আদিবাসী পুরাণ
মাহালিদের গরয়া উৎসবের মিথ
গ্রামের নাম শমনিপাড়া। গ্রামটিতে যখন পা রাখি, সবাই তখন কাজে ব্যস্ত। নারী-পুরুষ উভয়েই। বাঁশ কেটে ছোট ছোট ফালি তৈরি করছে পুরুষরা। নারীরা তা দিয়ে তৈরি করে নিচ্ছে হরেক রকমের ঝুড়ি। কোনোটি বড় কোনোটি আবার বেশ ছোট। গোটা গ্রামের এদিক ওদিক পড়ে আছে বাঁশ আর ঝুড়িগুলো।
জ্যৈষ্ঠ মাস এলেই এ মানুষদের কদর যায় বেড়ে। বাগানগুলোতে তখন পাকা পাকা আম আর লিচু ঝোলে। রাজশাহী থেকে তা বাঁশের ঝুড়িতে চলে যায় সারা দেশে। ঝুড়ির জন্য আশপাশের মানুষ এ সময় ভিড় জমায় এ গ্রামে।
আদিবাসী এ গ্রামের প্রধান দাও হাঁসদা। বয়স ষাটের মতো। পরিচয় হতেই জানলাম মাহালিদের সমাজকাঠামোর কথা। মাহালিদের সমাজব্যবস্থায় মানঝি হলেন গ্রাম বা সমাজপ্রধান। উনি গ্রামের যাবতীয় সামাজিক বিচার-সালিস, পূজা-পার্বণ, বিয়ে ও অন্যান্য অনুষ্ঠান সম্পাদন করেন। এ ছাড়া নানা বিষয়ে দিকনির্দেশনার জন্য জগ মানঝি, সংবাদ প্রচারের জন্য সাকিদার, সকল পূজা পরিচালনার জন্য নায়কি পদ রয়েছে। সাধারণত এই পদগুলো যোগ্যতার ভিত্তিতে ও গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচন করা হয়। এ নিয়ে মাহালিদের মধ্যে কোনো মতপার্থক্য তৈরি হয় না।
রাজশাহীর গোদাগাড়িতে বসবাসকারী সাঁওতাল আদিবাসীদের মতো মাহালিদেরও হেমব্রম, হাঁসদা, মুরমু, বাস্কে, টুডু, সরেন, কিস্কু ইত্যাদি গোত্র রয়েছে। কিন্তু গোত্র নামের মিল থাকলেও তাদের ধর্মীয় প্রতীকের মধ্যে রয়েছে ঢের পার্থক্য।
অনেকের মতে, মাহালি শব্দটি সাঁওতালি ভাষার মাহ শব্দ থেকে এসেছে। যার অর্থ হচ্ছে বাঁশ। যেহেতু বাঁশ থেকে ঝুড়ি নির্মাণের পেশাকে তারা বেছে নিয়েছে এবং বাঁশ জাতীয় বা বাঁশকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ধরনের কাজের সঙ্গে তারা যুক্ত, সে কারণে তাদের মাহালি বলে অভিহিত করা হয়। উত্তরবঙ্গের বরেন্দ্র অঞ্চল ছাড়াও রংপুর ও দিনাজপুরেও মাহালিদের বসবাস রয়েছে। এদের পূর্বপুরুষরা এসেছে ভারতের ঝাড়খন্ড, উড়িষ্যা, পশ্চিমবঙ্গ ও মধ্যপ্রদেশ থেকে।
ঝুড়ি নির্মাণকে মাহালিদের পেশা হিসেবে বেছে নেওয়ার পেছনে প্রচলিত আছে একটি বিশ্বাস। দাও হাঁসদা জানালেন তা। মাহালিরা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে, জমি বা মাটিতে সরাসরি ফসল উৎপাদন করলে তা হয় সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছার পরিপন্থী। তাই চাষাবাদের পরিবর্তে তারা বেছে নিয়েছে বাঁশের ঝুড়ি তৈরির কাজ।
সাঁওতাল বিয়ের রীতিতে কনেকে বাঁশের ঝুড়িতে বসিয়ে সাতপাক ঘোরাতে হয়। একসময় সাঁওতালদের ওই ঝুড়ি বাধ্যতামূলকভাবে কিনতে হতো মাহালিদের কাছ থেকে। এটি ছিল অনেক আগের রেওয়াজ। এ কারণে অনেকেই মনে করেন মাহালিরা সাঁওতাল আদিবাসীদেরই একটি অংশ।
গোটা গ্রামটি ঘুরে দেখি আমরা। গ্রামপ্রধানের বাড়িতে বসতেই আড্ডা জমে ওঠে। আসরে যোগ দেন জগ মানঝি, সুশীল হেমব্রমসহ অনেকেই। আলাপ ওঠে মাহালিদের আদি পূজা-পার্বণ নিয়ে। প্রথমে মুখ খোলেন সুশীল হেমব্রম। জানালেন গরয়া পূজাটির কথা। বাড়ির গৃহপালিত জীবজন্তুরা আদিবাসী সমাজে বিভিন্নভাবে পূজা পেয়ে থাকে। মাহালিরাও তাদের গৃহপালিত গো-মহিষকে কেন্দ্র করেই গরয়া পূজার আয়োজন করে থাকে। এই পূজায় বাড়ির মহিলারা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যাবতীয় কাজ করে থাকে। গো-সম্পদ বৃদ্ধি এবং গো-সম্পদের মঙ্গল কামনা করেই এ পূজার আয়োজন চলে।
