সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন
![](https://ntvbd.com/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2015/03/18/photo-1426657287.jpg)
‘কোন দূরে আছে বান্ধা বাইদ্যার বহর!’
‘ইসুফ মিয়া! ইসুফ মিয়া!’ ইমাম হুজুরে ঘাউরা পোলাটারে সামলানি দেয় এখন কী প্রকারে! সেয় তো কোরোধের কালে কথা কানে তোলোনের বান্দা না! দিশা বিশা না পাইয়া হুজুরে তারে কাতর গলায় ডাকা ধরে, ‘ইসুফ মিয়া ইসুফ মিয়া! বাপ,কতা হোন! মুরুব্বি হইয়া তোমারে হাতে ধইরা কই, বাজান, মাথা ঠাণ্ডা করো! দশজোনে দশকতা কয় যেইখানে, তারেই কয় মজলিশ!’
হুজুরে একদিগে বুঝ দিতে থাকে, আরেকদিগে দেখো- কী সোন্দর ইসুফ মিয়ায় ঠাণ্ডা হইয়া যাইতে থাকে। হুজুরে সেইটা খেয়াল করে ঠিকই, তাও বুঝের কথা থামাতে তার সাহস হয় না। থামানির লগে লগে আবার যুদি ছেড়ায় ফাত কইরা ওঠে!
সেই কারণে হুজুরে বুঝ দেওন চালাইতেই থাকে, ‘বাজি, তুমি বুজদার পোলা! তোমারে আর আমি কী বুজামু! বোজো তো তুমি, মাতা গরোম করোনের ওয়াক্ত না এইটা! দশের লগে চলতে গেলে দশের কতা হোনতে অইবোই! আবার দশ মোখের দশ কতারে ধরলেও চলবো না। আসল কথা মাতায় রাখোন লাগবো হগলতের আগে। আমাগো আসল কতা কি? জুলেখারে ফিরতি পাওনের রাস্তা বিছরান। সেই কতা বন কইরা, উল্টা সিধা কতা কইলে চলবো আমাগো? চলবো না। জুলেখার বাপ-মার বিপদবালাই ক্যামনে দূর করোন যাইবো, আহো বাজি হেই পথ বিছরাই!’
হুজুরের কথাও শেষ হয়, মসজিদের মুলিবেড়ার কিনার থেকে আবার কান্দনের জোর আওয়াজ ওঠে। কান্দতে কান্দতে জুলির বাপে একবার বাঁশের খুঁটিতে মাথারে বাড়ি দিতে থাকে, একবার বুকে থাপ্পড় মারতে থাকে।
‘এটি কী করতাছেন কাক্কা!’ মজলিশের আরেকমুড়ায় বসা ইসুফ মিয়ায় লোকের গাও বাঁচানি দিয়া তরাতরি পাও ফেলে জুলেখা বিবির বাপের দিকে আসে। আইসা, দুঃক্ষে ফাতাফাতা বাপটারে জাবড়ানি দিয়া ধরে বলে, ‘এইটা কী আকাম করতাছেন আপনে! বুজদার মাইনষে না-বুজের কাম করলে চলেনি কাক্কা!’
তারপর আঁতকা আবার হাঁকানি দিয়া ওঠে ইসুফ মিয়ায়,‘ এমুন ভালামাইনষের মাইয়ারে কুকতা কয় যেরা, হেরা আমাইনষের ছাও! দশজোনরে জিগাই, আমাগো হগলতের ঘরে মা-বইন আছে, যেই মাইয়া গেরামের পোলা-বুড়া কোনো একটা জোনের দিগে চোক তুইল্লা কতাও কয় নাইক্কা কোনো দিন, হেরে এমুন কলঙ্কী বানানি! খোদায় সইবো এটি!’ এই কথা কইতে কইতে দেখো ইসুফ মিয়ার গলাও কান্দা ধরে।
গলার কী দোষ! ভিতরে ভিতরে যে তার পরান কানতাছে কাউলকা দুপোর তেনে- হায় হায় হায়! সেই কান্দনের দুই এক ঝাটকা কী বাইর না হইয়া পারব! গলা আর কতখোন আটকানি দিয়া রাখব সেই চিক্কুর! কতখোন সেয় নিজেই সেই তুফানরে ভিতরে হামলানি দিয়া রাখব আর! জানে না, ইসুফ মিয়ায় কিছুই জানে না।
আর, এদিগে দেহো কিছমতের কী তামশা! সোনার টুকরা জুলেখারে নিয়া অই পয়মালের-পুতের কুকতা আজকা ইসুফ মিয়ারে হোনতেও হইলো, বরদাস্ত করতেও হইলো! সেয় অই বুইড়ার পো বুইড়ার টুটিটা ছিড়তে পারল না!
