দীপেশ চক্রবর্তীর বয়ানে বাঙালি মধ্যবিত্তের আড্ডা

আড্ডা কি বাঙালির প্রাণ ভোমরা? বিশেষত সাহিত্যপ্রেমী বাঙালি মধ্যবিত্ত পুরুষের জন্য?
দীপেশ চক্রবর্তী প্রভিনশিয়ালিযিং ইউরোপ বইটির “আড্ডা” অনুচ্ছেদে আড্ডা সংক্রান্ত একটি প্রাঞ্জল আলোচনা উপহার দিয়েছেন। চক্রবর্তী লিখেছেন বাংলা সাহিত্যের আধুনিক রূপের সাথে আড্ডার সম্পর্ক বেশ গভীর। এমনকি বাঙ্গালির সাহিত্যিক সত্ত্বাকে যেন আড্ডা ছাড়া কল্পনা করাই কষ্টকর। এই প্রসঙ্গে তিনি বাংলা সাহিত্যের বহু দিকপাল, প্রমথ চৌধুরী, সৈয়দ মুজতবা আলি, বুদ্ধদেব বোস, এমনকি সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের উল্লেখ করেছেন। তবে নীরদ চৌধুরী আর বুদ্ধদেব বসুর সাংঘর্ষিক পর্যবেক্ষণকে গুরুত্বের সঙ্গেই আলাপ করেছেন চক্রবর্তী।
আড্ডার আলোচনায় চৌধুরী আর বসুকে উদ্ধৃতি দেবার উদ্দেশ্য হলো বাঙ্গালীর আধুনিকতাকে আরেকটু নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ। চক্রবর্তী বাঙালি আধুনিকতাকে ইউরোপ কেন্দ্রিকতা থেকে বিছিন্ন করতে নারাজ, কারণ উপনিবেশে আধুনিক ব্যক্তি আর তার মনোজগত জ্ঞানালোকপ্রাপ্তির (Enlightenment) ডিসকোর্সগুলো দ্বারা নির্মিত। যদিও ইউরোপ কেন্দ্রিক এই ডিসকোর্সগুলো অ-ইউরোপীয় ধারণাগুলোকে পশ্চাৎপদ বলে বাতিল করে দেয়। আবার এক ধরনের আবেগে গদগদ হয়ে মধ্যবিত্ত সুলভ সামাজিক আচারগুলোকেও গুরুভক্তি প্রদর্শন করে। নীরদ চৌধুরী আর বুদ্ধদেব বসু, চক্রবর্তী দেখিয়েছেন, এই বিপরীতধর্মী, অথচ ইউরোপীয়-চিন্তাপ্রসূত কূপমুণ্ডকতায় (উত্তর-আধুনিক, উত্তর-উপনিবেশবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা ইউরোপ-কেন্দ্রিকতাকে কূপমুণ্ডক বলতেই পারি)আক্রান্ত্র।
দীপেশ চক্রবর্তী লিখছেন, নীরদ চৌধুরী আড্ডাকে বাতিল করে দেন আলস্য আর গোত্রমানসিকতার পরিচায়ক হিসেবে কিন্তু বসু আড্ডাকে বেশ উচ্ছ্বাসের সাথে উপস্থাপন করেছেন। আড্ডাকে বাতিল করার প্রবণতা আর একে সাদরে পরিবেশনের মধ্যে চক্রবর্তী ভিন্নমত খুঁজে পাননি, বরং বাঙালি আধুনিকতা কতটা পাশ্চাত্যের কাঠামোগুলো দ্বারা প্রভাবিত ছিল, তার একটি নিদর্শন খুঁজে পেয়েছেন। এই বৈপরীত্যকে তাই তিনি উল্লেখ করেছেন, আড্ডা সংক্রান্ত ক্রিটিক্যাল দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করে এমন অ-ইউরোপীয়, গণতান্ত্রিক ধারার মূল-সন্ধানী ডিসকোর্সের ব্যাপক আলোচনার স্বার্থে। এখানে দীপেশ চক্রবর্তীর উদ্ধৃতি দিচ্ছি (অনুবাদসহ)-
