ওরাওঁ বিয়ে-৩
পায়ের তলার ফাঁক দিয়ে লক্ষ্মী পালিয়ে যায়
ওরাওঁদের বিয়েতে মাড়োয়ায় বসে পুরোহিত কনের বাবাকে মন্ত্র পড়ান। একইভাবে বর-কনেকে মন্ত্র পড়ানোর পর কনের বাবা বর ও তার ভগ্নিপতিকে একটি করে ধুতি উপহার দেন। অতঃপর বিয়ের পিঁড়ির চারপাশে কাপড় দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়। ওই ঘেরার মধ্যে থেকে বর কনেকে শাঁখা পরায় এবং সিঁথিতে সিঁদুর পরিয়ে সাত পাক ঘোরে এবং সাতবার মালা বদল করে নেয়। এভাবে বিয়ের মূল আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলে বর-কনেকে ঘরে তুলে নেওয়া হয়।
মাড়োয়া থেকে বরকে ঘরে নেওয়ার পথে একটি করে কাঁসার থালা রাখা হয়। বর প্রতিটি থালায় পা রেখে ঘরে প্রবেশ করে। কনেপক্ষের ছোটরা তখন দরজা বন্ধ করে রাখে। পরে হাসি-তামাসা ও টাকা উপহারের বিনিময়ে দরজা খুলে দেয়।
ওরাওঁ আদিবাসী বিয়েতে পূর্বপুরুষদের আত্মার উদ্দেশে অর্ঘ্য নিবেদন করা হয়ে থাকে। বিয়ের দিন বরের ও কনের ভাই তাদের পাশে একটি নতুন গামছার কাপড় নিয়ে মুখোমুখি বসে। প্রথমে কনের ভাই গামছার ওপর তিন ফোঁটা সরিষার তেল এবং তেলের ওপর সিঁদুর ফেলে। একইভাবে বরের ভাইও কয়েক ফোঁটা তেল দিয়ে বেষ্টনী তৈরি করে। অতঃপর উভয়পক্ষের বাটিতে রাখা তেল একত্র করা হয়। ওরাওঁদের বিশ্বাস এ আচারের ফলে উভয়পক্ষের আত্মিক সম্পর্ক আরো সুদৃঢ় হয়। অতঃপর তারা ওই তেল একে-অপরের গায়ে আনন্দের সঙ্গে মেখে দেয়। এ সময় ওরাওঁরা নাচ-গান আর রঙ্গ-তামাশায় মেতে ওঠে।
ওরাওঁ রীতিতে কনে বিদায়ের আগে উপহার প্রদান অনুষ্ঠানের আয়োজন চলে। কুলায় রাখা ধান এক আজলি করে পাঁচবারে পাঁচ আজলি ধান তুলে নেয় মা। অতঃপর মেয়ে মায়ের হাতের নিচে হাত রেখে পেছন দিকে ওই ধানগুলো ফেলে দেয়। এ সময় দুজনের মাথার ওপর কাপড় ধরে রাখা হয়। কনে বরের বাড়িতে পৌঁছলে বরকে যে রীতিতে বরণ করা হয়েছিল, তেমনিভাবে পা ধুয়ে এবং ডালায় থাকা তেল, পান, দিয়াইর, আতপ চাল, ধান, দূর্বাঘাস ইত্যাদি দিয়ে নববধূকে বরের বাড়িতে বরণ করে নেওয়া হয়।
ওরাওঁ আদিবাসীরা বিয়ের পরদিন মাড়োয়ার গোড়ায় পুকুরাকৃতির ছোট গর্ত খনন করে। নিয়মানুসারে ১৪টি সুপারি দিয়ে পুকুরটির পাড় বেঁধে দিয়ে তার মধ্যে একটি কড়ি, একটি তামার পয়সা, একটি হলুদ, একটি সুপারি, একটি রুপার আংটি ও একটি হরীতকী দিয়ে মন্ত্র পড়িয়ে বাসি বিয়ে সম্পন্ন করা হয়। এ সময় বর-কনে মাড়োয়ার চারদিকে চৌদ্দপাক ঘুরে একটি করে পান তুলে নেয় এবং কনিষ্ঠ আঙুলের মাথা দিয়ে বর সিঁদুর তুলে কনের আঁচলে থাকা লাল গামছায় রেখে দেয়। এ সময় বর-কনেকেন্দ্রিক নানা ধরনের খেলার আয়োজন করে ওরাওঁরা।
