হাজং বিয়ে (শেষ পর্ব)
যে বিয়ের বাসনায় রংধনুর উৎপত্তি
হাজংদের বিয়ের পরদিন সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে বর-কনেকে স্নান করিয়ে বাসি বিয়ে করানো হয়। এই বাসি বিয়েকে বাহিয়া বিয়া বলে। এ পর্বে বর-কনে উপহারসামগ্রী গ্রহণ করে। অতঃপর আইড়ো, গীতালুদের কাজের সমাপ্তি ঘটে। তবে হাজং সমাজে বিয়ের কাজ সম্পন্ন হলেও কোনো অবস্থাতেই বর-কনেকে বাসরঘর দেওয়া হয় না। অনেক সময় সাত দিন একে অপরের মুখ দেখাও নিষেধ থাকে। সাত দিন পর দ্বিরাগমন শেষে বর-কনে বাসর ঘরে যেতে পারে। তবে হাজং সমাজে এ রীতি এখন তেমন প্রচলিত নেই।
এদের বিয়ের শেষ পর্বটি পাকপরশ বা ‘জ্ঞাতি ভোজন’। এ পর্বে কনে থালায় ভাত-তরকারি নিয়ে খাবারের স্থানে এসে ধূপ ও প্রদীপ জ্বালিয়ে জ্ঞাতিদের উদ্দেশে নিবেদন করে থাকে। এ ভাত-তরকারি প্রত্যেক জ্ঞাতির থালায় কিছু কিছু করে খেতে দেওয়া হয়।
হাজং বিয়েতে মেয়েরা বানা ও ছেলেরা ফটা, টোয়া, অর্গন প্রভৃতি পোশাক পরিধান করে। মেয়েরা কানে ধিরু, দুল মাকড়ি, হাতে বয়লা, চুড়ি, বাজুবন্ধ, পায়ে বাকগুঞ্জরী, কোমরে বিছা, গলায় আধুলি প্রভৃতি অলংকার ব্যবহার করে। উৎসবে অতিথিদের এরা বিশিভাত, ক্ষারপানি, ঢিং, বকনীভাত, ধানশামুক, ঝিনাই, কাঁকড়া, ছাগল, শুকর প্রভৃতি দিয়ে আপ্যায়ন করে থাকে।
হাজং সমাজে বিধবা বিয়ের প্রচলন রয়েছে। তবে কোনো অবস্থাতেই কোনো বিধবা স্বামীর বড় কিংবা ছোট ভাইকে বিয়ে করতে পারে না। এ ছাড়া বিয়ে বিচ্ছেদ ও বহু বিয়েও প্রচলিত আছে। এদের সমাজে নারী-পুরুষের অবৈধ যৌন সম্পর্ককে ঘৃণার চোখে দেখা হয় এবং তা পাপের সমতুল্য বলে বিবেচিত হয়।
তবে হাজংদের বিয়ে-বিচ্ছেদের প্রক্রিয়াটি বেশ চমকপ্রদ। কোনো কারণে যদি স্ত্রী বিয়ে বিচ্ছেদ করার ইচ্ছা প্রকাশ করে, তবে সামাজিক রীতিতে দুটি পান উপস্থিত লোকজনদের সামনে রেখে দেওয়া হয়। আলোচনা শেষে স্ত্রী পানগুলো প্রকাশ্যে ছিঁড়ে স্বামীর নাম ধরে ডাকে এবং তিনবার উচ্চারণ করে, ‘অমুক আমার বাপ লাগে।’ আর যদি স্বামী বিয়ে-বিচ্ছেদ ঘটাতে চায়, তবে একই পদ্ধতিতে পান ছিঁড়তে ছিঁড়তে স্ত্রীর নাম ধরে ডাকতে ডাকতে বলে, ‘অমুক আমার মা লাগে।’ এভাবে তিনবার উচ্চারণের মধ্যেই স্বামী-স্ত্রীর বিয়ে বিচ্ছেদ ঘটে এবং পান ছেঁড়ার মাধ্যমে প্রতীকী অর্থে তাদের সম্পর্কের ছেদ ঘটেছে বলে ধরে নেওয়া হয়। তবে গর্ভবতী স্ত্রীলোকের ক্ষেত্রে সন্তান ভুমিষ্ঠ হওয়ার পরে বিয়ে-বিচ্ছেদ কার্যকর হয়। তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রী কিংবা স্বামীকে পুনঃগ্রহণ হাজং সমাজে একেবারেই নিষিদ্ধ।
