সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন
যেমতে একখানা স্রোত অন্য স্রোতে মিশে !
সেইবার জষ্ঠিমাসের শেষাশেষি ইসুফ মিয়াগো কালা গাইটায় বিয়ানি দেয়। বিয়ানির পর পরের পাঁচদিনের দুধের উপরে মাইনষের কোনো হক নাই। সেই পাঁচদিনের দুধ হইলো বাছুরের ধন। যার ধন তারে তার তেনে বঞ্চিত করলে, গজবের তলে পড়তে হয়! এই কথা দেওভোগের সর্বলোকে মান্যি করে। ইসুফ মিয়ার মায়ে পাঁচদিন গাইয়ের কাছে-ধারেও যাইতে দেয় না কেউরে।
কয়, ‘আগে বাছুরে খাইয়া আছুদা হইয়া লউক, হেইরপর মাইনষের মোখে ওঠবো গাইয়ের দুধ! পাঁচদিন পরে অই দুধে মাইনষেরও হক হইবো। এইমতে পাঁচদিন যায়। তার পরে দুধ দোওয়াইয়া মাইপ্পা দেখা যায় যে, দুধ পাওয়া গেছে সোওয়া তিন সের। ঘরের সগলতে বোঝে, গাইটা সাক্ষাৎ লক্ষ্মী! পইল্লা বিয়ানেই এতাটি দুধ দিতাছে! আট্টু বাত্তি হইলে তো উয়ে চাইর সের পাঁচ সের দুধ দিবো!
ইসুফ মিয়ায় কয়, ‘মাগো পায়েস রান্ধো।’ ‘আয় হায়!’ মায়ে তরাতরি নিষেধ দিয়া ওঠে, ‘অহনই এমুন ফরমাইশ করিস না বাজান!’ ক্যান করবো না? মায়ে তখন ভাইঙ্গা কয় ভেদের কথাখান, ‘দিয়া খাইতে অয় বাবা! গাইয়ের দুধ, গাছের জিনিস—এটি হইলো আল্লার দান! দশজোনরে না দিয়া নিজেগো পাতে নিতে নাই। আগে গেরামের সগল ঘরে দিয়া লই! হেইর পরে তোমরাই ত্তো খাইবা!’
তোমার খালি আজাইরা কতা মা! পুতে চেত করে। মায় সেইদিগে গেরাজ্জি করে না।
‘এই কয়টা দিন খালি এক পোওয়া দুধ তগো বাপের লেইগা রাখমু। আর বাদবাকি দুধ আগে যাইবো পাড়াপড়শীগো বাইত। একদিনে সব ঘরে দেওন যাইবো না। অখন, যেয় কয়দিন লাগে, সেই কয়দিন গেরামের সগলতের বাইত দিয়া; তবে ঘরের পোলাপাইনের পাতে যাইবো দুধ।’
ইসুফ মিয়ায় জানে, সংসারে মায়ের কথার উপরে কথা নাইক্কা। বাপের কথাও শেষ কথা; তয় পারতে পোলাপাইনের লগে শেষ কথা কওয়ার দিগে যায় না তাগো বাপে। সব কথা মায়েরে দিয়া কওয়ায়। মায়েরে দিয়াই ফায়সালা দিয়া দেয়। সংসারের কোনোপ্রকার হাবিজাবিতে সেয় থাকেই না। গদির কাম-কাইজ নিয়া তার বোলে দম ফালানের ফুরসত নাই!
ঘরের সব পোলাপাইনেই বোঝে যে, এক মাসের আগে আর নিজ গাইয়ের দুধ তাগে পাতে পাওনের কোনো আশা নাই। মায় সেই কথা শুইন্না কয়; আল্লায় যখন কিসমতে লেখবো, তহনই খাবি! তারপর আর সবটি ভাই-বইনের মতোন ইসুফ মিয়ায়ও গাইয়ের দুধের বিষয়খান ভুইল্লা যায়।
কিন্তুক, কপালের কী ফের! আবার তারে সেই বিষয়খানে গিয়া পড়তে হয়। পড়তে হয় দুইদিনের মাথায়। সেইদিন সকালে, বেইল খালি এট্টু উঠছে; মায় তারে ডাক দিয়া কয়, ‘যা দেহি বাজান! এই দুধটুক এক বাইত দিয়া আয় গা!’
