আদিবাসী বিয়ে
ভরা কলসি দেখলে যাত্রা শুভ
উপজেলার নাম বিরল। দিনাজপুরের এ উপজেলাটি সত্যি অন্য রকম। নামের দিক থেকে যেমন, কাজের দিক থেকেও তেমন। নানা ভাষাভাষী আদিবাসীদের বাস এখানে।
তাদের কাছে বিশ্বস্ত সাংবাদিক কুদ্দুস। স্থানীয় বাঙালিদের সঙ্গে জমিজমা কিংবা কোনো বিষয়ে সমস্যা তৈরি হলেই আদিবাসীরা ছুটে আসে কুদ্দুসের কাছে। বাঙালিদের দ্বারা আক্রান্ত হলেও এখানকার আদিবাসীদের নির্ভরতা কুদ্দুসের মতো বাঙালির ওপর।
কুদ্দুসকে নিয়েই আমরা আসি রানীপুরের লোহার বা কর্মকার আদিবাসী পাড়ায়। পূর্বপুরুষদের জাতধর্ম ঠিক রেখে, দারিদ্র্যের সঙ্গে সংগ্রাম করে এখানেই টিকে আছে ১০টি আদিবাসী পরিবার।
কর্মকার বা লোহার আদিবাসী পাড়াটির এক পাশে গহীন শালবন। অন্যপাশে চোখের সীমানায় শুধুই ফসলের মাঠ। এখানকার বাড়িগুলো মাটির আর ছনে ছাওয়া। গায়ে গায়ে লাগোয়া। দূর থেকে অন্য আদিবাসীদের মতোই দেখতে। যত সামনে এগোই ততই টুং টাং লোহা পেটার শব্দ আমাদের ঘিরে ধরে। লোহা পিটার এ শব্দই এখানকার মানুষগুলোর ঐতিহ্য। কারণ এরাই লোহার বা কর্মকার আদিবাসী।
লোহার শব্দটি এসেছে লো-হর শব্দ থেকে। ধারণা করা হয় শব্দটি কোল ভাষাগোষ্ঠী থেকে আগত। ‘লো’ শব্দের অর্থ আগুন জ্বালানো আর ‘হর’ শব্দের অর্থ মানুষ। যে মানুষেরা সবসময় আগুন জ্বালিয়ে কাজ করে তারাই লোহার। এই লো-হর বা লোহার শব্দ থেকেই বাংলায় ‘লোহা’ বা ‘লৌহ’ শব্দটি এসেছে। লোহার আদিবাসীদের আদি পেশা এটি। এ আদিবাসীরা লোহা গলিয়ে বা পিটিয়ে কৃষির যন্ত্রপাতি ও সংসারের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র তৈরি করে। কিন্তু যাত্রিক জীবনের আগ্রাসনে লোহারদের এ জাত পেশাটি আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। ফসল কাটতে আধুনিক মেশিন প্রযুক্তির ব্যবহার আর লোহার চড়া দামের কারণে কর্মহীন হয়ে পড়েছে লোহাররা। ফলে দারিদ্র্যের কারণে এদের অনেকেই আজ নিজেদের যুক্ত করছে কৃষিসহ অন্যান্য পেশায়।
পাড়ায় ঢুকতেই দেখি এক বৃদ্ধ। বয়স ষাটের মতো। মুখে সিগারেট ধরিয়ে বিশেষ কায়দায় ছোট্ট একটি কাঁচিকে হাতুড়ি পেটা করছেন। মাঝে মাঝে দড়ি টেনে বাতাস দিয়ে কয়লার আগুনে পুড়িয়ে নিচ্ছেন কাঁচিটিকে। কালো রঙের রাবারের বায়ু দেওয়ার যন্ত্রটিকে এরা বলে ভাথি। এই ভাথিই এদের কর্ম দেবতা। ভাথির সাহায্যেই এরা লোহার তৈরি নানা জিনিস বানায়।
