সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন
‘তোমারো লাগিয়ারে বন্ধু সদা কান্দে আমার প্রাণ!’
মাথার বেণীতে টান দিয়াই খালি জুলেখারে থামায় না ইসুফ মিয়ায়; ধুছমুছ পাওয়ে অর সামোনে গিয়াও পথ আটকানি দেয় সে। না দিয়া কী করব! পথ আগলানি না দিলে অয় যুদি আবার হাঁটা দেয়!
‘কিরে টেপী! তরে না ডাক পারতাছি?’
‘পথ ছাড়েন মিয়াভাই! মায় বকবো!’ মোখ-চোখ নিচা রাইক্ষাই কোনোমতে কথাখান কয় জুলি।
‘এইনে আর এট্টু থাকলে কিছু অইবো না, জুলি!’
‘থাকমু না মিয়াভাই!’ যেমুনকার নামানো মোখ, তেমুন নামানোই থাকে জুলির।
‘ক্যান!’
সেই কথার কোনো জব না দিয়া আচমকা মোখ তোলে জুলি। এক ঝটকা চায় ইসুফের দিকে। সেই পানপাতা মুখখান! আবার য্যান পুরা তবদা খাওয়াইয়া দেয় ইসুফরে। কিন্তুক, এহন কী খালি সেই মুখেরেই দেখলো ইসুফে! না না! দেখলো আট্টু বেশি কিছু। এক ঝটকার মধ্যে দেখলো যে, জুলির চক্ষে পানি। উয়ে কানতাছে।
কিন্তু কান্দনভরা চক্ষেরেওনি এমুন দেহায়! এমন তো ইসুফ মিয়ায় কোনোদিন দেহে নাই! কী দেখলো উয়ে এইটা! জুলির চক্ষে পানি। তবে সেই পানি দুই চক্ষে দুই রকম হইয়া আছে! এক চোখ পানিতে টুবুটুবু! সেই চোখরে লাগলো য্যান নয়া পানিভরা পুষ্কুনিখান! পানিরা কাঁপতাছে, তিরতিরাইতাছে!
জুলির আরেক চোখ তেনে হাছামিছি এক ফোটা পানি-এই এট্টু নামছে চক্ষের কোলে! সেই চক্ষেরে ইসুফের মোনে হইলো য্যান চোখ না! য্যান সেইটা পানি-পড়পড় আষাঢ় মাইস্যা মেঘ! সেই মেঘের তেনে খালি একখান ফোটা ঢলকাইছে! একটা ফোটা খালি! অঝোর ধারারা নামি নামি করতাছে! কিন্তুক নামে নাই অখনও । কান্দনঅলা চক্ষের এমুন ঢক অয়! ইসুফে তো জিন্দিগিতে জানে নাই এমুন কথা! কান্দলে এমুন ঢকের দেহায় কেউরে! এমুন ঢকের!
তয়, ইসুফে অরে কানতে দিলে তো! অর এক ফোটা চক্ষের পানি মাটিতে পড়তে দিব না ইসুফ মিয়ায়। জিন্দিগিতেও দিবো না!
‘অইছে, অইছে! আর গোস্বা করোন লাগবো না!’ ইসুফে করে কী, জুলির একটা ডানা ধইরা টানতে টানতে অরে বহায় ক্ষেতের আইলে। তারবাদে কয়, ‘আয়! তরে একটা ভেলকি হিগাই!’
কি ভেলকি?
বহুত তামশার এক ভেলকি! এই যে তামানটা দুনিয়া ভইরা এতো এতো সইস্যার ক্ষেত; হইলদা ফুলের এই যে ঢল দেহা যায়, সেই ফুলে বনবনায় কারা?
