সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন
![](https://ntvbd.com/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2015/04/15/photo-1429075969.jpg)
‘অবেলার কালে নিরালা ক্ষেতের আইলে কে গো তুমি কন্যা!’
আরো এক বছর পরের সেই ফাগুন মাস। এইর মইধ্যে ইসুফরে মামুগো বাড়ির কর্ম-শিখুন্তির তেনে বাবায় ফিরত লইয়া আইছে। সেই ফিরত আনোন্তির পিছেও আছে আরেক বিশাল ঘটোনা।
মামুগো লগে থাকতে থাকতে ততোদিনে সওদাগরি কর্মের কায়দা-কানুন-কৌশল ইসুফ মিয়ার ভালামতোন শিক্ষা হইয়া সারছে। যেকোনো কর্ম মামুরা ইসুফ মিয়ারে দিয়া দেখছে, সেয় নিপাট ভাও-মতোন কর্মখান নিষ্পন্ন করতে কোনোরকম ভুল করে না। দেইক্ষা মামুগো চিত্তি খোবই সন্তুষ্ট হইলে পরে, তারা সাব্যস্ত করে যে, এইবার বাণিজ্যে নাও পাঠানের সোমে তারা আর অন্য অন্যবারের মতোন খালি কর্মচারীগোই পাঠাইবো না। এইবার বাণিজ্যে তারা তাগো ভাইগ্না ইসুফ মিয়ারেও লগে দিবো।
এই খেপে সর্বপ্রথমে নাও যাইবো এইবার মুর্শিদাবাদ। সেইখান তেনে যাইবো সপ্তগ্রাম, তারবাদে শ্যামদেশ। এমনে এমনে যাইবো গা পুরা বচ্ছরটা। বচ্ছরকার কাম শেষে নাও আইয়া ভিড়বো শীতলক্ষ্যার ঘাটে। সকল জায়গার বেচাকিনি, লেনদেন কর্মের সকল দায়িত্ব এইবার কার কান্ধে দিতাছে মামুরা! দিতাছে ইসুফ মিয়ার কান্ধে।
মামুরা কওয়া-বুলি করতে থাকে যে, এইবার হাতে-কলমে পরমান হইবো, ভাইগ্নায় এই বাণিজ্য কর্মের আও-ভাও কতোখানি শিখছে। মাঝে-সাঝে আটকাইয়া যাইতে পারে তার। নতুন তো! কিন্তুক তাতে কোনো সমস্যা নাই! লগে ঘাগু ঘাগু কর্মচারী তো থাকলোই। তারাই সামাল দিয়া নিতে পারবো বাকিটা।
অই সগল বিত্তান্ত শুইন্না ইসুফ মিয়ার পরান একবার খুশিতে লাফায়, একবার ডরে ঝাপটা খায়। কিমুন গুরুতর কথাটা! সেয় কি না যাইবো দূর বৈদেশে! যেইনে কি না তিন মামুর একজোনে ছাড়া বাকিরা জিন্দিগিতেও যায় নাই! যেই মামু গেছে, তারও যাওয়া পড়ছে পুরা বাত্তি মানুষ হইয়া! সেয় গেছে তার তিরিশ-বত্তিরিশ বয়সের কালে। ইসুফের লাহান এমুন আঠারো-উনিশ বছইরা ছেড়া তো আছিলো না সেয়! মামুর বাণিজ্যের মিয়াদ আছিলো তিন মাস, এদিগে ইসুফ মিয়ায় যাইতাছে পুরা বচ্ছরকার লেইগা। বেপারখান কী তাইলে কম গুরুতর!
এমুন কম বয়সে কে যাইতাছে আউজকা! ইসুফ মিয়ায় যাইতাছে। আবার যাইতাছে কী কারণে! না, বাণিজ্য করতে! এমুন আচরিত বিষয় দশ গেরামের কোনোজোনের জিন্দিগি হইছে বইল্লা শোনা গেছে কোনোকালে? কেউ কোনোকালে শোনে নাই। এই কথাখান মোনে আইন্নাই একবার পরান খুশিতে ধকধকায় তার, একবার ডরে ঝক্কর-পুক্কর করে।
পারবো নি সেয়? কোনোকালে তো এমুন কর্ম করোনের কোনো সুবিধা হয় নাই তার। তাইলে আঁতকা ইসুফে সেইসগল বাণিজ্যকর্ম কইরা আইতে পারবো! এমুন কতো কথা তার ভিতরে লড়তে-চড়তে থাকে। আবার মোনে মোনে নিজেরে সেয় নানামতে বুঝও দেয়; আইচ্ছা, গিয়া তো লউক একবার ইসুফে সেই দূর বৈদেশে। হেইরপর বোজোন যাইবো নে—পারবো কী পারবো না! ক্ষেতে গেলে সেনা কিষাণের বাও!