আমাদের দেখে বৃদ্ধ’র কাজে ছন্দপতন ঘটে। নাম তার জোহরলাল। এ পাড়ার সিকদার বা প্রধান তিনি। অন্যান্য জাতির মতো লোহারদেরও গ্রামপরিষদ রয়েছে। এদের গ্রামপরিষদের তিনজন সদস্য নির্বাচিত হয় গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে। গোত্র প্রধানকে এরা বলে ‘সিকদার’। সিকদারের সাহায্যকারীকে বলে ‘ওহেদার’। আর গোত্রে সকলের সঙ্গে যোগাযোগ করার দায়িত্ব থাকে ‘ছেড়িদারের’।
জোহরলাল জানালেন তার বাবা বান্টুর জন্ম এখানেই। কিন্তু দাদা দশরথ এসেছিলেন ভারত থেকে। এখনো ভারতের কুমারগঞ্জে তার পূর্বপুরুষরা রয়েছে। একসময় এদের অধিকাংশই লোহার কাজ করত। কিন্তু সময়ের গতিতে হারিয়ে যায় এদের আদি পেশা। এরা নিজেদের মধ্যে পশ্চিমা ভাষায় কথা বলে। নানা অভাব-অনটন। তবু টিকে আছে জাতিটা। প্রতি রবিবার পাশের মিশন থেকে আসা ফাদারের পদধূলি পড়ে এ আদিবাসী পাড়াটিতে। কিন্তু ধর্মান্তরিত হওয়ার প্রলোভন টিকতে পারে না নারিতে বাঁধা বিশ্বাসের কাছে।
রানীপুরের লোহার আদিবাসী পাড়াটি গড়ে উঠেছে একটি পুকুরকে ঘিরে। পাড়ার পশ্চিম পাশের একটি বাড়ির বাইরে থেকে শুনি ঢাকঢোলের শব্দ। যুবক বয়সী সুশীল জানাল কয়েক দিন পরেই ওই বাড়িতে বিয়ে। তাই সারিয়ে নেওয়া হচ্ছে বাদ্যযন্ত্রগুলো। বাড়ির কর্তা বাদল কর্মকারের সঙ্গে কথা হয় আমাদের। জোহরলাল ও বাদলই জানান লোহার আদিবাসীদের বিয়ে নিয়ে নানা আচারের কথা।
লোহারদের বিয়েতে একসময় পণপ্রথা চালু ছিল। কিন্তু বর্তমানে বাঙালি সমাজের আগ্রাসনে এখন বরপক্ষকে খুশি করার প্রথা চালু করেছে। অন্য আদিবাসীদের মতো লোহাররা তাদের বিয়েতে বাড়ির উঠানে চারটি কলাগাছ আর পাঁচটি কলস দিয়ে মাড়োয়া সাজায়। বিয়ের দিন বরপক্ষ কনের বাড়ির বেশ দূরে এসে অপেক্ষা করে। কনের মা-সহ খালা, ফুপুরা একটি কুলায় আতপ চাল, দুর্বাঘাস, ৫টি পান, কাঁচা সুপারি, সরিষার তেল, দেহের (প্রদীপ) আর নানা ধরনের ফল নিয়ে অপেক্ষা করে বাড়ির গেটে। বর এলে তারা এগিয়ে যায়। দুর্বাঘাস ছিটায়, সুপারি দিয়ে বরের কপালে তেলের ফোঁটা দেয়, দেহেরের আগুনে পান হালকা গরম করে বরের দুই গালে তিনবার গরম পান আলতো ছোঁয়ায়। অতঃপর বরকে নিয়ে আসা হয় বাড়ির ভেতর।