ওম্মা! মিয়াভাইয়ে না কইলো ভেলকি হিগাইবো! তার বদলে কিনা সেয় শোলোক জিগায়! হইলো এইটা! জুলি হাসতে হাসতে লায়লুট হইয়া যায়। ফুলে ফুলে বনবনায় আবার কিয়ে? বনবনায় মউপোকে; মৌমাছিয়ে! খালিনি বনবনায়! ঝাক্কে ঝাক্ক এই লৌড়ালৌড়ি দিতাছে তারা ক্ষেত ভইরা। আবার যেইটায় যেমনে পারতাছে, ধুপ্পুর-ধুপ বইয়া পড়তাছে ফুলে ফুলে। বওয়ার পরে, ফুলে ফুলে অরা এমুন আটকা খাইয়া থাকতাছে যে, আঁতকা দেখলে মোনে অয় অরা য্যান মউপোক না; সইস্যা ফুলের একটা টুকরা!
সেই মউপোকরে দুই হাতের তাউল্লার ঘেরে বন্দি করতে জানে জুলি?
ও মা মা মা! মৌমাছি বোলে হাতে ধরোন যায়! লগে লগে হুল বিন্ধাইয়া দি জানে শ্যাষ কইরা দিবো!
‘কিচ্ছু অইবো না! কিচ্ছু অয় না !’ ইসুফ মিয়ায় আলগোচ্ছে নিজের দুই হাতেরে বাড়ায়া দেয় হাতের কাছের একটা ফুলের ঝোপ্পার দিগে। সেইখানে এমনে-সেমনে বহুতগুলি মৌমাছি বসা। ‘দেখ, কেমনে ধরা খায় মউপোকে! ধরা খাইয়া আবার কিমুন সোন্দর চুপ মাইরা পইড়াও থাকে!’ মিয়াভাইয়ে কয়।
জুলি ডরে খাবিজাবি খাইতে খাইতে দেখে, মিয়াভাইয়ে কিমুন আস্তে হাত দুইটারে ফুলের ঝোপ্পার কাছে নিয়া যাইতাছে! নিলো তো, তারবাদে, চক্ষের পলকে হাতের তালু দুইটারে এক কইরা ফালাইলো সেয় ! মাগ্গো মা! হাছাইনি হাতের মিদে মউপোক!
‘এই যে দেখ মুষ্টি!’ ইসুফে এক লগে জোড়া-করা দুই হাতের পাতারে জুলির সামোনে আইন্না জিগায়; ‘এই মুষ্টির ভিতরে কয়টা মউপোক আছে,ক দেহি? সঠিক কইতে পারোস যুদি, অক্ষণ তরে এই ভেলকি হিগাইয়া দিমু। অক্ষণ!’
অমা! এইটা বোলে জিগানের কতা! জুলি সঠিক জানে তো, মুষ্টিত কয়টা মউপোক আছে! আছে একটা!
‘কইতাছস?’
‘হ মিয়াভাই। একটা!’
‘তাইলে দেখ!’ ইসুফে তরাতরি কইরা মুষ্টিখানরে অনেকখানি ফাঁক করে। সেয় ফাঁক কইরাও সারে না, মুষ্টির ভিতর তেনে দুপদুপাইয়া উড়াল দিয়া বাইর হইতে থাকে মউপোক। একটা, দুইটা, তিনটা!
এক খেপে এত্তাগিলি মউপোক ধরতে পারে মিয়াভাইয়ে! তার তাইলে কিমুন সাহোস! আর কিমুন চালাক সেয়! মিয়াভাইয়ে কতো কী পারে! অখন, সেয় এট্টু কষ্ট কইরা জুলিরে যুদি হিগাইতো! মিয়াভাই!
‘কেমনে শিখামু তরে! তুই তো শোলক ভাঙতে পারস নাই!’
‘মিয়াভাই! হিগান। মিয়াভাই!’
‘আয় তাইলে।’ ইসুফে অতি তরিজুতের সঙ্গে জুলেখারে হাতের মুষ্টিতে মউপোক ধরোনের কায়দা কানুন দেখানি ধরে। একবার, দুইবার, তিনবার। চার, পাঁচ, ছয়, সাত, আষ্টবার! জুলির দেখো হাতের তেনে ডরই যায় না। শিখবো কী! এতই যুদি ডর পায়, তাইলে এই ভেলকি শিখনের কাম নাই জুলির! ডরাইলে কামে ভুল হয় তো!