হুকুম শুইন্না ফাত কইরা গইরজা ওঠে ইসুফ মিয়ায়। কী! সেয় একটা জুয়ান পোলা, ষোল বচ্ছর বয়স তার। বাপের হুকুমে সেয় প্রায় প্রায় কয়দিন ধইরা গদির কামে তরি যাওয়া ধরছে! তারে মায় এইটা কেমুন ফরমাইশ দেয়! দুধের লোটা হাতে কইরা সেয় যাইবো মাইনষের বাইত! জিন্দিগিতেও এই কাম করবো না ইসুফ মিয়ায়! বাইত আর মানুষ নাই! তারা যাউক।
মায় কয়, একেক পোলাপানরে দিয়া একেক বাড়িতে দুধ পাঠাইছে মায়ে। সেইগিলি গেছে কোন সকালে, কিন্তুক একটায়ও অহন তরি বাড়িত আওনের নামও নিতাছে না! এদিগে, এক বাড়িতে অখনও দুধ পাঠানি বাকি।
এই কথা কইতে কইতে মায়ে নিজ কপালেরে দুষতে থাকে; এইই নি আছিলো তার অদিষ্টে! মায়ের দুক্ষু বোজোনের কেউ নাই সংসারে! এই যে, যেমুনকার কলসীভরা দুধ তেমুন পইড়া রইছে পুরাটা সকাল ধইরা! এর গতি করোনের কোনো উপায়নি ছাই-কপাইল্লা মায়ের আছে! একটা কেউরে দেহে না মায়ে, যারে সেয় পাঠায় দুধটি দিয়া! কোন বিয়ানে দোয়ানি হইছে এই দুধ! আর তো তারে জ্বাল না দিয়া রাখোন যায় না। অন্য পোলাপাইনের ফিরতির আশায় বইয়া থাকলে দুধটিরে নষ্ট করোন লাগে। নষ্ট হইবো একজোনের কিছমত এমনে, চক্ষের সামোনে! মা-র দর্দ করোনের কেউই নাই তাইলে দুনিয়ায়! মিছাই তাইলে ঝি-পুত জনম দেওন!
এমুন কথার-ছোলা যখন মায়ে ছাড়া শুরু করে, তহন দৌড়ের উপরে না থাইক্কা পারে পোলাপাইনে! পারে না। সেই কারণে ভিতরে গোস্বা নিয়া ইসুফ মিয়ায় ঘ্যাঙ্গাইতে ঘ্যাঙ্গাইতে কয়, ‘দেও তোমার দুধ। কও আলা, কাগো বাইত যাওন লাগবো।’
মায় তরাতরি দুধভরা ছোটো মাটির কলসিখান পুতের হাতে দিয়া কয়, ‘আল্লায় তোমারে বাঁছাইয়া রাহুক, বাজান! যাও, এক লৌড়ে দিয়া আহো গা জুলেখা গো বাইত! তয় কলসিখান কইলাম থুইয়া আহিস না!’
ইসুফ মিয়ায় দুধের কলসি হাতে সেই বাড়িতে গিয়া দেখে জুলেখার-মায় ঘর লেপে। তার দোনো হাতে পেঁক-পানি। এই হাত ধুইয়া, পেঁক সাফা কইরা দুধ ঢালতে যাওন এক বিরাট হুজ্জোতের কর্ম। সেয় তাইলে কলসিটা আজাইর কইরা দেয় কেমনে!
