সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন
‘অন্তরের বাসনাখান ক্রমে পুষ্প হৈয়া ফোটে! ’
এতো না বোলে গোস্বা জুলির উপরে ইসুফ মিয়ার! কই, পাঁচ দিনের দিন জুলিগো বাড়ির ঘাটায় জুলিরে দেইক্ষা দি ইসুফে জান-পরান হাতে লইয়া অর দিগে ছুট দেয়! গোস্বা করা মাইনষে কি এমনে কাছে যায়! জুলিরে দেখামাত্র ইসুফের পরানের ভিতরে কিমুন জানি চিলকি দিয়া ওঠে! তার বাদে ধকপক ধকপক করতে থাকে অর পরান! ক্রমে সেই পরানে য্যান ফাইট্টা যাইতে চাইতে থাকে! এইটার নাম গোস্বা! তাইলে খুশি লাগে ক্যান! ভিতরে-বাহিরে ফুরফুরা লাগতে শুরু হয় ক্যান আঁতকাই! আউলা-ঝাউলা লাগে ক্যান পুরা শইলখান! এমুন লাগে ক্যান অখন জুলিরে দেখলেই!
‘জুলি! জুলি! ভালা হইছে তর হাত! ভালা অইছস তুই?’ জুলিগো বাড়ির নামা দিয়া ঘুরান্তি দিতে থাকা ইসুফে এক লৌড়ে উইট্টা আহে জুলিগো ভিটার পুবমুড়ায়। পুব মুড়ায় আছে ভোমা তেঁতুল গাছখান। সেই গাছে ঠেস দিয়া খাড়ানো জুলি কাহিল চক্ষে চায় ইসুফ মিয়ার দিগে।
‘মিয়াভাই!’ কইতে কইতে জুলি গাছের গুঁড়িতে বসে। ‘আপনে আমারে বিছরাইছেন, না?’
‘বিছরাইছি তো! এমুন দংশনটা লাগছে তর হাতে, চিন্তা অয় কিনা মাইনষের!’
‘অনেক জ্বর আইছিলো মিয়াভাই! বহুত কড়ড়া জ্বর।’
‘দেহি; হুল বিন্ধনি জায়গাটার কী দশা!’
জুলি শরমে জুড়িমুড়ি খাইতে খাইতে কোনোরকমে নিজের ডাইন হাতের পাতাখান আলগোচ্ছে আগ্গাইয়া দেয় ইসুফের সামোনে। ডাইন হাতের তাউল্লার বুইড়া আঙুলের নিচ দিয়া দংশন খাইছে জুলি। আহহারে! অহনও এট্টু এট্টু ফুলা দিয়া আছে জায়গাটা! ‘অখনও বিষ করে রে তর?’ নিজের দুই হাতের পাতা দিয়া জুলির দংশন-খাওয়া, কাতর পাতাখানরে আলগোচ্ছে জাবড়ানি দিয়া ধরে ইসুফে।
এতো যে কাহিল এই এট্টুক হাতের পাতাখান, তাও দেখো কেমুন মুলাম আর ওম ওম এই হাত! কই দেখছিলো! কোনখানে জানি পাইছিলো এমুন ওম একদিন, ইসুফে! কই জানি দেখছিলো এমুন নরম, এমুন ওমেভরা কী জানি! ধরছিলো সেইটারে, মোনে আইতে থাকে ইসুফের! ধরছিলো সেয় সেই জিনিসরে! ধরছিলো দুই হাত দিয়া! হাতে ধরা আছিলো সত্য; কিন্তুক তাও সেই ধরা জিনিসটারে তার মোনে হইতাছিলো যে, সেই জিনিসরে য্যান ধরে নাই সেয়—সত্য সত্য ! তার তহন মোনে লাগতাছিলো য্যান সপন দেখাতছে সেয়!
কী ধইরা তার এমুন উচাটন, বেতালা লাগছিলো আগে, একদিন! কবে জানি! এই যেমুন অহন জুলির হাতখান ধইরা লাগতাছে! পুরা শইল এই অখনের লাহান বেতালা লাগছিলো কবে? মোনে আহে? হ! হ! মোনে আহে ইসুফের! মোনে আহে। মোনে আইতে থাকে অতি আস্তে।
একবার সেয় চৈত মাসে, তাগো গুলাব জাবুন গাছের একত্থোক্কা ফুলেরে ধরছিলো! কিমুন যে মুলাম অই ফুল! তার হাত পাগলা পাগলা লাগতাছিলো না হেসুম, অই ফুলের থোক্কাটারে ধরোনের পর? পুরাটা দিন হাতেরা অথির হইয়া আছিলো না, ইসুফ মিয়ার? আছিলো! আছিলো তো! আউজকা দেহো দেহি, সেই ফুলের থোক্কা আবার কেমনে ইসুফের হাতের ভিতরে আইয়া পড়ছে!
