সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন
উঠানে ঢোকার মুখে তাগো লগে ঠাকুরনীদিদির দেখা। কিগো মা-সগল! তোমরা পিছে পইড়া গেলা যে ! ঠাকুরনীদিদিয়ে হরদিশা পাওয়ে ঠাকুরদালানের দিগে হাঁটা দিতে দিতে তাগো জিগায়। তারা জব দিব কি, ডরে তাগো মুখ দিয়া বাক্যি বাইর হইতে চায় না। কিন্তুক, বিষয়টা তো ঠাকুরনীদিদিরে জানান লাগে! তয়,সেয় যুদি এমনে লউরের মধ্যে থাকে,তাইলে তারা ঘাটলায় দেখা আচরিত ব্যাপারখানার কথা তারে কয় কেমনে ! তারে এট্টু থির না পাইলে কথাটা কওন যায়? বিষয়খানা তো গুরুতর লাগতাছে তাগো কাছে।
আর,তারাও কি তার পিছে পিছে যাইবো,না উঠানে খাড়াইবো ! খাড়াইড়া থাকলে ফল কি! তারা আইছে জমিদারবৌদিদিরে সামলানি দিতে, সেইটা থুইয়া খালি খালি খাড়াইয়া থাকবো ক্যান! মাতারি দুইজোনে ধন্ধে পড়ে। দিশা পায় না য্যান- কি করবো!
থতমত খাইতে খাইতে তাও একজোনে পিছন তেনে ডাক দেয়, ঠাকুরনীদিদি,হোনোন গো! কথাটা হোনোন আগে!
‘বহো গো মায়েরা উঠানে, আমি আগে বৌদিদির সন্ধান লইয়া লই!’ ঠাকুরনীদিদির গলা য্যান তরাসে কাঁপে।
‘কেন, হেয় কই?’ আউলা পায়ে দিদির পিছে পিছে আগানি ধরে সেই দুইজোনেও।
‘হেরে বাড়ির কোনো খানে দেখতাছি না’! দিশেহারা হয়ে ঠাকুরনীদিদিয়ে বলে, ‘দেহি অহন হেয় নি ঠাকুর-দলানের দিগে গেছে।’
‘আরো কতা আছে গো ঠাকুরনীদিদি !’
‘ কি আক্কলে এমুন পিছে ডাকো গো মা-সগল! দেখতাছো পেরেশানিতে আছি। অহন নি কতা হোননের অবস্থাটা!’
‘কথাখান গুরুতর।’
‘কি তোমাগো গুরুতর কথা পড়ল আঁতকা?’
ভিতরের ঘাটলায় য্যান দেখলাম কেডায় জানি পইড়া রইছে!’
‘কি কও!’ ঠাকুরনীদিদির চলা বন্ধ হইয়া যায় পলকে, সেয় তাগো দিগে ফিরা খাড়ায়। বাড়িতে জনমনিষ্যি বলতে তিনজোন। বৌদিদি, আর তারা সোয়ামী ইস্তিরি দুইজোনে। তারমধ্যে পুরুত ঠাকুরে কোনোদিনও ভিতরের ঘাটলায় আইবো না। আর, সেয় তো অহন বাড়িতও নাই। কোন বিয়ানে গেছে সেয় ভোলাইল! এক যজমানের বাড়িতে বোলে শনি-কাটানি পূজা করোন লাগবো। একদিন যেয় কি না আছিল জমিদারবাড়ির পুরুত,আজকা তারে এইবাড়ি সেই বাড়িতে যজমানি কইরা ফিরোন লাগে! এত দুষখুও অদ্দিষ্টে আছিলো! তয়, কি করোন যাইবো! কপালের ফের।
‘না গো দিদি! পুরুষপোলা না! একটা মাতারিয়ে পইড়া রইছে।’
‘মাতারি ! মাতারি আইবো কইত্তেনে? বৌদিদিয়ে সোয়ামী খোয়ানের পর তেনে কোনোকালেও তো ঘাটলার দিগে যায় না!’ ঠাকুরনীদিদিয়ে বেতালা হইয়া কতখোন খাড়া দিয়া থাকে। তারপর আন্ধাগোন্ধা ছোটা ধরে ঘাটলার দিকে। যেই-ই পইড়া থাকুক না ক্যান, বিষয়টা তো নিষ্পত্তি করা লাগবো।
ঘাটলায় কে পড়া? জমিদারের কইলজার টুকরা,পরানের পরান আছিলো একদা যেয়, ঘাটলায় পইড়া রইছে সেয়। পইড়া রইছে জমিদারবৌদিদিয়ে।
প্রতিবার বকুল ফুল ফুটতে ফুটতে বৈশাখ মাসের দশ-বারো দিন হইয়া যায়। এইবার দেখো এই চৈত মাসের গোড়ায়ই কি না বকুল ফুল ধরছে গাছখানে। অকাইল্যা ফুল। সেই ফুল আউলা-পাথারি ঝইরা রইছে বৌদিদির মাথার আউলা –চুলে, নীলাম্বরী-জড়ানো দেহখানার এইখানে সেইখানে। সেই পড়া-ফুলের উপরে আরো ঝরতাছে ফুল- টাবুর টুবুর, ঝুরমুর। খালি, পাওয়ের পাতা দুইখানা ফাঁকা আছে,তারা পানিতে ডুবানো।
