সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন

‘মাইয়া কী কলঙ্কিনী!’
ফজরের নামাজের পর পরই ইমাম হুজুরে নামাজি-সকলরে কয়, আপনেরা বহেন। যাইয়েন না। আজকাও, অন্য সকল দিনের মতোই, গ্রামের প্রায় সবকয়খান ঘরের সাব্যস্ত বাপ-চাচারাই আসছে নামাজে। গেরামের জুয়ান পোলাগো যেদিন মর্জি হয়, আসে; নাইলে তোষামোদ কইরাও তাগো আনোন যায় না। সেই কারণে ইমাম হুজুরে কালকা রাতে তাগো জনে জনেরে আসার জন্য তাগাদা দিয়া আসছে। তারাও ক্রমে ক্রমে আধা-জাগনা চোখ নিয়া একে একে আইসা উপস্থিত হয় মসজিদে।
কেন এই মজলিশ ডাকা? এমুন কাউয়া-ডাকা বিয়ানের কালে ক্যান হুজুরে সকল বেটাগো একত্র করছে! হুজুরে কয় যে, এট্টু বেইল ওঠলেও সকলরে একত্র করোন যাইত। কিন্তুক তখন হাতে মোটের উপর সময় পাওয়া যাইত না। কোনো রকম এট্টু সময় নিয়া তো দরকারি কথাখান ফায়সালা করোন যাইব না! তখন, সকল পুরুষপোলারই বিষয়কর্মে যাওনের তাগদা থাকব। অই তাগদা নিয়া সকলে শান্তিহালে কথা কইতেও পারত না, শুনতোও না। হুড়াহুড়ি থাকলে কোনো কর্মখান ভালামতোন হয়! তাইলে কোন বিষয়ে, কী কথা কইবো হগলতে!
আউজকা দুইদিন ধইরা গ্রামের অশান্তির বিষয় তো একখানই। জুলেখার নাই হইয়া যাওন! হুজুরে মজলিশের সামনে আবার কথাখান তোলে। মাইয়টার তো হদিস করোন লাগে! এত্ত বড়ো একখান গজবরে তো হালকা মতোন নেওন যাইব না! সকলে একলগে বলে যে, কথা সত্য। তারা নানাজনে তারপর নানমতে, নানা কথা বলা ধরে। বলতে বলতে তারা এই গায়েব হওয়ার ঘটনাটার সুরাহা করার নানা চেষ্টা করে। তয়, কোনো পথ দেখে না কেউ! কারো মাথাই কোনো দিশা পায় না।
গ্রামের প্রত্যেকের জানে, গেরাম তেনে পোলাপাইন যে হারানি যায়, তার মূলে আছে বাইদ্যারা। কেউই কোনোদিন চক্ষে দেখে নাই, কিন্তু কানে শোনছে তারা সকলেই যে, বাইদ্যারা আইসা ফাঁকতালে পোলাপাইন ধইরা লইয়া যায়। জুলেখার নিরুদ্দিশির আগে, দেওভোগ গেরাম তেনে কোনো জিন্দিগিতেও কারো কোনো পোলাপান হারানি যায় নাই।
তবে, বাইদ্যানীরা গেরামে পাও দিছে– এই খবর পাওয়ামাত্র বাড়ির মুরুব্বি মা-চাচিরা যার যার নাবুঝ পোলাপাইনরে ঘরের ভিতরে নিয়া বাইরে থেকে শিকল দিয়া থুইছে চিরকাল। বাইদ্যারা যতখোন গেরামে থাকছে, ততোখোনই তারা কোনোজোনে সায়-শান্তিহালে হাতের কাম নিয়া থাকতে পারে নাই।
দিল তাগো খোনো খোনো খালি ধকধকানি দিছে। আছে নি পোলাপাইনটি ঘরের মধ্যে ঠিকমতোন! নাকি কোন ফাঁকে বাইর হইয়া গেছে গা আবার! ঘরের বেড়ার ফাঁক-ফোঁকড় দিয়া মা-চাচিরা পোলাপানগো কোনোপ্রকারে একটা ফুঁচকিও দিতে দেয় নাই। মাগ্গো মা! কী থেইক্কা শেষে কী না হইয়া যায়! বাইদ্যার জাতে যেই ভেলকি জানে!