এই বিরাট সংবাদখানরে মামুরা নিজেগো মইধ্যে চুপেচাপেই রাখে। দশকান করে না। তাগো জানা আছে, এই খবর ইসুফ মিয়ার মায়ের কানে গেলে আর কর্মখান করোন লাগবো না! বাগড়া পইড়া যাইবো। বাপ-মায়ের বড়ো পুত এই ইসুফে। বাকিগিলি ছোটো, টেমাটোমা। সেই বড়ো পুত মায়ের জানের জান, পরানের পরান। মামুগো বাড়িতে যে বাপে তারে কর্ম শিখতে দিছে, সেইটা কোনো প্রকারে মানছে সেয়। কিন্তু এইর বেশি আর মানবো না। পুতেরে সেয় নি দিবো বৈদেশ করতে! দুনিয়া উল্টাইয়া গেলেও দিবো না!
কিন্তুক কী তামশা! যেই বিত্তান্ত নিয়া অতো রাখঢাক, অতো লুকাছাপা; সেই বিত্তান্ত কিনা মায়ের কানেই গিয়া আগে পৌঁছে! সেই কথা য্যান বাতাসের মোখে আইসা হাজির হয় দেওভোগ গেরামে।
খবরখান মায়ে পায়; না, য্যান তারে সর্পে দংশন করে। কোনোমোতে আঁচোলখান মাথায় তুলতে যেট্টুক দেরি, তার পরেই সেয় চিক্কুর পাড়তে পাড়তে আউলা-পাথাইল্লা ছোটা ধরে লক্ষ্মণখোলা গেরামের দিগে। আয় হায় হায়! বেদিশা অইয়া ইসুফের মায়ে করতাছে কী! এতাহানি পোথ বোলে সেয় একলা হাইট্টা পাড়ি দিবো! লক্ষ্মণখোলানি বাড়ির কাছে! পাড়াপড়শি জাল-ননদেরা আইয়া জাবড়াইয়া ধরে তারে।
কিরাকসম কাইট্টা তারা কয় যে, অক্ষণ তারা হগলতে এইটা বিহিতের বেবস্তা করতাছে। ক বিহিত করবো অই মাতারিরা? ইসুফ মিয়ার মায়ে চিক্কুর পাইড়া, বুকে থাবড়া মাইরা মাইরা নিজেরে ফানাফিল্লা কইরা ফালাইতে থাকে।
তয়, কপাল ভালা যে, সেই সোম ইসুফ মিয়ার বাপে বাড়িতেই বহা। সেদিন বিয়ানে তার বিধবা বড়ো বইনে তারে মাথার কিরা দিয়া কয়, ভাইয়ে য্যান আউজকা দোপোরের ভাত খাইয়া, তার বাদে গদিতে যায়। একটা দিনও তো দুপুইরা কালের গরম ভাতটা ভাইয়ের পাতে পড়ে না। রান্ধা গরম ভাতই তো যায় গদিতে, কিন্তুক যাইতে যাইতে রাস্তা তো কম না! সেই ভাত আর গরম তহন থাকে কী প্রকারে! জুড়াইয়া হয় কড়কড়া ঠান্ডা। বইনের সেই কথাখান রাখতে যাওয়ার কারোনেই সেয় সেদিন অইসোম ঘরে।
দেখো খোদার কী লীলা! বাপে যেইদিন বাড়িতে বহা, সেইদিনই কিনা পুতের বাণিজ্যে যাওনের সংবাদখান আইসা পৌঁছে বাড়িতে। ইসুফের মায়ের চিক্কুর-ঢুক্কুর তার অন্তররে ফালা ফালা করতে থাকে ঠিক, তবে মোখে চিল্লানি-হাঁকানি দেওনের বান্দা না ইসুফ মিয়ার বাপে! সেয় কলের কাম বলে করতে যায় না কোনোকালে। সংবাদ পাইয়া সেয় বাড়িতে একদণ্ড বয়ও না। কেউর লগে একটা কথা তরি কয় না। বনবনাইয়া মেলা দেয় লক্ষ্মণখোলার দিগে। কে তারে সাধে দুপুইরা ভাত-পানি! কে তারে কয়, হুঁশ কইরা পন্থ পাড়ি দিতে! ঘরের মাতারিরা একজোনেও হুঁশে নাই!
