সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন
‘জলে স্থলে কোনোখানে তাহার সন্ধান নাই’
দেওভোগ গেরামে অখন, এই চৈত মাইস্যা দিনে, কেবল দুই তিনখান পুষ্কুনিতে হাঁটুর উপরে পানি। বাইরা মাসে হালকা-পাতলা মাছ মারার কর্ম করে না, গ্রামে এমুন কোনো বাড়ি নাই। সেই কারণে, সকলের বাড়িতেই আছে ছোটোমোটো কোনো না কোনো জাল। এমুন চৈত মাইস্যা শুকনার কালে আবার গেরামের পুরুষপোলারা যেই জাল হাতের নাগালে পায়, নেয়। নিয়া ছোটে অই হাঁটুপানির পুষ্কুনিতে, জুলেখার লাশ বিছরাইতে। খেও জাল, ঝাঁপি জাল, ঝাঁকি জাল- এমনে-সেমনে ফেলতে ফেলতে সেই পুষ্কুনি কয়টারে ধুমাধ্ধুম ফাতাফাতা করে সকলে। কিন্তু জালে কিচ্ছু ঠেকে না।
গেরামের বাকি সকল পুষ্কুনির কোনোটায় হাঁটুর নিচে পানি, কোনোটায় গোঁড়ালি-ডোবানো পানি। সেই পানিতে কোনোজনেরই ডুইব্বা মরোণের কোনো উপায় নাই। তাও বান-বাতাসরে বিশ্বাস কী! মাইরা শেষে প্যাঁকের তলে গুইজ্জা যে থোয় নাই, তা কী কওন যায়! যায় না।
সেই কথা মাথায় নিয়া গেরামের আধ-মাঝারি পোলাপান আর জুয়ান পোলারা- যে যেমনে পারে- সেই সকল পায়ের পাতা-ডোবা পানি-অলা পুষ্কুনিগুলাতে নামে। তুকে তুকে যতখানি পারা যায় হাঁটে সকলে। পাওয়ে নি কিছু লাগে! বজবজা প্যাঁক ছাড়া পায়ে কিছুই লাগে না। নিজেরা তো হাঁটেই, তার সঙ্গে তারা প্যাঁক-পানিরে লাঠি দিয়াও ঘোটার সীমা রাখে না। কিন্তু জুলেখার লাশ পাওয়া যায় না।
খবর দিয়া ভোলাইল তেনে, খামোখা কইরা জাউল্লা আনানো হয়। তারা বড়ো বড়ো পুষ্কুনিতে জাল ফেলা আর মাছ ধরার ওস্তাদ-লোক। সন্ধ্যার মুখে গ্রামে ঢুকে তারা এক লহমা জিরানি দেয় না। তগ-নগদ ছোটে ঠাকুর-বাড়ির পুষ্কুনিতে জাল ফালাইতে।
মনে তাগো নানা মতে কুচিন্তা ফাল পাড়ে । যেই কুসাইধ্যা বাড়িতে কর্মের ফরমাইশ পাইছে এমুন অবেলায়! খালি, একটা ডাঙর-সিয়ানা মাইয়ার বাঁচোন-মরোণের বিষয় দেইখ্যা তারা অরাজি হয় নাই! নাইলে এমুন সময়ে, এমুন স্থানে কর্ম করতে, তারা কোনোকালেও আইতো না! ভালাবুরা আইতে কতখোন! দুনিয়ায় পুষ্কুনির অভাব পড়ছে! পড়ে নাই। আর, তাগো কামকাইজেরও কোনো কমতি নাই। তাও, লোকের পানিতে-ডোবা ঠেকার কালে না আসে কোন পরানে তারা! এইমতে নানা ভাবনা তাগো সকলের চিত্তে লড়েচড়ে, কিন্তু মুখে কোনো বিষয় নিয়াই টু-আওয়াজখানও থাকে না কোনোজনের।
কথা শুরু করলেই কামে প্যাছ লাগবো তাগো। তার দরকার কী! অখন দরকার, সন্ধ্যার আগে আগে যা করার করে, বাড়ির পথে মেলা দেওয়া। ওস্তাদ জাউল্লারা এসেই ধুড়মুড় ছোটে ঠাকুর-বাড়ির দিকে। তাগো পিছে পিছে যায় পুরা দেওভোগ গেরামের সকলে। পোলা-বুড়া বেটা মাতারি একজোনও ঘরে থাকে না। জাউল্লারা জাল ফেলব তাগো নিয়মে, আরেক দিকে গেরামের মা-চাচিগোও কিছু ব্যাপার করার আছে- তাগো নিজেগো নিয়মে।
