সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন
‘টেমটেমানি পিদিমখান এক ঝাপটায় নিভে!’
কোনো মতে গেরামের মাতারিগো জেরা-জিজ্ঞাসা শেষ করে ইমাম হুজুরে বাইদ্যার বহরের সন্ধানে যাত্রা করে। লগে লগে মেলা দেয় ইসুফ মিয়ায়। সেয় সঙ্গে আসা ধরে ঠিক,তবে হাঁটতে থাকে হুজুরের পিছে পিছে। ‘কী বিত্তান্ত বাজি! পিছে পইড়া থাকতাছ ক্যান?’ হুজুরে জিগায়। থতমত মুখে ইসুফ মিয়ায় জব দেয়, ‘না! সেয় মুরুব্বি-মাইনষের লগে লগে কেমনে হাঁটে! বেত্তমিজি হইয়া যাইব না!’ হুজুরে ভিতরে ভিতরে একটু ধোক্কা খায়; ‘পোলাটার দেহি বহুত আক্কল-পছন্দ দিয়া থুইছে মাওলায়! বুড়া-মাইনষেরে তমিজ করতে জানে! অরে তয়, ঠ্যাটা বেত্তমিজ কয় লোকে কোন কারণে!’
অরে লইয়া গেরামের নানান জোনের মোখে তো উল্টা-সিধা কতার কোনো শুমার নাই! দেওভোগে এমুন একটা মানুষ পায় নাই ইমাম হুজুরে, যেয় কি না অরে ভালা কইছে! কোনো না কোনো কারণে গেরামের জুয়ান পোলাপানের কথা ওটলেই, আইয়া পড়ছে এই পোলার কথা। তখন সকলের মুখে কমবেশি সেই এক বুলি; ঘাউরা বেত্তমিজ পোলা! ময় মুরুব্বি মানে-গোনে না। মুখ সামলাইয়া কথা কয় না। বড়ো মাইনষের পুত। বাপ-মায়ের লাইয়ে পুতখান হইছে মুত।
হুজুরে নিজে কোনোসোম এই পোলারে ধারেকাছে পায় নাই। কোনো কারণেই অরে হুজুরের কাছে ভিড়তে দেখা যায় নাই। দূর তেনে লোক-মুখে শোনা যে, অই ছেড়ায় আদ্দব-লেহাজের ধার ধারে না। লোকের কথা কানে নিছে হুজুরে, কিন্তু ভালা-বুরা কোনো কতা নিজ মুখে আনে নাই। দুনিয়ার কোনো কিছু নিয়াই তার নিজের আর কোনোপ্রকার লড়ালড়ি দেওয়ার বাঞ্ছাখান নাই। জিন্দিগির রাস্তাঘাটে চলতে চলতে সেয় পষ্ট জানছে; ভালা-বুরা, রাইত-দিনের ভিতরেও নানা প্যাঁচ-ঘোজ থাকে। অত সহজে কালারে কালা কওনের উপায় নাই। ভালামোতন বুইজ্জা তয় তা কওন লাগে।
তয়, সেয় এইটাও জানে যে, লোকের মুখেই জয় লোকের মুখেই ক্ষয়! লোকের মুখে এই যে এত কুকতা ওটতাছে নিজের পোলারে নিয়া, বাপ-মায়ে সেই দিগে নজর দিব না? পোলাপানরে ভালামোতন সমঝানি দিলে, পোলাপাইন ভালা হইতে কতখোন লাগে! ইসুফ মিয়ার বাপে-মায়ে যে ভালা-মানুষ, সেই কতা সর্বলোকে কয়! আফসোস, সেই বাপে-মায়ে পোলারে সমঝানি দেওয়ার গর্জ পায় না!