ক্যান চাচি! জুলেখায় ঢাইল্লা নেউক! ইসুফ মিয়ায় বুদ্ধি দেয়। কিন্তু জুলি তো ঘরে নাই। সেয় আছে ঘাটলায়। বড়শি নিয়া বইছে। এই ভিতর বাড়ির তেনে ডাকলে কী তার কানে যাইবো! জুলেখার মায়ে দোনোমোনো করতে করতে কয়। তার ইচ্ছা পোলাটারে কয় যে, যাও না বাজান; অরে ডাক দিয়া আনো। কিন্তু এই ফরমাইশ দিতে তার শরম লাগতে থাকে। জীবনে না বরষে! এই পরত্থম ইসুফ মিয়ায় এই বাইত আইছে। কেমনে তারে এই হুকুমখান দেয় চাচিয়ে!
তয়, পোলাটার বড়ো বুঝ! আপনা তেনেই দেখো উয়ে মোনের কথাখান তুরুত ধইরা ফালায় ! সেয় কয়; ‘আমি অরে ডাক দিয়া আনতাছি চাচি! আপনের হাত ধুইয়া কাম নাই।’
ঘাটলায় যায় ইসুফ মিয়ায়। গিয়া সেয় জুলেখারে ডাকবো কী, সেয় কিনা জুলেখার কিরতি দেইক্ষা বাক্যিহারা হইয়া যায়। কারবারটা দেখছো! ঢেঁপের খইয়ে মাছ ধরতে বইছে, না আজাইরা এক তামশার কাম করতাছে! মাছ ধরোনের নামে এক আচানক কারবার করতাছে উয়ে। কি? না, বড়শিতে আধার এই গাঁথতাছে, এই বড়শি পানিতে দিতাছে, ফাৎনা টান খাইতাছে কী খাইতাছে না—তক্ষণ তক্ষণ হুড়ুম কইরা টান দিয়া তোলতাছে বড়শি, উপরে। বড়শি খালি। বড়শির আগায় আধারও নাই; মাছও নাই। আধারখান টুক কইরা খাইয়া যাইতাছে গা মাছে, কিন্তু বড়শিতে গাঁথতাছে না।
গাঁথবো কেমনে! বড়শির আগায় আধার লাগানের বিধিনিয়ম তো আছে কিছু। এই বাড়ির আহ্লাদি তো তার কিছুই পালনি করতাছে না! পিছন তেনে কতখোন কারবারখানা খাড়াইয়া খাড়াইয়া দেখে ইসুফ মিয়ায়। দেখছো কেমুন বেকুব এই ছেড়ি! আরে, কায়দা মতোন আধারটা গাঁথবি তো বড়শিতে! আধারখান ঠিকমতোন লাগলো কী লাগলো না—এইটুক যেয় ধরতে পারে না, সেয় ধরতে বইছে মাছ! হেগো বাড়ির জুলেখায় তো দেহি পুরা আকামের ঢেঁকি হইয়া রইছে!
‘অই, তুই এটি কি করতাছোস? এমনে মাছ ধরে?’ জিগানি দিতে দিতে ইসুফ মিয়ায় গিয়া জুলেখার পাশে মাটিতে লেট দিয়া বয়। ‘এটি কোন পদের মাছ-ধরা?’ ইসুফ মিয়ায় জিগায়। এমুন আঁতকা ইসুফ মিয়াভাইরে নিজেগো বাড়ির ঘাটলায় দেইক্ষা জুলেখায় শরমে আর ডরে লৌড় দেওনের জোগার ধরে। হেয় তো কোনোসোম জুলিগো বাইত আহে না! অহন কেমনে আইলো! আর, তারে তো জুলি দেহেও নাই বহুতদিন!
বহুত দিন ইসুফ মিয়াভাইরে কোনোদিগে চক্ষে পড়ে নাই জুলেখার। আগে ছোটোকালে, দূরের তেনে দেখছে তারে জুলি। আর আর সগলতের লগে ছোটোকালে সেয়ও জুলিরে ঢেঁপের খই কইয়া চেতানি দিছে কতো! কিন্তুক কোনোদিন তো অর লগে কতা কয় নাই! আগে মিয়াভাইয়ে দেখতে আছিলো এই টিঙটিঙা! অহন সেয় কেমুন বড়ো মাইনষের লাহান অইয়া গেছে!
