সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন
‘থালের ভাত থালে শুকায়, লগে শুকায় সুখ!’
মায়ে জালিবেড়ার জানালা দিয়া একবার মেয়ের আসার পন্থের দিকে চায়, একবার মেয়ের খাওন গোছানিতে মন দেয়। গোছানির কর্ম করে এট্টু,অমনেই আবার চোখ যায় জানলায়। দেখে, উঠান যেই খালির সেই খালি! মেয়ের আসার নামও নাই। দ্যাখছো! মায়ের মনে হুড়ুত করে একটু চেত ওঠে। তবে সেই চেতও বেশি সময় থাকে না। এই একবার চেত ওঠে, এই আবার মন ঠাণ্ডা হয়ে যায়। ‘আইচ্ছা করুক সেয় গোছল- ইচ্ছা মোতোন! এমুন ঠাঠা পোড়া গরমের দিন! পোলাপাইন মাইনষে– পানিতে পইড়া থাকব না কী করব!’
আসুক মেয়ে শান্তিহালে গোসলখান শেষ করে, মায়ে এদিকে কাজ আগায়ে রাখুক! পাতে কয় হাতা ভাত বাড়ে মা, তারপর আস্তে ছড়ায় সেই ভাত, থালের সবখানে। ভাতটা জুড়াক ধীরেসুস্থে, একটু একটু করে। ততক্ষণে আসুক জুলি। এট্টু ঠাণ্ডা না হলে, খিদার মুখে- বেশি গরম ভাত নিয়া- মেয়ের হবে জ্বালা! একটুখানি জুড়ানি দেওয়ার জন্য রাখা সেই ভাত- ক্রমে-জুড়িয়ে ঠাণ্ডা করা হয়ে যেতে থাকে, মেয়ের গোসল শেষ হয় না।
‘তামশা দেখছো মাইয়ার!’ বসে থাকতে থাকতে হঠাৎ গোস্বায় মায়ের ভিতরটা চড়াত করে ওঠে, ‘বহুত উজাইয়া গেছে গা তো সেয়! মায়েরও তো গাও-গোছল আছে, আল্লাখোদারে ডাকা আছে। সেইসবের কথা নি মাথায় আছে মাইয়ার!’ তারপর, আচমকা তার সব রাগ গিয়ে আছড়ে পড়ে নিজ খসমের ওপর। ‘এই বাপের লাইয়ে না মাইয়া এমুন নাদান, নাবুঝ হইতাছে দিনকে দিন! আসুক সেই লোক আজকা বাড়িতে। এর বিহিত না করলে আর চলব না!’
গোস্বা নিয়া মায়ে পাতের সামনে থোম ধরে বসে থাকে কতক্ষণ।‘ দেখো অহনও নি আহে! আউজকা অর কপালে ভাত লেখে নাই খোদায়! আহুক খাইতে! অরে পাতে ভাত দিমু, না ছাই দিমু!’ মা বকাবকি করতে করতে থালের ভাত আবার পাতিলে তোলে। ‘ঠাণ্ডা হইয়া যাইতাছে না ভাতটি! চুকার ঝোল দিয়া ঠাণ্ডা ভাত খাওন যায়!’ বেলা যায়। তারপরও মেয়ের আসার নাম নাই।
‘ওমা, মাইয়া তো দেখি আসেই না! ঘাটলায় অইটায় করতাছে কী?’ এইবার নিজের চোখে বৃত্তান্তটা দেখার তাগাদা পেতে থাকে মায়ে। তাঁর অন্তর সাব্যস্ত করে যে, আজকা এই মাইয়ারে সেয় চুলে ধইরা পানি থেকে তুলে আনবে। জিন্দিগিতে আজকা, এই একবার হলেও, সে, মেয়েরে শাসনটা দিবে! নাইলে শুধরাইবো না মেয়ের খাসলত-স্বভাবখান। খাসলতের এই ঢিলামি নিয়া শেষে, পরের পুতের মোখে বহুত গালি খাইতে অইবো তার মাইয়ারে!
রান্ধন ঘরের দরোজায় শিকল তুলে জুলেখার মায়ে পুকুরঘাটে আসে। ও খোদা! মায়ে তাজ্জব চক্ষে দেখে, কিয়ের গোসল-কিয়ের কী! ঘাটলায় তো জুলি নাই। ঘাটলার তক্তা শুকনা, খটখটা। সারা দিনে কেউ যে এই ঘাটলায় বসে গোসল করছে– তার কোনো চিহ্ণ ঘাটলায় নাই। জুলি কই!
