনিস তারা চক্ষে দেখতাছে, কানে শোনতাছে আজকা! যা দেখে তা হাছা দেখে, না মিছা দেখে! ঘাটলার সিঁড়িতে এইটা কে পড়া ! কেটায়!
দিশাহারা হয়ে কতোক্ষণ খাড়া দিয়ে থাকে তারা দুইজন। তারপর আতকা হুঁশ আসে য্যান একজোনের। সে অন্যজোনের হাত টানতে টানতে উল্টা ঘুরান দিয়া বাড়ির ভিতরের দিগে ছোটন দেয়। বিষয়খান তো ঠাকুরনী দিদিরে কওন লাগে!
(চলবে)