এতোসব কথা এক ঝলকের মধ্যে মোনে আসে জুলির, আবার সেই এক ঝলকের মধ্যেই সেয় লৌড় দেওনের লেইগাও ধুছমুছ ওঠা ধরে। ‘অই! লৌড় দিতাছস ক্যান? আমি তরে কিছু কইছি?’ ইসুফ মিয়ায় তিতা মোখে জিগায়, ‘লৌড় দিলে তরে মাছ ধরা শিখামু কেমনে?’
জুলি শরমে কাচুমাচু হইতে হইতে আবার বয়। এইবার সে বয়, না, য্যান কুঁকড়ানি দিয়া একটা পুঁটলির হইয়া পইড়া থাকে। দেখো তো! কী শনির দশা! কই থেইক্কা আঁতকা আইয়া ওঠছে কে! জুলিরে বোলে মাছ ধরা হিগাইবো! জুলির শরম লাগে না!
জুলি এদিগে শরমে খাবিজাবি খাইতে থাকে, অদিগে ইসুফ মিয়ার দেখো সেই বিষয় নজরেও আসে না। তার নজর পইড়া থাকে জুলির কিরতি-কলাপের দিগে। এই ছেড়িয়ে কী এইটা! ছিপ তরি ঠিকমতোন ফালাইতে পারে না! কিন্তুক মাছ ধরোনের বাসনাটা আছে ষোল্ল আনা!
দেওভোগ গেরামে এমুন একটা মাইয়া পাওন যাইবো না, যেয় এই কাম পারে না! চোখ বুইজ্জা এই কাম করতে পারে অন্য সগল মাইয়ায়। আর, এদিগে কেমুন আকাইম্মা হইয়া রইছে এই বাড়ির এই ছেড়ি! সাধে পোলাপাইনে অরে ঢেঁপের খই কইছে! এমুনই ঢেঁপের খই, ঢেঁকির ঢেঁকি এইটায় যে; বড়শি দিয়া পুঁটি মাছরে ধরোনের কায়দা তরি জানে না ! আকাইম্মা কেউরে ইসুফ মিয়ায় দুইচক্ষে দেখতে পারে না। আউজকা অরে সেয় শিখানি দিয়া যাইবোই যাইবো। মোনে মোনে ছেড়িটারে ধুম গাইল পাড়তে থাকে ইসুফ মিয়ায়।
কিন্তু মোখে কয়, ‘নে ধর!’ ছিপ নিজ হাতে ধইরা রাইক্ষা সেয় বড়শিখান বাড়াইয়া দেয় জুলেখার দিগে। লগে বাড়াইয়া দেয় এক টুকরা আধার। তারপর ছন্দে বন্ধে সেই আধার পোক্ত মতোন বড়শিতে বিন্ধাইতে শিখানি দিতে থাকে সেয় জুলিরে। পইল্লাবার শরমাইয়া দিশাহার জুলি আধার গাঁথবো কী, চক্ষেই আন্ধার দেখতে থাকে! ‘আরে ছেড়ি!’ ইসুফ মিয়াভাইয়ে খেঁজী দেয়; ‘যেমনে কই, করবি তো!’ জুলি কাঁপা হাতে আবার করা শুরু করে। পারে না। হইতে চায় না।
ইসুফ মিয়ার কেমুন রোখ যে চাপে! আধার বোলে এই ছেড়ি বড়শিতে গাঁথতে পারবো না! এইটা কেমুন কুয়ারার কতা! এইটা আবার না পারে কেমনে! ‘আয়, নে; আমি দেহাইয়া দিতাছি !’ ইসুফ মিয়ায় জুলির আঙুলে ধইরা বড়শির আগায় আধার গাঁথানি শিখাইতে থাকে। একবার, দুইবার, পাঁচবার। ক্রমে জুলেখার শরমটা কাটে। মিয়াভাইয়ে যেমনে কইতে থাকে, সেয় তেমনে তেমনে করতে থাকে।
তারপর মিয়াভাইয়ের হুকুম মতোন ছিপ ফালায় জুলি। ‘আমি লগে বইয়া থাকলাম; কিন্তুক ধরবি তুই। আমি কইলাম কিচ্ছু দেহামু না আর!’ মিয়াভাইয়ে স্পষ্ট কইয়া দেয়। জুলির আবার কাঁপুনি লাগা ধরে। কয়, ‘আউজকা থাউক মিয়াভাই?’
