সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন
এক.
এক চৈত্র মাসের দিনে ঘটনাটা ঘটেছিলো। ঘটেছিলো ঠিক দুপুরবেলা-একদম খনখনা দুপুরে। বাড়িতে বাড়িতে মা খালা চাচী জেঠীরা তখন রান্ধনঘরে চুলার জ্বাল আর তরিতরকারীর হাঁড়িপাতিল নিয়ে ধুন্ধুমার হুড়াহড়ির মধ্যে ছিলো। সুরুজ তখন ছিলো একেবারে চান্দি বরাবর, খাঁড়া। এমন দুপুরকে দেওভোগ গ্রামের ময়মুরুব্বিরা সদাসর্বদা সন্দেহের চক্ষে দেখে আসছে। যদিও ওই ঘটনাখানা ঘটার আগে কোনোজন্মে কেউ কোনোদিন কিছুই হতে দেখে নাই অমন দুপুরের কালে, তবুও চৈত্র মাসের দুপুররে নানীদাদীরা কেউ ভালো নজরে কোনোদিন দেখে নাই। তারা তাদের ময়মুরুব্বির মুখে শুনেছে যে, কি সব জানি বান বাতাসের আনাগোনা, ক্রিয়াকারবার চলে ঠিক ওই সময়খানাতেই। সন্ধ্যারেও সমঝে চলা লাগে সংবচ্ছর, তবে চৈতমাসের দুপুররে পার করতে হয় খুব হুঁশিয়ার ভাবে। এই হুঁশিয়ারীখানা তো আর একদিন-দুইদিনের ব্যাপার না! কোন সেই আগের আমলের কথা এইখানা–মুরুব্বিদের মুখে মুখে চলে আসছে! যদি কথার কথাই হবে, তাইলে মুরুব্বিরা এমনে জোর দিয়ে জানায়ে রেখে যেতো না! বেহুদা কথা কওয়ার কী এমন ঠেকা ছিলো তাদের!
তবে ঘরে-সংসারে দুই একখান চ্যাংড়া ফাজিল কি আর কালে কালে জন্মায় না? তারা ময়মুরুব্বির মুখের উপরে ফস করে বলেও ফেলছে যে, ‘কই- জিন্দিগিতেও তো কিছু হইতে দেখলাম না!’ ‘হয় নাইক্কা, হইতে কতখোন!’ মুরুব্বিদের এই জবাবের পরে কোনোটায়ই আর জবান চালানোর তাগাদা পায় নাই। সেই চৈত্র মাইস্যা দিনের খাঁড়া দুপুরের বেলাই ঘটনাখানা ঘটেছিলো।
কী সেই ঘটনা? না, পাড়ায় আগুন লাগে নাই। দিনেদুপুরে ডাকাত পড়ে নাই। কোনো সংসারের খসম তার বিয়াইস্তা বউরে খড়ম-পিটা করে আধামরাও করে নাই। হওয়ার মধ্যে হয় এই যে, পাড়া থেকে পাড়ার সকলের চেয়ে লয়লক্ষ্মী আর ঢক চেহারার মেয়েখান নাই হয়ে যায়। এই সে সকলের চক্ষের সামনে ছিলো, পলকটা না পড়তেই যেনো সে নাই হয়ে গেলো! বিষম তেলেসমাতি কারবার!
এখন, প্রিয় পাঠক; সেই দূর তেরোশো তিরিশ বঙ্গাব্দের দেওভোগ গ্রামে যে ঘটনাটি ঘটেছিলো-তার বিশদ বৃত্তান্ত শোনার আগে বরং চলুন গ্রামখানার সঙ্গে একটু চিনপরিচয় করে নিই আমরা।
দেওভোগ গ্রামের গড়নটা অদ্ভুত রকমের। ঢকে-ঢাকে গড়নে-পিঠনে বড়ো ছায়ছোট্ট গ্রামখানা। তাকে অন্য গ্রামের লোকেরা পাড়া বলেও হাসি-মস্করা করে। ফাতরা মানুষ কতোরকম ফাতরামি করে! সেইসব কে গোনায় ধরে! তবে দেওভোগ গ্রামখানা পুব দক্ষিণ উত্তর পশ্চিম-কোনোদিকেই টানা লম্বা নয়। যতোদূর দৃষ্টি যায় চোখে পড়ে শুধু ক্ষেতিখোলা, তার মধ্যে মধ্যে এইখানে ওইখানে একটা দুটা করে করে বাড়িঘর। ভিটাগুলা ছাড়া ছাড়া। একেক গৃহস্থের ঘরসংসার নিয়ে একেকখান ভিটা। পাড়াপড়শীর বাড়িতে যেতে হলে- যাও এখন নিজ ভিটির ঢাল বেয়ে একবার নামো; তারপর আবার লোকের বাড়ির ঢাল দিয়ে ওঠো। এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়িতে আনা-যানার এই ব্যবস্থা এইখানে।