“Formed at the opposite pole of Chaudhuri’s sensibility, such self-consciously lyrical panegyric to the spirit of adda is relatively rare [as is Bose’s]. There are, after all, Bengali words like gultani, gyajano, and so on, that generally refer to ‘useless talk.’ They suggest the existence of a critical attitude to adda that may not be indebted to the modern capitalist-colonialist theme of ‘the lazy native.’” (186)
“বুদ্ধদেব বসুর আড্ডা বন্দনা নীরদ চৌধুরীর বিপরীতে একটি মনোজ্ঞ অভিঘাত সৃষ্টি করে। আমরা বাংলা ভাষাতে গুলতানি, গ্যাজানো, এইরূপ বহুবিধ শব্দের কথা জানি যা কি না নেতিবাচক অর্থবহন করে। তবুও বলতে হয় আধুনিক ঔপনিবেশিক পুঁজিবাদী ধারণা প্রসূত ‘দি লেজি নেটিভ’-এর বিপরীতে তৈরি আড্ডার ধারণাটি স্বদেশি ক্রিটিক্যাল দৃষ্টিকোণকে উপস্থাপন করে।”*
এই ক্রিটিক্যাল দৃষ্টিকোণটি, চক্রবর্তী বলতে চেয়েছেন, একান্তই বাঙালির, যদিও উপনিবেশবাদী ধ্যান-ধারণার কাঠামোর মধ্যে এর বেড়ে ওঠা। চক্রবর্তীর এই মতের কারণ বিশ্লেষণে আমাদের আরেক বাঙালির শরণাপন্ন হতে হবে। যদিও সমসাময়িক দেশীয় চিন্তা চেতনার (vernacular thought) ঔপনিবেশিক কাঠামোর বৈতরণী পাড়ি দেওয়া বেশ দুঃসাধ্য। তারপরও এই প্রসঙ্গে বাঙালিসমাজ চিন্তক আশিস নন্দী স্মরণযোগ্য, তিনি বলেছেন, “আমাদের মনে রাখতে হবে, ফানোঁর জঙ্গিবাদী ইউরোপ প্রত্যাখ্যান কিন্তু জ্যঁ পল সার্ত্রের কেতাবি আঙ্গিকেই লিখিত হয়েছিল। ইউরোপ কেবল আধুনিক উপনিবেশবাদের জন্মদাতাই নয়, উপনিবেশবাদের বৈচিত্র্যময় ব্যাখ্যাও তাঁর উপস্থিতিতে তৈরি হয়। ব্যাখ্যার ব্যাখ্যাও পশ্চিমের হাতে তৈরি হয়।” (Preface to The Intimate Enemy: Loss and Recovery of Self under Colonialism xii) বলা যেতে পারে, আধুনিক উপনিবেশবাদের কাঠামোবাদী থাবাটি অতি দীর্ঘ, অন্তত চক্রবর্তী আর নন্দীর বিশ্লেষণ সেই রকম ইঙ্গিত বহন করে।
আড্ডা কি তাইলে বাঙালিত্বের ইউরোপ-কেন্দ্রিক জাতীয় সত্ত্বা পরিচায়ক? দীপেশ চক্রবর্তী, যিনি সাবঅলটার্ন তাত্ত্বিকদের মধ্যে অন্যতম উজ্জ্বল নক্ষত্র, হয় তো স্রেফ জাতীয় সত্ত্বার আলোকে ব্যাপারটি আলোচনা করছেন না। তিনি বলতে চাইছেন, আড্ডা আর বাঙালি জাতীয়তার মধ্যকার মেলবন্ধনের সত্ত্বাটি বেশ জটিল। তার উদ্দেশ্য রচনাটিতে উচ্ছ্বসিত উদযাপনের সমালোচনা উপস্থিত করা। তাইতো সৈয়দ মুজতবা আলীর কায়রো, কলকাতার আড্ডার তুলনামূলক আলোচনার সূত্র ধরে চক্রবর্তী বলেন,
It is not my aim to defend the Bengali metaphysical claim that the practice of adda is peculiarly Bengali. . . . What is peculiar, if anything, in twentieth-century Bengali discussions of the practice of adda is the claim that the practice is peculiarly Bengali and that it marks a primary national characteristic of the Bengali people to such a degree that the ‘Bengali character,’ it is said, could not be thought of without it (183)