বাড়ির বচ্ছরকার বান্ধা কামলা দুইজোনে নিজেরাই বুদ্ধি কইরা মনিবের লগে হাঁটা ধরে। এমুন আচুইক্কা বিপদের দিনে মুরুব্বিরে একলা যাইতে দেয় তারা কোন পরানে! শুকনার দিন। হাঁটোন ছাড়া গতি কী!
ইসুফ মিয়ার মামানিরা আঁতকা দেখে দুয়ারে তাগো বড়োকুটুমে আইয়া খাড়া! তোবা তোবা! এইটা কী দেখতে কী দেখতাছে তারা! যে জামাইরে দাওয়াত-পানি দিয়া, নাও পাঠাইয়াও বোলে পারতে কোনোদিন শালা-সম্বন্ধিগো বাড়িতে আনোন যায় না! সেয় দেখো আউজকা বিনা খবরে আইয়া দুয়ারে খাড়া! কী, কী বিত্তান্ত? ইসুফ মিয়ার মামুগো বাড়িতে হাউকাউয়ের তুফান ছোটে।
একমাত্র বইনের খসম, আবার বড়ো মানুষ; তারে কী যেমনে-সেমনে খাতির-যত্ন করলে অইবো! কী করবো কী দিবো—এই চিন্তায় ইসুফ মিয়ার মামানিরা জোর লৌড়ালৌড়ি দিতে থাকে। খবর পাইয়া গদির তেনে মামুরা সগলতে বাড়িতে আইসা হাজির হয়। কিন্তু ইসুফ মিয়ার বাপে না কেউরে ভালা-বুরা জিগায়, না একটা কিছু মোখে দেয়! সেয় কুটাটাও দাঁতে কাটে না। এক ঢোঁক পানি তরি মোখে তোলে না।
থমথমা মোখে বাপে ইসুফ মিয়ারে ডাক দিয়া কয়, অক্ষণ বাইত ল! তর মায় কান্দতাছে। বাপের মোখ-চোখই ইসুফ মিয়ারে বুঝানি দেয় যে, তারে গোপনে বাণিজ্যে পাঠানের বিষয়খান আর গুপ্ত নাই! জানাজানি হইয়া সারা হইছে। ইসুফ মিয়ায় এও বোঝে, দেওভোগে তার মায়ে এমুন তুফানই বান্ধাইছে যে, তার বাপেরে স্বয়ং আসতে হইছে পুতেরে ফিরত নিতে! তাইলে বাপের হুকুমের উপরে আর আছে কী! ইসুফ মিয়ায় তক্ষণ তক্ষণ বাপের পিছে পিছে নিজেগো বাড়ির দিগে যাত্রা করে।
মায়ের পুতরে মায়ের কোলে আইন্না ফিরত দেয় ইসুফ মিয়ার বাপে; কিন্তু সেয় গুপ্তিভাবে নিজের বিবিরে এও কয় যে, পোলারে য্যান সেয় চক্ষে চক্ষে রাখতে কোনো প্রকার গাফিলতি না করে। বৈদেশে যাওনের যেই নিশা মামুরা পোলার অন্তরে ঢুকাইয়া দিছে, তার টান কিন্তুক যাহা-তাহা টান না। বড়ো শক্ত সেই নিশার টান। পোলায় না এদিগে আবার পলাইয়া মামুগো বাইত যায় গা!