‘ইট্টুও না!’ মিয়াভাইয়ে জব দেয়; ‘অক্ষণ কর।’
জুলি ডরে-শরমে কোনোমতে ছিপ ফালায়, বেদিশা হইয়া চাইয়া থাকে ফাৎনার দিগে। আর ইসুফ মিয়াভাইয়ে তারে একের পর এক হুকুম দিতে থাকে। কইতে থাকে; এমনে কর, অমনে নে।
এই করতে করতে করতে কোনসময় যে মিয়াভাইয়ের ছিপ-ফালানি দেওনের হুকুমরে জুলির ভালা লাগতে থাকে, সেয় বোঝতে পারে না। অনেক অনেক ভালা লাগতে থাকে। অনেক ভালা। মোনে হইতে থাকে মিয়াভাইয়ে যুদি এমুন রোজ আইতো অগো বাইত! ইট্টু খালি আইতো! জুলিরে শিখানি দিতো এই সেই! নাইলে, খালি আইয়া এই পুষ্কুণীর পাড়ে এট্টু বইয়া যাইতো জুলির লগে। তাইলে, জুলির মাছ ধরতে কেমুন ভালা যে লাগতো! এই আজকার মতোন ভালা!
দশ বছরের মাইয়া কিনা জুলেখায়, তার বুঝ-বুদ্ধি বলতে পাকে নাই! মা-বাপ ছাড়া অন্য মাইনষের লগে মোখ খোলার কোনো অবস্থা তার আসেই না প্রায়! আর, মুরুব্বি কেউর সামোনে তার মায়ে তারে মোখ খোলতে দিলে তো! সবখানে সেয় থাকে চুপচাপ বোবা মোখে। সেই কামটাই জুলেখায় ভালা পারে। কিন্তু যেই আপনা তেনে মোখ খুইল্লা কথা চালাইতে যায়, তখন কেমনে যে তার কথাবার্তা আগামাথা ছাড়া হইয়া যায় প্রায় প্রায়; সে ধরতে পারে না! মায়ে সেইটা খেয়াল যে করে নাই, তা না। করছে। আর, শুধরানি দেওনের চেষ্টাও চালাইতাছে মায়ে। তয়, শুধরানির কোনো নমুনা তখনও মায়ের নজরে আসতাছিলো না। এমুন কালেই কিনা ইসুফ মিয়ার আসা পড়ছে জুলি গো বাইত।
মিয়াভাইয়ের হুকুম মান্যি কইরা ছিপ ফালানি দিতে দিতে, জুলেখায় করে কী, ফস কইরা অন্তরের একখান কথা মিয়াভাইরে কইয়া ফালায়। কয়, ‘মিয়াভাই, আপনে আবার আইয়েন? রোজ রোজ আইয়েন, আমারে মাছ-ধরানি দেহাইয়া দিতে? আইয়েন?’ জীবনে যেয় কিনা তাগো বাড়িতে কোনোদিন আসে নাই, তারে যে এমুন আন্ধা-গোন্ধা মিন্নতিখান করোন যায় না; এই বুঝখান অন্তরে নাই বইল্লাই জুলেখায় হড়বড়াইয়া কথাটা কইয়া ফালায়।
ওদিগে মাথা-আউলা ছেড়ির বুদ্ধির দশাখান দেইক্ষা ইসুফ মিয়ায় তবদা খাইয়া যায়! ইসুফ মিয়ায় বোলে আইয়া বইয়া থাকবো অরে মাছ-ধরানি শিখানের লেইগা! কী কয় এটি! ষোল বচ্ছরের জুয়ানপোলা সেয়! দুনিয়াতে ইসুফ মিয়ার আর কাম কাইজ নাই! যাওনের জায়গা নাই? ভালামানষি কইরা এই যে একদিন দেখানি দিছে, এইইত্তো অর কোন কপালের ভাগ্যি! এই ছেড়ি তো হুদা বুদ্ধিনাশা দেহি!