একসময় বিয়েতে পুরুষ নেংটি আর নারীরা ফতা নামের দুখ-ক্ষুদ্র কাপড় ব্যবহার করত। বর্তমানে শাড়ি সস্তা হওয়ায় বিয়েতে এরা শাড়ি ও ধুতি পাঞ্জাবি ব্যবহার করে থাকে। ওরাওঁ রমণীরা সৌন্দর্যপ্রিয়। বিয়ের অনুষ্ঠানে এদের রুপার তৈরি কানখুলি, তিপার পাতা, নলোক, নাকচনা, হাসলি, মাধলী, বাজু, পাইবি প্রভৃতি অলংকার পরতে দেখা যায়। এরা চুলে ও খোঁপায় বাঁধার জন্য রঙিন ফিতা ব্যবহার করে। বিয়েতে এরা খিচুরির সঙ্গে কাছিম, ভেড়া, শূকর, ছাগল, কাঠবিড়ালি, খরগোশ প্রভৃতির মাংস দিয়ে ভোজের আয়োজন করে।
ওরাওঁ সমাজে কোনো যুবক যদি বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে কোনো যুবতীর সম্ভ্রম নষ্ট করে, তবে সে ক্ষেত্রে ওই যুবক ও তার পরিবারকে অর্থদণ্ড ভোগ করতে হয়। যদি সামাজিক বিধি অনুসারে দণ্ডিত অর্থ প্রদানে তারা অসম্মতি জ্ঞাপন করে, তখন তাদের একঘরেও করে রাখা হয়।
এদের বিধবা বিয়ের প্রচলন থাকলেও সাধারণত বিধবা নারীরা পুনরায় বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হতে চায় না। নিঃসন্তান ও খুবই অল্প বয়সে কোনো নারী বিধবা হলে সে ক্ষেত্রে ওরাওঁ সমাজে পুনরায় বিয়ে হয়ে থাকে। বিধাব বা তালাকাপ্রাপ্ত রমণীকে বিয়ে করতে হলে আগে একটি ফুল বা গাছকে বিয়ে করতে হয়। এ ধরনের বিয়েকে অসবর্ণ বিয়ে বলা হয়।
বিয়ে নিয়ে ওরাওঁ সমাজে বেশ কিছু লোকবিশ্বাস প্রচলিত রয়েছে। বিয়ে-অনুষ্ঠানে কুলোতে ধান-দূর্বা, আতপ চাউল, মিষ্টি ইত্যাদি নিয়ে বরণ করার রীতি প্রচলিত রয়েছে। এরা মনে করে, কুলো লক্ষ্মীর শূর্প, অর্থাৎ যাতে সৌভাগ্য আসে। ধান-দূর্বা দীর্ঘায়ু ও নবদম্পতির সুখী জীবনের চিহ্ন বহন করে। আবার আতপ চাউল, মিষ্টি ইত্যাদি অপদেবতাদের খাবার। তাদের মতে, সিঁদুর যৌন-চিহ্ন বা বিজয় চিহ্ন এবং তেল হলুদ মেখে মূলত বিয়েতে অপদেবতার আসরকে বিনষ্ট করা হয়। পাত্র নির্বাচনে ওরাওঁ সমাজে পাত্রপক্ষের মুরুব্বিরা বেশ কিছু ঘটনার প্রতি দৃষ্টিপাত করে। যেমন : কনের সাংসারিক জ্ঞান কতটুকু, হাঁটার ক্ষেত্রে পায়ের ছাপ দেখে তারা নির্ধারণ করে কনে লক্ষ্মী না অলক্ষ্মী। কনে যদি খড়মপায়ী হয়, তাহলে সে অলক্ষ্মী। তাদের বিশ্বাস, পায়ের তলার ফাঁক দিয়ে লক্ষ্মী পালিয়ে যায়।
সাঁওতালদের মতো ওরাওঁ সমাজেও স্বামী-স্ত্রীর মাঝে ব্যক্তিগত কারণে বিবাদ তৈরি হলে বিয়েবিচ্ছেদ প্রথা চালু রয়েছে। পাঁচজন গণ্যমান্য ব্যক্তির সম্মুখে স্বামী-স্ত্রী উপস্থিত হয়ে স্বামী তালাক ঘোষণা করেন এবং শালপাতা টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে একটি পানিভর্তি কলসি উপুড় করে ফেলে দেন। শালপাতা ছিঁড়ে ও পানি ফেলে দিয়ে মূলত প্রতীকী অর্থে সম্পর্কচ্যুতি ঘটেছে বলে মনে করা হয়। তবে তালাকদাতা পুরুষকে ওরাওঁ সমাজে ঘৃণার চোখে দেখা হয়।
বিয়েতে সিঁদুরের প্রচলন নিয়ে ওরাওঁ সমাজে খুঁজে পাওয়া যায় চমৎকার একটি কাহিনী। কাহিনীটির ভাবার্থ :
