বিতর্কে জড়ানো আহমদ ছফা, হুমায়ুন আজাদ, অন্য লেখক

আহমদ ছফার মনজুড়ে সব সময় থাকত অন্যের চিন্তা, দেশের চিন্তা। এটাই ছিল তাঁর লেখালেখি, অন্যান্য কর্মকাণ্ড এবং অস্থিরতার কেন্দ্রবিন্দু। অন্যদিকে হুমায়ুন আজাদ ছিলেন নার্সিসিজমের চূড়ান্ত উদাহরণ। তার মানে এই নয় যে আমি হুমায়ুন আজাদকে অগুরুত্বপূর্ণ মনে করি; বরং তাঁর কিশোর সাহিত্যকর্মগুলো আমাদের সাহিত্যের চিরস্থায়ী সম্পদ বলেই আমার ধারণা। আর হুমায়ুন আজাদের অসাধারণ গতিময় গদ্যের কথা তো মনে রাখতেই হবে। গদ্য নিজেই যে একটি বড় শক্তি, তা সৈয়দ শামসুল হক, হাসান আজিজুল হক, হায়াৎ মামুদের মতো হুমায়ুন আজাদও আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন।
১
আশির দশকের শুরু থেকে মৃত্যু অবধি নিজেকে অবিরাম বিতর্কে জড়িয়েছেন হুমায়ুন আজাদ। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বিতর্কের সূত্রপাতকারী তিনি নিজেই। তিনি বিতর্কে জড়িয়েছেন আহমদ ছফার সঙ্গে, সৈয়দ শামসুল হকের সঙ্গে, এমনকি আজফার হোসেন-আনওয়ার আহমদের সঙ্গেও। দ্বিতীয় বা তৃতীয় জাতীয় কবিতা উৎসবে মূল প্রবন্ধ পাঠের পর আলোচনাকারী মহাদেব সাহা, নির্মলেন্দু গুণ, সৈয়দ শামসুল হকের সঙ্গে তাঁকে মঞ্চেই উত্তেজিত মৌখিক বিতর্কে জড়িয়ে পড়তে দেখেছি। কিন্তু কিছুদিন ধরে সামাজিক মাধ্যমে আহমদ ছফার সঙ্গে বিতর্কে লিপ্ত হওয়ার কথাগুলোই বেশি বেশি উঠে আসছে। সে কারণেই বর্তমান রচনাটির শিরোনাম এ রকম।
এমন তো হতে পারে না যে, সব বিতর্কে হুমায়ুন আজাদ ছিলেন ভুল অবস্থানের মানুষ। তাঁর বিতর্ক থেকেও মানুষ পেয়েছে অনেক সত্যকথন, আলো পড়েছে একেবারেই ভুলে থাকা, নজর এড়িয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে। তবে বাস্তবতা এটাই যে, সেই সময়কালে সাহিত্যজগতের অধিকাংশ মানুষের চোখে তিনি হয়ে উঠেছিলেন চূড়ান্ত স্টান্টবাজ এবং অশালীনভাবে নিজের ঢোল নিজে পিটিয়ে বেড়ানো লেখকের উদাহরণ। কোনো একটা বই লিখে শেষ করার পরে তিনি পত্রিকার সাক্ষাৎকারে এমন তথ্যও জানান দিয়েছিলেন যে বইটি লিখতে তাঁর কত বোতল হুইস্কি, কতগুলো বিয়ারের ক্যান এবং কত কার্টন সিগারেট খরচ করতে হয়েছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছিল যে হুমায়ুন আজাদের সঙ্গে কারো সম্পর্ক দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে, এমন চিন্তাই কেউ করতে পারতেন না।
হাসান আজিজুল হকের কাছে শুনেছি, একবার বইমেলায় আহমদ ছফা শত শত মানুষের সামনে হুমায়ুন আজাদের স্ত্রীকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করেছিলেন। কারণ হিসেবে বলেছিলেন, এই রকম মানুষের সঙ্গে যিনি ঘর-সংসার করতে পারেন, তিনি অবশ্যই প্রণম্য। তবে সেই সময়টাতে ছফার সঙ্গে আজাদের সম্পর্ক ততটা তিক্ত হয়ে ওঠেনি। তাই হতে পারে সেদিনের সেই ঘটনাটি ছিল ছফা ও আজাদের পারস্পরিক স্নেহ ও হিউমারের একটি পরিচয়।