বরকে মাড়োয়ায় কনের পাশে বসিয়ে এরা পালন করে বিশেষ ধরনের আচার। বরের মাথায় গামছা বেঁধে বরকে কাঁধে নেয় কনের বোনহে বা দুলাভাই। একপাশে আরেকটি গামছা নিয়ে অপেক্ষা করে কনের ছোট ভাই। দু’পাশ থেকে তুলসী ভেজানো পানি ছিটিয়ে দেওয়া হয় বরের গায়ে। কনের ভাই নিচ থেকে বরকে খাইয়ে দেয় মিষ্টি। বর তখন তার মাথায় বাঁধা গামছাটি উপহার দেয় কনের ছোট ভাই বা শ্যালককে। শ্যালক আবার তার গামছাটি জড়িয়ে দেয় বরের মাথায়। অতঃপর মাড়োয়ায় মুখোমুখি হয়ে বর-কনেকে বসতে হয় তাদের বাবার কোলের ওপর। খানিক আলাপ হতেই বর চলে আসে কনের বাবার কোলে আর কনে চলে যায় বরের বাবার কাছে। এই অবস্থাতেই বর কনেকে সিঁদুর পরিয়ে দেয়।
বিয়ে শেষে উপহার পর্বের পাশাপাশি চলে নাচ-গানের আসর। ঝুমের নাচে মেতে ওঠে গোটা লোহার পাড়া। বিয়ের পরদিন ছেলের বাড়িতে বউভাতের অনুষ্ঠান হয়। এদিন ছেলের আত্মীয়স্বজন, পাড়া প্রতিবেশীসহ তাদের নিজস্ব সামাজিক সংগঠনের প্রধানকে নিমন্ত্রণ করে ভোজের আয়োজন করা হয়। পরদিন মেয়ে বাবার বাড়িতে চলে যায় অষ্টমঙ্গলার উদ্দেশ্যে। সেখানে সে আটদিন অবস্থান করে।
বিয়ের সময় লোহার আদিবাসীরা গান গায় :
০১। ‘যা যা রে চোঁচা চেঁরেই
উ-দেশকর বলিবচন শুন আবারে।’
ভাবার্থ: চোঁচা চেঁরেই অর্থ বিয়ের কনে। তাকে বিয়ে করে শ্বশুর বাড়ির দেশে গিয়ে ওই দেশের বুলিবচন বা কথা বলার ভাষা শেখার কথা বলা হচ্ছে।
০২। ‘আম্বা পতেই লড়ে চড়ে
কেনিয়াক মায়কর মন পড়ে
ঝনরী ঝনরী টাকুয়া ঝোঁকোয়ে
কাহে কেনিয়া কান্দেয়ে।’
ভাবার্থ: আম পাতা নড়ে চড়ে, কন্যার মায়ের কথা মনে পুড়ে যায় দুঃখে। অতীতে পাত্রপক্ষ চাঁন্দির খুচরা পয়সায় সাড়ে বারো টাকা পণ দিয়ে মেয়েকে তার বাবার কাছ থেকে কিনে নিত। এই টাকা নিতে দেখে মেয়ে শুধু কাঁদতো। এখানে সেটিই বলা হচ্ছে।
লোহার সমাজের আদিবাসীরা বিশ্বাস করে জলের মতো পবিত্র আর কিছুই নেই। যে অর্থে জলের অপর নাম জীবন সে অর্থে জলে রয়েছে অতিমাত্রায় জীবনসার। এরা মনে করে জীবনসার দিয়েই জীবনকে দীর্ঘায়ু করা যায়। এ কারণেই বিয়ের আচারে জলের ব্যবহার বেশি। বিবাহ-অনুষ্ঠানে কুলোতে ধান-দূর্বা, আতপ চাউল, মিষ্টি ইত্যাদি নিয়ে বরণ করার রীতি প্রচলিত রয়েছে। ধান-দূর্বা দীর্ঘায়ু ও নব-দম্পতির সুখী জীবনের চিহ্ন বহন করে।
আবার আতপ চাউল, মিষ্টি ইত্যাদি অপদেবতাদের খাবার। এদের কাছে সিঁদুর যৌন ও বিজয়ের চিহ্ন। এ ছাড়া লোহারা বিয়ের নির্ধারিত দিনে যদি কোন শিয়ালকে ডানদিক থেকে বামদিক যেতে দেখে তবে সেদিনের জন্য যাত্রা স্থগিত রাখে। তাছাড়া কোন গাভীর মৃতদেহ দেখলেও তারা আর যাত্রা করে না। তবে কোন লোকের মৃত্যুসংবাদ শুনলে কিংবা ভরা কলসী দেখলে যাত্রা শুভ বলে মনে করা হয়।