এই আফসোসখান ছাড়া অই পোলার লেইগা ইমাম-হুজুরের অন্তরে আর কোনো ভালা-বুরা চিন্তা ওঠে নাইক্কা কোনোদিন! আজকা দেখো, এইটা সেয় কারে দেখতাছে! নরোম-দিল, তমিজ-লেহাজ-অলা সুন্দর এক সু-খাসলতের পোলা একখান, তার লগে লগে যাইতাছে! যাইতাছে বিপদে-পড়া দুক্ষী মাইনষের উপকার করোনের লেইগা! আপনা আপনেই হুজুরের অন্তরের ভিতরের তেনে দোওয়া আইতে থাকে অই পোলার লেইগা। হের লগে দুঃখ-সুখের কতা কওনের বাঞ্ছায়, পরান আপনা তেনেই ফাল পাড়তে থাকে হুজুরের।
‘আয়, বাজান! আমার লগে লগে হাঁটা দে!’ হুজুরে পিছে ফিরা ডাক দেয় ইসুফ মিয়ারে। ইসুফ মিয়ায় জড়োমড়ো কদমে চলোন শুরু করে, ইমাম হুজুরের পাশে পাশে। দেওভোগ গেরামের দক্ষিণের খাল ধইরা পুব বরাবর ক্রোশ তিনেক রাস্তা গেলে পরে, পাওয়া যায় শীতলক্ষ্যা গাঙ। সেই মোতাবেক চলতে থাকে দুইজনে।
চলতে চলতে হুজুরে দেখে পোলাটায় একটা রাও-ও পাড়োনের নাম নিতাছে না। এদিকে হুজুরের অন্তরে কত দুনিয়ার কতা লড়তাছে চড়তাছে। এমুন বোবা, দাঁত-কপাটি দিয়া নি এত্তা পোথ পাড়ি দেওন যাইবো! এমুন পোথ চলতির কালে নিয়মই আছে যে, একজোনের লগে চলবা। থাকবা কথার বাওয়ে। তাইলেই তোমার মন থাকবো অন্যদিগে। কাহিল লাগোনের ফুরসতটা পাইব না তোমার অন্তর।
সেই নিয়ম পালন না করার লোক ইমাম হুজুরে না। এই পোলায় কথা কউক না কউক, হুজুররে কইতে হইবোই। নাইলে যাইতে পথেই শইল কাহিল হইয়া জারেজার হইব। আর, তহন আসল জায়গায় গিয়া আসল কর্মখান করোনের শক্তি থাকব না। জুলেখারে বিছরানি দেওনের ঠেকা কামটা তো করতে অইবো! হুজুরে তখন আপনা তেনেই কথা তোলা দেয়। এই কথা সেই কথা। এই যে তা-পোড়া তা-পোড়া চৈত মাস যায়, অন্য অন্য বার এই দিনে গেরামে ঘরকে ঘর মানুষ কাইন্দা জারে জার হইতে থাকে। কি? না, এর তার বাড়িতে- হয় গুটি-বসন্ত, নাইলে ওলাবিবির দয়া লাগছে!
এইবার এই দিগে অখনও তাগো কোনো বইনের কোনো দয়া আইসা হাজির হয় নাই। মাবুদ মেহেরবান। গেরামের প্রতিটা জোনে আল্লার দরবারে মোনাজাত ধইরা আছে; আল্লা! এইবার য্যান মাফ পাই আমরা। এই পাপী-তাপী মানুষটিরে মাফ দিও মাবুদ! এইবার য্যান তাগো দয়া না আসে। এইবার য্যান রেহাই মিলে সগলতের, খোদা!
কী জানি খোদার কী কুদরত! ধরনে মোনে হইতাছে, এইবার য্যান আল্লাপাকের দরবারে লোকের আর্জি পৌঁছাইছে! লোকের ফরিয়াদ মাবুদে শোনছে লাগতাছে সগলের। এইবার অখনও তাগো দুই বইনের একজোনেরও দয়া দেখা দেওনের নামও নাই! মাবুদ! তোমার মেহেরবানি! অখন খালি বড়ো একটা ধুম ঝটকা মেঘ নামোন লাগবো। মেঘের পানিও আইয়া নামব মাটিতে, তাগো দুই বইনের রাজত্বির দিনও শেষ হইবো লগে লগে। মেঘ আইতে আর কয়দিন! অখন তখন আইল বইল্লা! দেওভোগ গেরামের সগলের অন্তরে এই আশা!
কিন্তু দেখ, এক গজব আহে নাই তাতে কী! অন্য আরেক গজব ঠিকই তো আইয়া খাড়া! আইল অন্য চেহারা ধারণ কইরা। দেওভোগ, বাবুরাইল, ছোনখোলা,পঞ্চবটী, ভোলাইল, আখড়া– এই দেশের কোনো গেরামের কোনো মাইনষে যেই কথা জিন্দিগিতে শোনে নাই, এইবার সেই কথাও শোনা গেল। আস্তা একটা সিয়ানা মাইয়া– নাই হইয়া গেল। এমুন খোয়ানির কতা লোকে কোনোদিন হোনছে! হোনে নাই। এমুন আসমানি গজব আর কোনোদিন নামছে লোকের সংসারে! নামে নাই। অই যে, ময়-মুরুব্বিরা কইয়া গেছে না, আপোথ পোথ হইবো! অচিন্ত্য বেপার হাছা হইবো। তখনই রোজ কেয়ামত!