আশির দশকেই খোন্দকার আশরাফ হোসেন সম্পাদিত ‘একবিংশ’ পত্রিকার দশম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে একটি অনুষ্ঠান হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরসি মজুমদার হলে। সেখানে শুভেচ্ছা বক্তব্য দিতে এসে লিটল ম্যাগাজিন, লিটল ম্যাগাজিনের লেখক-কবি এবং একবিংশ পত্রিকাটিকে নিয়ে খুব উপভোগ্য ঢঙে বেশকিছু কুরুচিপূর্ণ কথা বলেছিলেন হুমায়ুন আজাদ। সেখানেও নিজের ঢোল নিজে বাজাতে কসুর করেননি। বলেছিলেন যে ১০ বছরে ‘একবিংশ’ মাত্র দুটি সংখ্যায় দুটি ভালো লেখা ছেপেছে। তার একটি হচ্ছে হুমায়ুন আজাদের গুচ্ছ কবিতা, আর একটি হচ্ছে সৈয়দ তারিকের করা কোনো এক বিদেশি কবির কবিতার অনুবাদ।
পরে বক্তব্য দিতে উঠে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ সরাসরি প্রতিবাদ না করলেও হুমায়ুন আজাদকে উদ্দেশ করেই বলেছিলেন, কিছু মানুষ আছে ‘অপরের মুখ ম্লান করে দেওয়ার চাইতে’ বেশি আনন্দের আর কিছু নাই যাদের। আর এটাও তো সত্যিকথা যে, আশির দশক তো বটেই, এই একবিংশ শতকের দেড় দশকেও ‘একবিংশ’-এর মতো উচ্চমানের কবিতাকেন্দ্রিক পত্রিকা আর একটিও ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়নি।
২
লিটল ম্যাগাজিন এবং তার কবি-লেখকদের নিয়ে আরো একবার বইমেলায় বাজে মন্তব্য করায় কিছু তরুণের সঙ্গে একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাও ঘটেছিল হুমায়ুন আজাদের। সৈয়দ শামসুল হকের সঙ্গে তাঁর লিখিত বিতর্কের সূত্রপাত আজাদের প্রবচনগুচ্ছ নিয়ে। প্রবচনগুচ্ছ প্রথম ছাপা হয়েছিল সালাম সালেহউদ্দিনের ‘অরুন্ধতী’ পত্রিকায়। সেগুলো ছাপা হওয়ার পর পরই পাঠক টেনেছিল বিপুলভাবে, আর হুমায়ুন আজাদও স্বভাবসুলভ বলে বেড়াচ্ছিলেন যে বাংলা সাহিত্যে নতুন এবং মৌলিক একটি জিনিস তিনি সংযোজন করে দিলেন।
একটি প্রবচন নিয়ে সৈয়দ হক আপত্তি তুলেছিলেন দৈনিক সংবাদে তাঁর ‘হৃৎকলমের টানে’ কলামে। সেটি ছিল, ‘আগের যুগে কাননবালারা আসত পতিতালয় থেকে, এখন আসে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।’ এই প্রবচনটিকে সৈয়দ শামসুল হক নারী এবং সিনেমার জন্য অবমাননাকর বলে মন্তব্য করেছিলেন। এর পরেই শুরু হয়ে গেল পরস্পরের কাদা ছোড়াছুড়ি। কে কোন বই কোন বিদেশি লেখকের বই থেকে চুরি করে লিখেছেন, তার তালিকা পেতে থাকলেন পাঠকরা। একই সঙ্গে ব্যক্তিগত চরিত্র নিয়ে কটাক্ষ, চরিত্রে কলঙ্কলেপন। একপর্যায়ে বিনীত হস্তক্ষেপ করলেন কবি শামসুর রাহমান। তিনি আহ্বান জানালেন বিতর্ক বন্ধ করতে। কারণ তাঁর মনে হয়েছে, স্বাধীনতার পক্ষের এ দুই লেখকের ব্যক্তিগত কাদা ছোড়াছুড়ি থেকে লাভবান হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি। কয়েক মাস পরেই কোনো এক পত্রিকায় সাক্ষাৎকারে দেখা গেল, হুমায়ুন আজাদ বলছেন যে বাংলাদেশে উপন্যাস নিয়ে যদি কেউ সত্যিকারের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে থাকেন, তো তিনি হচ্ছেন সৈয়দ শামসুল হক।
নিজের কোনো কথা বা লেখার ভিন্নমত একেবারেই সহ্য করতে পারতেন না হুমায়ুন আজাদ। মনে হতো যা তিনি বলেছেন, সেটাই ধ্রুব, এর কোনো অন্যথা হতে পারে না। ভিন্নমত এলে এতটাই হিংস্র হয়ে উঠতেন যে তাঁকে তখন বিকারগ্রস্ত মনে হতো। ‘আমার অবিশ্বাস’ কিনেছিলাম অনেক আগ্রহ নিয়ে। পড়ার পরে ততটাই হতাশ। আমরা যারা ছাত্রজীবনে বাম রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলাম, নাস্তিকতা এবং বস্তুবাদী দর্শন নিয়ে এর চেয়ে অনেক উন্নত মানের বই পড়ে ফেলেছিলাম একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ার সময়ই বিভিন্ন পাঠচক্রে ও রাজনীতির ক্লাসে। তবু তাঁকে এ রকম সময়ে নিজের নাস্তিকতা ঘোষণা করার সাহসিকতা দেখানোর জন্য ধন্যবাদ জানিয়েছিলাম।
নার্সিসিজম তাঁকে কীভাবে অধিকার করে রেখেছিল, তার অসংখ্য উদাহরণ আছে। একটা উদাহরণই দেওয়া যাক। নিজে হুমায়ুন আজাদ না হয়ে একজন পাঠক হলে তিনি হুমায়ুন আজাদকে কীভাবে মূল্যায়ন করতেন—প্রশ্ন করায় তাঁর উত্তর ছিল, ‘কবিতায় তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তবে তাঁর আরো কবিতা লেখা উচিত ছিল; সমালোচনার ক্ষেত্রে তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ; ভাষাবিজ্ঞানে এখন তিনিই সবচেয়ে ভালো; কিশোরসাহিত্যে তাঁর লেখাই সবচেয়ে শিল্পিত; কলামপ্রবন্ধে উৎকৃষ্টতম যেমন ভাবেন অন্য পাঠকরা; আর বাংলায় নারীবাদের জননী নেই, জনক রয়েছে, তিনি হুমায়ুন আজাদ।’
নিজের লেখকসত্তা নিয়ে গর্বিত হওয়া কোনো দোষের কাজ নয়। কিন্তু নিজেকে সবার চেয়ে সব ক্ষেত্রে উঁচু অবস্থানে দেখতে এবং দেখাতে চাওয়ার আকুলতা অনেক সময়ই হাস্যকর করে তুলত তাঁকে। আবার লেখকত্ব নামক কর্মকাণ্ডকে অনেক উঁচুতে স্থাপন করে লেখকদের ভেতর থেকে হীনম্মন্যতা দূর করতে সাহায্যও করেছেন তিনি। তাঁর মুখেই সেই সগর্ব ঘোষণাটি শুনতে পাওয়া যায়, ‘একটি মহৎ বই লেখা একটি রাষ্ট্র স্থাপনের থেকে অনেক বড় কাজ, একটি বড় আবিষ্কার অসংখ্য রাষ্ট্রসৃষ্টির থেকেও মহৎ কাজ। একজন রবীন্দ্রনাথ বা আইনস্টাইনের কাছে তুচ্ছ কি নয় অসংখ্য রুজভেল্ট-চার্চিল-স্ট্যালিন-দ্য গল?’ আর বিতর্কিত ছিল তাঁর অবিমিশ্র ইউরোপ-প্রীতি। তাঁর কাছে আধুনিকতা মানেই পশ্চিম।