বাপে-মায়ে-ফুপুয়ে যুক্তি কইরা ঠিক করে, ইসুফ মিয়ারে অখন নিজেগো গদির কোনো কর্মেও নেওনের কাম নাই। কে কইতে পারে যে, গদির কর্মে গিয়া সেয় বাপের আগোচোরে পলাইয়া যাইবো গা না মামুগো কাছে! গঞ্জের তেনে লক্ষ্মণখোলা আর কতোদূর! অখন থাকুক কয়দিন পুতে বাড়িতে বওয়া। মা-ফুপুর চক্ষের উপরে থাকুক। বাড়িতে কামলা-মুনিষ আছে, গুঁড়াগাঁড়া ভাই-বইনটি আছে; সগলতের চক্ষের উপরে থাকলে পলানের সুবিধা পাইবো না।
সেই মতে সগলে ইসুফ মিয়ারে কদমে কদমে এমুন আগলানি দিয়া রাখা ধরে যে, তার দম ফাঁপড় দম ফাঁপড় অবস্থা হইয়া শেষ। দশা ক্রমে এমন হইয়া খাড়ায় যে, তার কি না শান্তিহালে পেশাব-পায়খানা ফিরতে যাওনেরও উপায় থাকে না। নাও লইয়া বৈদেশে যাওনের কোনো বাঞ্ছা যে তার অন্তরে আছিলো না, অইটা যে সেয় করতে যাইতাছিলো কেবল মামুগো হুকুম তামিল করোনের লেইগা—এইকথা ঘরের একটা জোনে যুদি বিশ্বাস করতে চায়! এ কী ফেরের তলে পড়ছে ইসুফ মিয়ায়!
এমনে তো আর চলোন যায় না! কী করে, কী করে সেয়! দিশা-বিশা না পাইয়া শেষে একদিন সেয় হত্তা দিয়া পড়ে তার মা আর ফুবুর কাছে। তারা দোনোজোন মুরুব্বি আছে ইসুফের সামোনে বহা, তারা যেই বিধি সাব্যস্ত করবো ইসুফে তাইই পালনি করবো। তাও তারা অরে বিশ্বাস করুক! আর তো এমনে ঘরের ভিতরে টুন্ডা অইয়া পইড়া থাকোনের জ্বালা সহ্য করতে পারতাছে না ইসুফ মিয়ায়!
মা-ফুবু দোনোজোনে কয়, হেরা অরে বিশ্বাস করতে পারে; যুদি সেয় তাগো দোনোজোনের মাথা ধইরা কিরা কাটে! কে না জানে যে, ময়-মুরুব্বিগো মাথা ছুইয়া, কিরা-কসম কাইট্টা, যুদি কেউ সেই কিরা ভাঙ্গে; তাইলে আর দেখোন লাগে না! যাগো ধইরা কিরা কাটে, তাগো নাকেমোখে রক্ত উইট্টা লগে লগে দম যায় গা! কেউই ফিরাইতে পারে না! কাটবো সেই কিরা ইসুফে?
না-পাইরা শেষে ইসুফে নিজের মা আর ফুবু—দোনোজোনের মাথায় হাত থুইয়া কিরা কাটে। তিন সত্য কইরা ইসুফে কিরা কাটে যে, সেয় কোনো প্রকারেই বাপ-মা আর ফুবুরে ফাঁকি দিয়া, পলাইয়া বৈদেশ করতে যাইবো না! যাইবো না। যাইবো না।
ইসুফ মিয়ার কিরা কাটা শেষ হয় একদিগে, আরেকদিগে তার মায় গলা উছাইয়া নিজের সাক্ষী গো কইতে থাকে; আসমান-জমিন-চান্দ-সুরুজরে! তোমরা কইলাম আমার সাক্ষী! আমার পুতে যুদি তার কসম ভাঙ্গে, তয় য্যান আমার নাক-মোখ দিয়া রক্ত উইট্টা লগে লগে মউত ঘটে।’ ফুবু কয়, ‘আমি সাক্ষী থুইলাম তোমারে রে গাঙ্গের পানি। আর সাক্ষী থুইলাম গাছ-গরানের পাতা-ঠাইল্লা, তোমাগো! ভাইস্তায় যুদি কিরা নষ্ট করে, তয় লগে লগে য্যান উষ্ঠা খাইয়া আমার জান শেষ হয়!’