সেই কথাই ফলা ধরছে। এই যে এমুন ভালামাইনষের মাইয়াখান উধাও হইছে, এইটা কিয়ের আলামত?
হুজুরে হাঁটে হাঁটে, আর ইসুফ মিয়ার কাছে পরানের দুক্ষুর বিত্তান্ত কয়। ‘কী ফল হইল এত মোনাজাত ধইরা? ইমাম হুজুরে তো গেরামের বেবাকটি বাড়ির লেইগাই প্রত্যেক ওয়াক্তে দোয়া-খায়ের করে। নিত্যি করতাছেই। মাবুদ! সবতেরে হেফাজত দিয়েন! জানে-মালে হেফাজত দিও খোদা! আফসোস! এই পাপী-তাপীর মোনাজাত আল্লায় কবুল করে নাই।’
পাও টানতে টানতে ইসুফ মিয়ায় কোনো মোতে আগ্গায়, আর হুজুরের হায়-আফসোসের কথা হোনে। হুজুরে তো তার কতা কইয়া নিজের ভিতরের বোঝারে পাতলা করতাছে, কিন্তুক ইসুফ মিয়ায় কার কাছে কইবো, কই গিয়া কইবো নিজ অন্তরের দুক্ষুর কথা! কারে কইবো যে, তার পরান ফাতফাতাইয়া জ্বইল্যা যাইতাছে দিবানিশি। তার দিল পুইড়া আংড়া হইয়া যাইতাছে জুলির চিন্তায়।
কই গেল উয়ে! কি হইছে অর! বাইচ্চা আছে? নাকি শ্যাষ! এই চিন্তা ইসুফ মিয়ার রাইত-দিনরে ছারখার কইরা দিতাছে। এক একবার মোনে হইতাছে য্যান ইসুফ মিয়ায় আর মাটিতে খাড়া নাই, সেয় পইড়া গেছে তপ্ত তাওয়ায়; আর পোড়া পোড়া হইয়া যাইতাছে। কিন্তু তারে হাতে ধইরা তোলে এমুন কেউ নাই খোদার দুনিয়ায়! এমুন কেউ নাই এই দুনিয়ায়, যারে নিজের দগ্ধানির কতাখান কইয়া কইলজাটা ঠাণ্ডা করে ইসুফ মিয়া! কোনো বান্ধব তার নাই। নাই।
অখন,এই ঠাটা-পড়া গজবের দিনে ইসুফ মিয়ায় নিজ অন্তরের বিত্তান্তটা কেউর সামনে তোলা দিবই বা কী প্রকারে! সুদিন থাকতেই যখন বিষয়টা সেয় মীমাংসা করতে পারে নাই, অখন অদিনে সেই বিষয়রে মুখে আনবো সেয় কোন পরানে! আর, গেরামের দশজোনে দশরকম মন্দ-ছন্দ কইতে কইতে শেষে দোষ নিয়া ফালাইবো নিদুষী ছেড়ীটার উপরে। ইসুফে জান থাকতে নি দিব জুলেখারে কলঙ্কী নাম কিনতে? দিব না। কাজেই মনের ঘুঁষঘুষা আগুন মনে নিয়া তারে নামতে হইছে জুলির সন্ধানে। দেখব ইসুফ মিয়ায়, কী লেখছে মাবুদে, তার নসিবে!
হুজুরের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে সেয় দেখে যে, তার পাও য্যান আর চলতে পারতাছে না! ভাইঙ্গা য্যান থুবাইয়া যাইতে চাইতাছে পাও, খোনে খোনে। শইল্লে য্যান আর নড়োন দেওনের বলখান নাই। অথচ এমন কিছু রাস্তা তো তারা হাঁটে নাই। এইটা কী হইতাছে তার! হুজুররে সেয় কেমনে বলে তার এই বেগতিক দশার কথা!
কিন্তু কেমুন আচানক বেপার যে, হুজুররে কিছুই কওন লাগে না। ভাবে মোনে অয় যে, সেয় য্যান ইসুফ মিয়ার দিকে একখান চোখ দিয়াই থুইছিল আগাগোড়া। ইসুফ মিয়ার শইল পুরা বেগতিক হওনের আগেই সেয় পোলাটারে কয়, ‘আয়! কতক্ষণ গাছের ছেমায় বই। আগে জিরান্তি। হেশে মেলা দিমুনে।’ তয়, ইসুফ মিয়ার আর বওনই বা কী; চলোনই বা কী! হুজুরে যেমনে যা কয়, তাই সই। সেয় হুজুরের কথা শুনে তবদা-লাগা পাওয়ে খাড়া দিয়া থাকে।
কিন্তু হুজুরে তগ-নগদ মাটিতে লেট দিয়া বসে পড়ে। বসে, ইসুফ মিয়ার দিকে মুখখান তোলা দিয়া আঁতকা কয়; ‘দেখ বেকুব! আমারে যুদি একটা বার অন্তরের বাসনাখান ভাইঙ্গা কতি; তাইলে কইলাম এমুন দগ্ধ হওন লাগে না তরে!’