সেই ফুলে তো ওম আছিলো না! ইসুফের হাতের ভিতরের এই ফুলের থোক্কায় এমুন ওম আইছে কোনখান তেনে! কেমনে আইছে! কইত্তেনে আইছে! এইত্তো, অস্তে অস্তে, মোনে আইতাছে ইসুফের। মোনে আইতাছে সেই ওমের কতা!
অই যে সেইবার মায়ের পালা গিরিবাজ কবুতরটারে এক ঝলকের লেইগা ধরছিলো সেয় দুই হাতে! অই যে কবে একদিন! হাত তার ওমে, আহ্লাদে কেমুন তপ্ত হইয়া গেছিলো! চক্ষের পাতাটা ফালানেরও আগে কেমুন ওমে ভরভরা হইয়া গেছিলো না তার হাত! কেমুন তপ্ত, অবশ লাগতাছিলো না তার হাতেরে! পুরা দিন তামানটা রাইত! সেই ওম—অখন আবার—এই যে ইসুফের দুই হাতের ভিতরে! এই যে!
তখন দেখো ইসুফ মিয়ায় নিজেরে কেমুন তালছাড়া, বেবোধা, আন্ধা লাগতে থাকে! লাগে য্যান ধুম জ্বর আইছে তার এইমাত্র! নিজের চক্ষের সামোনের তেনে দিন-দুনিয়া পুরা নাই হইয়া যায়। খালি তার হুঁশহারা মোখ—অই ওমমাখা ফুলের থোক্কার উপরে ঝাপটাইয়া পড়োনের লেইগা দাউদাউ করতে থাকে! তার বাদে আঁতকা সেয় নিজের জ্বর-ওঠা মোখখানরে, বন্ধ চোখগিলিরে, ফাতফাতাইয়া জ্বলতে থাকা ঠোট দুইখানরে গুইজ্জা দেয় সেই নরম, মুলাম, তপ্ত ওমে!
এমনে এমনে কতখোন যায়? পুরা জনমখান? পুরা দিনখান? নাকি এক পল! কী জানি! তাগো দোনোজনের কেউরই সেই হুঁশটা থাকে না। তয়, মাটির দুনিয়া তো চলে পাক্কা হুঁশ নিয়া। বাড়ির ভিতরে জুলেখার মায়ের খেয়াল পড়ে যে, তার মাইয়ায় উঠানে নাই! তক্ষণ সেয় গলা চড়ানি দিয়া ডাকা শুরু করে মাইয়ারে। ‘জুলি! অই ছার-কপালি! অসুইক্ষা শইল লইয়া কই গিয়া রইছস আবার! জোলেখা! অই মাইয়া!’
সেই ডাকের তুফান আইয়া তাগো দোনোজনরে কঠিন ধাক্কা মারে। একটা টু আওয়াজও না—কইরা জুলেখায় ভিতর-বাড়ির দিগে ছুট দেয়! এমুনই ডরে থাকে সেয় যে, একবার ঘাড়টা ঘুরানি দিয়া মিয়াভাইয়ের দিগে একটা চাওন দেওনেরও খেয়াল পড়ে না তার।
বারে ব্বা! গেলো গা উয়ে! গেলো গা! এমনে গেলো গা! অখন সেয় কী করবো! নিজেরে নিয়া কই যাইবো! এই যে তার শইল থরথরানি দিতাছে, কই নিয়া থির করবো এরে, ইসুফে! তামান দুনিয়াভরা খলখলা রইদ। তাও ইসুফের সামোনে য্যান সবকিছু আন্ধার, খুয়া খুয়া! এমুন লাগে ক্যান!
তেঁতুলতলার ছেমাতে, কতখোন থোম দিয়া খাড়াইয়া থাকে ইসুফে। তারবাদে করে কী, সেয় ধুমাদ্দুম নিজের তবনে কাছাটা মাইরা, হুনহুনাইয়া তেঁতই গাছখানে গিয়া চড়ে। সেই কোন আমলের এই তেঁতই গাছ। দুইজোন সিয়ানা মাইনষে চাইর হাত দিয়া বেড় দিলেও তারে পুরা ঘের দিয়া ওঠোন যায় না! যেমুন উঁচা, তেমুন ভোমা এইবাড়ির এই তেঁতই গাছখান! আর, তার ডালাডোলারও কোনো হিসাব-নিকাশ নাই! সেই সগল ডালে তার যতো না পাতা, তার তেনে হাজারে-বিজারে বেশি ধইরা রইছে তেঁতই!