এতো সব কিছুরে সাক্ষী থুইয়া, এমুন কিরা-কসম খাইয়া, সেই কিরা ভাঙ্গছে কোনোদিন—এমুন কোনো মানুষের সন্ধান দেওভোগ গেরামের কেউ কোনোদিন পায় নাই। মায়ের পরানে চাক্কু বিন্ধানের মতোন সীমার, জল্লাদ, কসাইও দেওভোগ গেরামে কোনোদিন জন্মাইছে বইল্লা কেউ কোনোকালে হোনে নাই। আর ইসুফ মিয়ায় যেমুন তার মা-র আহ্লাদের ময়না পক্ষী; মায়েরেও তেমুন সেয় জানে নিজের দিনদুনিয়া বইল্লা। সেয় নি মা-র কইলজায় দাগা দেওনের পুত!
বাড়ির সগলে কয়; ইসুফে ঘোরাফিরা, আনাযানা—যা করোনের করবো—বাড়ির ঘাটা তরি সীমানার মইধ্যে। এর বাইরে এক পাওও না। কিন্তু এটি কেমুন কতা! উয়ে কি কালাপানির দণ্ড নেওয়া দাগি আসানি নি! কিরা কাটছে না? তাও এমুন করে ক্যান মায়ে? ইসুফে বিরাম আরাম ভুইল্লা গ্যাজ গ্যাজ করতে থাকে। এক দণ্ড থামে না!
অনেক কওয়া-বুলির পরে, ঘরের মুরুব্বিরা তারে বাড়ির বাইরে যাইতে দিতে রাজি হয়। তারা কয়, বাড়ির বাইরায় যাইতে পারবো পোলায়; কিন্তুক একলা না। সেয় নিজেগো ক্ষেতি-খোলা তদারকিতেই যাউক, কী যেইনে সেইনে ঘোরাঘুরিতেই যাউক, তার লগে থাকবো বান্ধা কামলা-মুনিগো কোনো না কোনোটায়। একলা তারে ছাড়োনের সাহোস নাই তার ঘরের মাইনষের।
ইসুফ মিয়ায় খুশি হালে কয় যে, তাইই সই!
ফাগুন মাসটা খালি আইছে দেওভোগে। যারা রাই-সইস্যা আবাদ করছে, তাগো এই ফাগুন মাসের পইল্লা কয়দিনের মধ্যে ক্ষেতে শেষ নিড়ানিটা দিয়া ফালাইতে হয়। অখন ক্ষেতে ক্ষেতে রাই-সইস্যা ফুলেরা ধুম মাথা তুলছে। তাগো গাছেরাও পোক্ত হওয়ার দিগে যাইতাছে খালি! সইস্যা ক্ষেতে ক্ষেতে জংলা ঘাস-লতা যা কিছু মাথা তোলছে ফসলের লগে লগে, সেইগুলারে সরানের এইই শেষ সময়। অখন, ইসুফ মিয়াভাইয়ে কি যাইবো কামলাগো সেই কামের তদারকি দিতে?
ইসুফে কয়, ‘ল! যাই।’
ক্ষেতে গিয়া ইসুফে দেখে, অন্য অন্য ছোটো ক্ষেতগুলারে কামলারা নিড়ানি দেওয়া শেষ করছে ঠিক, কিন্তু থুইয়া দিছে সগলতের তেনে বড়ো ক্ষেতখানরেই! এই ক্ষেতরে বাড়ির বান্ধা দুই কামলায় ঢিলা তালে নিড়ানি দিবো কয়দিনে, আর তারে শেষই বা করবো কয়দিনে! এমনে তো চলে না! ইসুফ মিয়ার মিজাজ এট্টু তিতা তিতা লাগা ধরে। বাজানে তো দেহি এইসব নজরই করে নাই!