ইসুফ মিয়ার পরান চমকানি দিয়া ওঠে। শরীরে কাঁটা দেয়! ‘হুজুর! এইটা কী কইলেন! আপনে কেমনে বোজলেন!’ হুজুরে তার লগ দিয়া ইসুফ মিয়ারে বহাইতে বহাইতে কয়,‘ আরে মিয়া! বিনা বাতাসে নি গাঙ লড়ে! তর মুখ-চোখই তো বেক্ত করতাছে তর পরানের দুক্ষু!’
কওয়া নাই বুলি নাই, দেখো আঁতকা কী ঘটে! ইসুফ মিয়ার খরখরা চক্ষে পানি আইসা ঝাপটা মারে। কী বেকুব আর আন্ধা হইয়া আছিল সেয় এত দিন! এই দেওভোগ গেরামে, ইমাম হুজুররে কে অমান্যি করে! কেউই না। এমুন জিনিস নাই, যার মীমাংসা দেয় নাই হুজুরে! এমুন একজোনও নাই, যেয় অখুশী হইছে হুজুরের মীমাংসা নিয়া!
তাইলে, তার কাছে ক্যান গিয়া হত্তা দিয়া পড়ে নাই ইসুফে! তাইলে তো এমুন জীয়ন্তে দগ্ধাইয়া মরতে হইত না তারে! ক্যান যাওনের কতাখান একবার মনেও ওঠে নাই তার! করছে কী সেয়! করছে কী! অহন, আল্লায় একবার খালি জুলিরে ফিরত দেউক। অরে ফিরত পাওনের লগে লগে ইসুফে গিয়া হুজুররে ধরব। পাও ধইরা পইড়া থাকব। উপরে আল্লায়, নিচে হুজুরে। সেয় যেমনে পারে সমাধা কইরা দেউক ইসুফরে।
‘ল, মেলা দেই!’ আসমানে রইদ চড়বড় করে উঠতে দেখে হুজুরে উঠে পড়ে। যাইতে হইবো আরো বহুত দূরের পথ, সেই গাঙের মুখে। গিয়াই তো আর বাইদ্যার বহরে তল্লাশি জোড়ানোর উপায় নাই। বাইদ্যারা থাকব বহুতজোন, আর তারা খালি এই দুইজোন। এই একলা দোনোজোনে বাইদ্যাগো লগে জোলাইয়া পারব! হুজুরে বোঝে যে, পারব না। কারণ বাইদ্যারা তাগো লগে মারামারি জোড়াইতে আসব না ঠিক, তবে কৌশল আর তুকতাক দিয়া ভেলকি দেখানের কিছু বাদ রাখব না তারা।
কলের কাম কোনোদিনও বাইদ্যারা বলে করে না। আবার তাগো জিজ্ঞাসা কইরাও যে জুলেখার বিষয়ে কোনো কথা পেটের তেনে বাইর করন যাইব, তাও না। তাইলে কী করতে হইবো! করতে হইবো এই যে, লোকবল নিয়া হাইরে-মাইরে কইরা হামলানি দিয়া পড়তে হইবো বাইদ্যার বহরে। তারপর যা থাকে কপালে।
‘হায় হায় হায়!’ ইসুফ মিয়ায় কঁকানি দিয়া ওঠে, ‘এই জায়গায় তো দেওভোগ গেরামের কোনো মাইনষের কোনো ইষ্টি-কুটুমের নাম-গন্ধও নাই। তাইলে কোন বেটাটায় আগ্গাইয়া আইবো তাগো দোনোজোনের লগে খাড়াইতে!’