তবে এতকাল সকলে জানছে ডর আছে কেবল কোলের দুধের ছাও থেকে শুরু করে ছয়-সাত বছরের পোলাপান নিয়া। শোনা গেছে, বাইদ্যার জাতে এগোই চুরি কইরা নিয়া যাওয়ার নিশানা কইরা থোয়। আট্টু বড়ো, কী ডাঙর বয়সের কারো দিকে বাইদ্যারা নজর দিছে- এমন কথা কোনোকালে শোনা যায় নাই। চৌদ্দ বছরের একটা আস্তা সিয়ানা মাইয়ারে বাইদ্যারা চুরি কইরা নিব? এইটা কী হইতে পারে! এমনটা কী সম্ভব! মজলিশ এই কথার মীমাংসা করতে গিয়া ফাঁপড়ে পড়ে যায়।
গেরামের উঠতি জুয়ান ছেড়াগো সবটিয়ে কওয়া ধরে যে, এমনটা হইতেই পারে না। মুরুব্বিরা বলতে থাকে যে, জগতে হয় না- এমুন কোনো বিষয় নাই। সব হইতে পারে। এমুনটা খুবই সম্ভব যে, জুলেখারে একলা পাইয়া সেই দুপুরে বাইদ্যানীরা ধুলি-পড়া দিছে। তখন আর তাগো লগে জুলেখার যাওন আটকায় কে!
ধুলিপড়ার কথাটা ওঠা মাত্রই, পলকে, গেরামের জুয়ান-বুড়া সকলজোনের জবান বন্ধ হইয়া যায়। ভিতরে ভিতরে সকলেরই কইলজায় ডর কামড় দেয়। কে না জানে যে, বাইদ্যার জাতরে বিশ্বাস নাই! বাইদ্যার জাতে না পারে এমুন কোনো কাম নাই! জাদু টোনা, তুকতাক, বাণ মারা, বশীকরণ বিদ্যা তো তারা জানেই।
আরো জানে নুন-পড়া, লাল তেনা-পড়া দিতে। আবার দেখ, গজব নামানের তাবিজ-কবজ করোন, সংসার ছারখার করোনের মাদুলি দেওন– এসব কর্মে তাগো মতোন দড়ো দুনিয়াতে নাই! দুনিয়ার ঘরে ঘরে যে হাউড়ি-পোলারবউ গো নিয়া এত পদের অশান্তি চলে, তার মূলে কে? অই বাইদ্যার গুষ্টি!
বাইদ্যাগো সকল টোনার বড়ো টোনা হইতাছে এই ধুলিপড়া। এক মুষ্ঠি ধুলার মধ্যে তন্ত্রমন্ত্র পইড়া ফুঁ দেয় তারা। ফুঁ দিয়া সেই ধুল যার দিগে ছিটাইয়া দেয়, সেয় লগে লগে বেবোধা হয়ে যায়। হুঁশ থাকে, কিন্তু ভালা-বুরা, নেক-বদ বোঝনের চেতনাটাও থাকে না আর। লড়েচড়ে সব করে একদম অন্যগো মতোনই; কিন্তুক কী করতাছে, কই যাইতাছে, ক্যান যাইতাছে, ক্যান করতাছে– সেই দিশাটা কিছুমাত্র থাকে না।
সর্বনাশরে! ধুলিপড়া দিয়া থাকলে জুলেখারে নিতে আর ঝামেলা কী হইবো বাইদ্যানীগো! কোনো রকম ঝামেলাই হয় নাই দেখ গা। তারা ধুলিপড়া দিয়া কোনোরকমে খালি কইছে, ‘আয়! আমাগো লগে লগে আয়!’ জুলেখায় বেবোধা হইয়া, সুন্দর, তাগো হুকুমমতোন তাগো পিছে পিছে গেছে গা! হায় হায় হায়! তাইলে তো বিষম গজইব্বা কাম অইছে!