টায়ে টুয়ে এই গ্রামে এখন বিশ-পঁচিশ ঘর গৃহস্থের বসতি আছে। আগে আরো পাঁচ দশ ঘর গৃহস্থও বসত করতো এইখানে। তাদের কাউরে কাউরে ঝাড়েবংশে নিয়ে গেছে হয় ওলা বিবি, নয় কালাজ্বরে। সেইসব গুষ্টির একজনও রেহাই পায় নাই। তাদের ভিটি বিরান-আন্ধার পড়ে আছে সেই থেকে। দিনেরাতে সকল সময় সেইসব ভিটিরে কেবল ঘুটঘট্টা আন্ধার দেখায়। অন্য অন্য বাড়ির মানুষদের পাকেপ্রকারে যেতে হয়েছে অন্য জায়গায়। হয়তো তাদের আশা ছিলো যে, কালে একদিন নিজ ভিটায় ফেরত আসবে। সেই কারণেই কিনা বেচাবিক্রি করে যায় নাই তারা। এখনও ভিটির জায়গায় ভিটি আছে। তাতে বচ্ছরের পর বচ্ছর ধরে জংলা গাছগরানেরাই নিজগুষ্টির সকলকে নিয়ে বসবাস করে যাচ্ছে। দেওভোগ গ্রামের লোকেরা তাদের ফিরে আসার জন্য অপেক্ষা করে করে কবে যে তাদের কথা ভুলেও গেছে – সেইটাও আর এখন মনে করতে পারে না। সবরকমের এইসব ভিটির পরেই টানা ক্ষেতের ঢল। তারপরে বহু দূরে অন্য এক গ্রাম, পায়ে হেঁটে আধাদিনের রাস্তা গেলে পরে তার দেখা মেলে।
এই যে দেওভোগ গ্রাম, তার একেকটা বাড়ির ভিটি মস্তো উঁচু করে বাঁধা। কতো নিচে ফসলী জমি, আর কোন উঁচায় একেকটা ভিটা! এমনটা হওয়ার পিছে কারণ আছে। এই তল্লাটের আশেপাশে কোনো নদীর নামনিশানাও নেই সত্য; কিন্তু দক্ষিণে, একটু দূরে, ক্ষেতখোলার মধ্যে দিয়ে গেছে শুকনা-শাকনা একখান খাল। সেই খাল বাইরা মাসে নিজে তো তাগড়া হয়ই, সঙ্গে করে যেনো দূরের নদীখানারেও নিয়ে আসে দেওভোগে। বানের পানি ভিটি ছুঁই ছুঁই থাকে স্বাভাবিক সময়েই। আর আজদাহা বন্যা আসলে তো কোনো কথাই নেই। উঠান পৈঁঠা থাকে হাঁটু পানির তলে।
ওদিকে, শুকনার দিনে পানির কষ্টের কোনো সীমা যদি থাকে! যদিও ঢাল, আর জংলা - পতিত জমি দিয়ে ঘেরাও সবকয়টা বাড়িরই ভিটি লাগোয়া পুকুর আছে। কোনো পুকুর বড়োসড়ো, কোনোটা কোনোরকম কাজ চালানোর একটুখানি ডোবা। সে পুষ্কুনী যেমনই হোক না কেনো, চৈত বৈশাখ মাসে তার পানি আর মুখে তোলার উপায় থাকে না! পৌষ মাঘ থেকেই সবকয়টা পুষ্কুনীর পানি ধাই ধাই করে তলের দিকে যেতে থাকে আর বাড়ির পুরুষপোলারা তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ঘাটলা নামাতে থাকে। এই নামানি থামে গিয়ে একেবারে চৈত মাসে, যখন পানি আর পেঁক একাকার হয়ে শেষ। তখন, গোসল-গাসল যেমন তেমন, খাওয়ার পানি নিয়ে যাতনায় ছটফটায় সবকয়টা ঘরের লোক!