‘থাউকগা, জুলি!’ ইসুফে কয়; ‘এই কাম হিগোন লাগবো না! আমি তরে সইজনা গাছে ওঠতে হিগাইয়া দিমু নে। সত্য কইতাছি!’
সইজনা গাছ হইলো অতি মটকা ডালপালার গাছ। এইটাতে উঠতে হইলে ভালারকম কেরামতি জানোন লাগে! যেয়-সেয় এই গাছে ওঠার ভাও-কায়দা জানেও না; ওঠতে পারেও না। ভাও শিক্ষা না কইরা, আন্ধাগুন্ধি তুমি গাছে উঠতে গেছ, তো মরছ! ঠালা-ঠোলা ভাইঙ্গা, পইড়া, হাত পাও ভাইঙ্গা তুমি শেষ! ইসুফে সেই গাছে ওঠোনের কায়দা জুলিরে শিখাইবোই। এই ইসুফে অরে জবান দিতাছে!
জুলি কয়, না না না! আগে সেয় মউপোক ধরোন হিগবো, হেইরপর অন্য কিছু।
মিয়াভাইয়ে আবার জুলিরে মউপোক ধরোনের ভাও দেখাইতে থাকে, জুলিয়েও সেইসগল কায়দা-ভাওরে শিক্ষা করতে থাকে । তয়, বুঝানি-পড়ানিরও তো শেষ আছে। এইবার তো মিয়াভাইরে মউপোক ধইরা দেখান লাগে জুলির! দেখাউক সেয় অখন; আসলেই ধরার কায়দা শিখছে,না অখনো শিখে নাই!
আরে খোদারে খোদা! মিয়াভাইয়ে হুকুম দিয়াও সারে না, জুলিয়ে কী সুন্দর খপ কইরা হাতের তাউল্লাতে মউপোকরে বন্দি কইরা ফালায়!
মিয়াভাইয়ে তখন জুলিরে কয়, ‘এইবার তোরে যেমনে খুশি তেমনে- মকশো করোন লাগবো। আমি কিচ্ছু কমু না। কিচ্ছু দেখামু না। তুই নিজে নিজে, গইন্না গইন্না পাঁচবার, মকশো করবি!’ এমনে মকশো করার ফজিলত কী!
ফজিলত হইলো এই যে, তাইলে আর জিন্দিগিতে কোনোদিন মউপোক ধরোনের কায়দাখান ভোলবো না জুলিয়ে। মিয়াভাইয়ে থির হইয়া আইলে বসে। আর, তার কথামাফিক জুলিয়ে এই একবার মউপোক ধরে; এই আবার মুষ্টি আলগা করে। তখন পোক ভুরুত কইরা উড়াল দেয়। আবার ধরে, আবার ছাড়ে। তিনবারের বার মুষ্টিবান্ধার পর, আঁতকা জুলির মোনে অয় কী, এইবার য্যান তার মুষ্টিতে কোনো মউপোক আটকা পড়ে নাই। এইবার মোনে অয় য্যান- সেয় মউপোক না ধইরা, কতোখানি বাতাসরে খপ কইরা মুষ্টিতে লইছে!
মোনের ভিতরে এমুন দ্বন্দ্ব লাগে দেইক্ষা জুলি করে কী, এই আলাঝালা এট্টুখানি ফাঁক করে মুষ্টিখান। এই এট্টু, এক ঝলক খালি দেখবো সেয়; আছে ভিতরে মউপোক? না কি নাই?
‘এমনে না! এমনে না! এমুন করে না। জুলি এমুন করিস না!’ ইসুফ মিয়ায় নিষেধ দিতে দিতে জুলির কাছে আসার আগেই জুলি ডাক-চিক্কুর দিয়া আছড়াইয়া পড়ে ক্ষেতের ভিতরেই। হায় হায় হায়! মউপোক ধরতে গিয়া যা করতে নাই, তাই কইরা ফালাইছে জুলিয়ে!
