সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন
‘দিন যায়! থাকে না!’
বৈশাখ মাস যায় যায়। ১৩৩১ বঙ্গাব্দের বৈশাখ মাস। বিকালের কালে আসমানের উত্তর-পশ্চিম কোণে ধুমধুমা মেঘ জমতে দেইক্ষা, মায় তরাতরি আসে ইসুফ মিয়ারে ঘরের ভিতরে নিতে। ইসুফ মিয়ায় তাগো পুবের ঘরের বারিন্দায় শোওয়া। অখন সেয় অনেক ভালা। তার শইল্লের গুটি শুকাইছে। সেই গুটির মামড়িও পইড়া শেষ। খালি গুটির দাগগিলি এট্টু কাঁচা কাঁচা দেখায়। তয়, ক্রমে সেইগুলাও শুকাইবো। অখন আর ডরের কিছু নাই।
প্রতিটা দিন সকাল সকাল মায়ে তার পুতেরে উঠানের নিমগাছের ছেমায় নিয়া বসায়। জলপিঁড়ায় বসা থাকে পুতে, তার পাও রাখতে দেওয়া থাকে আজদাহা পিঁড়িখান। তরিজুত মতোন তাতে ইসুফ মিয়ারে বসাইয়া, মায়ে নিজের হাতে পোলার সারা শইল্লে কাঁচা নিমপাতা আর হলদি-বাটা ডলতে থাকে। আলগোচ্ছেই ডলে, তাও বড়ো ডরডর করতে থাকে মায়ের। পোলায় নি আঁতকা কোনোরকম দুক্ষু পায় আবার! শইল তো আর ভাওয়ে নাই পুতের! কোনসোম না আবার অই গুটি-থকথকা দেহখানের কোনো দিগে এট্টু গুঁতা নাইলে খামচি লাইগা যায়!
লাগলে, সেইটা সহ্য করার আর কোনো তাকদ পুতের শইল্লে নাই। যতোখোন খুশি ততোখোন ডলে মায়ে। পুতের মোখে সেইটা নিয়া একটা রাও নাই, লড়াচড়ি কিচ্ছু নাই; ঝুম বসা দিয়া থাকে উয়ে। দেখলে মোনে অয় কী—য্যান অর কাছে কোনো কিছুই অখন কিছু না। শইল্লে নিম-হলদি দিলে কী, আর না দিলে কী! কিছুতেই য্যান কিছুরে গোনায় নেওনের কিছু নাই ইসুফ মিয়ার।
বিষয়খান নজরে নিয়া পরান ছাৎ কইরা ওঠে ইসুফ মিয়ার মায়ের! এইটা কেমুন দেহায় তার পুতেরে! দেহায় য্যান দিন-দুনিয়ায় নাই উয়ে! এইটা কেমুন কতা! এমুনটা দেখলে কইলজা না ছাতছাতাইয়া পারে! মায়ের পরান না? তয়, লগে লগেই মনেরে সেয় বুঝ দিয়া ঠান্ডা করে। এত্তাবড়ো বিমার তেনে ওঠা তার পুতে! অর অখন ভালা-বুরার হুঁশ আইছে নি!
ইসুফ মিয়ার শইল্লে হলদি-নিমপাতাবাটা ডলা শেষ কইরা, আস্তে আস্তে এক লোটা এক লোটা কইরা পানি তোলে মায়ে। সামনে রাখা আছে পানি ভরা, বিরাট মাটির গামলা। আজদাহা বড়ো অই মাইট্টা চাড়িখান মায়ে কিনাইছেই পুতের এই গোছল দেওনের কর্ম নিষ্পন্ন করোনের লেইগা। আইজ-কাইল সংসারের সকল কাজের আগে, এক পাতিলা পানিরে নিমপাতা দিয়া জ্বাল দেওনের কর্মখান সারা হইতাছে। এক্কেরে বিয়ান বেলায়ই সেই কর্ম শেষ। বেইল বাড়তে বাড়তে সেই জ্বাল দেওয়া পানি জুড়াইয়া শীতল হয়। তখন তারে নিয়া মিশানো হয় চাড়ির অন্য পানির লগে। তা দিয়া পুতের গাও-গতর ধোয়ানি দিয়া চলছে মায়ে, আউজকা পাঁচদিন।
মায়ে পুতেরে হলদি মাখায়, আর কাতর চক্ষে পোলার দিগে এট্টু এট্টু চায়। পুতে নি আবার চেতানি দিয়া ওটে! ভালার দিনে মাথার একখান চুলে নি ইসুফ মিয়ায় হাত দিতে দিছে! মায় যুদি কোনোসোম ডাক দিছ; ‘কই রে ইসুফ মিয়া, আয় আউজকা তর মাথায় তেল ঘইস্সা দেই। মাথাটা কেমুন কাউয়ার বাসা অইয়া রইছে তর!’ পুতে তক্ষণ ঘ্যাত কইরা ওটছে; ‘আমারে তোমার মাইয়া পাইছো নি! আজাইরা কতা কও। তেল দেওন লাগবো না!’
আজাউকা দেহো সেই পোলার মোখে একটা রাও নাই! মায়ে তারে লাড়েচাড়ে, পোলায় ঝুম ধইরা বইয়া থাকে। বইয়া থাকতে থাকতে কোনো কোনো সোম ঝিমাইতেও থাকে। আল্লা! যমে যে আমার পুতরে থুইয়া যাইবো, এমুন বিশ্বাস কেউর দিলে আছিলো না!
শীতলা বিবি দয়া করে নানান জোনরে, কম আর বেশি নানান মতে দয়া করে। কিন্তুক, ইসুফ মিয়ারে যেমনে দয়া ঢাইল্লা দিছে , এমুন সর্বনাইশ্যা দয়া কমই নামতে দেখা গেছে কোনোদিগে। মাবুদ! কোনোরকমে একটা সুই রাখোন যায়, এমুন এক তিল ফাঁক আছিলো না পোলাটার শইল্লে! সর্বখানে খালি গুটি। হায় হায় হায়! হাজারে বিজারে গুটি।
শইল্লে গুটি, মোখে গুটি। আঙুলের আগায়, পাওয়ের তলে, চক্ষের পাতায়—নাই কোনখানে! সগলে মায়ের আগোচরে হাঁকাহুকি করে; ‘যুদি গুটি চক্ষের মণিতেও হইয়া থাইক্কা থাকে, তাইলে সর্বনাশের বাকি থাকবো না। সেই গুটি পাইক্কা ফাটবো, চক্ষের তারা দুইখানও যাইবো জন্মের মতোন। এমুন তো কতো ঘটতে দেখতাছে লোকে, আখছার দেখতাছে! আহ হারে! এমুন জুয়ান পুত। পুরা জিন্দিগি কেমনে পার করবো সেয় পুরা আন্ধা হইয়া!’
সেই হাঁকাহুকি কী মায়ের কানে আহে নাই! আইছে। আইয়া তার কইজা ছেঁদা ছেঁদা করছে! একদিগে পুতের বাঁচোন-মরোনের চিন্তা, আরেকদিগে এই চক্ষের চিন্তা! একটা চোখের পাতা এট্টুখানি তোলা দিয়া যে ভিতরের অবস্থাটা একনজর দেখবো কেউ—তার কোনো উপায় নাই তখন। চক্ষের পাতা দবদবা গুটিতে বোঝাই! চক্ষের পাতার একটা কোণে এট্টু ধরোনের জো-ও নাই যে, ভিতরের হালটা দেখে কেউ! আল্লার হাতে ভালামন্দ সব ছাইড়া দিছে তখন মায়ে। মাবুদে যেমন রাখার রাখুক! মাইনষের হাতে তো কিছু নাই!
মাবুদ! সেই দিনও পার করছে বাড়ির লোকে। হাজার শুক্কুর আল্লার দরবারে। শীতলা মায়ে অর চোখ দুইটারে রেহাই দিয়া গেছে। জানে ফিরত পাওয়া গেছে পুত, কিন্তু তার শইল মোখ আর শইল মোখ নাই! থক্কর থক্কর, তুবা তুবা গুটি-চিন্নে ছয়লাব হইয়া গেছে তামান শইল আর পুরাটা মোখ। আহহারে! জষ্ঠি-মাইস্যা পাটপাতার লাহান ছলছলা নাক-মোখ-শইল শেষ হইছে জন্মের মতোন!
গুটি-চিন্নে তুবা তুবা সেই শইলরে মায়ে হলদি-নিমপাতা মাখায়, আর চিপ্পা চিপ্পা কান্দে। কিয়ের তেনে কী হইয়া গেলো আমার যাদুর! এই নি আছিলো কপালের লিখন! কান্দে মায়ে অন্তরে অন্তরে, চিপ্পা চিপ্পা। তয় সেয় তার সেই অন্তর-কান্দানিরে এক লহমার লেইগা বাইরে আইতে দেয় না। না না! পুতের তাইলে কইলজা ফাইট্টা যাইবো দুক্ষে আর পেরেশানিতে। নিজ শইল্লের এই কুছবি দশা নিয়া অরে ভাবনা করতে দেওন যাইবো না। উয়ে বাইচ্চা যে আছে, আল্লার কতো বড়ো মেহেরবানি!
অন্য অন্য সোম তো থাকেই, এমনকি এই গোছল-করানির খোনটুকও পারতে অন্যকামে লড়ে না ইমাম হুজুরে। মায় গোছল করায়, হুজুরে একটু ফারাকে খাড়াইয়া আল্লা রছুলরে ডাক পাড়তে থাকে। গোছল শেষ হয়; মায়ের লগে লগে হুজুরেও আইয়া ইসুফ মিয়ার আরেক ডানাখান ধরে। একলা হাঁটোন দিয়া ঘরে যায়, ইসুফ মিয়ার দেহে সেই শক্তি ফিরা আসতে বহুত দেরি।
পোলার এই বিষম হাল নিয়া মায়ের অন্তরের দুঃখু ইমাম হুজুরের কাছে গোপন থাকে না। সেয় পুতের আউলে নিয়া মায়েরে বুঝ দেয়, ‘আল্লায় যে অরে হায়াত দিছে, সেই কারণে ঢোকে ঢোকে লাখো শুক্কুর করেন তার দরবারে! আপনের পুত সোনার আংটি। বেকা হইলে দোষ নাইক্কা মা!’
গোছল শেষ করাইয়া মায়ে নিয়া পুতেরে শোওয়ায় পুবের ঘরের বারিন্দায়। বড়ো শীতল পাটিখান পাতা থাকতাছে সেইখানে, আজকা পাঁচদিন হয়। বিয়ানেই বারিন্দা সাফসাফা করে নিজ হাতে পাটি পাতে মায়। মা-র হুকুমে সেই পাটির উপরে, এক কোনা দিয়া নিত্যি রাখা হইতাছে পাতাভরা নিমের ডাইল্লা। খালি হুজুরের দেওয়া পড়া-পানিই না, লগে সোনা-রুপার পানি ছিটাইয়া সেই পাটিও শুদ্ধ করে মায়ে নিজেরই হাতে। পুতেরে গোছল দেওনে পরে, আগে মা-র এই কাম।
ইসুফ মিয়ার গোছল শেষ হইতে হইতে নানা-পদের পানি-ছিটাইন্না পাটিখান সোন্দর শুকনা হইয়া থাকে। সেই পাটিতে খ্যাতা-ত্যানা আর কিচ্ছু থাকে না, খালি থাকে একখান ফকফক্কা বালিশ। পারলে সেইটাও দেয় না মায়ে। কী জানি কিয়ের তেনে শেষে আবার কোন ছুইত লাইগ্গা যায়—মউতের দরোজা মোখ থেইক্কা ফিরত আসা পোলার! তয়, হুজুরে কয় শিথানে বালিশ না দিলে ইসুফ মিয়ার ঘাড়ে চাপ পড়বো। তাতে হিতে না বিপরীত হয়! তখন নিজহাতে সাফ করা বালিশখান দেয় মায়ে। নিজের হাতে সেই বালিশ সেয় পাটিতে পাতে, আবার সন্ধ্যার মোখে নিজের হাতে তোলে।
এই বারিন্দায় ইসুফ মিয়ায় পুরাটা দিন পড়া-দিয়া থাকে। সন্ধ্যার আজানটা হয় একদিগে, মায়ে পাকসাফ হাতে আইসা পোলারে ঘরের ভিতরে নেয়। একলা পারে না বিধায় লগে আরো এক-দুইজোনরে লয়। তারাও সাফা বস্ত্র ধারণ কইরা তবে মায়ের সামনে আসার হুকুমটা পায়। সারাদিন কেনো তারে অমন বারিন্দায় শোওয়ানি দিয়া রাখোন? জনে জনে জিগায়।
বড়ো মাইনষের বাড়ি। গেরামের সকল ঘরের লোকের ভিতরে ইসুফ মিয়ার বাপেই একলা বড়োমানুষ। তার নিজের গদি আছে। গদিতে না-কইয়া হইলেও চাইর-পাঁচ জন বান্ধা কর্মচারী আছে। টেকায়-পয়সায়, সোনায়-দানায়, দানে-দাওয়াতে এই বাড়ি এক্কেরে ভরপুরা। ভরাপুরা একেবারে ইসুফ মিয়ার দাদার আমল তেনে।
গেরামের বেশির ভাগ বাড়িতে চৌকি-চাকির নামও নাই। লোকে সন্ধ্যাকালে মাটিতে হোগলা পাতে। সেই হোগলার পাটিতে খেতা বিছাইয়া রাইত পার করে। দুই এক বাড়িতে চৌকি আছে। তয়, সেই চৌকিতেও খেতা বিছানি পড়ে রাইতে। নাইলে সারাদিন শূন্য চৌকির উপরে ফেলানো থাকে সেই হোগলার পাটি। এক-দুই বাড়ি ছাড়া অন্য কোনোখানে শীতলপাটি পর্যন্ত নাই।
যুগ-জনম ধইরা অন্য অন্য সগল বাড়িতে এই বন্দোবস্ত। খালি এই বাড়ির সগল ঘরে পালঙ্ক। আবার, পালঙ্কে পালঙ্কে খালি তোশকই পাতা নাই; তোশকের ওপরে বিছানো আছে শীতলপাটি। সেই আরামের বিছানা থুইয়া ইসুফ মিয়ার মায় কোন দুক্ষে পুতেরে সমস্তটা দিন বারিন্দায়, খালি একটা পাটির উপরে শোওয়াইয়া থোয়! হোক শীতলপাটি, কিন্তু পাটি তো!
লোকের কথা শুইন্না মায়ে ভালা-বুরা কিছুই মোখে আনে না। লোকে কেমনে বোজবো মায়ের অন্তরের দর্দ! পুরাটা দিন তো আর পোলার শিথানের কিনারে বহা দিয়া থাকোনের ভাগ্য কইরা আহে নাই পোলার মায়ে। ঘর-গিরস্থালির হাজারটা কামের দিকে তারে নজর দিতে অয়। নানান দিকে লড়াচড়ি করতে অয়। পুবের বড়োঘরের বরাবর হইতাছে রান্ধনঘর। মায়ে অখন রান্ধনঘরের ভিতরেই থাকুক, বা রান্ধনঘরের সামোনের দরোজার মুখে বসাই থাকুক; ইসুফ মিয়ারে দেখতে পাইতে থাকে স্পষ্ট। যখন ইচ্ছা একলৌড়ে তারে একনজর দেইক্ষা যাইতাছে মায়ে, নাইলে একছুটে আইয়া মিছরির শরবতটা খাওয়াইয়া যাইতাছে।
আবার, খোলা জায়গায় থাকোনে সোন্দর শইল্লে বাতাসটা লাগতাছে! এই বাতাস না লাগলে ঘাও নি শুকাইবো জিন্দিগিতে! তাইলে পুতেরে এমনে না রাইক্ষা মায়ে করবো কী! ইসুফ মিয়ায় সারাটা দিন একলা ঘরের ভিতরে পড়া থাকলে মায়ের কইলজা আস্তা থাকবো!
তাও লোকের মোখ য্যান বন্ধ হইতেই চায় না। এক বিষয় নিয়া কথা শেষ হয়, তো আরেক বিষয় নিয়া কওয়াবুলি শুরু কইরা দেয়। গেরামের নানান বাড়ির এয় অরে কইতে থাকে যে, এই বুড়াকালে ইসুফের মায় য্যান পোলার লেইগা বেশি উতলা হইয়া থাকতাছে। কোলের ছাওয়ের লেইগা এমুন বেদিশা অয়, তয় শোভা পায়।
এত্তা বড়ো সিয়ান পোলা! তার রোগবালাই আইছে, আবার যাইবো গা। মায়ে তো করবোই! দুনিয়ারই এই নিয়ম! মায়ে করবো। তয়, ইসুফ মিয়ার মায়ে য্যান বেশি তুলুতুলু করতাছে। বড়ো মাইনষের তামশা এটি! আগে তো তারে কোনোদিন পোলাপাইন নিয়া এমুন ল্যাতা ল্যাতা করতে দেহা যায় নাই। এই বুড়াকালে সেয় অখন জুয়ান মায়ের আদেখলামি জোড়াইছে!
তয়, কেউ কেউ এই কথার পিঠেও কথা তোলা দেয়। এই যে মরমর পুতেরে নিয়া মায়ের এই হরদিশা লড়ালড়ি, এইটা বিনা কারণে না। কে না জানে যে, বিয়ার পরে এই পইল্লা-পরথম ছাওরে দিয়াই সংসারের তাবৎ মাইয়া পরের বাড়িতে তার শক্ত খুঁটিখান গাড়ে। পইল্লা ছাওখান কোলে আহে, না, মায়েরে খুঁটা গাড়োনের শক্তিটা দেয়! সেই কারণে এই পরথম ছাওয়ের দিগে সংসারের সগল মায়ের এমুন দর্দ থাকে! অন্যগিলি যেমুন-তেমুন, পইল্লাটা নয়নের তারা! তাইলে ইসুফ মিয়ার মায়ে ভুল কী করতাছে!
এইসগল কতাও ইসুফ মিয়ার মায়ের কানে আহে! সেয় চক্ষের পানি চক্ষে রাখতে পারে না। ইমাম হুজুরে তারে বুঝ দিয়া কয়, ‘মাগো! আপনে কাইন্দেন না! লোকের মন্দ কতা নিয়া বেজার অন ক্যান! মাইনষে যতো আবি-জাবি কইবো, ততো আপনের পোলার ফাঁড়া কাটতে থাকবো। আপনে খালি আল্লারে ডাকেন। দুরুদ পড়েন গো মা; ঢোক্কে, ঢোক্কে। কতো বড়ো মুসিবত তেনে মাওলায় আপনেরে মুক্তি দিছে!’
মুসিবত কী বলতে মুসিবত! সেইটা এক তুফান ফাঁড়া! আয় ছোবানাল্লা! ঘোর সন্ধ্যাকালে ধোঁকতে ধোঁকতে পুতে বাড়িত আইলো! চোখ লাল কটকট্টা, শইল জ্বরে পুইড়া যাইতাছে! হায় হায় হায়! গেলো ভালা মানুষটা; ফিরা আইলো দম যায় যায় হইয়া! আরও দেহো কী গজব! শীতলা মায়ের দয়া দরদরাইয়া আইয়া দখল নিয়া নিলো পুরা শইলে।
গেরামের লোকে ইসুফ মিয়ার লেইগা ভাবনা করবো কী, নিজেগো কথা চিন্তা কইরাই তারা ধড়ফড়ানি খাইতে থাকে। সগলের মনে হইতে থাকে যে; নাই, কেউরই আর রেহাই নাই! আইয়া পড়ছে শীতলার দয়া! অখন একে একে সগলতেরেই গ্রাস করবো। এই তরাস নিয়া ঘরে ঘরে বেটা-মাতারি প্রতিটা জোনে পইড়া থাকে য্যান মরাকাষ্ঠ। লড়া নাই চড়া নাই; আহার নাই নিদ্রা নাই।
অদিগে, ইসুফ মিয়ার শইলে দেখো দয়ার খই ফোটোনের সীমা থাকে না। এক রাইতের ভিতরে পাওয়ের পাতার তেনে চুলের গোড়া—কোনো জায়গা বাদ নাই; গুটিতে গুটিতে শইল গিজগিজা হইয়া যায়। হায়রে হায়! ইসুফ মিয়ায় বেহুঁশ; তাও কী তার ছটফটানি! আর কী তার গোঙানি-কঁকানি!
সেই ঘুষ-ঘুষা গোঙানি যার কানে যায়, তারই পরান কাঁপোন দিয়া ওঠে। কাঁপতে কাঁপতে আল্লা-রাছুলরে তরি ডাকতে ভুইল্লা যায় একেক জোনে। এমনে এমনে দেওভোগ গেরামের দুই রাইত আর একদিন পার হয়। দুই দিনের দিন দেখা যায় আচরিত বিত্তান্ত! চক্ষু দিয়া দেইক্ষাও বিশ্বাস হয় না—এমুন ঘটনা ঘটা শুরু হয় দেওভোগ গেরামে!
কি? না, দুইদিনের দিন সকালে ধুইম্মা মেঘ নামে। আষাঢ় মাইস্যা ঢলের মতোন মেঘ। এট্টু-আট্টু না! বিশাল তুফাইন্না বিষ্টি! চৈতমাইস্যা দিনে এমুন ঢল আহে কোনখান তেনে! আচানক কাহিনী! বিয়ান পার হয়, দোপোর গড়াইয়া যায়; তাও থামোনের নাম নাই, সেই মেঘের।
বাইরে ঝোঁরে মেঘ, এদিগে মাইনষের নয়নে ঝোঁরে পানি! শুকারিয়ার পানি নামতে থাকে লোকের চক্ষু তেনে। সেই পানিরও থামাথামি নাই। আল্লা! আল্লা! মেঘ দিয়া পাঠাইছো তুমি মাবুদ! তোমার বান্দাগিলিরে রহম দিলা মাবুদ! তুমি মেহেরবান! মাবুদ!
এক ঢলক মেঘ নামলো; না, ওলাবিবি শীতলাবিবি-দোনো বইনের সকল তেজ, সকল শক্তি টুন্ডা-লুলা আর থ্যাতা-ভ্যাতা হইয়া শেষ হইলো।
সেই বিষ্টি শীতলাদেবীর দয়ার তেনে রক্ষা করে দেওভোগ গ্রামরে। সগলতে রেহাই পায়। একলা খালি ইসুফ মিয়ায় তার ভোগ ভোগতে থাকে, দিনের পর দিন।
(চলবে)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১৬)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১৫)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১৪)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১৩)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১২)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১১)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১০)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ৯)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ৮)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (সপ্তম কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (ষষ্ঠ কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (পঞ্চম কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (চতুর্থ কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (তৃতীয় কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (দ্বিতীয় কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (প্রথম কিস্তি)