‘রাখ, ডরাইস না!’ হুজুরে কয়,‘বল বল আপনা বল, আর জল জল গাঙের জল। আমার তো দুই চাইরটা হইলেও ইষ্টি-খেশি আছে দুনিয়ায়। গাঙ-পাড় মজিদের ইমামে আমার আপনা মানুষ।’
তয়, যাই ঘটুক, অখন মানে মানে জুলিরে উদ্ধার কইরা বাড়িতে ফিরতি নেওনই হইলো মাথায় রাখোনের বিষয়। সেই কাম করতে গিয়া যুদি কাইজ্জা-ফেসাদ করন লাগে, করতে হইবো। যুদি বাইদ্যাগো মাথায় বাড়ি দেওন লাগে, দিতে হইবো। যুদি নিজেগো মাথায় বাড়ি খাওন লাগে; খাইতে অইবো। তহন মনে ধরতে হইবো যে, ওই-ই কপালের লিখন আছিল।
খাল শুকায়ে ল্যাগব্যাগা হইলে কী হয়; গাঙের পানি আছে মিশকালো, ভর-ভরান্তি, শীতলা থিরথিরা। সেই পানির দিগে চোখ পড়া মাত্র শরীরখান ঠাণ্ডা হইয়া যায় এক ঝটকায়! তিন ক্রোশ রাস্তা তেতেপুড়ে হাঁটোন দিয়া আসা দুই জোনের চোখ শীতলক্ষ্যার পানিতে আছাড় খায়; আর দেখো চক্ষের পাতাখান নামানের আগেই তাগো দোনোজনের চোখ-মুখ-দেহ-পরান জুড়াইয়া শেষ। ভোন ভোন করতে থাকা মাথা, ঘিলুও লগে লগে থির-সুস্থির হয়। তখন তারা দোনোজনে ঠাণ্ডা চক্ষে দেখতে পায় যে, গাঙ আছে গাঙের মোতন শূন্য, ফকফকা। বাইদ্যার বহর আছে বা আছিল- তার কোনো চিহ্নও দেখা যায় না কোনোখানে।
ইমাম হুজুরের খেশিয়ে একলা বইসা থাকে নাই। সেয় দুই দশজোনরে খবর দিয়া আনায়েও রাখছে। তারা সগলতে আবার খুব ভালামোতন খোঁজও নিয়া রাখছে, যে, এই বছর এই সময়ে বাইদ্যার বহর আইসা ভিড়ে নাই এইবার। আসে নাই তারা। এই অঞ্চলে এইবার তো নাইই, গেলোবার কী তারও আগেরবারেও তাগো আসতে দেখা যায় নাই এই সময়ে।
‘এমুন নি হইছে যে, তারা চুপেচাপে আসছিল?’ ইমাম হুজুরের গলাটা আঁতকা কেমনে জানি ভাঙ্গা ফ্যাসফ্যাসা হইয়া যায়। সেই গলা নিয়াই সেয় লোকেরে কথা জিগানি চালাইতে থাকে। লোকে এমুন তামশার কতা শুইন্না হাসা বন্ধ রাখব কোন প্রকারে! হুজুরে যে কী কয়! বাইদ্যাগো কামই হইতাছে হাঁকডাক দিয়া চলোন। বাইদ্যানিরা ডাক না দিলে গিরস্ত-ঘরের মাতারিরা কেমনে বোজবো যে, হেরা আইছে! কেমনে হেরা কামকাইজের ফরমাইশটা পাইবো! সেই কারণে ডাক-চিল্লান ছাড়া বাইদ্যানিগো চলোনের পথ নাই।
আসে নাই তারা। নাওয়ের বহর নিয়াও আসে নাই। বা দল বাইন্ধা, হাঁটা পথ দিয়াও আহে নাই। কেউ শোনে নাই তাগো চড়া, চিকন সুরের ডাক- দুপুরে দুপুরে; বিষবাত সারাই। শিঙা লাগাই। বদ-রক্ত ফালাই। লাগবো নি গো!
সন্ধ্যাসন্ধি পুরা দেওভোগ গেরামের জানা হয়ে যায় যে, ইমাম হুজুরেও বিফল হইয়া ফিরতি আসছে। জুলেখারে পাওন যায় নাই। কারোরই বুঝতে বাকি থাকে না যে জুলেখারে আর পাওয়া যাইব না! উয়ে গেছে যে গেছেই। কিন্তু পোলা বুড়া বেটা মাতারি কোনোজোনের মুখেও একটা জবান ওঠে না। সগলে ঠাসকি-খাওয়া, তবদা-লাগা হয়ে খাড়া দিয়া থাকে ইমাম হুজুরের আশপাশে।
(চলবে)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১৪)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১৩)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১২)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১১)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১০)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ৯)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ৮)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (সপ্তম কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (ষষ্ঠ কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (পঞ্চম কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (চতুর্থ কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (তৃতীয় কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (দ্বিতীয় কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (প্রথম কিস্তি)