পাহাড়ি বিয়ে
কনের মা বরের পা ধুয়ে বরণ করেন
পাহাড়ি আদিবাসী বিয়ের দুদিন আগে উভয় পক্ষকে গা চালানী বা গ্রামপূজার আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করতে হয়। এ ছাড়া বিয়ের দিন কনের বাড়িতে যাওয়ার আগে বরকে সাক্ষী পূজা হিসেবে আমগাছকে বিয়ে করতে হয়। আমগাছের চারপাশে চালুন বাতি (মাটির প্রদীপ) নিয়ে বরকে সাতপাক ঘোরানো হয়। বিয়ে বাড়ির উঠোনে সাজানো হয় চলমা তলা। চারটি কলাগাছ সমান চারটি গর্তে পুঁতে দেওয়া হয়। তার আগে গর্তে দেওয়া হয় পয়সা। এ সময় পাহাড়িয়ারা আদিবাসী গান গায়—
এতোদিন ছিলি রে কলার গাছ—জঙ্গলে জঙ্গলে
আজ কেন আলীরে কলার গাছ রণজিতের (বরের নাম) বাড়িতে
ডুম তাক্কা ডুম
ডুম তাক্কা তাক্কা...।
বিয়ের দিন কনের বাড়িতে বরপক্ষ পৌঁছানোর পর তুলসী জল ছিটিয়ে তাদের বাড়ির ভেতরে আনা হয়। পাহাড়িয়া ভাষায় এই আচারকে বলে মাড়াকাম্বে। এতে শয়তান বাড়ির ভেতরে ঢুকতে পার না বলে এরা বিশ্বাস করেন। এরপর কনের মা বরকে পা ধুয়ে বরণ করে নেন। পনের সঙ্গে বরকে আনতে হয় দুই কলসিতে টাডি (এক প্রকার মদ), ঘাস, কলা, বিড়ি, পান-সুপারি, চিনি, বাতাসা, তেল, জল, সিন্দুর, চাল, ভাত, ধূপ, বাতি, ডিম, দুধ, আমকুড়ি, আমপাতা,তুলসী পাতা, ধান, আলো চাল প্রভৃতি।
কনে সাজিয়ে বর-কনেকে চলমা তলায় কাঠের পিঁড়িতে বসানো হয়। সে সময় উভয়ের মামা ও কাকা বসা অবস্থায় তাদের পিঁড়ি ধরে চলমা তলার চারপাশে সাত পাক ঘোরে। এ সময় বর প্রতি পাকে তুলসী পাতা দিয়ে কনেকে জল ছিটিয়ে দেয়। অতঃপর বর তার বাঁ হাতের কনিষ্ঠ আঙুল দিয়ে সিঁদুর পড়ায়। এভাবেই তারা একে অপরের জীবনসঙ্গী হয়ে যায়। এ সময় পাহাড়িরা গান গায়—
১। কর তেহ করন দারিয়া
এস একন লালতি
গার সোকেতেক পুপাতকতি।
যামেন চুমা তোরতি
ইন্দার ইন্দার লাগি
ঈানি আতয়ে আর দুবড়া গাসি লাগি।
ভাবার্থ :
ছেলের ছেলে ধর
আমি যাব নাচতে
সাথে ফেলে ফুল তুলে
জামাইকে বরণ করতে কী লাগে
পানির পাতা আর দূর্বা ঘাস লাগে
জামাইকে বরণের সময় পানের পাতা প্রদীপের আগুনে সেঁক দেয়।
গালে দূর্বা ঘাস দেওয়া হয়।
২। ইলকো দিনি মলিতাম
এমু বেদেক হিমু মালতাম
উগলি নিন্দাপে
ভালবাসা এারকো আঁদিন ওয়্যানা।
আঞ্জলি এমকি চামেকি ডালানো
বেয়ো ইন্দির যাহা
এমকি উগলিকি আযেগেন নিমে
চিয়াম উপহার।
মকি উগলিকি চিয়াম মেলেকে নোউনেন
বালই ঢেউমাজা চিন্তা বঙ্গ
এমকি উগনি মাকেকি নাওয়ে নিমেন বেদি
এমবি উগলেকি মুকচিয়াম মেলকিনো উনান।
মজাকানি দিনেনো নিমেন বেদেকা
পানও কাঁদি আমসেতি নিমেন ভালোবাসচতাম
ন্যাক এ নিমেকি বন্যমেনেকা এমকি কামনায়
উগলি নিন্দেপে ভালবাসা ইরিকো কান্দিন তয়্যানা।
ভাবার্থ :
এসব দিনের মাঝে আমরা
কিছুই ভেবে পাই না
হৃদয়ভরা ভালোবাসা এটুকু মোর লও না।
অঞ্জলি মোর গানের ডালায়
নেই তো কিছু আর
আমার মনের আবেগ টুকু
দিলাম উপহার...