পুরা পুষ্কুনিতে এখন হাঁটুসমান পানি। এই পানিতে মাইয়া ডুইব্বা মরবো- এমনটা মায়ে বিশ্বাসই করব না! আর, জুলি কি সাঁতোর না জানে নাকি? বহুত ভালা রকম সাঁতার জানা মাইয়া তাঁর জুলেখায়। সেই মাইয়া পানিতে পইড়া গেছে- সেই কথা শোনলে একটা পিঁপড়ায়ও হাসব!
তাইলে কই গেছে মাইয়া! গেছে নির্ঘাত পাড়া-পড়শী গো পুষ্কুনিতে! কতদিন মায়ে নিষেধ দিছে এই কর্ম না করতে! কার না কার নজর লাগব অর উপরে! শেষে সেই কুদিষ্টির ফাঁড়া কাটাইতে মায়ের জান বাইর হইবো! সেই নিষেধ অমাইন্য করার মতন পোংটা হয়ে উঠছে মাইয়ায়! চেতে মায়ে বাক্যিহারা হয়ে যায়। ‘এত দূর বাড়ছে!’ মায়ের মন বিশ্বাস করতে পারে না, ‘এত দূর অলক্ষী হইয়া সারছে মাইয়ায় তলে তলে! আর তো এরে ঘরে রাখন যাইবো না!’
মনে মনে কপালে মারতে মারতে মায়ে আশপাশের সকল ঘাটলা ঘোরান দিয়া সারে। কোনোখানে জুলির চিহ্ণসুদ্ধা নাই। হইছে কী অর! গেছে কই! মায়ে ধুছমুছ পায়ে আবার নিজেগো ঘাটলায় আসে। আসছে নি মাইয়ায় এতক্ষণে ফিরা, নিজেগো ঘাটলায়? না। জুলি নাই ঘাটলায়। বাড়িতে নি আসছে! না, আসে নাই!
এইবার তার প্রাণ ছাৎ করে ওঠে। মাইয়া তার কই গেছে! জুলি!
মায়ে এমনকী বাড়ির পুব, উত্তর ও দক্ষিণ– সব দিকেই একবার ঘোরান দেয়। কী জানি, যেই বেবুঝ মাইয়া! কোনো কারণে কোনো গাছের তলে গিয়া সেয় বইয়া রয় নাই তো আবার! কিন্তু না, কোনোখানে তারে দেখা যায় না। মেয়ে তার কোথাও নাই। মায়ে এইবার বেদিশা হয়ে অকারণেই বাড়ির পশ্চিমে যায়। পশ্চিমে পতিত খেতি-খোলা। কোনো কারণ নাই মেয়ের, সেই দিকে যাওয়ার। তাও মায়ে যায় সেই দিকে।
পতিত সেই ক্ষেতের কিনারা দিয়া দুনিয়ার গিমা শাক হয়ে আছে। মাইয়ায় যুদি আবার ঝোঁকের মাথায় সেই শাক তোলতে গিয়া থাকে! অর মাথার খেয়ালের কোনো সীমা আছে নি! মায়ে জানে যে, নাই। জমির কিনারে লেট দিয়া অইটা কে বসা! না না, জুলি না! বসা অন্যজনে।
গ্রামের গরিবের গরিব মংলার মায়ে বসা অইখানে। সেয় গিমাশাক তোলতাছে। চৈত মাসের রইদও তার শাক তোলায় আটকানি দিতে পারে নাই। কেমনে পারব! এই শাক এর-তার বাড়িতে দিয়া খুদ-কুঁড়া যাই পারে- জোটায় মংলার মায়ে। তবেই দিনকার আহার জোটে তার।
‘কি গো জুলির মা! তোমারে এমুন পেরেশান দেহায়!’ পায়ের আওয়াজে মুখ তোলে মংলার মায়ে, ‘কি হইছে গো?’
‘মংলার-মা খালা, মাইয়াটারে দেখতাছি না কোনোদিগে!’ মায়ের গলা ফোঁপানির মতন শোনায়।
‘তোমাগো জুলি?’ মংলার মায়ে আবার শাক তোলায় মন দেয়, ‘উয়ে তো হেই কোন আগে, লোটা হাতে লইয়া, লোইড়াইয়া গেল ঠাকুর-বাড়ির দিগে!’