হাজং আদিবাসী সমাজে বিয়ে-সংক্রান্ত বেশ কিছু লোকবিশ্বাসের প্রচলন রয়েছে। এদের বিয়ের পূর্বে শুভ ও অশুভ সম্পর্কে নিশ্চিত হতে চায়। বিয়ের শুভ-অশুভ সম্পর্কে জানতে তারা একটি সপ্তাহকে নির্বাচন করে। ওই এক সপ্তাহ দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সময়ে ঘুমে অশুভ কোনো স্বপ্ন দেখলে অমঙ্গলজনক বিয়ে বলে তা ভেঙে দেওয়া হয়। এই স্বপ্নকে ‘ডিন হপন’ বলে। এ ছাড়া ওই সপ্তাহে যদি উভয় পরিবারের কোনো অপমৃত্যু, অকস্মাৎ হাত থেকে কোনো কিছু পড়ে যায়, কোনো তৈজসপত্র ভেঙে যাওয়াসহ যেকোনো ধরনের অমঙ্গলজনক ঘটনার আশঙ্কা থাকে তবে উভয় পক্ষের আলোচনাক্রমে বিয়ে ভেঙে দেওয়া হয়। হাজংরা সাধারণত ভাদ্র, পৌষ ও চৈত্র মাসকে অশুভ মাস হিসেবে গণ্য করে। বাকি মাসগুলোতে দিনক্ষণ দেখেই বিয়ের কাজকর্ম চলে।
এ ছাড়া হাজং শিশুরা ছোটবেলায় মাত্রারিক্ত কান্নাকাটি করলে হইল্যাবাড়ি, অর্থাৎ অশুভ শক্তির কারণেই তা হচ্ছে বলে বিশ্বাস করে হাজংরা। এ থেকে রক্ষা পেতে শিশুকালেই বাবা-মা মানত করে। মানত দেওয়া হয় শিশু বড় হয়ে বিয়ে করার সময়। এ মানত আদায় করতে এক কাঠা বিন্নি ধানের খৈ, এক ছড়ি আঠিয়া কলা, এক বা দুই সের ঢেঁকিছাঁটা চাল ভাজা গুড়া ও একটি ছাগি আনা হয়। নির্দিষ্ট দিনে পূজারির দায়িত্বে যে থাকেন ও যে মানত আদায় করতে চান সে, অর্থাৎ শিশুর বাবা, কাকা, অথবা মামা প্রথমে শুদ্ধ কাপড় পরে প্রস্তুত হয়ে নেয়। সকলে মিলে পূর্বনির্ধারিত শেওড়া গাছের তলায় যায়। সে গাছের তলায় পূজারি কিছু খৈ, কলা ও চালের গুড়া মিশিয়ে নাড়ু তৈরি করে কলাপাতায় করে শেওড়া গাছের গোড়ায় রেখে দেয়। বাকি কলাসহ অন্যান্য সামগ্রী পাশেই থাকে। পরে পূজারির পেছনে পেছনে মানতকারী শেওড়া গাছের গোড়াকে কেন্দ্র করে সাতবার প্রদক্ষিণ করে। প্রদক্ষিণ শেষ হলে পূজারি ছাগিটি সেখানেই বালি দেয়। সে সময় মানতকারী তার শিশুর প্রতি অদৃশ্য অশুভ শক্তির হাত থেকে রেহাই পেতে প্রার্থনা করে। এ আনুষ্ঠানিকতার কোনো সামগ্রী মানতকারী নিজের বাড়ি নিয়ে যেতে পারে না।
বোনকে বিয়ের ইচ্ছায় রংধনুর উৎপত্তি হাজংরা বিশ্বাস করে রংধনু সৃষ্টির পেছনে রয়েছে নিজের বোনকে ভাইয়ের বিয়ে করার বাসনা। এদের সমাজে এ নিয়ে প্রচলিত কাহিনীটি :
‘এক দেশে ছিল এক রাজা। রাজার ছিল এক ছেলে আর এক মেয়ে। ছোটবেলা থেকেই মেয়েটা ছিল বেজায় সুন্দরী। তার আলোকছটা রূপে অন্ধকার ঘরেও কোনো আলোর প্রয়োজন পড়ত না। তার রূপের আলোয় আলোকিত হতো চারপাশ।