আমার মনের মুক্তো দেব কণ্ঠে গহনা।
তার হাওয়ার এই ঢেউয়ের মাঝে
চিত্ত ছুটেছে
আমার মনের আমার তরী
তোমায় খুঁজছি।
আমার মনের মুক্তো দেব কণ্ঠে গহনা।
সুন্দর একটি দিনে তোমায় খুঁজে পেয়েছি
একটি মাত প্রণামে ভালোবেসেছি।
জীবন তোমার জন্য হোক আমাদের কামনায়।
আমার মনের মুক্তো দেব কণ্ঠে গহনা।
হৃদয়ভরা ভালোবাসা এটুকু মোর লও না।
বিয়ের পর্ব শেষে কনেকে তুলে দেওয়া হয় বরপক্ষের মোড়লের হাতে। কনেকে বরের বাড়িতে আনার পর বরের মা তুলসী জল ছিটিয়ে, চালুন বাতি রেখে উভয়ের পা ধুইয়ে ঘরে প্রবেশ করায়। এরপর বর যে আমগাছকে সাক্ষী পূজা দিয়েছিল সে গাছে কনেকে চুম্বন ও প্রণাম করিয়ে ঘরে তোলা হয়। এ ছাড়া কনেকে বরসহ তার বাবার বাড়িতে ফিরিয়ে নেওয়া হয়। একে বলে আট মংলা ফিরনী।
পাহাড়িয়া আদিবাসী সমাজে বিয়েপণ গ্রহণের বিশেষ নিয়ম রয়েছে। পাত্রীর বাড়িতে পাত্রীর মা একটি চালনে ধূপ, সিঁদুর, দূর্বা ঘাস, চিনি, বাতাসা, তুলসী পাতা, চুকরী বাতি এবং জলসহ ঘটি রাখেন। পাত্রী ওই চালনটি নিয়ে পাত্রপক্ষের প্রত্যেকের কাছে যান এবং প্রণাম করেন। এ সময় সকলেই ঘটিতে রাখা পানি তুলসী পাতাসহ পাত্রীর মাথার ওপর ছিটিয়ে তাকে আশীর্বাদ করেন। পণের নির্ধারিত টাকা এবং বরপক্ষের আনা একটি নারিকেল ও শাড়ি ওই চালনে রাখা থাকে। পাত্রী যখন পাত্রের মাকে প্রণাম করতে যান তখন তিনি চালনে রাখা পণের টাকা পাত্রীর শাড়ির আঁচলে বেঁধে দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে আশীর্বাদ করেন। এভাবেই পাহাড়িয়া সমাজে বিয়েপণ দেওয়া হয়।
বিয়ের সময় কনের জন্যে সাদা শাড়ি লাল পাড় আঁচলের হলুদ রঙের শাড়ি দেওয়া হয়। বরকে পাঁচ অথবা ছয় হাত মারকিন কাপড় পরানো হয়। কেউ আবার বর-কনেকে বাজার থেকে শার্ট-প্যান্ট এবং শাড়ি কিনে দেন। আগে বর-কনেকে নিয়ে যাওয়ার জন্য পালকি, রাহি, চৌডাল, গরুর গাড়ি, মহিষের গাড়ি ব্যবহার করা হতো। বর্তমানে বিয়েতে বাস-মাইক্রোবাস ব্যবহার হয়।
পাহাড়িয়াদের সমাজব্যবস্থা পিতৃতান্ত্রিক। মেয়েরা সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হতে পারেন না। তবে পরিবারে যদি কোনো পুত্রসন্তান না থাকে, তাহলে বাবার সম্পত্তি মেয়েরা ভোগ করতে পারবে। যদি পরিবারে শুধু মেয়েসন্তান থাকে তখন ঘরজামাইয়ের ব্যবস্থা করা হয়। সে ক্ষেত্রে মেয়ে ইচ্ছা করলে তার স্বামীকে সম্পত্তি লিখে দিতে পারেন। পাহাড়িয়া নারীরা রুপা বা তামার তৈরি অলংকার বেশি ব্যবহার করেন। তাদের অলংকারগুলোর মধ্যে কাডু (চুড়ি), পুণ্ড (গলার মালা), ইয়ুপাটড়া (কানের দুল), মসুডুবী (নাকের নোলক), কমর ধনী (কোমরের বিছা) প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
