মালো বিয়ে
সাদা কাপড় হলুদে ডুবিয়ে হয় বিয়ের শাড়ি
মেয়েটির নাম মারিয়া মালো। মালো জাতির আদিবাসী নারী তিনি। থাকেন দিনাজপুরে। মাস্টার্স শেষে কাজ করছেন একটি এনজিওতে। দিনাজপুরের ঘোড়াঘাটের শীতল গ্রামেই মারিয়ার জন্ম। সেখানে প্রায় দেড়শটি মালো পরিবারের বাস। একসময় এঁদের পূর্বপুরুষ বাস করত রংপুরের তাজহাটে। একবার ওই গ্রামে কলেরা মহামারী আকার ধারণ করে। তখন কলেরা থেকে মুক্তি পেতেই বহু পূর্বে মারিয়ার পূর্বপুরুষ এসে বসতি গড়ে শীতল গাঁয়ে। দিনাজপুর ছাড়াও রংপুর, জয়পুরহাট, নওগাঁ প্রভৃতি এলাকায় অধিকসংখ্যক মালো আদিবাসীর বাস। মারিয়ার সঙ্গে মুঠোফোনে মালোদের নিয়ে এমন নানা আলোচনা আমাদের আগ্রহী করে তোলে। শীতল গাঁওয়ের ঠিকানাটি জানাই ছিল। তাই একদিন দিনাজপুর শহর থেকে আমরা পা বাড়াই শীতল গাঁয়ের উদ্দেশে।
বৈশাখ মাস। তার ওপর গত রাতে হয়েছে কালবৈশাখী। জল আর হাওয়ার ঝাপটায় প্রকৃতিটাও বেশ সজীব। জমে থাকা ধুলোবালি ধুয়েমুছে একেবারেই অন্য রকম। রোদের তীব্রতা তেমন নেই। দমকা হাওয়ার ঝাপটায় মাঝেমধ্যেই দুলে উঠছে মনটা। আমরা বাস থেকে নামি ঘোড়াঘাট টিঅ্যান্ডটিতে ।
রাস্তার পাশে বড় একটি বটগাছ। বটের ছায়ায় বাসস্ট্যান্ডটি। পাশে গোটা দুয়েক চায়ের দোকান। দোকানে বসে গল্প জমিয়েছে জনাকয়েক লোক। ফাঁকে ফাঁকে ধোঁয়া তোলা চায়ে চুমুক দিচ্ছে তারা। বাঙালি ছাড়াও দু-একটি আদিবাসীর মুখপানে আমাদের দৃষ্টি আটকায়। ঠাওর হয় এখানটায় আদিবাসী-বাঙালির সহ-অবস্থান।
দোকানের সামনে পাঁচ-ছয়টি ভ্যানের জটলা। এ অঞ্চলে পথ চলতে ভ্যানই একমাত্র ভরসা। শীতল গ্রামের কথা বলতেই আতর আলী নামের এক ভ্যানচালক এগিয়ে আসেন। ভাড়া দরদাম করে আমরাও শীতল গাঁওয়ের পথ ধরি।
লাল মাটির শক্ত পথ। রাস্তার পাশে নানা ভাষাভাষী মানুষের আনাগোনা। দূর থেকে আদিবাসী পাড়ার ছনে ছাওয়া ঘরগুলো দেখতে অন্য রকম লাগে। চারপাশে সবুজ ধানক্ষেত। তার মাঝে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি তালগাছ। বিশাল দেহী আদিবাসীরা দলবেঁধে কাজ করছে মাঠে। গ্রামের ভেতর থেকে ভেসে আসা ঢোল-মাদলের ছন্দ এ অঞ্চলে আদিবাসীদের আধিক্যকেই বারবার মনে করিয়ে দেয়।
কথায় কথায় আমরা পেরোলাম কিলো পাঁচেক পথ। রাস্তার ডানে বাঁক নিতেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে একটি আদিবাসী গ্রাম। এটিই মালোপাড়া।
সদর দরজায় কড়া নাড়তেই বেরিয়ে আসে মারিয়ার ছোট বোন বাসন্তী মালো। বাসন্তীর বাবা ভরত মালো। গ্রামের মাঝিহারাম বা গ্রামপ্রধান তিনি। তার খোঁজ করতেই বাসন্তী আমাদের নিয়ে যায় বাড়ির পেছনে। মাঠের শক্ত মাটিতে কোদাল চালিয়ে হলুদ তুলছিলেন ভরত মালো। বয়স সত্তরের মতো। কিন্তু দেহের গড়ন তা প্রকাশ করে না। গায়ের রং কালচে হলেও লম্বা ও সুঠামদেহী এ মানুষটি যেন আদি মানুষেরই জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। তার সহধর্মিণী ভারতী মালো। হলুদ তোলাতে তাঁকে সাহায্য করছেন তিনি। কাজ থামিয়ে আমাদের সঙ্গে আলাপ জমান তাঁরা।