সেই দুরকাইল্যা দিনে ভরসা বলতে ওই ঠাকুরবাড়ির বড়ো পুকুরখান। ঠাকুরবাড়ি দেওভোগ গ্রামের পশ্চিম সীমানায়। দুইটা বড়ো মাঠের পরে আছে একখান লিচু বাগিচা। সেই বাগিচা থেকেই ঠাকুরবাড়ির সীমানা শুরু। একদিন এইগ্রাম যার নিজস্ব সম্পত্তি ছিলো, সে অই ঠাকুরবাড়ি। ঠাকুরেরা জমিদার, তবে তারা বড়ো বাউলা কিসিমের জমিদার। আগের জনেরা যেমনেই হোক, সুন্দরমতো জমিদারী সামাল দিয়ে গেছে। কিন্তু বংশের শেষজন যে, সে যেনো এইসব জমিদারীর ক্রিয়াকর্মে থেকেছে কোনোমতে। যেনো না-পারতে থেকেছে; বিষম ঠেকায় পড়ে! তার আমলেও বাড়িতে গমক-ঠমক, শোভা-বাহার যতোখানি যেমন থাকার কথা, ঠিক তেমন তেমনই ছিলো। কিন্তু প্রজা রায়তের হেনতেন, খাজনাপত্রের ঝামেলা, টাকা আদায়-উশুল—এইসব কিছু দেখাদেখি তারে যেনো কাহিল-পেরেশান করে রাখতো আগাগোড়া। অইসব ক্রিয়াকর্ম রেখে জমিদারের মন নিত্য যখন-তখন উড়াল দিতো পূজা আরতি, জপতপ আর ধ্যানের দিকে।
যেমন কিনা আছিলো জমিদারে, তেমন আছিলো তার মায়ে! খালি পূজাপার্বন, খালি ব্রতউপোস, খালি গঙ্গাস্নান। এই করে করে একদিন কিছুর মধ্যে কিছু না, জমিদারে মউতের দুনিয়ায় যাত্রা করলো। আরো আশ্চর্য বৃত্তান্ত এই যে পুত্রশোকে জমিদারের মায়ে য্যান চল্লিশ দিনও চানসুরুজের মুখ দেখলো না! আগে গেলো পুতে, তার গলাগলি গেলো মায়ে! ওমা, বিধবা পোলার বউটারে তখন কে দেখে! বংশে যে তিনকুলে কেউ নাই! পরানের দুঃখ মোছে, নয়নের অজ্জোর ধারারে শুকায় –কোলের নিধি একখান ছাওও নাই তার কোলে ! আহারে!
দেওভোগ গ্রামের অতিবৃদ্ধ নানীদাদীদের যে দুএকজন বেঁচে আছে, তাদের মুখে ঘুরেফিরে এই কথা চলে আসে যখন তখন। জমিদার বাড়িতে অইসব বৃত্তান্ত যখন ঘটে, তখন কিনা তারা কোনো কোনো জন আছিল ছোটো পোলাপান। দুনিয়াদারীর কিছু বোঝে, কিছু বোঝে না অবস্থা তখন তাদের। সেই কতো বচ্ছর, কতোকাল আগের কথা এইগুলা! কিন্তু তাও কেবল এইসব কথাই তাগো বলবার বাসনা হয়! বলে বলে য্যান তিয়াস পুরায় না! নিত্যি তাগো মুখের এইসকল পরস্তাব শুনতে শুনতে গ্রামের সকলজনের কানাপট্টি তবদা লাগার দশা! তাগো এই প্যাঁচাল শুরু হলেই যে সকলে, যে যারমতো সুরুৎ-সারুৎ পলানি দেয়, তারা তা দেখে। কিন্তু তাও তাদের কথা বন্ধ হয় না।
এমনে জমিদারে, কী তার মায়ে বেঁচে থাকতে—সেই আমলের দেওভোগ গ্রামের বৌ-ঝি পোলাপান জমিদার বাড়িতে যেতে পেতো খালি বছরে দুইবার। দুর্গাপূজার বিজয়ার দিনের দুপুরের দাওয়াতে; আর লক্ষ্মীপূজার রাতে। বিজয়ার দুপুরে ভিতর বাড়ির উঠানে পাত পড়তো পোলাপান আর মা-বৌদের। আর ঠাকুর দালানের আঙ্গিনায় বসতো পুরুষপোলারা। রায়ত তুমি, সে হিন্দু মুসলমান যাই হও—তোমার দাওয়াত বান্ধা। খিচুড়ি আর পাঁচপদের নিরামিষ আর বেগুন ভাজি—খাও তুমি যতো পারো। আছুদা হইয়া খাও। রান্ধনঘরের দরোজা বরাবর জলপিঁড়ায় বসে জমিদারের মায়ে সকল বৌ-ঝির খাওয়া তদারকী করে, আর একপাশে খাড়া হয়ে পোলার বউ তারে বাতাস করে। হোক সে জমিদারের বউ, এই মুরুব্বিজন তো তার সোয়ামীর মা! তারে খেদমত না করলে হইবো!
লালে হলুদে নীলায় আর কইচ্চা রঙে মিশানি দেওয়া কী বাহারের ফুলতোলা পাঙ্খা! আর কী রূপ সেই হাতখানের! কাঁচা হলদিরে কয় তফাত যা—এমন বরণ-মাখানো হাতখানা দিয়া সেই বৌ তার হাউরিরে বাতাস করে, বাতাস করে! দাওয়াতী মা-বৌ-ঝিরা সেই শোভা দেখবো, না খাইবো!
(চলবে)