তয়, এই আক্কলমন্দ ছেড়িরে এতো কথা বুঝায় কে! মোনের কথা মোনে রাইক্ষা ইসুফে মোখে কয়, ‘হ গো জুলি, তুই বহুত বুজের কতা কইছস! দুনিয়ার সগল কিছু ফালাইয়া থুইয়া তো অহন আমারে মাছ-ধরানি শিগানের কামেই নামোন লাগবো দেহা যাইতাছে!’
কথাখানের ভিতরের বিষয়টা ভালামতোন ধরতেই পারে না জুলেখায়। তয়, কতাটা কওনের সোমে মিয়াভাইয়ের গলা যে কেমুন শোনা যাইতাছিলো, এইটা সেয় ধরতে পারে। তার মোনে হইতে থাকে যে, মিয়াভাইয়ের গলা য্যান তারে ভেঙ্গাইতাছিলো! য্যান বিজলাইতাছিলো তারে! তাইলে তো মোনে অয় সেয় কোনো ভুল কথা কইয়া ফালাইছে মিয়াভাইরে! মিয়াভাইয়ে তাইলে গোস্বা হইছে তার উপর!
ক্যান গোস্বা হইলো! জুলি নি মিয়াভাইরে মন্দ-ছন্দ কইতে পারে! সেয় এই পইল্লা আইছে! জুলির দি কতো ভালা লাগতাছে! কেমুন ভালা লাগতাছে! মিয়াভাইয়ে তার দোষ নিলো! ক্যান দোষ নিলো!
ইসুফ মিয়ায় দেখে, জুলির হাতের ছিপ হাতে ধরা; ওদিগে ফাৎনায় ধুম টান পড়তাছে, কিন্তু জুলির চোখ সেইদিগে নাই। উয়ে ঘাড় নিচা কইরা চোখ নামাইয়া বইয়া রইছে তো রইছেই। আরে অই ছেড়ি! বড়শি তোলোস না ক্যান? ইসুফ মিয়ায় ঝাড়ি দেয়। জুলেখার ঘাড় যেমুন নামাইন্না, তেমুন নামাইন্নাই থাকে। মাথা তোলে না সেয়।
ঘটনা কী! ইসুফ মিয়ায় তাজ্জব হইয়া যায়। এই ছেড়ির চলাচলতির তো কোনো আগামাথা নাই! জুলিরে ডাকা বন্ধ কইরা সেয় অর দিগে ভালা মতোন নজর ফালায়। তখন সেয় দেখে যে, জুলেখার চোখ থেইক্কা পানি ঝরতাছে ঠপ্পর ঠপ্পর। ‘ওম্মা! কি রে, কান্দস ক্যান তুই!’ ইসুফে পুরা বেকুব হইয়া যায়, ‘আমি তো তরে বকি নাই, জুলি!’
‘কিন্তুক, আপনে আমার কতার দোষ পাইছেন! মিয়াভাই। হগলতে খালি আমার দোষ পায়। আমি ইচ্ছা কইরা দোষ করি নাইক্কা ! সত্য কইলাম। আমি এমুন করি নাই!’ জুলেখায় ফোঁপানি দিতে দিতে কোনো মতে কয়।
‘কেমুন আচরিত স্বভাবের মাইয়া উয়ে!’ মোনে মোনে নিজের লগে বুঝ-বাঝ করার কালে এই কথা নিজের ভিতরে আসে ইসুফ মিয়ার; ‘এমুন মাথা-পাগলা কিসিমের ক্যান জুলেখায়!’