“ আড্ডা একমাত্র বাঙালিরাই মারতে জানে এমন মেটাফিজিক্যাল দাবির সমর্থন করা আমার উদ্দেশ্য নয় ... বরং আড্ডা ও বাঙালি চরিত্রের মধ্যকার সম্পর্ক উদ্ঘাটন করা, এমনকি বিশ শতকের আড্ডা সংক্রান্ত আলোচনার মধ্যে বাঙালির জাতীয় চরিত্র নির্মাণে যে পরিচয় আমরা পাই তার তত্ত্ব-তালাশ করা।”*
চক্রবর্তীর এই বিশ্লেষণটি তার প্রাথমিক জিজ্ঞাসার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তপন রায় চৌধুরিকে উদ্ধৃত করে প্রভিনশিয়ালিযিং ইউরোপ বইয়ের ভূমিকায় তিনি বলেছেন আধুনিক বাঙালি মনস্তত্ত্ব জ্ঞানালোকপ্রাপ্তির (Enlightenment) সময়কার বড় বড় কথা (meta-narrative) দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত। তাইতো আড্ডার উচ্ছ্বসিত বয়ানগুলোতে একটি মেটাফিজিক্যাল সত্ত্বা খোঁজার প্রবণতা বিশেষভাবে লক্ষ করা যায়। এ ছাড়া রচনাটির তিনি শুরুতে তিনি বলেছেন, আধুনিক (ঔপনিবেশিক) শিক্ষায় শিক্ষিত (মগজে উপনিবেশ বলা যেতে পারে নগুগির ভাষায়) মধ্যবিত্ত বাঙালি পুরুষের দৃষ্টিকোণ থেকে আড্ডাকে বাঙালির জাতীয় চরিত্রের অংশ বলে ধরা হয় :
“Adda is often seen as something quintessentially Bengali, as an indispensable part of the Bengali character, or as an integral part of such metaphysical notions as ‘life’ and ‘vitality’ for the Bengalis” (182)
“আড্ডা কি বাঙালিয়ানার পরিচায়ক, অথবা বাঙালি চরিত্রের প্রকাশক অথবা বাঙালির ‘জীবন’ ও ‘প্রাণের’ সরবরাহকারী, যেমন করে একে প্রথাগতভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে।”*
প্রথাগত এই বিশ্লেষণ কি বাঙালি বুর্জোয়ার এক ধরনের আত্মদম্ভের পরিচায়ক? চক্রবর্তী আড্ডা নিয়ে উচ্ছ্বাসে আত্মদম্ভ খুঁজে পান না, আবার নীরদ চৌধুরীর মতো আড্ডা মারাকে আত্মঘাতী বাঙালির আদিখ্যেতাও মনে করেন না। আবার বুদ্ধদেব বসুর সাথেও তিনি একমত নন। চক্রবর্তীর লেখায় আরো কিছু বিষয় মুখ্য হয়ে দেখা দেয়। তিনি এই আলোচনার একপর্যায়ে পৃষ্ঠপোষকদের কথা উল্লেখ করেছেন, যারা অনেক সময় আড্ডার বিষয়বস্তু নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছেন। এমন কি কীভাবে সাহিত্য আড্ডাগুলো নারীপুরুষের মধ্যে একটি বিভাজনের দেয়াল তৈরি করেছে উনিশ শতকে অথবা বিশ শতকের প্রথম ভাগে সেই বিষয়টিও এড়িয়ে যাননি চক্রবর্তী। এমনকি তিনি এও বলছেন যে আড্ডার রাজনৈতিক অর্থনীতি বিবিধ অসমানুপাতিক সামাজিক সম্পর্ক দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতো-