কার্তিক মাসের অমাবস্যার পরদিন অর্থাৎ শুক্লা প্রতিপদ তিথিতে মাহালিরা গরয়া পূজা পালন করে। ওই দিন তারা তাদের বাড়িঘর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে গোবরজল ছিটায়। এ উপলক্ষে ভেঙে ফেলা হয় বাড়ির পুরোনো উনান। ঘরের পুরোনো মাটির বাসনপত্রগুলোও ফেলে দেওয়া হয়। পূজার দিন ভোরে বাড়ির মেয়ে-বৌরা স্নান সেরে পুকুর বা নদী থেকে এঁটেল মাটি নিয়ে এসে সেই মাটি দিয়েই নতুন করে উনান তৈরি করে। অতঃপর এই নতুন উনানেই তৈরি করা হয় পূজার জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক পিঠে। সুশীল হঠাৎ থেমে যান। বাকিটা বলেন দাও হাঁসদা।
শালুক ফুল বা পদ্মফুল ছাড়া মাহালিদের গরয়া পূজা হয় না। বাড়ির গোয়ালঘরে গরয়া ঠাকুরণের উদ্দেশে মাটি দিয়ে তৈরি করা হয় উঁচু ঢিপি। শালুক বা পদ্মফুল এবং নতুন উনুনে তৈরি পিঠেসহ আতপ চাল দিয়ে প্রতি পরিবারের কর্তারাই গরয়া ঠাকুরণের উদ্দেশে পূজা দেন। এই পূজায় মুরগি বলি দেওয়া ও উপবাস থাকার রীতিও চালু রয়েছে। পূজার দিন গোয়ালঘরে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় শালুক ফুল। পূজা শেষে বাড়ির নারীরা নতুন কুলায় ধান, দূর্বা, সিঁদুর, ধূপ, ধুনা, প্রদীপ ইত্যাদি সাজিয়ে গো-দেবতাকে বরণ করেন গোয়ালঘরে গিয়ে। এ সময় সবার পরনে থাকে নতুন কাপড়। পূজা উপলক্ষে নতুন উনানসহ মাটির নতুন বাসনপত্রও ব্যবহার করা হয়। মাহালিদের গরয়া পূজাটির সঙ্গে মিল পাওয়া যায় সাঁওতালদের সহরায়, মুন্ডাদের গঠবতা, ভূমিজ ও কোড়াদের বাঁদনা পূজাটির।
কেন এবং কখন থেকে গরয়া পূজা মাহালি সমাজে প্রচলিত হয়ে আসছে? এমন প্রশ্নের উত্তর হিসেবে মাহালি সমাজে প্রচলিত আছে একটি পৌরাণিক কাহিনী। কোনো বিশেষ কারণবশত শ্রীকৃষ্ণ একবার বৃন্দাবনবাসীদের ইন্দ্রের পূজা করতে বারণ করেন। শ্রীকৃষ্ণের কথামতো বৃন্দাবনবাসীরাও দেবতা ইন্দ্রের পূজা করা বন্ধ করে দেন। এতে দেবতা ইন্দ্র অপমান বোধ করেন এবং ক্রুদ্ধ হন। বৃন্দাবনবাসীদের শিক্ষা দিতে তিনি সারা দিন মুষলধারে বৃষ্টিপাত ঘটিয়ে বৃন্দাবনকে জলমগ্ন করতে চাইলেন। হলোও তাই। বৃন্দাবনের চারদিকে তখন শুধু জল আর জল।
এ সময় বৃন্দাবনবাসীদের রক্ষা করতে এগিয়ে আসেন শ্রীকৃষ্ণ। তিনি গিরিগোবর্ধনকে বৃন্দাবনের ওপর ছাতার মতো ব্যবহার করেন। ফলে মুষলধারার বৃষ্টিপাতের হাত থেকে রক্ষা পায় বৃন্দাবনবাসী। সেই থেকে শ্রীকৃষ্ণ বৃন্দাবনবাসীদের গিরিগোবর্ধন এবং গো-জাতির পূজা করার নির্দেশ দিয়েছেন। ফলে তখন থেকেই গরয়া পূজার প্রচলন হয়ে আসছে। এ পূজার সময় গোয়ালঘরে গিরিগোবর্ধনের প্রতীক হিসেবে একটি ঢিপি এবং পাশাপাশি গোবরের একটি ঢিপি বানিয়ে পূজা করে মাহালিরা। দাও হাঁসদা থামতেই গান ধরেন জয়নিকা হেমব্রম। তাঁর সঙ্গে কণ্ঠ মেলায় অন্যরা।
আকাশেতে চাঁদ নাই
কি করিবেক তারা?
যার ঘরে সয়া নাই
জিয়ন্তে সে মরা।
গরয়া পূজা ছাড়াও বৈশাখ মাসে-সূর্য্যদেবীর পূজা, মাঘ মাসে শস্য দেবতার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য ধরম পূজা, অশুভ শক্তি ও রোধব্যাধি দূর করার জন্য মাঘ মাসে গরাম ঠাকুর ও যুগিনী পূজা, ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমীতে জিতিয়া উৎসবের আয়োজন করে মাহালিরা।
পূজা ও উৎসবগুলো মাহালিদের কাছে আজ শুধুই স্মৃতি আর পূর্বপুরুষদের কুসংস্কারের কাহিনী মাত্র। কেননা এ অঞ্চলের মাহালিরা খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করে আঠারশ শতাব্দীতে। ফলে মাহালিরা হারিয়ে ফেলে আদিবাসী হিসেবে তাদের স্বকীয় আচার ও সংস্কৃতিগুলোকে। মাহালিরা আজ নিজেদের খ্রিস্টান হিসেবে পরিচিত করলেও বাঙালি খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের কাছে এখনো তারা আদিবাসী।
সালেক খোকন : লেখক ও গবেষক