‘ও মাবুদ! কই গেছে!’
‘দেহো না কই গেল?’ কাঁটাঝোপের ভেতর দিয়ে যাওয়া চিপা রাস্তাখান দেখায় মংলার মায়ে।
হায় হায় হায়! মায়ের অন্তর-আত্মা ডরে কাঁপানি দিয়া ওঠে! ‘বেবুঝ-বেকুবে তো তাইলে একলা একলা গেছে গা ঠাকুর-বাড়ির পুষ্কুনিতে! হায় হায় রে! দ্যাখো পরানে নি এট্টু ডর আছে! ড্যাকরা গরু নি বাঘ চিনে! কিয়ের তেনে না জানি কী হইয়া যায়! খোদা!’
মায়ে এইবার জান-পরান হাতে নিয়া ছোটা ধরে। মেয়ের ভালা-মন্দের চিন্তায় তার প্রাণ বেধোন্ধা হয়ে থাকে বলে তার খেয়াল হয় না যে, সেও একলাই যাইতাছে ঠাকুর বাড়িতে। দেওভোগ গেরামের কেউ যা করে নাই জীবনে, নিজের বেবুঝ মাইয়ার মতোন সে নিজেও সেই একই কর্ম করতে যাইতাছে। একলা যাইতাছে সেয় ঠাকুর বাড়িতে!
চিলের-ছায়া দেখে বেতালা হওয়া মুরগির মতোন তেজি পায়ে ছোটে মায়ে। অই তো- অই দেখা যায় ঠাকুরবাড়ির উত্তর-মুড়ার পুষ্কুনি! অই যে শান-বান্ধানো পুকুর-ঘাট! ম্যাড়ম্যাড়া লাল। সেই চাতাল সুনসান খালি। কোনো মাইনষের চিহ্ণমাত্র নাই সেইখানে।
তবে পানির কাছের সিঁড়িখানে সোন্দর নিপাটে রাখা আছে লাল-সবুজে ডোরা দেওয়া আধা পুরান গামছাখান। তার পাশে রাখা আছে কাঁসার লোটাটা। রইদের ঝাটকায় সেই লোটা ঝকর মকর ঝলকাইতাছে! কিন্তু জুলির নামনিশানাও নাই কোনোখানে। ও আল্লা! আমার মাইয়ায় কই!
অন্তরের ধকধকানি এইবার মায়ের শরীররেও ঝাপটা মারতে থাকে। ঘাটলায় নাই ক্যান উয়ে? আমার মাইয়ায়! কই গেছে! গোসল করতে আইয়া ঠাকুরবাড়ির ভিতরে যাইব জুলেখায় কোন কারণে? মায়ে নানান চিন্তায় খাবিজাবি খেতে খেতে ধীর পায়ে ঘুরান দিতে ছোটে ঠাকুরবাড়িরে।
ঠাকুরবাড়ির মস্ত উঠানখানা- কোনো কোনো জায়গায় খালি একটু আস্তা আছে। বেশিটাই ভাঙ্গাচোরা, গর্ত-খন্দে বোঝাই, জংলা ঝোপের আখড়া! সেই দিকে তাকালে স্পষ্টই বোঝা যায়, বহুত দিন এইখানে মানুষের পা পড়ে নাই। মায়ে এর মধ্য দিয়া কই যাইব! কোনোখানে খোঁজবো না-বুঝ মাইয়ারে?
হরদিশা হয়ে মায়ে আবার ঘাটলায় ফিরতি আসে। নাই, মাইয়ায় নাই ঘাটলায়! যেমুনকার লোটা গামছা তেমুনই পইড় রইছে! জুলি নাই! অবশ হাত-পাও-রথ নিয়া মায়ে আর খাড়া থাকতে পারে না। একটা সিঁড়িতে খালি সে বসেও সারে না, অমনেই পরানের কোন গহীন থেকে জানি কু-ডাক আসতে থাকে! ক্যান জানি ঢোকে ঢোকে মনে হইতে থাকে; নাই। তার মাইয়ায় নাই!
সে দেখে তার চক্ষের সামনে পুষ্কুনির পানি হালকা বাতাসে তিরতির নড়েচড়ে। নড়েচড়ে আর য্যান হাঁকাহুঁকি কথা কয়! কি কথা কয় পানি? না, পানি জুলেখার মায়েরে ডাক পাড়ে। ধীর-নরম স্বরে ডাক পাড়ে, আর কী জানি কয়!