“For all the claims made by the celebrants of adda, we know that it did not work equally well for everybody, that there were aspects of exclusion and domination in the very structure of adda” (213)
“বাঙালির আড্ডার ভূয়সী প্রশংসার দাবিদার অনেকে হলেও আমরা জানি আড্ডা সবার জন্য একই ভূমিকা পালন করেনি। আড্ডার কাঠামোতেই বাতিল করে দেওয়ার প্রবণতা এবং আধিপত্য বিস্তারি চেহারা লক্ষ করা যায়।”*
এই পর্যবেক্ষণটি চক্রবর্তীর আড্ডা নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত ও সমাধান খোঁজার উপায় ধরা যেতে পারে। তবে হঠাৎ করে আড্ডা নিয়ে বিশ্লেষণধর্মী লেখনীর উপস্থাপনা করলেন কেন, যখন এর আধিপত্যবাদী আর বাতিল করে দেওয়ার মতো উপসর্গগুলো তাঁকে শঙ্কিত করছে? আমরা বলতে পারি তিনি ঔপনিবেশিক আমলে তৈরি হওয়া আধুনিক বাঙালি মননের ঠিকুজী আবিষ্কারে নেমেছেন। উত্তর-উপনিবেশবাদি জটিল পৃথিবীতে বাঙালির শ্রেণিগত, লৈঙ্গিক আর জাতিগত পরিচয়ের বিভিন্নতার নিরীখে তিনি ঔপনিবেশিক আমলের সাহিত্য চর্চার আদলে গড়ে ওঠা মনস্তত্ত্বের বিশ্লেষণ করেছেন।
তিনি বাংলা সাহিত্যের এই অত্যাবশ্যকীয় উপাদানটিকে বলছেন উত্তর-আধুনিক, বিশ্বায়িত বাঙালি সাহিত্যপ্রেমীদের নস্টালজিয়া উপযোগের উপলক্ষ : “the current Bengali nostalgia for adda” (213)। পুঁজিবাদী, মেট্রোপলিটান শহুরে সমাজ কাঠামো, যেটি বাঙালি অভিবাসীকে বহু অসম, যোগাযোগহীন, অনেকটা আবেগহীন পুঁজিবাদের সেবকে পরিণত করেছে, সেই আবার অনেকটা হুমকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে বাঙালির সাহিত্য চর্চার অত্যাবশ্যকীয় এই উপাদানকে । অথবা মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে, চক্রবর্তী মেলটিং-পট, সালাদ-বউল কালচার অথবা মাল্টিকালচারালিজমকে সূক্ষ্ম আক্রমণ করে বাঙালি সত্ত্বা ধরে রাখার একটি পথ তিনি বাতলে দিচ্ছেন। পথ আসলেই কি বাতলানো যায়, এমন এক সময়ে যখন অভিবাসী বাস্তবতা, ওয়্যার অন টেরর আর তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়ন অর্থনীতির লাগামহীন ঘোড়া পথকে করেছে অনিশ্চিত? তবে কি কাঠামোবাদী, ঔপনিবেশিক সত্ত্বা সন্ধানী চিন্তার নিগড় হতে আধুনিক বাঙালির মুক্তি নাই? বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক সমস্যার সূত্র হয়তো এই আড্ডার বিশ্লেষণে পাওয়া গেলে যেতেও পারে।
শরণ :
চক্রবর্তী, দীপেশ। প্রভিনশিয়ালিযিং ইউরোপ : পোস্টকলোনিয়াল থট অ্যান্ড হিসটরিক্যাল ডিফারেন্স। প্রিন্সটন : প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২০০০।
Nandy, Ashis. The Intimate Enemy: Loss and Recovery of Self under Colonialism. New Delhi: Oxford University Press, 1983. Print.
* লেখকের অনুবাদ
আসিফ ইকবাল : গবেষক ও শিক্ষক