ঠাকুরবাড়ির অন্দরের পুষ্কুনি চিরকালের ধীর-সুস্থির-শীতল-টলটল। সেই পুষ্কুনির এই মুড়া সেই মুড়া দিয়া জাল ফালানি ধরে বারোজন জাউল্লায়। চার চারখান বিরাট জালের আবড়া-জাবড়া ধাক্কা-ধাবড়ায় উথাল-পাথাল করতে থাকে জমিদারগো পুষ্কুনিখান। কিন্তু কিয়ের কী! জুলেখার লাশের কোনো সন্ধানও মিলে না। মাছ ছাড়া সেই সকল জালে কিচ্ছু ওঠে না।
পুষ্কুনির এক কিনারে খাড়া-দেওয়া থাকে দেওভোগ গেরামের সকল মাতারি। আর নানা কিনারে জাউল্লাগো আশপাশে খাড়া থাকে পুরুষ-পোলারা। তাগো সকল জনের চক্ষের সামোনে খালি,শূন্য জালেরা ঝুড়ুত করে লাফ দেয় পুষ্কুনির ছলছলা পানিতে।
সেই জালেরা উঠে আসে ভর-ভরতি, খলবলা সাদা হয়ে। আরে মাছরে মাছ! চাইর চাইট্টা কালা-কুষ্টি কটকইট্টা জালের সবখানে খালি মাছ গাঁথা! ও মা রে- মা! শত জাতের মাছ- শত রকমের মাছ! মাছের উপরে মাছ! জালের একটা কালা সুতা পর্যন্ত দেখা যায় না! কেবল চক্ষে পড়ে নানা মতে লড়তেচড়তে থাকা সাদা মাছ! জালে আটকা সেই সকল মাছ ছটফট করে, তড়বড় করে, ছড়বড় করে! এত মাছ এক লগে দেওভোগ গেরামের কোনোজনের চৌদ্দগুষ্টির কেউ দেখে নাই।
তবে সকলেই ভালামতন জানে, এই মাছ ঘরে নেওনের জিনিস না। এগিলি হইলো তুক্ষার সাধন-ভজন করা বাড়ির পুষ্কুনির জিনিস। এরে পাতে নেওয়া তো দূর, উঠানে নিয়া রাখলেই ঘরে কুফা আইবো। নাকেমোখে রক্ত উইট্ঠা গুষ্টির সকলের শেষ হইতে বেশিক্ষণ লাগবো না! এই কারণে এই মাছের দিকে, এই যাবতকালে কোনো এলাকার একটা জনপ্রাণীও নজর দেয় নাই।
যেই কায়া-বদলানো যুগী-ঋষির বাড়ির জিনিস এইগুলা, তার জিনিসে হাত দেয় কার এত্ত বড়ো কইলজা! সেই কইলজা সেই সাহস জিন্দিগিতে কারো হয় নাই। মুরুব্বিরা কইয়া থুইয়া গেছে, এই জিনিসে হাত দেওন আর গজবরে নিজ হাতে কোল দেওন- একই কথা।
এই মাছ কেউ ঘরে তোলব না। এই মাছরে নষ্ট করনের হকও কেউরই নাই। জালের মাছ আবার আস্তে জাল ঝাড়া দিয়া পানিতে নামায়ে দিতে থাকে জাউল্লারা। দুই চাইরটা মাছ যে মাটিতে, এদিকে সেদিকে ছটকা খেয়ে পড়ে, সেই মাছরে আস্তে-সুস্থে মানকচুর পাতায় তুলে ঘেরাও দিয়া বসে মা চাচিরা। তাগো কিছু টোটকা করার আছে।
পাতালের মাছ তো যাইবো গা আবার পাতালে। যাওনের আগে তারা- এই শনির দশায় পড়া মানুষগুলির- মিন্নতিখান শুইন্না যাউক। মা-চাচিরা একজোন একজোন করে কাতর গলায় মিন্নতি করে মাছদের; ‘পাত্তালের মাছ অত্তলের মাছ গহীনের মাছ রে! বাবাসগল, তোমাগো মিন্নতি দেই। পুষ্কুনির কোণা-খামছিতে যুদি জুলেখারে চক্ষে পড়ে তোমাগো,অক্ষণ অক্ষণ আইসা সন্ধানটা দিয়া যাইও ধন!’