বিধান হইলো এই যে, দুই হাতের মুষ্টিতে তো তুমি ধরতাছো মউপোক! রাখো তারে তেমনে, যতখোন তোমার মোনে লয়। মুষ্টির আন্ধারে মউপোক আঁতকা গিয়া পুরা আন্ধা হইয়া যায় কিনা, সেই কারণে সেয় কিছুতেই তোমারে দংশাইবো না।
আন্ধা হইয়া থাকে বইল্লাই, হুল বিন্ধানের হুঁশটা থাকে না তখন অগো। এমনে তো রাখা গেল মউপোকরে হাতের মুষ্টি আন্ধারে; তারবাদে তারে ছাড়বা যেসুম, সেসুম তোমার মুষ্টি খুইল্লা দিবা। পুরা খুইল্লা দিবা। তাইলেই আর কোনো বিপদ নাই। কিন্তুক মুষ্টিরে এট্টু ফাঁক কইরা হাতের ভিতরে আলো ঢুকাইছো- কী গেছো!
জুলি মুষ্টি আলগা কইরা দেখতে গেছে না? পোকে তো অইট্টুক কালেই দেখার হুঁশ ফিরত পাইছে! উয়ে তো তখন হুঁল মারবোই! জুলির ডাইন হাতের তাল্লু দেখো চক্ষের পলকে ফুলা দিয়া তো ওঠেই, লগে গরম আর ডগডগা লালও হইয়া শেষ। অখন এই হাতেরে কী করা! গেরাম সেই কোন দূরে! এক দৌড়ে গিয়া যে ইসুফে এট্টু নুন, কী ইট্টু চুন লইয়া আইবো- তার তো উপায় নাই!
কোন টোটকা করবো অখন ইসুফে! কোনো টোটকা না দিলে তো এই হাতেরে নিয়া জুলির ভোগান্তির শেষ থাকবো না! ইসুফ মিয়ায় পুরা বেদিশা, বেবোধা হইয়া করে কী, নিজের দুই হাত দিয়া জুলির ডাইন হাতেরে জাপোইট্টা ধইরা রাখে কতোক্ষণ। কী করবো কী করবো ইসুফে অখন! জুলির কঁকানিয়ে খালি আসমান-জমিনই কাঁপতে থাকে না; ইসুফের হাড্ডি-গুড্ডিসুদ্ধা কাঁপতে থাকে।
কাঁপতে কাঁপতে আচমকা ইসুফের মোনে অয় যে, জুলির হাতে নি সেয় দুব্বা থেতলাইয়া দিয়া দেখবো! এমুন দংশানিতে দুব্বার রস কাম করে? সেয় তা জানে না। তাও ইসুফে ক্ষেতের আইলের তেনে পটপটাইয়া দুনিয়ার দুব্বা তুইল্লা নিজের মোখে দেয়। দিয়া, ধুম চাবানি দিতে থাকে। এমনে ছাড়া আর কেমনে সেয় এই বিপদের কালে দুব্বা থেতলাইবো!
বিষষে-বেদনায় থরথর করতে করতেও জুলির মোনে আহে যে, তার মায় তারে পাঠাইছে শাক তোলতে। সেই কামখান অখন তরি জুলি করে নাই! বেইলও তো এদিগে কম অয় নাই! অখন কী উপায়! মিয়াভাইয়ে নি দুগা শাক তুইল্লা তার কোঁচড়ে ভইরা দিতে পারে! নাইলে জুলি বাড়িত যাইবো কোন মুখে!
কোঁচড়ে মিয়াভাইয়ের তুইল্লা দেওয়া শাক নিয়া জুলেখায় কোনোমতে বাড়ির পথে যায়। পিছে পিছে একটু ফারাক নিয়া যাইতে থাকে ইসুফ মিয়ায়ও। জুলির হাতে যে বিষ- টাটানির তুফান চলতাছে, তার ভাগ তো আর নিজের শইল্লে নেওনের কোনো রাস্তা নাই ইসুফ মিয়ার!