দিন গড়িয়ে চলে। রাজার ছেলেমেয়েও বড় হতে থাকে। যৌবনে রাজার মেয়ের রূপ যেন আছড়ে পড়ে চারপাশে। খুব কাছ থেকে তা দেখে রাজার ছেলে মনে মনে ভালোবাসতে থাকে নিজের বোনকেই।
রাজা তার ছেলেমেয়েকে সব সময় ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখেন। কখনো তাদের চোখের আড়াল করেন না। সকাল থেকে ঘুমাতে যাওয়ার পূর্বপর্যন্ত ছেলেমেয়েকে কাছে কাছে রাখতেন।
ভাইয়ের আচরণে বোনও টের পেয়ে যায়। নিজের ভাই বোনের প্রেমে মত্ত। এ যে বড়ই লজ্জার ব্যাপার! টের পেয়ে রাজার মেয়ে নিজেকে সামলে রাখেন। কিন্তু মুখ ফুটে সে কথা কাউকে বলতে পারেন না। এদিকে বোনের রূপে ভাইয়ের পাগল হওয়া অবস্থা।
একদিন ঘটল এক কান্ড। খাওয়ার সময় পেরিয়ে যাচ্ছে অথচ খাওয়ার ঘরে রাজপুত্র নেই। রাজা চিন্তিত হয়ে পড়েন। খোঁজ নিয়ে জানতে পারলেন ছেলে নাওয়া-খাওয়া ভুলে নিজ ঘরে খিল এঁটে বসে আছে। রাজা গিয়ে অনুরোধ করার পরেও রাজপুত্র দরজা খুললেন না। রাজা এপাশ থেকে জানতে চাইলেন , ‘হাতি, ঘোড়া, টাঁকশালের টাকা—তুমি কী চাও? যা চাবে তাই পাবে।’ উত্তরে রাজপুত্র নিজের রূপসী বোনকে বিয়ে করার প্রস্তাব করে। ছেলের প্রস্তাবে রাজার মাথায় যেন বাজ পড়ে। আদরের ছেলের একি উন্মাদনা! সে সময় ছেলেকে শান্ত করতে রাজা সে প্রস্তাবে রাজি হন। কিন্তু ভেতরে ভেতরে তিনি ছেলের জন্য অন্য পাত্রী ঠিক করে ফেলেন। অন্যত্র বিয়ে হলে হয়তো রাজপুত্রের উম্মাদনা আর থাকবে না। তেমনটাই চিন্তা রাজার।
রাজবাড়িতে রাজপুত্রের বিয়ের ধুমধাম। এর মধ্যেই রাজপুত্র জেনে ফেলে তার জন্য অন্য পাত্রী ঠিক করা হয়েছে। তার সঙ্গেই আজ তার বিয়ে হবে। রাজার ছেলে তখন ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। বিয়ের পোশাক ফেলে সে তার রূপসী বোনের খোঁজ করতে থাকে।
বোন তখন পুকুর ঘাটে স্নান করছিল। তার ভাই রাজপুত্র সেখানে গিয়েই বোনকে বিয়ের কথা বলে। শুনেই বোনের হৃদয় কেঁপে ওঠে। নিজের আপন বড় ভাইকে সে কী বলবে। রাজার মেয়ে তখন অশ্রুসজল চোখে মহাদেবকে স্মরণ করে। তার কৃপা প্রার্থনা করে। ঠিক তখনই মাহদেবের আশীর্বাদ নেমে আসে। রাজকন্যা পুকুরের জল থেকে সে আশীর্বাদের শক্তিতে আকাশের দিকে উঠতে থাকে। এভাবে একসময় সে আকাশের মাঝে অদৃশ্য হয়ে যায়।
হাজংরা বিশ্বাস করে, এখনো আকাশ থেকে মাঝেমধ্যে স্নানের দৃশ্য মনে হলে জলকণার স্মৃতিতে রাজার মেয়ে রংধনু হয়ে ফুটে ওঠে। রংধনু নিয়ে এটিই হাজংদের আদি বিশ্বাস। রংধনু তৈরির আধুনিক বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের সঙ্গে যার অনেকটাই মিলে যায়।