মালো আদিবাসীরা এ অঞ্চলে এসেছে ভারতের রাঁচি থেকে। এদের গানেও মিলে তার সত্যতা—রাঁচি থেকে আসলো ঘাসী, তারপর হলো আদিবাসী। কথিত আছে, ব্রিটিশ আমলে রেললাইনের কাজের সূত্র ধরেই এ অঞ্চলে এদের আগমন ঘটে। ভরত মালোর বাবার নাম প্রতাপ মালো। প্রতাপের বেড়ে ওঠা এ অঞ্চলে হলেও তার বাবা এসেছিলেন রাঁচি থেকে। ভারতের রাঁচি ও জলপাইগুড়িতে ভরতদের এখনো অনেক আত্মীয়স্বজন বসবাস করছেন।
একসময় জমিদাররা মালোদের দিয়ে ঘোড়া, মহিষ ও গবাদি পশুর ঘাস কাটার কাজ করাত। সে কারণে মালোদের ঘাসী বলেও ডাকা হতো। এ ছাড়া এদের অনেকেই বংশানুক্রমিকভাবে জমিদারদের লাঠিয়াল ও বরকন্দাজ হিসেবেও কাজ করত। স্থানীয়রা এদের চিনে নেয় বুনা বা বুনো হিসেবে। বিহারের মালভূমি ও মালই টিলার অধিবাসীদের জীবনযাত্রার সঙ্গে মিল আছে বলেই এদের মালো নামে ডাকা হয়।
মালোদের এক-একটি গ্রাম পরিচালিত হয় তিন সদস্যের পরিষদের মাধ্যমে। মাঝিহারাম বা গ্রামপ্রধানের পদ ছাড়াও রয়েছে পারমানিক ও গুরদিক নামের দুটি পদ। গ্রামের সবার কাছে নানা খবরাখবর পৌঁছানোর কাজটি করেন পারমানিক। আর মাঝিহারামের বিচারের রায় পাঠ করে শোনাতে হয় গুরদিককে। মালো আদিবাসীদের গোত্র বিভক্তি তাদের বংশ পরিচয়কেই তুলে ধরে। গোত্রগুলোর নামগুলো জানতে চাইলে ভরত মালো হরহর করে বলতে থাকেন—পরনদীয়া, এসলোকিয়া, কারচাহা, সরকার, নায়েক প্রভৃতি। এদের একই গোত্রে বিয়ে নিষিদ্ধ। এরা তাদের নামের শেষে টাইটেল হিসেবে মালো ছাড়াও অঞ্চলভেদে নায়েক, রাজ, সরকার ব্যবহার করেন।
আমরা মন দিয়ে শুনছিলাম বাসন্তী, ভরত ও তাঁর সহধর্মিণীর কথা। হঠাৎ মাদল-ঢোলের টুংটাং শব্দ ভেসে আসে পাশের একটি বাড়ি থেকে। জানা গেল, পাশের বাড়ির মেয়ের বিয়ে চূড়ান্ত হয়েছে। তাই মালো বিয়ের আগপর্যন্ত নানা আচার চলবে ঢোল-মাদলের ছন্দে।
ভরত মালো ও তার সহধর্মিণীকে নিয়ে আমরা ওই বাড়ির দিকে এগোই। আমাদের বসার জায়গা হয় একটি ঘরের বারান্দাতে। এককোণে বসে মাদলের ছন্দ তুলছিলেন নিরমল মালো। মালোদের বিয়ে নিয়ে আমরা আলাপ জমাই। ঘরের ভেতর থেকে আসরে যোগ দেন গঙ্গা মালো। মালোদের মুখেই শুনি মালো বিয়ের আদ্যোপান্ত।
মালোদের বিয়ের পাকা কথা হয় কনের বাড়িতে। এ সময় কনেপক্ষকে ভালো ভালো খাবারের সঙ্গে খেতে দিতে হয় হাড়িয়া। হাড়িয়া মালোদের প্রিয় পানীয়। এটি ছাড়া মালোদের সম্মান রক্ষা হয় না। একসময় এদের বিয়েতে পণপ্রথা চালু ছিল। কিন্তু বর্তমানে সামর্থ্য অনুযায়ী ছেলেকে যৌতুক দিতে হয়। কিন্তু যৌতুক প্রথাকে মালোরা তেমন ভালো চোখে দেখে না। গঙ্গা মালোর ভাষায়, ডিমেন না নেওয়াই ভালো।
মালোদের বিয়ের পর্ব পাঁচটি। সাজনা সাজা, লগন, কৈইলনী, মারোয়া ও বিহা। সাজনা সাজো পর্বে বরপক্ষ কনেকে সাজানোর জন্য হলুদের শাড়িসহ চিউরা (চিড়া), গুড়, তেল, হেরদি (হলুদ), আয়না, ককোই (চিরুনি), দুইটা মাটির পুতুল, চুড়ি, কানফুলি, নাককুটি, মালা, ফিতা, পানসুপারি, জবা ও গাদা ফুল, কুশ (এক প্রকার জঙ্গলি ফুল), গংগিকা নূপুর (শামুকের নূপুর), পুতুলের খেটিলা (খাট) পাঠায়। এরা কনের জন্য সাদা রঙের কাপড় হলুদে ডুবিয়ে তৈরি করে বিশেষ ধরনের শাড়ি। মালো ভাষায় এটি, হরদি লেংগন লুগা।
গঙ্গা থামতেই লগন পর্বের কথা জানান নিরমল। এ পর্বে কনের মা-বাবাকে প্রথমে প্রার্থনা করতে হয় আদিরীতি মেনে। অতঃপর কনেকে ঘরের ভেতর রেখে গায়ে হলুদ দেন তার চাচা-চাচি, মামা-মামি ও নিকটাত্মীয়রা।