তয়, জুলির লগে লগে যতখানি পারা যায় ততখানি যাইবো সেয়। একলা কেমনে ছাড়বো মাথা-খরাপটারে! এতখানি ক্ষেতের পথ, এমুন যাতনা নিয়া, উয়ে একলা একলা যাইবো! আর এদিগে ইসুফ মিয়ায় সেই যাওনরে খালি চাইয়া চাইয়া দেখবো? ইট্টুও না!
যতখানি রাস্তা পিছে পিছে গেলে লোকের নজরে না পড়ার উপায় আছে, ততোখানি পথ ইসুফে জুলির পিছে পিছে যায়। যাইতে যাইতে হাজারবার নিজেরে দোষ দিয়া জুলির কাছে মাফ চাইতে থাকে সেয়! অর ভুলেই জুলির এমুন দুর্দশা! ইসুফে যুদি আগেই জুলিরে হিগাইয়া থুইতো- আগেই যুদি জানাইয়া থুইতো যে, কী করলে কী হয়- তাইলে তো এমুন অঘটনটা ঘটে না! জুলি য্যান মিয়াভাইরে মাফ দেয়! মাফ দিস, জুলি!
কিন্তু বাড়িত গিয়া কেমনে কী অইবো! মায়েরে কোন বুঝ দিবো জুলি! সেই চিন্তায়ই তো বেশি অস্থির হইতে থাকে ইসুফে!
এতো বিষ-বেদনা নিয়াও জুলির মুখে হাসি আসে! কাহিল, কাতর হাসি-লাগা মুখখানে ইসুফরে কয়, সেয় ঠিকই তার মায়েরে বুঝ দিতে পারবো। সেয় কইবো যে, শাক তোলতে তোলতে ভুলে মউপোকের উপরে হাত পইড়া গেছিল, তাতে এই হুল বিন্ধছে হাতে!
‘আইচ্ছা! এমনে যুদি চাচিরে বুঝ দেওন যায়, তো জুলি য্যান সেইটা করে! কিন্তুক এইবার জুলি তিন সত্য কইরা কউক যে, সেয় ঘরে গিয়া লগে লগে এক খাবলা চুন দংশনের জায়গায় লাগাইবো! কোনো মতেই দেরী করবো না! মিয়াভাইয়ের এই কথাখান মনে থাকবো তো জুলির?’
হ। গিয়াই চুন লাগাইবো জুলি। একফোটা বিলম্ব হইবো না! তরাতরি পাওয়ে আগাইতে আগাইতে তিন সত্য করে জুলি। অই যে দেখা যায় জুলিগো বাড়ির ঘাটা। আর জুলির পিছে পিছে আগানি দেওয়া শোভা পায় না ইসুফের!
সেয় অখন কী করে তবে! কিছুর দিশা না পাইয়া ইসুফে থব কইরা বয় এক ক্ষেতের আইলে। বইয়া জুলির যাওয়া দেখতে দেখতে তার খেয়াল আসে যে, এই যে জুলি গেল গা; এরপর তো আর কোনো উপায় নাই অর খোঁজখান নেওনের! জুলি গো বাড়িতে সেয় যাইবোই বা কোন ছুতায়! কারেই বা পাঠাইবো অর খবরটা আইন্না দেওনের লেইগা। আছে ইসুফের এমুন কোনো বান্ধব! নাই। তাইলে জুলি কেমুন আছে- কেমনে জানবো ইসুফে! সেয় বোঝে, সেইটা জানোনের কোনো উপায় তার নাই।
কোনো প্রকারে সেই দিন ক্ষেতের কাম আধা-মাধা কইরা থুইয়া বাড়িত আসে ইসুফ মিয়ায়। বাইরে লড়াচড়ি করতে থাকে সেয় সয়-সুস্থ মাইনষের মতোন, কিন্তুক অন্তরে দেখো কেমুন ছটর-ফটর অশান্তি যাইতে থাকে তার! ডাইন হাতে হুল বিন্ধছে জুলির। কেমনে কী করতাছে উয়ে! বিষ-বেদনা কমছে এট্টু? চুন লাগাইছিল? মিয়াভাইরে দোষতাছে উয়ে?