মজলিশের প্রায় সকর জনের অন্তর ডরে আর আফসোসে, শইলমাছের মতোন মোচড়ানি দিতে থাকে। কী হইলো মাইয়াটার! এমুন আস্তা, জলজ্যান্ত এক মাইয়া দিনে-দোপোরে এমুন গায়েব হয় কেমুন কইরা! এটি কিয়ের আলামত!
তয়, এইসকল হায়-আফসোস দেখতে দেখতে মজলিশের একজোনের চিত্তি একবারে তিতা-জহর হইয়া ওঠতাছিল- ক্রমে ক্রমে। আরে কী জোড়াইছে সবতে! হুদামিছা বেহুদা হাউকাউ! দেহো তো দেহি! এতটি পুরুষপোলা একত্রে বসা দিয়া কী আজাইরা ফেদা পেছাল পাড়তাছে! আসল কতার দিগে কোনো হালার পো-র নি নজর যায়!
‘আরে, এই এত্তা বড়ো জুয়ান ছেড়িরে বাইদ্যানীগো নেওন লাগে?’ আচমকা মুখ খোলে সেই লোক। দশজোনে তারে ডাকে মন্তাজের বাপ কইয়া; ‘দেহো গা, কার লগে মাইয়ায় পিরিত বান্ধাইয়া থুইছিল তলে তলে! যেই কি না বাপে গেছে সম্বন্ধ করতে, মাইয়ায়ও আরেকদিগে ভাইগ্গা গেছে পিরিতের মাইনষের লগে! বেহুদা পেছাল বন কইরা, অখন মজলিশের দশজোনের উচিত আসল গোমোড় বিছরাইয়া বাইর করোন!’
গলাটা শুরুতে নিচাই থাকে মন্তাজের বাপের, কিন্তু বলতে বলতে তার গলা এতখানি চড়ে যায় যে, আশপাশের কোনো একটা ভিটির মা-চাচিরও তা শোনার বাকি থাকে না। তারা নিজেরা নিজেরা কথাটা কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে লাড়াচড়া করা ধরে। ‘তোবা তোবা তোবা! মন্তাজের বাপের কথাখান তো উড়াইয়া দেওন যায় না! রাখছে মাইয়া খাম্বা কইরা ঘরে, এমুন ফলই তো ফলব! এমুন জুয়ান মাইয়ার অন্তরের ভেদের খবর কোন বাপ-মায়ে কবে পাইছিল! অগো জুলেখায়ও তলে তলে এই-ই করছে! অখন ভাইগ্গা গেছে ভাও মতোন! এইই হইছে! আর কিছু না!’ মা-চাচিরা সগলতে স্থির মীমাংসায় পৌঁছায়।
ওদিগে, মন্তাজের বাপের কথা কওয়া শেষ হওয়ার পরে মজলিশে য্যান আঁতকা ঠাটা পড়ে! সগলতে পুরা তবদা-লাগা হয়ে যায়। কারো মোখে একখান রাও-ও ওঠতে চায় না। আর, ভিতরে অন্তরে সকলেরই কেমুন দোটানা লাগতে থাকে। একবার সকলের মনে হতে থাকে যে, মন্তাজের বাপের কথাখান য্যান উড়াইয়া দেওন যায় না!