‘তুই এমনে কান্দতে থাকলে চাচি আইয়া আমারে বকবো না? কইবো না, তুমি আমার মাইয়ারে কি করছো? তুই আমারে চাচির গাইল খাওয়াইতে চাস? আমি তো তরে বকি নাই জুলি!’
জুলি লগে লগে চোখ মোছা দিয়া মোখ তোলে। কয়, ‘মিয়াভাই দেহেন তো ছিপখান বাও মতোন ধরা হইছে নি? হইছে?’ কইতে কইতে জুলেখার মোখ খুশিতে চিকচিকাইতে থাকে।
ইসুফ মিয়ায় কতখোন থতমত মোখে জুলিরে দেখে। দেখো এই কান্দতাছে এই হাসতাছে! কেমুন উয়ে! তয় মোনের সেই কথা মোনে থুইয়া সেয় আবার জুলেখারে একে একে নানান কিছু বুঝানি দেওয়া শুরু করে।। মিয়াভাইয়ের দিতে থাকা সেই বুঝ মতোন জুলি ছিপ ফালানি দেয়, আধার গাঁথে, বড়শি তোলে।
এই সেই করতে থাকে, করতেই থাকে। খুব খুশি হালে, জান-পরান দিয়া করতে থাকে। জুলির সেই ছিপ ফালানি, ছিপ তোলানি দেখতে দেখতে একবার ইসুফ মিয়ার মোনে অয় যে; এইবার যাইগা! অমনেই জুলেখার খুশিভরা মোখখান চক্ষে পড়ে। তখন আবার লগে লগেই তার মোনে অয় যে, আট্টু থাকি। এইত্তো অর শিখা হইয়া গেছে! অখন কেমুন পারতাছে, দেইক্ষা যাই!
এমনে এমনে, একেবারে আলগোচ্ছে; জুলিরে শিখানি দিতে দিতে, আর জুলির শিক্ষা নেওনের নরম ইচ্ছাখান দেখতে দেখতে দেখতে পুরা কর্মটারে কোনসোম যে ইসুফ মিয়ার ভালা লাইগ্গা যাইতে থাকে—বহুত বহুত ভালা লাইগ্গা যাইতে থাকে; সে সেইটা ধরতে পারে না। ধরতেই পারে না।
অনেক অনেকক্ষণ ইসুফ মিয়া আর জুলির আওনের লেইগা বার চাইয়া থাকে জুলির মায়ে। অহে না ক্যান অই দুইটায়! হইছে কী অগো! জুলিরে ডাক দিয়া আনতে নি এতখোন লাগে!
শেষে চিন্তা হইতে থাকে তার। কী হইলো! তখন হাতের কর্ম ফালাইয়া থুইয়া, পেঁক-পানি ভরা হাত নিয়াই জুলির মায়ে তরাতরি ঘাটলায় আসে। আইসা দেখে, দেহো পোলাপাইন দুইটার কিরতি! মাছ ধরা লইয়া কেমুন বেহুঁশ হইয়া রইছে দোনোজোনে ! জুলি বেধুম ছিপ ফালাইতাছে, আর মাছ-বিন্ধাইন্না বড়শি দমদমাইয়া তোলতাছে। এদিগে, এক মুড়ায় বইয়া ইসুফ মিয়ায় অরে নানান মতে শিখানি দিতাছে, কইতাছে এই সেই নানান কিছু। ওদিগে দেহো, আধ-মাঝারি মাছের ডুলাখান গলা তরি বোঝাই হইয়া গেছে পুঁটিমাছে! সাদা, তাজা তাজা পুঁটি মাছটি কেমুন খলবলাইতাছে, ডুলার ভিতরে!
(চলবে)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১৮)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১৭)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১৬)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১৫)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১৪)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১৩)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১২)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১১)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১০)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ৯)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ৮)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (সপ্তম কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (ষষ্ঠ কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (পঞ্চম কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (চতুর্থ কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (তৃতীয় কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (দ্বিতীয় কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (প্রথম কিস্তি)