তারপর তারা আলগোচ্ছে সেই মানকচুপাতা নিয়া পানিতে চুবায়। আর এমনে তেমনে মাথার কিরা দিতে থাকে মাছেগো। সেই কিরা শুনতে শুনতে মাছেরা একেকটায় একেক রকমে পানির তলে ডুব দেয়। ভাবে বোঝা যায় যে, তারা মা-চাচিগো কিরা-কসম শুনছে, মাথায়ও নিছে। এখন তারা অতলে ভালামতন খোঁজটা নিয়া সংবাদ দিতে ফিইরা আসতে যতক্ষণ লাগে!
মা-চাচিরা পানির কিনারে বসা দিয়া অপেক্ষা করতে থাকে। আসে নি মাছেগো কোনো একজোনেও! কিন্তু মাছেগো কোনো একজনও কোনো বার্তা নিয়া ফিরা আসে না। একটা মাছেও তার মুখ উপরে তোলে না। হায় হায়রে! আর কোনো আশা নাই! মা-চাচিরা মনে মনে বোঝে; যুদি এই পুষ্কুনি জুলেখারে নিয়া গিয়া থাকে, তাইলে মাছেগো সাধ্য নাই- সেই ভেদের খবর মানুষের কানে দেয়! যেই পাতে খায়, সেই পাত ছেদা করে না মাছেরা!
গেরামের সকল পুরুষপোলা যখন জাউল্লাগো লগে ঠাকুরবাড়ির পুষ্কুনির তলে জুলেখার খোঁজে মাথা-গরম অবস্থায় থাকে, তখন মুরুব্বি, মা-চাচিরা কয়েকজোনে থাকে মাছেগো লগে কথাবার্তার কাজ সারতে, আর অন্য কয়জোন মা মুরুব্বিরা যায় অন্য আরেক কর্মে। তারা পোলাপানদের দঙ্গলটারে নিয়া পুরা ঠাকুরবাড়ির সকল দিক আঁতিপাতি তল্লাশ করে।
জুলেখায় যে পানিতেই পড়ছে, তার ঠিক কী! তারে যে বানবাতাসে পায় নাই, সে কথা কে বলতে পারে! দুপুইরা বাতাসরে বিশ্বাস কী! তারে বিশ্বাস নাই! একলা পাইয়া সেয়, মাইয়াটারে, জানে আস্তা থুইয়া গেছে নি! মাইরা, দেখো গা, জুলেখার ঘাড় ভাইঙ্গা ফালাইয়া থুইয়া গেছে গা কোনো ঝোপের তলে ! সেই কারণে এই ছাড়া-বাড়ির কোনো কিনার, কোনো কোনা, কোনো চিপা- বিছরান বাকি রাখে না তারা। কিন্তু কোনোখানে জুলেখার একটা চিহ্ণ তরি দেখা যায় না। সেয় নাই তো নাই-ই। জুলেখার কোনো খোঁজ মেলে না।
এদিকে, সকল কর্ম বাদ দিয়া আর কত খোঁজাখুঁজি করবো লোকে! সন্ধ্যার মুখে সকলে একে একে যে যার বাড়ির দিকে হাঁটা ধরে। তবে যাওয়ার আগে তারা শোকে-তবদা-খাওয়া মা-বাপরে বুঝ দিতে ভোলে না। তারা গলা উঁচা করে, কপাল-পোড়া মা-বাপেরে বলে যে, চিন্তা করোনের কোনো কারণ তারা দেহে না। পানিতে পইড়া মরলে জালে লাশ ওঠতোই।
কেউ কেউ আরো বেশি বুঝ দিতে গিয়ে বলে, ‘ঠাকুর-বাড়ির পুষ্কুনি অরে গ্রাস করলে, মাছেরা তার সন্ধান পাইতোই। সেই কথা তারা মনিষ্যির কানে জানান দিতে পানির উপরে মুখ তোলতোই! কিন্তু মাছেরাও তেমন গজবের কোনো নিশানা পায় নাই!’ মুখে মুখে তারা হরদিওশা বাপ-মায়েরে এই কথা বলে বুঝ দেয় ঠিক; কিন্তু তাগো অন্তর জানে, এই কথা হাছা না। এইটা মিছা কথা। পানি যুদি নিয়া থাকে, তাইলে লাশ সেয় ফিরত নাও দিতে পারে! আর, সেই সংবাদ মাছেরা লোকেরে জানান দেওয়ার খ্যামতা রাখে না!