জুলিয়ে, ইসুফরে ছাড়া দিন-দুনিয়ার কী চিনে! কিছু চিনে না। গেরামের দশজোনে কিছু না জানুক, সেয় নিজে জানে জুলি তার জিন্দিগির কোনখানে বসত করে! সেয় পলাইলে কার হাত ধইরা পলাইতো! এই ইসুফের হাতখান ধইরা পলাইতো! পলায় নাই; পলানি দেওনের মাইয়া সে না। তারে বাইদ্যানিরাই ধইরা লইয়া গেছে গা! এই সকল কথা ইসুফ মিয়ার অন্তরে লড়েচড়ে, আর জুলেখার বাপেরে জাবড়ানি দিয়া ধইরা গলা তার ফোঁপাতে থাকে বেশুমার।
ইসুফ মিয়ার অমুন আঁতকা ফোঁপানি মজলিশরে টাসকি-খাওয়া বাক্যিহারা বানায়ে দেয়। এই মাথা-গরম, ঘাউরা, ঠ্যাটা পোলাটার দিলনি এমুন নরোম! বোজা যায় নাইক্কা তো কোনোকালে! ‘ইসুফ মিয়া- বাবা!’ ইমাম হুজুরে তারে একবার ডাক দেয়, তারপর পুরা মজলিশরে উদ্দিশ করে কওয়া ধরে,‘ হাজেরানে মজলিশ! ইসুফ মিয়ার চক্ষে যে পানি, হেইটা এমনে এমনে বিনা কারণে না! তার মস্তো কারণ আছে।’ সকলের মোখ চোখ সেই কারণ খান জানোনের লেইগ্যা অস্থির হয়ে যায়, কিন্তু তাগো কারোরই মুখে জবান ফোটে না।
‘ইসুফ মিয়ার দিলে যে কান্দন, আমার পরানও সেই একই কান্দন কানতাছে!’ ইমাম হুজুরে কয়, ‘সেই কারণেই আপনেগো হগলতেরে আবার একলগে করছি এইনে। আমার দিল কান্দতাছে এই তরাসে যে, আউজকা এক বাড়ির জুলেখা বিবিয়ে নাই হইছে, কাউলকা অন্য বাড়ির আরেকজোনে যাইব! গেরামে সর্বনাশ ঢুকছে! তার আলামত হইতাছে জুলেখার হারানি।’
হুজুরের কথায় মজলিশের শইল্লে কাঁটা দিয়া ওঠে। ‘ঠিক কইছেন তো হুজুর! ঠিকই তো মোনে হইতাছে!’ তাগো সকলের কাছেই হুজুরের কথারে সঠিক মোনে হইতে থাকে। তারা সমস্বরে হুজুরের কথায় সায় দেয়; তবে সেই সায় দেওয়ার কথারে কথা মনে হয় না। তারে ডর-লাগা গোঙানির মতোন শোনায়।
তাইলে এর তো বিহিত করা লাগে! হাজেরানে মজলিশ গাও-ঝাড়া দিয়া ওঠে। কিন্তু কী বিহিত করব তারা! আগের রাইতে গেরামের মানুষ নানা গেরামে গিয়া ঢেন্ডেরা দিয়া আসছে। সেই ঢেন্ডেরার তো কোনো ফল ফলে নাই। কোনো খবর কোনোদিক তেনেই পাওয়া যায় নাই। পুষ্কুনি, ঝোপ-জঙ্গল কিছু বিছরানি দেওন বাদ রাখে নাই গেরামের মাইনষে। জুলেখার কোনো চিহ্ন পাওয়া যায় নাই।
সকলের শোনা আছে, বানবাতাসে কোনো কোনো সোম মানুষরে নিয়া গাছের আগায় তুইল্লা থোয়। শেষে তার গলায় টিপি দিয়া মারে, নাইলে ঘাড় ভাইঙ্গা ফালাইয়া থুইয়া যায়। মনেরে বুঝ দেওনের লেইগা, অতি বুড়াগো কথামতো, গেরামের যতটি উঁছা গাছ আছে,তার সবগুলিতে যেয় যেমনে পারছে উইট্টা দেখছে। কিন্তুক সবগাছ খালি, ফকফক্কা। জুলেখার লাশ কোনো ডালে নাই। তাইলে অখন আর কী করবো গেরামের লোকে! হুজুরেই রাস্তা বাতাইয়া দেউক তাগো অখন!