এই সেই- দুনিয়ার কত কতা যে ইসুফ মিয়ার পরানরে ঝাপটা বাড়ি মারতে থাকে! কত রকমের কত ভাবনা যে তার ভিতরে গোঙাইতে থাকে, তার শুমার থাকে না। হরেকপদের ডর আইসা অরে ধাক্কাইতে থাকে, কিছুতেই চইনে থাকতে দেয় না। ঘরে থির হইয়া পইড়া থাকতে দেয় না। দম ফাঁপড় দম ফাঁপড় লাগতে থাকে তার। না পাইরা ইসুফ মিয়ায় করে কী, বেতালা পাওয়ে গেরামখানে এট্টু ঘুরানি দিতে বাইর হইয়া পড়ে। তার মনে অয়, এমনে-সেমনে হাঁটলে বুঝি তার মাথা-গরমখান জুড়ানি পাইবো।
এদিগে দেখো রে; হাঁটাইতে হাঁটাইতে তার পাও তারে কই লইয়া যায়! লইয়া যায় জুলিগো বাড়ির ঘাটায়। দেহা যায় কোনোদিগে জুলির চিহ্ণ? দেখা যায় না। শুকনার দিন। অখন সকল দিক দিয়াই দেওভোগ গেরামের সগলতের বাড়িরে ঘুরান দেওয়া যায়। ইসুফে আলগোচ্ছে জুলিগো ভিটির সগল দিগেই ঘুরানি দেয়। কেউরেই নজরে আসে না তার।
সেয় তাইলে কী করে! আবার তার বেজার পাওয়েরা বাড়িত ফিরা আহে। আইয়া ধোম ধইরা বহা দিয়া থাকে দক্ষিণের ঘরে ওঠোনের পৈঠায়। বেইল গিয়া সন্ধ্যা আইসা পড়ে, ইসুফে পইঠার তেনে লড়ে না, ঘরের ভিতরেও যায় না; কেউর লগে কোনো কথাও কয় না। এমুন থোম ধইরা পইঠায় বইয়া রইছে ক্যান পোলায়! মায়ের পরান য্যান কু গায়! এইটা কী বেপার! আছরের ওক্ত গিয়া তিন সন্ধ্যাকাল হইয়া গেল! পোলায় এইটা কী করে!
‘কি রে? কি জোড়াইলি আউজকা? এমুন ঘাটের মড়ার মতোন পইঠায় বওন দিয়া আছস কোন কারণে?’
মায় কতাটা কইয়াও সারে না, পোলায় ঘুড়ুত কইরা গরজানি দিয়া ওঠে, ‘সব কামে খালি দোষ বিছরাও কে? আমি তোমার চক্ষের কাঁটা অইছি? কইলেই তো পারো, আমি বাড়ির তেনে যাই গা!’
হায় হায়! কী কতার কী জব দিল পুতে এইটা! এমুন গরজানি দিয়া কথা তো উয়ে কোনোকালে কয় নাই! ময়-মুরুব্বির মুখের উপরে খেজি দিয়া কথা কওয়া! এমুন তো এই পোলায়, অর এই এতখানি বয়স তরি, কোনোদিন করে নাই! আউজকা এইটা করল কী!
তিনসন্ধ্যার কালে ওদিগে ঘরের ভিতরে ইসুফ মিয়ার ফুবু নামাজের পাটিটা খালি হাতে লইছে, সেয়ও জুয়ান ভাইপুতের গরজানির ধাক্কায় কাইপ্পা ওঠে। তোবা তোবা! এটি কী হইতাছে বাইত! তিনসন্ধ্যার সোমে শনিয়ে ভর করছে তো ছেড়াডারে! ফুবু কোনোরকমে পাটিরে মাটিতে ফালাইয়াই থতমত পাওয়ে উঠানে আসে। ইসুফের মায়েরনি শোভা পায় এমুন বেলেহাজ পুতের মোকাবিলা করন! সেয় তরাতরি মায়েরে তার পুতের সামনের তেনে সরাইয়া নেয়।
জুয়ান পুত! অরে মোখে মোখে নিয়াই-তর্ক করতে দেওন যাইবো না! কথার উপরে কথা কইতে দিলেই অর চক্ষের লাজ ঘোচবো । একবার লাজ ঘোচলে মুখে মুখে চোপা শুরু করব। তখন হইবো বিপদ! এইটা অইতে নি দেওন যায়! আর, ইসুফের মায়ে কি বোজতাছে না তার পুতের এই আঁতকা বেত্তমিজির মূলে কী?