‘কাউলকার তেনে আরো তিনজোন কামলার জোগাড় দেখবি!’ ইসুফ মিয়ায় বান্ধা কামলাগো ফরমাইশ দেয়। তার বাদে সেই দুইজোনের একজোনরে বসায় ইসুফ মিয়ায় ক্ষেতের উত্তর মাথায়। আরেক জোনরে কয়, ‘তুই গিয়া পচ্চিমের মাতায় ব। অই দোনো দিগে তরা নিড়ানি দেওয়া ধর। বাকি দুই দিগ—দেহি আলা—আমি কতোখানি পারি।’
ক্ষেতের দক্ষিণ মুড়ায় আইসা ইসুফ মিয়ার মোনে হয় যে, নিড়ানি দিতে বওয়ার আগে একবার ক্ষেতের পুরা দক্ষিণ আর পুব দিকখান ঠিক মতোন দেইক্ষা লওন ভালা। সেই মোতাবেক ক্ষেতের দক্ষিণের আইল দিয়া হাঁটা দিতে দিতে সেয় আগ্গাইতে থাকে—পুবের আইলের দিগে।
আগ্গাইতে আগ্গাইতে ইসুফ মিয়ায় দেখে পুব আর দক্ষিণ দিগের আইল আইসা যেইনে মিলছে, সেই কোনার আইলটুকে কে জানি হাত-পাও ছড়াইয়া বসা। ভাবে বুঝা যাইতাছে যে, সেয় বইছে দুগা সইস্যা শাক তোলোনের আশায়ই! কিন্তু শাক না তুইল্লা সেয় দেখো কেমুন বেতালা হইয়া চাইয়া রইছে সইস্যা ফুলের ঢলের দিগে।
বচ্ছরকার এই দিনে দেওভোগ গেরামের সকল বৌ-ঝি-মা-চাচি—যার যখন দরকার পড়ে আশপাশের আবাদি ক্ষেতের তেনে সরিষা শাক তুইল্লা নিয়া যায়। নিজের জমি কী পরের জমির ভেদ করে না কেউই। কয় আঁটি শাকেরই তো বিষয়! লাগলে নিবো, তাতে দোষ কী! তয়, শাক নিতে হয় আলগোচ্ছে তুইল্লা। কোনো একখান গাছের মাথা মুড়াইয়া নেওনের কর্ম কেউই করে না। তাইলে তো গাছেই বাঁচবো না।
কাজেই; অই নিরালা কোণে থির, উদাসী বসা-দিয়া থাকা শাক-তুলুনীরে দেইক্ষা ইসুফ মিয়ায় বিশেষ আমলে আনে না। কার জানি দরকার পড়ছে শাকের, সেয় আসছে। নিয়া যাউক, যেট্টুক লাগে। এই মোনে নিয়া আগ্গাইতে থাকে সেয়। তবে মোনে মোনে ইসুফে এও সাব্যস্ত করে যে, কাছে গিয়াই অই শাক-তুলুনীরে সেয় কইবো অন্য দিগে যাইতে।
তাগো ক্ষেতের এই দিগের পরে আছে কেবল আরো আরো রাই-সইস্যা আবাদ-হওয়া ক্ষেত। সেই সগল ক্ষেতের কোনোটাতে একটা জোনরেও দেহা যাইতাছে না। সকল ক্ষেত সুনসান খালি। এমুন বিরান এই জায়গায় অখন নিড়ানি দিতে বইবো ইসুফ মিয়ায় একলা। সেই নিরালা জায়গায় অই শাক-তুলুনির বইয়া থাকোনটা ভালা দেহায় না।
আগ্গাইতে আগ্গাইতে একবার ইসুফ মিয়ার এও মোনে অয় যে, গেরামের আশপাশে এতো দুনিয়ার রাই-সইস্যার ক্ষেত থুইয়া এই শাক-তুলুনি কোন দুক্ষে, এই এত্তা দূরের ক্ষেতে আইছে? মাথা খরাপ নি মাতারির? কেটায় এইটা! গেরাম তো কাছে-পিঠে না। গেরামের কোন বাড়ির গাছে বইয়া, অই যে কুকিলায় ডাক দিতাছে, সেই জোর ডাকরে এই ক্ষেতের তেনে শোনা যাইতাছে হাছা-মিছা কোনোরকম। দুগা শাক নিতে নি কেউ এত্তা তফাতে আহে!
কুকিলার ডাকের দিগে ইসুফ মিয়ার কানটা খালি এট্টু গিয়াও সারে না, অমনেই তার মাথার ভিতরে বাউ-কুড়ালি বাতাস আইয়া ঘুরপাক দিতে থাকে। অইটা কে? গেরামে এমুন পাগল আর কে আছে? এত্তা ফারাকে একলা কে আর আইয়া বওয়া দিয়া থাকতে পারে? এমনে কে পারে!