হুজুরে কয় যে, দশজোনে তাগো সাধ্য মতোন যা করছে, এর উফরে আর কতা নাইক্কা! তারপরও যে মাইয়াটার কোনো খোঁজ মিলল না, এইটা কপালের গরদিশ ছাড়া আর কিছু না। কিন্তু তাও খোঁজ পাওনের চেষ্টাটা বন করোন যাইবো না!
‘কী করবো তাইলে অখন গেরামের মাইনষে! ইমাম হুজুরে কইয়া দেউক খালি একবার, সগলতে জান দিয়া সেই ফরমাইশ পালন করব!’ মন্তাজের বাপে ছাড়া মজলিশের সকলের মুখেই এই এক কথা। হুজুরে কয় যে, গেরামের পুরুষপোলারা সগলে নিত্যি, খোদার তিরিশটা দিন, বিষয়-কর্মে নানান জায়গায় যাইতাছে। কেউ যাইতাছে সেই গঞ্জের সদরে, নারায়ণগঞ্জে।
কেউ গাঙ পাড়ি দিয়া যাইতাছে সোনাকান্দা কী লক্ষ্মণখোলা। আউজকাও তারা বেবাকেই যার যার কর্মে যাইব। অখন, যে যেইনে যাইতাছে; সেয় য্যান সেইনেই চোখ-কান খোলা দিয়া চলে। য্যান খেয়াল রাখে, মাইয়াটার কোনো খোঁজ মিলে কি না! বাতাসেও যুদি মাইয়াটার কোনো গন্ধ পাওয়া যায়, খপ কইরা সেইটারেই য্যান ধরে। শেষে, পরের ব্যবস্থা পরে করোন যাইব।
এমনে তেমনে যেয় যেমনে পারে জুলেখার খোঁজখান চালাইয়া য্যান যায়- ইমাম হুজুরে সগলতেরে খোসামোদ কইরা কয়। সঙ্গে সেয় এও কয় যে; সেয় নিয়ত করছে একবার নিজে গিয়া বাইদ্যার বহরে তল্লাশি দিব। আউজকাই যাইব। বেইল আট্টু চড়লেই মেলা দিব হুজুরে।
তার অন্তর য্যান কইতাছে, জুলেখারে ভোন্দা বানাইয়া নিজেগো কোনো নাওয়ে নিয়াই ফালাইয়া থুইছে বাইদ্যানিরা। গিয়া একবার তল্লাশিটা দিলেই মাইয়াটারে পাওন যাইব! এই একদিনের মধ্যে বহর উঠাইয়া যাওনও বাইদ্যাগো পড়তায় পড়োনের কথা না। কাজেই তারা যেমনে নোঙর ফালাইছে, তেমনেই আছে। সেই বহরে গিয়া অখন খালি তল্লাশিটা দিলেই হইবো!
বাইদ্যাগো সেই জাদুটোনা, ধুলি-পড়া কাটানের লায়েক মানুষ এই দেওভোগ গেরামে কে আছে! আছে একমাত্র এই ইমাম হুজুরেই। কাজেই বাইদ্যার বহরে তল্লাশি দিতে তারেই যাওন লাগব। গেরামের অন্য কোনোজোনরেই লগে যাইতে কইব না সেয়। যারেই নিবো, তারেই একটা পুরাদিন কর্মে কামাই দিতে হইবো। দিনকার রুজির উপরে এমুন গ্যাঞ্জাম দেওনের কোনো হক হুজুরের নাই। সেই কারণে যাইবো সেয় একলাই। দেহি, আলা নসিবে কী আছে! হুজুরে মজলিশরে বিদায় দিতে দিতে নিজের কথাখান শেষ করে।
বিদায় নিতে নিতে সগলে দেখে যে, ইসুফ মিয়ায় ক্যান জানি হাত-জোড় কইরা হুজুররে কী কওনের লেইগা খাড়াইছে। আবার তার কী কওনের আছে! কওনের আছে একখান খালি কথা! ইসুফ মিয়ায় হাতজোড় করে হুজুররে কয়,‘ হুজুর! আমারে আপনের লগে নেন! আপনে একলা মানুষ! বাইদ্যার দলের লগে মুকাবিলা করতে গিয়া যুদি ফেসাদ বান্ধে! একলা মানুষ আপনে তহন কোনদিগে যাইবেন?’
হুজুরের অন্তর খুশি হইয়া যায়। সেয় কয়, ‘বাজি, তোমার বুঝ-বিবেচনা তো আল্লায় কম দেয় নাই! তোমার মা-বাপের কিমুন খোশ-নসিব!’