কী?
কী আবার! অই যে, বৈদেশে বাণিজ্যে যাওনের নিশাখান! ইসুফের মায়ের কী স্মরণে নাই,পুতে মা-ফুবুর মাতা ধইরা কিরা কাটছে? সেয় তো অখন সেই কিরা ভাঙবো না। কিন্তুক মায় যুদি চেতের মুখে খালি একবার কইয়া ফালায়, চক্ষের সামেনের তেনে দূর অইয়া যা পয়মাল! তাইলেই আর অরে পায় কে! এক ফালে যাইবো গা মামুগো কাছে!
ননাসের কথাখানরে বহুত পোক্ত মোনে হয় ইসুফ মিয়ার মায়ের! কতা য্যান হাছাই লাগে! পোংটা পুতের মনে নি এই ফন্দি!
মায়ের লগে হুদামিছা চেত কইরা সেই সন্ধ্যাকালে ইসুফ মিয়ার অন্তর এমুন তিতা তিতা লাগতে থাকে যে, তার আর একদণ্ড বাইত তিষ্টাইতে ইচ্ছা করে না। ধুর! আবার হাড়ুম-ধাড়ুম পাওয়ে সেয় বাড়ির ভিটার তেনে নামে। নাইম্মা কোন দিগে যায় তার পাও? হায়রে হায়, তার বেখেয়াল পাওয়েরা আবার আইয়া খাড়ায় জুলিগো ভিটির পচ্চিম-মুড়া। সেইখানে তো অগো পুষ্কুনির ঘাটলা! আইছে কেউ এই তেসন্ধ্যাকালে, ঘাটে? না!
নিজের হাতের দংশন নিয়া জুলি আছে তাগো নিজের বাড়িতে। কিন্তুক সেই দংশনের জ্বালা কিনা ইসুফ মিয়ারে পুরাটা রাইত রাখে অস্থির দশায়! রাখে তারে আধা ঘুমে,আধা জাগনায়। তারবাদে বিয়ান হয়। অখন,বিয়ান হইলেই কী! ইসুফে কেমনে পাইবো জুলির খবর!
এক পারে সেয় নিজে যাইতে। কিন্তুক সেয় তো আর ফাল দিয়া জুলিগো বাইত গিয়া হাজির হইতে পারে না! কোন কারণে যাইবো? অই বাড়িতে যাওনের লেইগা কত না ছুতা সেয় বিছরাইতে থাকে! কিন্তু একটা কোনো জুৎসই ছুতা তরি সেয় বিছরাইয়া পায় না! এমনে এমনে দিনের বেশিটা যায়। ভিতরে ভিতরে ছুতার সন্ধান করতে করতে সেয় কতোবার যে জুলিগো বাড়ির ঘাটা দিয়া গিয়া ঘুরান্তি দিয়া আসে, তার হিসাব খালি খোদায় জানে!
জুলি একটাবার, এট্টু, কোনোদিগে আইয়া খাড়াইতে পারে না! উয়ে কী! এমুন কম-বুদ্ধির মানুষ ক্যান এই ছেড়িয়ে! একটাবার মনে আনতাছে না ক্যান যে, মিয়াভাইয়ে অর ভাবনায় উতালা অইয়া আছে!