হায় হায় হায়! দেখছো! অই মাথা-খরাপে ছাড়া আর কে অইটা! অইটা তো জুলেখায়!
ইসুফ মিয়ার পরান তুফাইন্না বাতাসের মতোন ছুট দেয় জুলির দিগে; কিন্তু পাও দুইটারে সেমনে ছুট দেওয়ায় ইসুফে কোন মোখে! সেয় কি অই মাথা-খরাপটার মতোন ছোটো পোলাপাইন? না তো! ধড়ফড়াইন্না পরানরে কোনোরকমে সামলানি দিয়া, ধীরে যাইতে থাকে ইসুফ মিয়ার পাওয়েরা। কিন্তু ভিতরে ভিতরে তারা বড়ো টলতে থাকে। বড়ো কাঁপতে থাকে। আইলের রাস্তাটুক য্যান শেষ হইতে চায় না! এমুন যে ক্যান লাগে!
‘অই! তর কইলজায় ডর-ডারি বোলতে নাই?’ ক্ষেতের আইলে ধুপ্পুর কইরা নিজেরে ফালাইতে ফালাইতে কয় ইসুফ মিয়ায়। মোখ তো এই বলে, কিন্তু তার ভিতরে তার পরান বারেবারে কইতে থাকে দেখো কোন কথা! কইতে থাকে যে, তরে কয় জনম পরে দেখলাম জুলি! কয় জনম পরে!
‘মিয়াভাই!’ জুলি এট্টু হাসে, এট্টু গোস্বা করে, ‘দেখলেই খালি আপনে আমারে বকেন! এট্টুও ভালা কতা কন না আপনে! ক্যান! আমি ডরামু ক্যান! আমি তো দূরের তেনেই দেখছি আপনে ক্ষেতে আইছেন! তাইলে আর কিয়ের ডর!’
‘ডাক দিলি না ক্যান তাইলে?’
কামলাগো ফরমাইশ দিতে আছিলেন যে! আমি আপনের লেইগা বার চাইয়া বইয়া আছিলাম তো!
‘এত্তা ফারাকে একলা ক্যান আইছোস?’
‘এত্তা এত্তা সইস্যা ফুলের ঢলেরে দেইক্ষা, আমার কিমুন যে খুশি ধরতাছিল মিয়াভাই! আইতে আইতে কেমনে জানি আইয়া পড়ছি! খেয়াল করি নাইক্কা!’
‘জলদি শাক তোলা শেষ কর। বাইত যা জলদি জলদি। চাচিয়ে কইলাম চিন্তা করবো নাইলে!’
‘আপনে কাম করেন মিয়াভাই! আমি আইলে বইয়া থাকি?’
‘না না! কেউ দেখলে মন্দ কইবো, জুলি! তুই বাইত যা! আয়, আমিও তরে শাক তুইল্লা দিই।’
‘লাগবো না!’ কোনোমতে উত্তরখান দিয়া জুলি হাঁটা শুরু করে। আরে! যাইতাছে গা তো উয়ে! ইসুফ মিয়ার অন্তরাত্মায় য্যান আচমকা ফালটা ফালটা চির দেওয়া ধরে। ক্যান যাইতাছে গা উয়ে! ক্যান যায়! তারবাদে একলা এই ক্ষেতে পইড়া থাইক্কা ইসুফে কি করবো? অর হাতে কাম ওটবো আর! ওটবো না! জুলি!
ধুড়ুম-ধাড়ুম পাওয়ে হাঁটা দিয়া আইস্যা, পিছন তেনে জুলেখার কলাবেনীর একটা ধইরা আলগোচ্ছে টান মারে ইসুফে।
‘ অই বেবুঝ! এমনে যায় মাইনষে! মিয়াভাইয়ে বেজার হই না?’
(চলবে)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ২১)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ২০)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১৯)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১৮)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১৭)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১৬)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১৫)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১৪)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১৩)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১২)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১১)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১০)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ৯)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ৮)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (সপ্তম কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (ষষ্ঠ কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (পঞ্চম কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (চতুর্থ কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (তৃতীয় কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (দ্বিতীয় কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (প্রথম কিস্তি)