বাংলাদেশটা ইউরোপের সর্বোচ্চ বিকশিত রূপ হয়ে উঠলেই কেবল মুক্ত ও সভ্য দেশে পরিণত হতে পারবে, নচেত নয়। এমন চিন্তা যে ইতিহাস-ভূগোল-পরিবেশ-সংস্কৃতির একরৈখিক মাত্রাকেই কেবল গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করতে প্ররোচিত করে, সে ব্যাপারে তিনি কোনোদিনও সচেতন হতে রাজি হননি।
তবে আহমদ ছফার সঙ্গে হুমায়ুন আজাদের বিতর্কে জড়িয়ে পড়াটা আমাদের কারোই কাম্য ছিল না। হুমায়ুন আজাদ সামাজিক-রাজনৈতিক চিন্তার দিক থেকে অনেকটাই অগভীর ছিলেন।
আওয়ামী লীগ-বিএনপি-জাতীয় পার্টি-জামায়াত নিয়েই ছিল তার রাজনৈতিক চিন্তার চৌহদ্দি। আওয়ামী লীগ ভালো না বিএনপি ভালো—এ রকম আলোচনায় তিনি প্রবল উৎসাহে অংশ নিতেন। অ্যাকটিভিস্ট হিসেবে তাঁকে কোথাও দেখা যায়নি। কোনো সামাজিক-সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক আন্দোলনে বা কর্মসূচিতে তাঁকে কখনো দেখা যায়নি। কোনো সংগঠনের সঙ্গেও তিনি সময় দিতেন না। যদিও তিনি নিজে বলেছেন, ‘এখানে রাষ্ট্রসমাজ দখল করে থাকে এমন দুর্বৃত্তরা যে বিবেকী মানুষের পক্ষে আত্মমগ্ন শিল্পচর্চা অসম্ভব হয়ে পড়ে। আমার কবিতায় রাজনীতি এসেছে সামাজিক বিবেক থেকে, আমি যে সমাজ-রাষ্ট্র চাই তার স্বপ্ন থেকে। আমাদের মতো দুর্দশাগ্রস্ত-পীড়িত অঞ্চলে চোখ বুজে শিল্পকলার স্তনের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারে শুধু শয়তানের সেবকেরা।’ বলেছেন বটে, কিন্তু কোনো আন্দোলন-সংগ্রামে সশরীরী উপস্থিতি থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখেছিলেন তিনি।
অন্যদিকে, আহমদ ছফা ছিলেন জাতির সার্বিক মুক্তি নিয়ে আগ্রহী একজন মানুষ। শুধু লেখা নয়, বক্তৃতা দেওয়া নয়, মিছিলে হাঁটা মানুষ। বোঝাই যাচ্ছিল, দুজনের বিতর্কটা হবে অসম। কিন্তু পিছিয়ে যাওয়ার স্বভাব তো আহমদ ছফারও ছিল না। তিনি হুমায়ুন আজাদের করা প্রথম কিস্তির আক্রমণের জবাব শুরুই করেছিলেন এই বলে যে, শুয়োরের বাচ্চার দাঁত উঠলে আগে বাপের পাছায় কামড় দিয়ে ধার পরখ করে। সে রকম সদ্য দাঁত ওঠা হুমায়ুন আজাদ আক্রমণ করতে এসেছেন আহমদ ছফাকে। এই বিতর্ক লিখিত আকারে খুব বেশিদিন চলেনি। তবে আহমদ ছফা ভোলেননি বিষয়টি। হয়তো ভোলেননি হুমায়ুন আজাদও। এর পরে আজাদের একের পর এক গ্রন্থের অসারতা-অগভীরতা মানুষকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখানোর কাজটি করে গেছেন আহমদ ছফা।
এইসব লেখা নিয়েই এখন সামাজিক মিডিয়ায় ঝড়-ঝাপটা। এরচেয়ে দুজনের গুরুত্বপূর্ণ রচনাগুলো পাঠ করাটাই বোধহয় অনেক বেশি ফলদায়ক। পাঠকের নিজের জন্য যেমন, সমাজের জন্যও।