বিয়ে নিয়ে পাহাড়িয়া সমাজে বেশ কিছু লোকবিশ্বাস যুগ যুগ ধরে প্রচলিত হয়ে আসছে। নবদম্পতির দিনগুলো সুখের হবে কি না, তা যাচাইয়ের জন্য এরা একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। প্রথা অনুযায়ী, চালনা সাজিয়ে পুকুর বা নদীতে দুটি বাতি জ্বালিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। বাতাসে বাতি দুটো যদি একত্রিত হয় অথবা বাতি দুটির মিলন ঘটে তাহলে নবদম্পতির বাকি জীবন সুখের হবে। আর বাতি দুটোর মধ্যে যদি কিছুটা দূরত্ব থাকে তাহলে ধরে নেওয়া হয় নবদম্পতির সংসারজীবনে দ্বন্দ্ব থাকবে। এ ছাড়া এ আদিবাসী সমাজে বর-কনেকে হলুদ মাখিয়ে স্নানের জন্য পুকুরে বা নদীতে নেওয়ার সময় পথে শুভ-অশুভ লক্ষণ যাচাই করে থাকে। পথে যদি কেউ হোঁচট খায় অথবা সাপ বা হিংস্র প্রাণীর দেখা মিলে তবে তা অশুভ লক্ষণ বলে ধরে নেওয়া হয়। একইভাবে বরযাত্রীরা যদি রাস্তায় হিংস্র পশুর আক্রমণ বা সাপের দেখা পায় তবে ওই বিয়েকে অশুভ হিসেবে ধরে নেয় পাহাড়িয়ারা। আবার পথে যদি বন্য পশুর বা সাপের মিলন ঘটতে দেখা যায় তাহলে বিয়ে শুভ হবে এবং মেয়ে আজীবন স্বামীকে ভক্তি করবে বলে বিশ্বাস করে পাহাড়িয়া আদিবাসীরা।
পাহাড়িয়া আদিবাসী সমাজে বিয়ে বিচ্ছেদ নাই বললেই চলে। কেউ বিবাহবিচ্ছেদ করতে চাইলে বা অন্যত্র বিয়ে করলে তাকে সমাজচ্যুত করা হয়। তবে যদি কেউ সংসার করতে না চায় তবে তার কারণ যথাযথভাবে প্রমাণ করতে হয়। প্রথমে স্বামী-স্ত্রীর সমস্যা জানার পর সমাজে মীমাংসার চেষ্টা করা হয়। তারপরও যদি অশান্তি হয়, তখন দুই পক্ষের লোকজনের উপস্থিতিতে তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের মতামত দেওয়া হয়। বিবাহবিচ্ছেদের সময় মেয়েকে কোনো ক্ষতিপূরণ দিতে হয় না। তবে মেয়ে তার সন্তানকে নিয়ে যেতে পারে না।
পাহাড়িয়াদের সমাজে ধর্মান্তরিত হওয়ার প্রলোভন এসেছে বারবার। কিছু এলাকার আদিবাসীরা তা গ্রহণ করলেও অধিকাংশ পাহাড়িয়া আজও আগলে রেখেছেন তাঁদের পূর্বপুরুষের জাতধর্মকে। ফলে টিকে আছে তাঁদের বিশ্বাসের নানা আচার। পাহাড়িয়াদের বিশ্বাস, এভাবেই তাঁদের বিয়ের আদিসংস্কৃতিও টিকে থাকবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে।