শাশ্বতকালের বাংলা নাট্যের ধারায় নজরুলের নাটক
কবির হাতের নাটক লেখা হলে নাটকের ভাষা ও চরিত্র বদলে যায়। নাটক তখন শুধু বস্তুগত জীবনের ভাষাচিত্র হয়ে থাকে না, তা হয়ে ওঠে জীবনের কাব্যরূপ। কাজী নজরুল ইসলামও তেমনি যেসব নাটক রচনা করেছেন, তাতে জীবনের হুবহু অনুকরণ ঘটেনি, তা হয়েছে জীবনের ব্যাখ্যা। আর এই ব্যাখ্যা কাব্যের অনুপম ব্যঞ্জনায় সমৃদ্ধ হয়ে জীবনকে প্রতীকায়িত করেছে। নজরুলের নাটকসমগ্র তাই ভিন্নার্থে আলোচনা হওয়া দরকার। অর্থাৎ আমাদের মতে, নজরুলনাট্যের একটি পুনঃপাঠ তৈরি হওয়া প্রয়োজন নতুন কালের নাট্য ভাবনার নিরিখে। আর এ কথা সত্য যে নাটক কিংবা কাব্যের রস আস্বাদন কালনিরপেক্ষ হয়ে ওঠে শাশ্বত কালের আবেদন যখন শিল্পভাবনার তুঙ্গস্পর্শী থাকে। সেদিক থেকে নজরুল বাঙলা নাট্য রচনার ধারায় হাজার বছরের বাঙলা নাট্যের সংগীতময়তাকে আধুনিককালের প্রেক্ষাপটে দাঁড় করাতে পেরেছেন। কারণ নজরুলের নাটকের ভাষা কাব্যগন্ধী বলেই একই সঙ্গে তা শ্রবণ ও দর্শনের আনন্দ হয়ে ওঠে। অর্থাৎ নজরুলের নাটক পাঠ করেও আনন্দ পাওয়া যায় আবার দেখেও আনন্দ পাওয়া যায়। আর এ জন্যই তা দৃশ্যকাব্যের মর্যাদায় অভিষিক্ত।
আধুনিক নাটকের গীতহীনতার মধ্যে নয়, তাঁর নাটককে বিচার করতে হবে হাজার বছরের বাংলা নাট্যের গীতময়তার আলোকে। নজরুল কবি বলেই বাংলা নাট্যের ভেতরের গীত সুধারসের ধারায় প্লাবিত হয়েছে তাঁর নাটক। সুরের এই প্লাবন হয়তো অনেক নাট্য সমালোচকের কাছেই তাঁকে সার্থক নাট্যকার বলে মনে হয়নি। এই নাট্য সমালোচক ও পণ্ডিতদের মানসভাবনায় শেকড় গেড়ে আছে ঔপনিবেশিক শিল্পবোধ। ফলে নজরুলের নাটকে তাঁরা বাংলাদেশের গীত ও নাট্যের প্রাণের স্পন্দনটুকু ধরতে ব্যর্থ হয়েছেন। কারণ তাঁরা বাংলাদেশের হাজার বছরের গেয়মূলক পরিবেশনার খোঁজ রাখতে চান না। দীর্ঘকাল ধরে আসরে গেয় আখ্যান পরিবেশনার মাধ্যমে এ দেশের মানুষ যে তাদের নাট্যরস পিপাসা মিটিয়েছে তা অনুধাবন করার জন্য উপমহাদেশের নন্দনভাবনার সঙ্গে পরিচয় থাকা দরকার। বাঙালির নিজস্ব নাট্যনন্দন ভাবনার আলোকে নজরুলের নাটক বিচার করা হলে ঔপনিবেশিক নাট্যধারার বাইরে নজরুল যে ভিন্ন নাট্যধারার পথিকৃৎ তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আর এর প্রথম ও সার্থক প্রয়োগ করেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর নাটকের আঙ্গিক নির্মাণে। আমরা নজরুলের নাট্য বৈশিষ্ট্য আলোচনার ক্ষেত্রে এই বিষয়টি বিবেচনায় রাখব।
কাজী নজরুল ইসলাম জীবনের শুরুতে জীবিকার তাগিদে যোগ দিয়েছিলেন গ্রাম্য লেটো গানের দলে। লেটো গান পালাভিত্তিক। আসরে গীত ও অভিনয়ের মাধ্যমে পরিবেশিত হতো। লেটো গান বাংলার লোকজীবনের সঙ্গে অঙ্গীকৃত বলেই সহজেই মানুষকে আবিষ্ট করে রাখত। কিশোর বয়সে নজরুলের ভেতরে, সেই যে বাংলাদেশের প্রাণের সুরধারা প্রতিষ্ঠা পেল তা সারাটা জীবন তাঁকে তাড়িয়ে নিয়েছে নব নব সৃজনের সার্থকভুবনে। লেটো গানে পালা রচনার মধ্যদিয়ে নজরুলের নাট্য প্রতিভার যাত্রা শুরু হয়েছে বলেই সুর ও কাব্য তাঁর পরিণত জীবনে লেখা নাট্য থেকে বিসর্জিত হয়নি। এ ক্ষেত্রে আমরা রবীন্দ্রনাথের নাটকের প্রসঙ্গ তুলনা করতে পারি। রবীন্দ্রনাথ তাঁর নাটকের আঙ্গিক নির্মাণে হাত বাড়িয়েছেন বাংলা পালা, পাঁচালি, যাত্রার দিকে। বাংলা নাট্যের সুরকে তিনি সংলাপে গ্রহণ করেছেন, ফলে তাঁর নাটকের সংলাপের ভেতরে গীতময়তা প্রবলভাবে অস্তিমান। বাংলা নাটক যে গান থেকে বিচ্ছিন্ন নয়, তার প্রমাণ মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে লভ্য। চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে আমরা দেখি কবি বলেছেন-
বিশ্রাম দিবস আট শুনহ গীত দেখহ নাট
আসরে করহ অধিষ্ঠান।
এই যে গীত শোনা ও নাট দেখার কথা কবি বলেছেন, তার মধ্যে হাজার বছরের বাংলা নাট্যের স্বরূপ বিধৃত। গীত ও নাটের যুগল বন্ধনে দীর্ঘকাল ধরে চর্চিত হয়েছে বাংলা নাটক। এই ধারার আধুনিক রূপায়ন ঘটিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আর নজরুলের নাটকে তারই প্রতিফলন ঘটেছে। রবীন্দ্রনাথের মতোই সুর ও কাব্যময়তাকে বাঙালির শিল্পভাবনার উৎসের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছেন নজরুল। তাই বলা যায় বালক কবির হাতে রচিত লেটো গানের পালার আধুনিক রূপায়ণ ঘটেছে ‘সেতুবন্ধ’, ‘মধুমালা’ প্রভৃতি নাটক।
নজরুল কাব্যজীবনের শুরুতে, বলা যেতে পারে ১২-১৩ বছর বয়সে বাঙালির সুরপ্রিয়তাকে মূল বিবেচনায় রেখে রচনা করেছিলেন দাতা কর্ণ, সুকণি বধ, চাষার সং, মেঘনাদ বধ, রাজপুত্র, আকবর বাদশা, কবি কালিদাস প্রভৃতি পালা। বিষয়ের দিক থেকেও এসব পালা ছিল বৈচিত্র্যপূর্ণ। এই পালাগানগুলো বালক কবি আসরে সুর, সংলাপ ও অভিনয়ের মাধ্যমে উপস্থাপন করতেন। নজরুলের সংগ্রামী জীবনে কত মানুষই তাঁকে ছেড়ে গেছে কিন্তু সুর তাঁকে ছাড়েনি। তা আরো পরিণত হয়ে উঠেছে। নতুন নতুন নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে কবি তাঁর নাট্যভাবনাকে পরিণতির দিকে নিয়ে গেছেন। নজরুলের নাটক তাই ইউরোপীয় শিল্পাদর্শের নিরিখে নয়, বিচার করতে হবে বাঙালির নাট্যরীতির আদলে যা হাজার বছর ধরে পরিপ্লাবিত করেছে বাঙালির অন্তর। ওই যে শুরুতে বলেছি, নজরুলের নাট্যরচনা যেন কবির হাতে রচিত নাট্যপ্রতিমা। জীবনের সকল পর্যায়ের অভিজ্ঞতাকে ধারণ করেই তা এগিয়ে গেছে শিল্পের অভীষ্টভূমির লক্ষ্যে।
একেবারেই বেঁচে থাকার অবলম্বন হিসেবে কবি যে রেকর্ড নাটিকাগুলো রচনা করেছিলেন, তাতেও সুরের মধ্যদিয়ে শ্রোতার সামনে বহু চিত্রকল্পের সমাহার ঘটিয়েছেন। আর এভাবে গাননির্ভর নাট্য রচনা কবি নজরুলের সমগ্র জীবনের বিচিত্র ভুবনের মধ্য দিয়েই বেড়ে উঠতে থাকে। কবির এ পর্যায়ের রচনাগুলো অপ্রধান হলেও উল্লেখের দাবি রাখে। আজ পর্যন্ত প্রাপ্ত একাঙ্কিকা ও রেকর্ড নাট্যের তালিকার মধ্যে রয়েছে ছিনিমিনি খেলা, খুকী ও কাঠ বেড়ালী, জুজুবুড়ির ভয়, পুতুলের বিয়ে, শ্রীমন্ত, আল্লাহর রহম, কালির কেষ্ট, কানামাছি ভোঁ ভোঁ ও বনের বেদে। এসব রচনাকে আমরা নজরুলের নাট্যরচনার প্রক্রিয়াকাল হিসেবে ধরতে পারি। তাঁর নাট্য রচনার পরিণতি ও সমৃদ্ধি ঘটেছে নাট্যমঞ্চের সঙ্গে কবির সরাসরি সম্পর্কের মধ্যদিয়ে। তিনি এ সময় উপলব্ধি করেছেন যে নাটকের প্রায়োগিক শৈলী কখনই মঞ্চ ব্যতিরেকে শরীরী হয়ে ওঠে না। আর এভাবে কবিকৃত নাটকগুলো বাংলা নাট্যের হাজার বছরের রূপটি অঙ্গীকরণ করে আধুনিক ও পূর্ণাঙ্গ হয়ে উঠেছে।
এ ক্ষেত্রে সংস্কৃত নাট্যের সূত্র অনুযায়ী দৃশ্যকাব্য কথাটি হয়তো নজরুলের বিবেচনাকে ঋদ্ধ করেছিল। কারণ নজরুল শুধু মঞ্চায়নের বিষয়টিকে বড় করে দেখেননি। নাটকের পাঠযোগ্যতাকেও বিবেচনায় রেখেছেন। এ জন্যই দৃশ্যকাব্যের শ্রব্য এবং দর্শনের বিষয়টি নজরুল সাঙ্গীকরণ করেছেন তাঁর নাটকে। তবে দৃশ্য এবং শ্রব্যের এই অদ্বৈত রূপটি তাঁর নাটকে অঙ্গীকৃত হয়েছে বাংলা নাটকের হাজার বছরের সংগীতময়তাকে কেন্দ্রে রেখে। আর ওইখানেই নজরুলের নাটকের শিল্প সফলতা এবং শিল্প মানোচ্চতার ভিত্তিভূমি। বাংলা নাট্যের বিকাশ ও সে সময়ের ধারাবাহিকতায় নজরুলের অবস্থানকে চিহ্নিত করতে গেলে এই শিল্প বোধটিরই পুনঃপাঠ প্রয়োজন।
কাজী নজরুল ইসলামের পূর্ণাঙ্গ নাট্য নিদর্শন হিসেবে আমরা আলেয়া, ঝিলিমিলি, সেতুবন্ধ, শিল্পী, ভুতের ভয়, মধুমালা নাটকের নাম উল্লেখ করব। এগুলোর মধ্যে আবার পাশ্চাত্য ঘরানার শিল্পরীতির বিভাজিত পথটি ধরে অনেকেই কয়েকটি নাটককে প্রতীকী, কিংবা সাংকেতিক ইত্যকার নানা অভিধায় চিহ্নিত করেছেন। আসলে কাজী নজরুল ইসলাম যে সময়ে নাটক রচনায় হাত দিয়েছিলেন, তাঁর পূর্বকাল থেকেই রবীন্দ্রনাট্যের বিকাশ ঘটেছে। ইউরোপীয় শিল্পরীতির আলোকে আলোকিত দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের নাট্যপ্রতিভার স্মরণ ঘটেছে। ফলে নজরুলের নাটক বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে ইউরোপ মনস্ক রূপক সাংকেতিকতার শ্রেণীকরণের ধূম্রজালের বাইরে বেরিয়ে আসতে পারেননি নাট্য সমালোচকরা। যেমন করে নাট্য সমালোচকরা রবীন্দ্রনাট্যের রূপক সাংকেতিকতা বিশ্লেষণ করে থাকেন। অথচ রবীন্দ্রনাথ কিংবা নজরুল ইউরোপীয় রূপক সাংকেতিকতার আদলে কোনো নাটক রচনা করেননি। রূপক কিংবা সাংকেতিকতা মূল অবলম্বন নয়, মূল শিল্পভাবনার বিচ্ছুরণমাত্র। যেমন, ‘মনমাঝি তোর বৈঠা নেরে আমি আর বাইতে পারলাম না’ কথাটির মধ্যে যে রূপক ‘মনরূপ মাঝি’ তার সঙ্গে একটি জনপদের বিস্তৃত জীবনের বহুমাত্রিক চিত্রকল্প উদ্ভাসিত। তা কোনো দুরূহ সংকেতে পর্যবসিত হয়নি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কিংবা কাজী নজরুল ইসলামের নাটক বিচার করলে আমরা দেখব এঁদের নাটকে একেবারেই প্রাচ্য ঘরানার শিল্পতত্ত্বের উত্থান ঘটেছে। নজরুলের আলেয়া, ঝিলিমিলি, শিল্পী ও সেতুবন্ধ নাটকের আলোচনা প্রসঙ্গে দেখব যে রূপক-সাংকেতিকতার ভাবনাটি ইউরোপীয় শিল্পতত্ত্ব থেকে আলাদা হয়ে আমাদের শিল্পভাবনার সঙ্গে অঙ্গীকৃত হয়েছে। এই বিষয়টি নজরুলের নাটকের পুনঃপাঠের ক্ষেত্রে আলোচনার দাবি রাখে।
প্রথমেই নজরুলের আলেয়া নাটক নিয়ে আলোচনা করা যায়। আলেয়া নাটকের বিষয়বস্তু ও নামকরণ দেখেই একে প্রতীক নাটক নামে অভিহিত করা হয়। এই ভাবনাটির মধ্যে নজরুলকে বড় করে দেখার প্রবণতা রয়েছে ঠিক, তবে নজরুলের মহৎ প্রতিভার যথার্থ মূল্যায়ন করা হয়নি। এই নাটকটি সেকালে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল। আলেয়া প্রায়শই গ্রাম্য জনপদের বিরান প্রান্তরে, বিলের ধারে হঠাৎ জ্বলতে দেখা যায়। জ্বলেই আবার হারিয়ে যায় আলেয়া। আলেয়ার মতো নরনারীর চিত্তেও হঠাৎ প্রেমের শিখা জ্বলে ওঠে এবং তা অনির্দেশ্য কোনো বেলাভূমিতে আবার হারিয়ে যায়। এসব বিবেচনায় এটিকে প্রতীকী নাটক হিসেবে গণ্য করা হয়। আমরা এতে মতদ্বৈধ নই। কিন্তু একই সঙ্গে এই নাটকের গীতি প্রাবল্য দেখে গীতিনাট্য নামে অভিহিত করলেই আমাদের মধ্যে দ্বিধা তৈরি হয়। গীতের আধিক্য গীতিনাট্য হলে বাংলাদেশের হাজার বছরের আসরে পরিবেশনামূলক গেয় কাব্যের অভিনয় রূপটি মিছে হয়ে যায়। কারণ হাজার বছরের বাংলা নাট্যের প্রাণটি লুকিয়ে রয়েছে গীতের শরীরে। তাই গীতিনাটক নয়, তা বাঙালির হাজার বছরের নাট্যরীতি। নজরুলের আলেয়া তাই গীতিনাটক নয়, পরিপূর্ণ নাটক। গীত তার অবলম্বন, যেমন শরীরকে অবলম্বন করে থাকে আত্মা। নাটকের গঠন কাঠামোর মধ্যেই আলেয়া নাটকের সংগীত প্রোথিত বলে তা নাট্যের বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল।
আলেয়া নাটকের গল্পটি প্রেমমূলক আখ্যানকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। এই নাটকের নায়িকা জয়ন্তীর প্রেম ব্যাকুলতা, সিদ্ধান্তহীনতা এবং আবেগের তীব্রতা শেষ পর্যন্ত ঘটনায় ট্রাজিক আবহ তৈরি করেছে। জয়ন্তী, মীনকেতু এবং উগ্রাদিত্যের ত্রিভুজ প্রণয়কাহিনী নাটকের প্লটকে পরিণামমুখী করেছে। কিন্তু জয়শন্তী আসলে কাকে ভালোবাসে তা নিরূপণ করার আর সুযোগ ঘটে না। এ যেন রবীন্দ্রনাথের মায়ার খেলা নাটকের প্রতিধ্বনি। তবে গল্পের জটিলতা ও নাট্যের তীব্র গতিবেগের কারণে এটি স্বতন্ত্র ও অনবদ্য হয়ে ওঠে। আলেয়া তাই গীতের বন্ধনে নাটক কিন্তু গীতিনাট্য কখনো নয়। আলেয়া নাটকের সংলাপ রচিত হয়েছে গীত ও কাব্যের দ্বৈত বন্ধনে। এ তো কবির রচিত নাটক, জীবনের বিচিত্র আকুলতা যেখানে একীভূত হয়েছে সুরের ধারায়। নাট্যের বস্তুনিষ্ঠতা রয়েছে এতে কিন্তু কবি বলেই কল্পনার অবাধ প্রবহমানতায় বস্তুনিষ্ঠতার ক্লিশে মোড়কটি ছিন্ন করে নাট্য চরিত্রের জীবন সংলগ্নতার কাব্যভাষাকে নির্মাণ করেছেন নাটকে। শুধু এই নাটকেই নয়, নজরুলের সকল নাটকেই গীতরস নাট্যরস নিষ্পত্তিতে সহায়ক হয়েছে।
বাস্তবতা ও কল্পনার মিশেলে লেখা নজরুলের আরেকটি নাটক ঝিলিমিলি। বাস্তবজীবনের প্রেম ও বিরহকে কেন্দ্র করে এই নাটকটি লেখা হয়েছে। নজরুল যতই রোমান্টিক কিংবা বাস্তববুদ্ধি বিবর্জিত হোন না কেন ঝিলিমিলি নাটকের প্রেম পরাস্ত হয়েছে প্রখর বাস্তবতার কাছে। পিতার বাস্তব বুদ্ধিও যৌক্তিকতায় ফিরোজা এবং হাবিবের প্রেম পরিণতি পায় না। ফলে নজরুলের নাটকে বাস্তবতার ঘাত-প্রতিঘাত একেবারেই নেই যাঁরা বলেন, তাঁরা কবির প্রতি বড় একটা সুবিচার করেন না। বাস্তবতার