‘চার বন্ধু কোনো এক কাজে অন্য দেশে রওনা হয়েছে। যেতে যেতে তারা পৌঁছাল এক জঙ্গলের কাছে। সন্ধ্যা গড়িয়ে ঠিক তখনই এলো রাত। ফলে কী আর করা, সবাই সিদ্ধান্ত নিল জঙ্গলের মধ্যেই রাত্রিযাপনের। বিপদ এড়াতে পালাক্রমে একজন জেগে থেকে পার করে দেবে রাতটি। এমনটাই ছিল তাদের পরিকল্পনা।
চার বন্ধুর মধ্যে একজন কাঠুরে, একজন স্বর্ণকার, একজন তাঁতি এবং চতুর্থজন ছিল সিঁদুর বিক্রেতা। প্রথমে কাঠুরে জেগে থাকল আর বাকি তিনজন ঘুমিয়ে পড়ল। কাঠুরে জেগে জেগে কী করবে? সে একটি কাঠ কেটে এনে তা থেকে গড়ল অপরূপ সুন্দরী এক নারীমূর্তি। মূর্তি তৈরি করেই স্বর্ণকার বন্ধুটিকে জাগিয়ে দিয়ে সে ঘুমিয়ে পড়ল।
স্বর্ণকার বন্ধুটি ঘুম থেকে জেগেই নারী মূর্তিটি দেখেই তো অবাক। সে জেগে আর কী করবে? গয়না তৈরি করে সাজাল মূর্তিটিকে। অতঃপর সে তাঁতি বন্ধুটিকে জাগিয়ে নাক ডেকে ঘুমোতে গেল।
তাঁতি জেগে জেগে কী করবে? সে কাপড় তৈরি করে মূর্তিটিকে সুন্দর করে জড়াল। অতঃপর সে সিঁদুর বিক্রেতা বন্ধুটিকে জাগিয়ে নিজে ঘুমিয়ে পড়ল।
সিঁদুর বিক্রেতা নারীমূর্তি দেখে অবাক হলো। দুপুর রাত্রে এমন সুন্দরী নারীমূর্তি কোথা থেকে এলো? সে আর কী করবে। সিঁদুর পরিয়ে দিল মূর্তিটিকে। আর অমনি নারীমূর্তিটি প্রাণ পেয়ে কথা বলতে থাকল।
নারীর কণ্ঠে ঘুম ভাঙল অন্য বন্ধুদের। জেগেই সবাই তো অবাক। মূর্তি হয়ে গেছে অপরূপা সুন্দরী রমণী। কাঠুরে বলে, ও আমার। কারণ আমিই ওকে প্রথম গড়েছি। স্বর্ণকার বলে, আমি ওকে সাজিয়েছি। তাই ও আমার। তাঁতি বলে, আমি ওর লজ্জা ঢেকেছি। সুতরাং ও আমারই হবে। সিঁদুর বিক্রেতা বলে, আমার সিঁদুরে ও প্রাণ পেয়েছে। তাই ও আমার। এসব নিয়ে চার বন্ধুর মধ্যে চলছে তুমুল ঝগড়া।
এমন সময় সেখানে উপস্থিত হন এক দেবতা। চার বন্ধুই দেবতাকে সব কথা খুলে বলে এবং সুন্দরী রমণীকে নিজের বলে দাবি করে। সব শুনে দেবতা খানিক হাসে।
অতঃপর দেবতা রায় দেন, যে কাঠ দিয়ে মূর্তি গড়ল সে রমণীর বাবা। যে অলংকার তৈরি করে সাজিয়েছে, সে ওর মামা। যে কাপড় পরিয়েছে, সে ওর ভাই। আর যে সিঁদুর দান করে ওর প্রাণ দিয়েছে, সে রমণীর স্বামী। দেবতার এ রায় মেনে নিয়েই চার বন্ধু রমণীকে নিয়ে বাড়ি ফিরে আসে।’
একদিকে দারিদ্র্য, অন্যদিকে ধর্মান্তরের হাতছানি। এই দুয়ের বিরুদ্ধে নীরব সংগ্রাম করেই টিকে আছে এ দেশের ওরাওঁরা। সময়ের হাওয়ায় এখন বদলে গেছে অনেক কিছু। সংখ্যায় কমে যাওয়ায় ওরাওঁরা এখন শুধু একই গোত্রেই নয়, এদের বিয়ে হচ্ছে কড়া, মুণ্ডা, তুরি প্রভৃতি আদিবাসীর সঙ্গে। ফলে ওরাঁও বিয়ের আদি রীতিগুলোও পাল্টে যাচ্ছে অন্য জাতির সংমিশ্রণে। টিনপাড়ার ওরাও গ্রামের নিপেন টিগ্গা তবুও আশায় বুক বাঁধেন। প্রজন্মের হাত ধরেই ওরাঁওরাদের আদি সংস্কৃতি, আচার ও বিশ্বাসগুলো টিকে থাকবে যুগে যুগে। এমনটাই তাঁর বিশ্বাস।