এ আদিবাসী সমাজে বিয়েযোগ্য মেয়েকে উপযুক্ত সময়ে বিয়ে দিতে না পারলে উদ্ধার বিবির পূজা করার রেওয়াজ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে সিঁদুর দিয়ে প্রথমে উদ্ধার বিবির মূর্তি তৈরি করা হয়। তিনজন বৃদ্ধা নারী দেড় কেজি চাল ঢেঁকিতে গুঁড়ো করে, সাদা পিঠা পায়েস রান্না করে, কলা পাতায় রেখে তা উদ্ধার বিবির উদ্দেশ্যে নিবেদন করে কন্যাদায় থেকে মুক্তি কামনা করেন।
লোহারদের বিয়ে বিচ্ছেদের আচার অনেকটাই সাঁওতাল আদিবাসীদের মতোই। এরা বিয়ে বিচ্ছেদের পর্বটিকে বলে ‘ছাডিদেওয়া’। এদের সমাজে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সম্পকের্র অবনতি হলে প্রথমে উভয় পক্ষের গোত্র প্রধান বা সিকদার আলোচনায় বসে সমাধানের চেষ্টা করে। সমাধান না হলে এরা বিচ্ছেদ পবের্র আয়োজন করে। স্বামী কিংবা স্ত্রী যে কারোর বাড়িতেই বিচ্ছেদ পর্বটি হতে পারে। এ পর্বে দুই পক্ষের আত্মীয়স্বজনদের সামনে স্বামী-স্ত্রীকে দাঁড় করানো হয়। তাদের সামনে দেয়া হয় একটি কাঁসার ঘটি। ঘটিতে থাকে পানি। পানিতে পাতাসহ একটি ছোট আমের ডাল ও তিনটি পান ডুবিয়ে রাখা হয়। ঘটির পাশে রাখা হয় তিনটি সুপারি। স্বামী-স্ত্রী ঘটির পানিতে হাত রাখতেই উভয় পক্ষের সিকদার তাদের আবার প্রশ্ন করে জানতে চায় তারা বিবাহবিচ্ছেদে সম্মত কিনা। উভয়েই হ্যাঁ-সূচক জবাব দিতেই ঘটির পানি তাদের দুজনের গায়ে ছিটিয়ে দেওয়া হয়। পানি ছিটানোর পরপরই তাদের বিবাহবিচ্ছেদ ঘটেছে বলে মনে করা হয়।
তবে এদের সমাজে লিখিত রীতিতে বিয়ে না হলেও খুব সহজে এদের বিয়েবিচ্ছেদ ঘটে না। যেসব কারণে বিয়েবিচ্ছেদ ঘটে তার মধ্যে বন্ধ্যত্ব, ঘন ঘন সন্তানের মৃত্যু, যৌনকর্মে অপারগতা, সম্পত্তির বিনষ্ট সাধন, অযাচিত ঋণকরণ, কলহ-ঝগড়া প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। লোহার বা কর্মকার সমাজে পুরুষদের বহুবিবাহ রীতির প্রচলন আছে। তবে মেয়েরা দ্বিতীয় করতে পারে না।
চারদিকে অন্ধকার নামতেই আমরা ফিরতি পথ ধরি। পেছনে পড়ে থাকে লোহারদের পাড়াটি। প্রতিবছর বিশ্বকর্মা পূজা পালন করলেও লোহার আদিবাসীদের ভাগ্যটি সুপ্রসন্ন হয়নি অদ্যাবধি। বরং ধীরে ধীরে পূর্বপুরুষদের আদি পেশাটিকেও হারিয়ে ফেলছে তারা। দারিদ্র্যর মাঝে তবুও এরা টিকে থাকার স্বপ্ন দেখে। বুকভরা বিশ্বাস ও নানা আশা নিয়ে এরা টিকিয়ে রাখে বিয়েসহ তাদের আদি সংস্কৃতিটাকে।