মধ্যদিয়ে গড়ে ওঠা ঝিলিমিলি নাটকের কাহিনীতে যন্ত্রণা ও চেয়ে না পাওয়ার একটি তীব্র বেদনাবোধের বাণীচিত্র আমরা দেখতে পাই। হাবিব, ফিরোজা ও ফিরোজার পিতা মির্জা সাহেবের অবস্থান থেকে নাট্য ঘটনা ও চরিত্র বিচার করলে দেখব বাস্তবতাকে নিয়েই গড়ে উঠেছে নাটকটির গল্পের ভুবন। কিন্তু দুঃসহ বেদনাময় পরিসমাপ্তি নাটকটিকে দিয়েছে কাব্যিক পরিব্যাপ্তি। বাস্তব প্রেমের আখ্যানের ভেতর দিয়ে এই নাটকে জীবনের সূক্ষ্ম অনুভূতি অনুরণিত হয়েছে। এই নাটকের দ্বিতীয় দৃশ্যে যেভাবে ফিরোজার না পাওয়ার যন্ত্রণাকে তার কল্পনার ভুবনে শোভন ও সুন্দর করে চিত্রিত করা হয়েছে তা এককথায় অনুপম। একে রূপক বলা যেতে পারে এই অর্থে যে তা প্রাচ্য শিল্পভাবনাজাত জীবনেরই ব্যাখ্যা, পাশ্চাত্যের ঘটনা-সংঘাতের অন্ধ অনুকরণ নয়। তাই যাঁরা বাংলা নাট্যের মূল প্রণোদনাকে উপলব্ধি না করে এটিকে গীতিনাট্য বলতে চান, তাঁদের ঔপনিবেশিক মানসিকতাপুষ্ট শিল্পবিচারের প্রতি বড়জোর করুণা করা যায়, প্রশংসা নয়।
নজরুলের মধুমালা দৃশ্য ও কাব্যের সংমিশ্রণে গঠিত বলে এটি সত্যিকার অর্থেই দৃশ্যকাব্য। গীত ও সংলাপের মধ্যদিয়ে এই নাটকের চরিত্রগুলো ক্রমাগত গঠিত হয়েছে। রূপকথা কিংবা ঐতিহ্যের ভেতরে থেকেই নাট্যচরিত্র ও নাট্য ঘটনা আমাদের মস্তিষ্কের কোষে কোষে ঐতিহ্যের আধুনিক ও বিশ্বাসযোগ্য নাট্য নির্মিতি সম্পন্ন করে। রূপকথার আদলে থেকেই তিনি রূপকথাকে ভেঙেছেন। মধুমালাকে আদি সৌন্দর্য বিবেচনা করে তাকে মদনকুমারের ঘর গেরস্থালির ক্লিশে প্রাত্যহিকতায় প্রতিষ্ঠা করেননি। মধুমালা শেষ পর্যন্ত সমুদ্রের অতলে তলিয়ে যায়। নজরুলের এই শিল্পভাবনাটি তাঁকে একজন মহৎ ও পরিমিতিবোধসম্পন্ন নাট্যকার করে তুলেছে। সমগ্র নাটকটি পালার আদলে রচিত হলেও আধুনিক শিল্পবোধ নাটকটিকে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে।
কাজী নজরুল ইসলামকে একশ্রেণির সাহিত্য সমালোচকরা অতিমাত্রায় মুসলমান কবি হিসেবে দেখানোর প্রয়াস পেয়েছেন। মানবধর্মী বাঙালির শিল্পধারার উত্তরাধিকার হিসেবে তাঁকে কমই দেখানো হয়েছে। নজরুল আসলে সাম্যের কবি, মানবতার কবি, মানুষের কবি। শুধু মুসলমান কবি বলে তাঁকে বড় করে দেখানোর কোনো মানে নেই। বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিদ্রোহী কবি নামে পরিচিত। নজরুলের এই বিদ্রোহে যা কিছু অন্যায়, যা কিছু অসুন্দর তার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ উচ্চারিত হয়েছে। তবু বিদ্রোহী কবি বলে তাঁকে অনেকটা খণ্ডিত করে উপস্থাপন করা হয়। নজরুলের সমগ্র কাব্য বিচার করলে দেখা যায়, তিনি এমন এক মহত্তম অনুভবের কথা তাঁর কবিতায় ব্যক্ত করেছেন যে তা কোনো গণ্ডীর ভেতরে আবদ্ধ থাকে না, সর্বমানবধর্মে পরিব্যাপ্ত থাকে। কবির এই সর্বমানবিকতাবোধ থেকেই বিদ্রোহী কবিসত্তার উদ্ভব। নতুন চাঁদ কাব্যগ্রন্থের ‘অভেদম’ কবিতায় তিনি এ কথাটি স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন-
মোর বিদ্রোহ সাম্য সৃষ্টি, নাই সেথা ভেদ নাই
শ্রেণিবৈষম্য, নিপীড়ন, বঞ্চনা, বিভেদ প্রভৃতি শব্দগুলো কবিকে নিয়ত তাড়িত করেছে। মানুষের প্রতি গভীর ভালোবাসায় নিবেদিত কবির যন্ত্রণাক্ষুব্ধ চিত্তের ক্রন্দনধ্বনি কবিতার পঙক্তি হয়ে নামে। আর এভাবেই মানবতার কবি, জীবনের কবি মানবজীবনের নিপীড়ন ও বঞ্চনার প্রতিবাদে যে বিদ্রোহের বাণী উচ্চারণ করেন তা সাম্যের কবিতা হয়ে ওঠে।
কবি হিসেবে তাঁর মূল্যায়নে যেমন ধর্মীয় পরিচয়টা অনেকেই প্রথম নিয়ে আসতে চান, অন্যদিকে নাট্যকার হিসেবে তাঁর মূল্যায়নের সময় অধিকাংশ সমালোচক আধুনিকতার দোহাই দিয়ে তাঁকে আড়ালে রাখতে চান। তিনি কোনোভাবেই আধুনিক নাট্যকার নন এমন ধারণার বশবর্তী হয়ে তাঁর নাটকের আলোচনা তেমন একটা করেন না অনেক সমালোচক। অনেকেই আবার নজরুলের নাটক মূল্যায়নের ক্ষেত্রে উত্তর তিরিশের মুসলমান নাট্যকারদের প্রেরণার উৎসরূপে বিবেচনা করেছেন। এই মূল্যায়ন কোনোভাবেই উনিশ শতকের বাংলা নাট্যধারার প্রেক্ষাপটে করা হয়নি বলে নজরুল খণ্ডিতভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। নজরুলের নাটক বিচার করতে হবে হাজার বছরের নৃত্য-গীত ও কাব্যময় বাংলা নাট্যের প্রেক্ষাপটে। উনিশ শতকের ইওরোপীয় ক্লিশে নাট্যধারার অনুকৃতির বদলে নজরুলের নাটকের গীতবহুলতা তাঁকে স্বতন্ত্র করেছে। সে ক্ষেত্রে বাংলা নাট্যধারায় কাজী নজরুল ইসলাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উত্তরসূরি। নজরুল হাজার বছরের আখ্যানধর্মী বাংলা নাট্যের সুর ও কাব্যভাষাকেই অন্বিষ্ট ভেবেছেন ঐতিহ্যের অনুপ্রেরণায়। আর এভাবেই তিনি হয়ে উঠেছেন আধুনিক নাট্যকার, যাঁর শিল্পের শেকড় প্রোথিত বাঙালির গীত ও নাটের কোমল জমিনে। কাজী নজরুল ইসলামের নাটক বিশ্লেষণে এই শিল্প বিবেচনাটি আজকের প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।