এইটা হইছে কি! এইতো দেহি বৌদিদিয়ে! এমনে পড়া ক্যান সেয়! ঠাকুরনীদিদি চিক্কুর দিয়া গিয়া ধরে সেই কাৎ-হয়ে পড়ে থাকা দেহখানারে। হায় হায়গো মা-সগল! কিয়ের তেনে কি হইলো! বিধি রে ,এই নি তোমার মোনে আছিলো ! ওরে বিধি! ঠাকুরনীদিদিয়ে চিল্লান দিতে দিতে ডুকরানি ধরে। দেখো রে,বিধির লীলা! দেহখানা পইড়া রইছে জমিদারবৌদিদির,কিন্তুক পরান-পঙ্খী কোন ফাঁকে-কেমনে জানি উড়াল দিছে। আত্মা-পঙ্খী ছাইড়া গেছে দেহ-পিঞ্জর।
ইচ্ছামিত্তু হইছে তার।
দেওভোগ গেরামে অই ঘটনা ঘটে গেছে সেই কোন আগের আমলে। কতো কাল আগে- তা এখনকার দেওভোগ গ্রামের কোনোজনই সঠিক বলতে পারে না। যাদের চক্ষের সামনে এইসব কিছু ঘটছিলো,তারাও সেই কবে দুনিয়া থেকে বিদায় নিছে ! তয়,জমিদার-বৌয়ের মরোনের পরে তারা আরো একখান ঘটনা হইতে দেখছিলো। সেই কোন পুরান আমলে,সেই ঘটনাখানাও ঘটছিলো।
একদিন, ভোর সকালের কালে, গেরামের লোকেরা দেখে, গাট্টি-বোঁচকা বাইন্ধা পুরুত মোশায়ে ঠাকুরনীদিদিরে নিয়া মেলা দিলো তিত্থ করতে। কইয়া গেলো – ‘আইয়া পড়মু তরাতরি!’ আঁতকা ক্যান এমুন তিত্থে চললো তারা! আহা! সংসারে বোলে ঠাকুরনীদিদিয়ে আর তিষ্টাইতে পারতাছিলো না। তার চিত্তি সয়-সুস্থির করোনের লেইগাই এই তিত্থ!
তারপরে যুগ-জনোম গেলো গা, হেরা দুইজোনে এই জিন্দিগিতে আর ফিরা আইলো না। জমিদারবাড়ির ঘরে ঘরে,ঠাকুর-দালানে- সকলখানের দরোজায় তালা দিয়া গেছিলো তারা। সেই তালা ক্রমে ক্রমে মরিচা-পড়া হইয়া,কবে ভাইঙ্গা ঝুরঝুরা হইয়া রইছে,তার সন্ধানও কেউ জানে না। কি হইছিলো তাগো দুইজোনের,কেউ কইতে পারে না। গেরামের যারা এই সকল ঘটনা চক্ষের সামোনে হইতে দেখছে, তারাও কালে কালে মরলো । কালে কালে দেখো, ঠাকুরনীদিদিগো কথা মোনে আনার লোকও প্রায় নাই হইয়া গেলো একদিন।
যে একদুইজোন অতি-বুড়া নানীর-নানী অহন জমিদার বাড়ির সেই সকল মানুষের পরস্তাব কথা কয়; তারা নিজেরা অই সকল বিত্তান্ত চক্ষে দেখে নাই,কিন্তু কানে শোনছে। তাগো কোনো কোনো জন কিনা তখন মায়ের পেটে। একজোনে খালি আছিলো এক্কেরে গুঁড়াগাঁড়া,দুধের ছাও। তারা ডাঙ্গর হইতে হইতে তাগো মুরুব্বিগো মোখে শোনছে সেই সব আচানক-কথা। শোনছে,আর ডরে তাগো শইল্লে কাঁটা দিছে। ডরে তারা কোনোজনও পারতে ঠাকুর-বাড়িতে পাও ফেলতে যায় নাই।
এই নতুন কালে, তারা নিজেগো আমলের সেই সব শোনা-কথা ইতিবিতি কইয়া যায়,কইয়া যাইতে থাকে; কিন্তু তারা দেখে যে, নতুনকালের নতুন মাইনষেগো চিত্তিতে অই কথা শোনার বাসনাখানা নাই। বড়োরা যেমুন তেমুন, কেবল ডাঙর হইয়া ওঠতাছে - এমুন পোলাপানে তাগো কথাতে কান দেয়ই না। দেওভোগ গেরামের সকলের চক্ষের সামোনে জমিদার বাড়িখান নিরালা, ছনাছনা পুরী হইয়া পইড়া রইছে। কিন্তু পোলাপাইনের ভাবে-ঢঙ্গে মোনে হয় য্যান বাড়িখান থাইক্কাও নাই। আর, সেই বাড়ির অই এত্তা বড়ো একখান বিত্তান্ত য্যান বাতাস!