বাইদ্যার বহরের তল্লাশিতে বাইর হইতে গিয়া হুজুরে দেখে, কঠিন অবস্থা! দেওভোগ গেরামের দক্ষিণ দিয়া যে খালখান গেছে, সেইটা গিয়া পড়ছে দূরের শীতলক্ষ্যা নদীতে। বাইরা মাসে অই খাল যেমুন টুপটুপা ভরা থাকে, তেমুন খালের দুই দিকের সকল খেতিখোলাও থাকে বাইর্যা মাইস্যা পানিতে ডুবা।
সেই ভরা খাল বাইয়া তখন বাইদ্যার বহর আইসা উপস্থিত হয় এই স্থানে। তারা নোঙর ফালায় গেরাম তেনে বহু দূরে, খালের নিরালা কোনো জায়গায়। তারপর একটা দুইটা কোষা নাওয়ে কইরা তাগো বাইদ্যানিরা নানান গেরামের দিকে যায়, দেওভোগ গেরামেও আহে। সারাদিন হাঁটু পানি, কোমর-পানি ভাইঙ্গা ভাইঙ্গা দেওভোগের এক মাথার তেনে আরেক মাথায় যায়।
আর,গলা উঁচায়া ডাক দিতে থাকে, ‘শিঙা লাগাই! বিষব্যথা সারাই! বদ-রক্ত ফালাই! লাগবো নি গো কেউর? শিঙা লাগাই!’ বাইরা মাসের সেই সময়ে দিন পনেরো, একদিন দুইদিন অন্তর অন্তর বাইদ্যানীগো আনাগোনা চলতেই থাকে। আর, বাড়ির মা-বৌয়েরা যার যেমুন লাগে, বাইদ্যানিগো দিয়া তাগো ঠেকা কাম সারাইয়া লয়।
তবে এই অঞ্চলে তারা শুকনার দিনে আসে কদাচিৎ। না-পারতে আসে। কোনোরকম ঠেকার কর্ম কোনো প্রকারে সামলাতে আসে তারা কোনো কোনো সময়। পাঁচ বছরে হয়তো একবার দেখা যায় যে, বাইরা মাসের পরে আবার তারা মাঘ ফাল্গুন মাসেও আইসা হাজির। তেমন শুকনার দিনে তারা যখন আসে, তখন তাগো বহর বান্ধা থাকে মূল গাঙে। সেই কোন কদম রসুলের ঘাট ছাড়াইয়া আরো দূরে। সেই দিকে দেওভোগ গেরামের মানুষের কোনো কারণেই যাওয়া পড়ে না।
সেইখানে বহর বাইন্ধা বাইদ্যানিরা হাঁটতে হাঁটতে আসে গঞ্জের সদরে, নারায়ণগঞ্জে। সদররে পাক দেয় দিন পনরো, তারপর তাগো কোনো কোনো দল আসতে আসতে এই কয়ঘর মাত্র লোকের বসতি- দেওভোগ গেরামেও আসে। তবে সেটা তো নিত্যি বছরের ঘটনা না। আঁতকা কোনো এক বছরের ঘটনা। এখন, এইবারের এই চৈত্র মাসে কি আইছিল বাইদ্যানিরা? আইছে তারা? শোনা গেছে তাগো ডাক? লাগবো নি গো, শিঙা লাগাই,বিষ রক্ত ফালাই!
তাগো শিঙা ফুঁকানির আওয়াজ পাইছিল নি গেরামের বৌ-ঝিয়েরা, এরমধ্যে কোনোদিন? তারা মাথা ঠাণ্ডা কইরা স্মরণ করুক তো, বাইদ্যানিগো ডাক-হাঁক তারা পাইছিল কি না এই চৈত মাসে! ইমাম হুজুরের হুকুম পেয়ে গেরামের মা-চাচি, আঙর-ডাঙর ঝি-বৌরা বহুত মনে করার চেষ্টা করে। আইছিল? আইছে নি! নাহ! একজোন কেউও স্মরণে আনতে পারে না যে, এর মধ্যে বাইদ্যানিগো শিঙার আওয়াজ তারা পাইছিল, নাকি পায় নাই!
(চলবে)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১৩)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১২)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১১)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১০)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ৯)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ৮)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (সপ্তম কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (ষষ্ঠ কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (পঞ্চম কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (চতুর্থ কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (তৃতীয় কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (দ্বিতীয় কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (প্রথম কিস্তি)