আছরের ওয়াক্তে ইসুফ মিয়ার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে। যাওন যায় জুলেখাগো বাইত! যাইবো সেয় স্বয়ং। কী কারণে যাইবো? যাইবো অই বাড়ির তেনে একটা ঝাঁকি জাল একদিনের লেইগা চাইয়া আনতে। ইসুফ মিয়াগো ঝাঁকি জাল নাই। কাজেই এইটা সেয় কর্জ আনতে যাইতেই পারে। বুদ্ধিটা ভালা ঠেকে তার কাছে।
জালখান আইন্না নাইলে কাউলকা পুরাদিন ইসুফ মিয়ায় থাকবো পইড়া পুষ্কুনিতে। তাইলে তো আর কোনো প্রকার মিছা কথাও কওয়া হইলো না! তয়, জুলির মায়ে অইলো দুনিয়ার মাথা-চালাক মাতারি! তার মনে যুদি কতা ওঠে যে, বাড়িতে যেইনে দুই দুইটা বান্ধা কামলা আছে; তাগো না পাঠাইয়া এমুন জিনিসটা নিতে ইসুফে আহে কোন কারণে? তহন কী কইবো সেয়!
চিন্তায় পড়ে ইসুফ মিয়ায়। তবে পোক্ত একটা জব মাথায় আইয়াও পড়ে অল্পখোনের মইধ্যে। জিগাক আর না জিগাক, ইসুফে আপনা তেনেই জুলির মায়েরে কইবো - কামলারা নিড়ানির গ্যাঞ্জামে আছে কিনা, সেই কারণে তারেই আসতে হইলো- জাল কর্জ নিতে!
জুলির খবর পাওনের একটা ন্যায্য ব্যবস্থা তাইলে করতে পারছে ইসুফে! পারছে তো! সেইটা করতে পাইরা খুব ফুরফুরা হইয়া যায় ইসুফের দিল। জুলিগো বাড়ির দিগে তার পাও হাটোন দিয়া যায়? না, না! হাটোন না! য্যান ওড়তে থাকে তার পাওয়েরা। কিমুন অশান্তি তার অন্তররে দাগা দিতাছিল এতখোন! ভালা লাগেনি এমুন নাই-জ্বালা?
দক্ষিণ দিগের ঢাল বাইয়া জুলিগো ভিটিতে ওঠার সোমে ইসুফ মিয়ায় দেখে কী, জুলিগো ভিটির সেইদিগে মংলার মায়ে খাড়া। সেইখানে খাড়াইয়া মংলার মায়ে কি করে? সেয় জুলিগো লেম্বুগাছটার তেনে লেম্বুপাতা ছিঁড়ে! মংলার মায়ে এই বাড়িতে ক্যান! কথাটা মনে আসে ইসুফের।
আবার লগে লগে এওও মোনে আসে যে, দেওভোগ গেরামের যেই বাড়িতেই কোনো কারণে একটু বেশি কাম-কাইজের ঠেলা পড়ে, সেই বাড়ির লোকেরাই মংলার মায়েরে তোষামোদ কইরা তাগো বাড়িতে আনে। মংলার মায়ে আইসা বাড়তি কাম-কাইজগুলা তুরুত হাতে কইরা দিয়া যায়। আউজকা জুলিগো বাড়িতে আবার মংলার মায়ের কী কাম পড়ল!
ঢাল বাইয়া ইসুফরে ওঠতে দেইখ্যা, মুঠাভরা লেম্বুপাতা নিয়াই, মংলার মায়ে তরাতরি নামতে থাকে ইসুফ মিয়ার দিকে। এই মাতারি আবার তার দিগে আহে ক্যান! সেয় ইসুফ মিয়ার সামনে আইসা কয়, ‘অখন যাইয়েন না বাজান, অগো বাইত!’ মংলার মায়েরে কিছু জিগানের আগেই লেম্বুপাতাগো তাজা, ছলছলা গন্ধখান ইসুফ মিয়ার অন্তরাত্মায় গিয়া ঝটকা দেয়। জুলিগো বাড়ির লেম্বুপাতার সুবাসও এমুন মিঠা!
(চলবে)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ২২)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ২১)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ২০)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১৯)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১৮)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১৭)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১৬)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১৫)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১৪)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১৩)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১২)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১১)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১০)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ৯)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ৮)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (সপ্তম কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (ষষ্ঠ কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (পঞ্চম কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (চতুর্থ কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (তৃতীয় কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (দ্বিতীয় কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (প্রথম কিস্তি)