কিন্তুক কোন মুখে কী আর কইবো তারা আধা-মরা বাপ-মায়েরে! কোনোমতে আরো এট্টু বুঝ দেয় কোনো কোনোজোনে। কয়,‘ লাশও কিনা কোনো দিগেই মিলে নাই। তাইলে কওন যায়- মাইয়া জেতা। মরে নাই। গেছে হয়তো কোনো দিগে ঘুরান দিতে। আইয়া পড়ব সন্ধ্যা হইতে না হইতেই।’
একে একে সকলে যায়। বাড়িখান ফাঁকা হয়। যাওয়ার আগে মংলার মায়ে, খুঁজে মুজে রান্ধন ঘরের কুপিখান ধরায়ে রেখে যায়। বাড়ির দুইজন সাব্যস্থ মানুষ- জুলেখার বাপে আর মায়ে বাড়িতেই আছে। তারপরও বাড়িখান মুর্দা দাফন করতে নিয়া যাওয়ার পরের মউতা-বাড়ির মতন হা হা, থমথম করতে থাকে।
বাপে মায়ে আজকাও, অন্যদিনের মতো বড়োঘরের ভিতরেই আছে। তবে তাগো নিজেগো য্যান নিজেগো দুইজনের কথা আর মনে নাই। সকল অন্তর-মন দিয়া তারা উঠানে মাইয়ার পাওয়ের আওয়াজখান পাওয়ার জন্য কান-পাতানি দিয়া আছে। জুলেখার মায়ে মাটিতে পড়া। ঘরের খুঁটিতে হেলান দিয়ে নিজেরে সেয় কোনোরকমে আধ-বসানি দিয়া রাখছে। আরেকজনে, জুলেখার বাবায়, সেয় চৌকিতে উপুড় হয়ে পড়া। দেহ তাগো একই মতন নিঃসাড়, অবশ। খালি তাগো কান জাগনা দিয়া আছে।
উঠানে পাওয়ের আওয়াজ শোনা যায়? আইলো মাইয়ায়? আসুক সেয়। আহুক অখন। লোকের কথাই য্যান হাছা অয় মাবুদ! বেবুঝা মাইয়ায় বেখেয়ালে অন্য কোনোখানে ঘুরানি দিতে গেছে– এইই য্যান সত্য হয়। যত ইচ্ছা ঘুরা-ফিরা দিয়া বাপ-মাওয়ের কোলের ধন য্যান কোলে ফিইরা আহে! সন্ধ্যা হয় কী রাইত হয়- হউক। উয়ে খালি বাড়িত আহুক! বাড়িত আহো গো ধন! মায়ে-বাপে তোমারে কিচ্ছু কইবো না। কিচ্ছু কইবো না।
কিন্তু ক্রমে রাত প্রথম প্রহর যায় যায় হয়; কোলের মানিক কোলে ফিরে না। যেমনকার সুমসাম উঠান তেমনকার সুমসাম ঠাণ্ডা পড়ে থাকে। ঘরের ভিতরে বাপ মায়ে খালি জীয়ন্ত কান নিয়া যেমনকার পড়া তেমনই পড়ে থাকে। আল্লা! গায়েবের মালিক তুমি! কই গেল উয়ে!
এমন সময়ে উঠানে পাওয়ের আওয়াজ ওঠে। আইছে! আইছে জুলি! মাবুদ! বাপে মায়ে হরদিশা হইয়া উঠানে নামে। উঠানের আরেকমাথা থেকে গলা-খাঁকানির আওয়াজ পাওয়া যায়। কে? কেডায়? বাপের অন্তরের আশাখান ফুত্তুর কইরা নিভভা যায়। না, অইটা আসছে আর-কেউ, তার মাইয়ায় না!
(চলবে)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১০)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ৯)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ৮)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (সপ্তম কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (ষষ্ঠ কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (পঞ্চম কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (চতুর্থ কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (তৃতীয় কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (দ্বিতীয় কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (প্রথম কিস্তি)