আরেকবার তাগো দিল কইতে থাকে যে, এমুন কথা বিশ্বাস করা তো দূর, কানে নেওনও গুনা। ভালা খাছলতের কেউরে মিছা কলঙ্ক দেওন, গুনা না? গ্রামসুদ্ধা মাইনষের কে না জানে যে, জুলেখার স্বভাব-খাসলত বড়ই পয়-পরিষ্কার। বড়ই ভালা। তাইলে করোনটা কী অখন! এই কথাখান মজলিশের মনে জাগনা দেয়; কিন্তু কোনোজনের মোখেই জবান ফোটে না।
সকলে যখন এমন বোবা-ধরা অবস্থা নিয়া বেদিশা, তখন মজলিশের একদম শেষ কিনার তেনে আঁতকা কে জানি ডাক-চিৎকার ও কান্দন দিয়া ওঠে। কে কে কেটায়! জুলেখার বাপে। তারে কেউ আসতে কয় নাই, তাও সেয় কোনসোম যে আইয়া মজলিশে বসা দিয়াই আছে, কেউই খেয়াল করে নাই।
মসজিদের মুলিবাঁশের বেড়ায় হেলান দিয়া আলগোচ্ছে বসা সেয়। বসা আছে মজলিশের সকলের শেষে। কখন সেয় আসছে, কখন অমন আলগোচ্ছে বসা দিয়া দশজোনের দশকথা শুইন্না অন্তরে দুক্ষু পাইছে, কেউই তা নজর করে নাই। ‘আহা!’ ইমাম হুজুরে শরমিন্দা গলায় আফসোস করে ওঠে।
তারপর আরো কিছু কইতে যায় হুজুরে, কিন্তু জুলেখার বাপের হুড়ুম-দাড়ুম চিক্কুরের তলে হুজুরের গলা চাপা পড়ে যায়, ‘মজলিশে হাজেরান! মিয়া ভাইরা, বাবাসগল! আমার দগ্ধ কইলজারে আর অপমানি কইরেন না! আমার মাইয়ায় এত বড়ো কুকাম করোনের শিক্ষা পায় নাই! আমি এই মজিদে বইয়া কসম খাইয়া কইতে পারি- আমার মাইয়া দুধে-ধোওয়া। উয়ে এমুন কাম করোনের আগে ফাঁসি লইবো, কিন্তুক অই পথে যাইবো না। আল্লারে হাজির-নাজির কইরা কইতাছি, এমুন মাইয়া আমি পয়দা করি নাইক্কা।’
জুলেখার বাপের কথা শেষ হয় কী হয় না, মজলিশের কে একজন জানি ফড়াত কইরা গর্জানি দিয়া ওঠে। ‘এই মন্তাইজ্জার বাপে আছে খালি কুকতা গাওনের তালে। মাইনষের পুটকির পিছে লাইগ্গা থাকোন ছাড়া জিন্দিগিতে হের আর কোনো কাম আছে?’
মজলিশের লোকে মনে মনে স্বীকার করে যে, কথা হাছা। দেওভোগ গেরামে আছে এই একজোন। গিবত গাওন ছাড়া আর কোনো কাম নাই তার। পুরা জীবন এই-ই কইরা চলতাছে এই মিয়ায়। গেরামের বৌ-ঝিয়েগো স্বভাব-খাসলতের দিকে নজর দিয়া থোওন ছাড়া আর অন্য কিছুতেই নাই সেয়।
ইমাম হুজুরে দেখে যে, আসল কথা বাদ গিয়া এক্ষণ মজলিশে ফাও কথা নিয়া কাইজ্জা শুরু হওয়ার দশা হইয়া গেছে গা তো! যেয় গর্জানি দিয়া ওঠছে, তারে গেরামের বেটা-মাতারি সর্বজনে আমল দিয়া চলে! পোলাটা ভালার ভালা, কিন্তুক দুনিয়ার ঘাড়-তেড়া আর সীমাছাড়া ঘাউরার ঘাউরা। আরে সব্বনাশ! এই ছেড়ার মাথা-গরম হইলে- অখন যে তুফান বান্ধবো-তারে সামলানি দেওনের শক্তি কেউর নাই! ধুম কাইজ্জা- চাই কী মারামারিসুদ্ধা- জোড়াইয়া দিব অখন এই পোলা। সেই গোলেমালে জুলেখার বিষয়খান কই যে উইড়া যাইব!
(চলবে)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১২)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১১)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১০)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ৯)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ৮)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (সপ্তম কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (ষষ্ঠ কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (পঞ্চম কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (চতুর্থ কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (তৃতীয় কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (দ্বিতীয় কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (প্রথম কিস্তি)