পলকে মায়ের কান খাড়া হয়ে যায়! কি কথা কও রে পানি অভাগী মায়েরে? জুলেখার মায়ে শোনে যে, সেই পানি তারে ডাক দিয়া কাতর স্বরে কইতাছে,‘নাই! নাইক্কা তোমার মাইয়ায় গো! আর পাইবা না তারে! যে তারে নিছে, সেয় ফিরত দেওনের জন্য নেয় নাই!’
‘কে নিছে? কেটায়! কেটায়? কও পানি!’ মায়ে পাগলা চিক্কুর দিয়া,পুষ্কুনির পানির উপরে উপুড় হয়ে পড়ে। ‘দোহাই চান-সুরুজের! দোহাই আসমান জমিনের! দোহাই এই বসতভিটির! তোমার মাথার কিরা লাগেরে পানি, ভাইঙ্গা কথা কও!’ মায়ে মিন্নতি করতে থাকে। কিন্তু পানি কোনো উত্তর করে না। সে কেবল সেই একই কথা কইয়া যায়। সেই একই কথা কইতেই থাকে, কইতেই থাকে, কইতেই থাকে।
শুনতে শুনতে খাবলি-দিয়া ওঠা মায়ের পরান- একবার – খালি- জোর চিল্লানি দেওয়ার শক্তিটা পায়– মাবুদ! তারপর পলকে দুনিয়াদারি আন্ধার হয়ে যায় তার সামনে।
মংলার মায়ে শাক তুলতে তুলতে শোনে, কে জানি চিক্কুর দিয়া উঠল আঁতকা! কে চিক্কুর দেয়! এমুন কইলজা-কাঁপানো, ডর-ধরানো চিক্কুর! শাক তোলা থামায়ে সে মুখ তুলে বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করে। তার পিছনে পুরা দেওভোগ গেরাম। চিক্কুর সেইদিক থেকে আসে না। আসতাছে তেছরা উত্তর-পশ্চিম থেকে। সেইদিকে তো খালি ঠাকুরবাড়ি। সেই বাড়িতে চিক্কুর দিব কেটায়! ছাড়া-বাড়িতে আঁতকা চিক্কুর ওঠে! বান-বাতাসে খেইল দেহায় নি!
সঙ্গে সঙ্গে তার খেয়ালে আসে যে, এইমাত্র না জুলির মায়ে গেল অই বাড়িতে! তার মাইয়ারে না সেয় বিছরাইতে গেছে? চিক্কুরটা য্যান জুলির মায়ের গলার মনে হইতাছে! চিক্কুর দিল ক্যান সেয়!
গেরামের দশজনেরে ডাক দেওয়ার কথা ভুলে, কোঁচড়ের শাক সামলাতে সামলাতে মংলার মায়েও একলাই ছোটে ঠাকুর-বাড়ির দিকে। চিক্কুরের আওয়াজ য্যান বলে যে, মুসিবতের কিছু ঘটছে! আল্লা রসুল! রহম করো, রহম করো! কিছু না বুঝেও মংলার মায়ের দাঁতে দাঁতে বাড়ি খেতে থাকে।
ঠাকুরবাড়ির পুষ্কুনির ঘাটলায় এইটা কি দেখতাছে মংলার মায়? হায় হায় গো! জুলির মায়ে দাঁতি-খেয়ে ঘাটলায় পড়া! পাকা চাতালের সঙ্গে বাড়ি খাইছে তার মাথা। ফাটা মাথা থেকে দেখ রক্ত পড়তাছে একফোঁটা একফোঁটা। ঘাটলার ম্যান্দা লাল-রঙে পড়তে থাকা সেই রক্তরে দেখাইতাছে দগদগা। তুফান লাল। খোদা গো!
ডরে উতলা মংলার মায়ের গলা খুলে যায় আপনাআপনি। সেই গলা জোর চিল্লানিও দেওয়া ধরে আপনা আপনিই; অই! তরা কে কোনখানে আছস রে! জলদি আয়! জলদি আসো গো বাবাসগল! সর্বনাশ হইছে! সর্বনাশ হইছে! ঠাকুরবাড়ির ঘাটলায় আসো গো বাবারা! জলদি আহো সগলতে!
(চলবে)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ৮)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (সপ্তম কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (ষষ্ঠ কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (পঞ্চম কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (চতুর্থ কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (তৃতীয় কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (দ্বিতীয় কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (প্রথম কিস্তি)