অই বিত্তান্তরে এই পোলা-পাইনে গ্রাহ্যিই করে না! রক্তের গরমে না এমুনটা করে? এইটা কেমুন কাল আইছে! এত্তাবড়ো একখান গুরুতর কথারে কানে তোলতে চায় না –এটি কেমুন পোলাপাইন! অতি-বুড়া নানীর-নানীরা কতোক্ষণ এলেবেলে বিড়বিড়ায়। একটু চুপ থাকে, তারপর আবার পরস্তাব বলা ধরে। শোনার জন্য ধারে-কাছে কেউ আছে কি নাই,বিষয়টা তাদের আর খেয়ালে থাকে না।
এদিকে গেরামের কে না জানে যে,বুড়া হইলে মানুষের প্যাচাল পাড়োনের বাই হয়। সকল ঘরের মা-চাচিরা পোলাপানদের সেইকথা বোঝায়। বলে যে,এই মানুষ কয়টা – দুনিয়ায় আর কয়দিন আছে? তাগো প্যাচাল শোনার জন্য এট্টু থির হইয়া বসলে তো পারে পোলাপানগুলা! তাগো লগে এট্টু বইলে কি হয়! তবে যতোই বোঝানো হোক, পোলাপানরা মা চাচিগো কথারে কানে তোলে না মোটের উপরে। দোখো গা, একই প্যাচাল চলতাছে খোদার তিরিশটা দিন ! একই প্যাচাল কতো হোনন যায়!
আর, অই বুড়ীগো কথার যুদি কোনো আগা-মাথা থাকে! এই বলতাছে জমিদার বাড়ির পরস্তাব-কথা, তার মধ্যে আঁতকা আনতাছে বান-বাতাসের ভালা-বুরার কথা। তখন,জমিদারবাড়ির পরস্তাব কথা যে কই যায়! চলতে থাকে হুঁশিয়ারি! শোন সগলতে! বান-বাতাসরে গোনা-বাছা করে চলা বহুত দরকার ! মাইন্যা চলবা ভালা-মন্দ! জানবা, ভালা-বুরা যে না বাছে—ছারেখারে যায়! আবার তার সঙ্গে সঙ্গে সর্বক্ষণ দিয়া যাইতে থাকে সেই পুরান হুঁশিয়ারি। কি? না, অতি অবশ্যই চৈত মাইস্যা দোপোররে মান্যিগন্যি কইরা চলতে অইবো! নাইলে কালের দিষ্টি পড়বো! অন্য অন্য কথা কোনো মতে আধা শোনা,আধা না-শোনা করে না-হয় ছাড়ান দিলো পোলাপানে, কিন্তু অই চৈত মাইস্যা ডরের কথা কতো সওয়া যায়!
‘আরে! কি এক নাই জিনিসের কথা কথা কয় তারা! পাইছে এক চৈত মাস! তারে এই থুরত্থুইরা বুড়িরা টাইন্না আনবোই আনবো! দাদার আমল গেছে। বাপের আমল গিয়া আমাগো দিন শুরু হইতে যাইতাছে; কোনোদিনও তো চৈত মাইস্যা দিনে অমোঙ্গল ঘটতে দেখলো না কেউ! তাও তাগো অই নাই-জিনিস নিয়া কতা কওন লাগবোই!’ মা-চাচির নিষেধ ভুলে, পোলাপানগো কোনো কোনোজন খেঁজি দিয়া ওঠে, ‘হুদামিছি আকতা লইয়া ফাল পাড়ো ক্যা,তোমরা? জিন্দিগিতে দেখছো কিছু ঘটতে?’
‘ঘটে নাই,ঘটতে কতখোন!’ অতি-বুড়া নানির-নানিগো মোখে সেই একই উত্তর লড়েচড়ে বরাবর। সেই কথা বলা শেষ করে, তারপর থতমত গলায় তাগো কোনোজনে হয়তো বলতে যাইতো যে, ‘জমিদারবৌদিদির ইচ্ছামিত্তুখানও কইলাম হইছিলো অই চৈতমাইস্যা দোপোরে রে, পোলাপাইন!’ তবে সেই কথা বলতে গিয়ে- কোন কারণে জানি - একদম নিঃস্বর হইয়া যাইতো তাগো গলা। একটা কোনো আওয়াজ করে- সেই শক্তিখানও য্যান নাই হইয়া যাইতো পুরা। পরানের ভিতরটা শুকনা খরখরা লাগতে থাকতো বিনা কারণেই। কথাখানা আর বলা হইতো না।
পাঠক,এভাবে চলতে চলতেই একদিন দেওভোগ গ্রামে আসে ১৩৩০ সনের চৈত্র মাস।
(চলবে)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (চতুর্থ কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (তৃতীয় কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (দ্বিতীয় কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (প্রথম কিস্তি)