গাছে উইট্টা তবদা-লাগা শইল নিয়া, বহুতখোন, ধোম মাইরা বইয়া থাকে ইসুফে। ক্যান গাছে ওঠলো সেয়! কী করতে ওঠছে! এইসব গুঁড়াগাঁড়া কথা ইসুফে এট্টু লাড়া-চাড়া দিয়াও সারে না, কইলজার ভিতরে আবার কিমুন জানি একটা কামড় পড়ে তার। কামড়টা ক্রমে গাড়াইয়া যাইতে থাকে। বহুত চেত ওঠতে থাকে তার, কার উপরে জানি! আবার দেখো, বিরাট চেত ধরতে থাকে তার এই তেঁতই গাছখানের উপরে। তর, হালার তেঁতই গাছ! খ্যাতা পুড়ি তর!
দাঁতে দাঁতে কিড়মিড়ানি দিতে দিতে ইসুফ মিয়ায় করে কী, নিজের কাছাখান খুইল্লা তারে উল্টা প্যাঁচ দিয়া গিট্টু দেয়। তার বাদে সেয় ধমধমাইয়া তেঁতই তোলতে থাকে। একখান পোক্ত ঠাইল্লায় ভাও মতোন খাড়াইয়া তেঁতই তোলা ধরে সেয়। কাঁচা-পাকা বাছে না; বাত্তি-আবাত্তি বিচার করে না, দুই হাতে ঠাইসসা তেঁতই পাড়তে থাকে। পাড়তে থাকে, আর তবনের কোঁচড়ে থুইতে থাকে। থুইতে থুইতে থুইতে—আরে সব্বনাশ! তবন ফুইল্লা দেখো ঢোল! আঙ্গুলও য্যান আর আঙুল নাই! পুরা বেবশ, ভোন্দা দশ দশখান কাঠি য্যান ইসুফের হাতের আগায় কোনোমতে খাড়া দিয়া আছে!
সেই আঙুলগো নিয়া হেঁচড়াইয়া-পাছড়াইয়া মাটিতে নামে ইসুফে। অখন, এই তেঁতই দিয়া সেয় কী করবো! ক্যান! যাগো গাছের তেঁতই, তাগো হরাদ দিবো সেয় এই তেঁতই দিয়া। না, ইসুফে হরাদ দিবো না! নিজেগো তেঁতই দিয়া তারা নিজেরাই নিজেগো ছেরাদ্দ করুক! নিজেগো হরাদ করুক গা ইচ্ছামতোন!
সেয় কোঁচড় তেনে তেঁতইটি হড়বড়াইয়া গাছের সামোনের মাটিতে ঢালে। ইসস! আলা য্যান মাথাটা ঠান্ডা লাগতাছে! আলা য্যান দিন-দুনিয়ারে চক্ষে দেখতে পাইতাছে সেয়! মায় জানি কোন বিছরান বিছরাইতাছে ইসুফরে! হুড়মুড় পাওয়ে ইসুফে বাড়ির দিগে যায়। পিছে অই যে সেয় কী কইরা থুইয়া গেলো, অই যে সেয় গাছে-মাছে কোন আগুন লাগাইয়া থুইয়া গেলো; সেই কথা একটা ফোটা তার স্মরণে থাকে না।
শোন-শোনা-শোন পুরা গেরামের লোকের কাছে খবর আইয়া পড়ে যে, হেগো বাড়ির ইসুফ মিয়ায় দেখো গা আবার কত্তা বড়ো একটা কুকাম করছে! গাছের ফল, মাইনষের কিছমতের জিনিস! তার নি এমুন অনিষ্টি করে কোনো মাইনষে! তোবা আছতাগফেরুল্লা! ছেড়ায় তো চামারের চামার হইয়া ওঠছে, তলে তলে!
শরমে ইসুফ মিয়ার বাপে গেরামের কেউর দিগে আর মোখ তুইল্লা চাইতে পারে না। এত্তাবড়ো সিয়ান পোলা! আইজ বাদে কাইল, বাড়ির ভালা-বুরা দেখোনের দায় যার কান্ধে যাইবো; সেয় যুদি এমুন নাক-কাটা কাম করা ধরে, তাইলে আর কিসের আশা! বাপে-মায়ে-ফুবুয়ে চুপ্পে-চাপ্পে যুক্তি করে যে, আর বাড়িত বহাইয়া রাখোনের কাম নাই পুতেরে। এইবার তারে গদির কামে নিয়া লাগাউক বাপে! বিয়ানে লগে লইয়া যাইবো, রাইতে লগে লইয়া ফিরতি আইবো।
গদিতে তো কামের লোকের কোনো কমতি নাই। হেগো ভিতর তেনে কোনো একজোনে এট্টু নজর নাইলে রাখবো পোলার দিগে! তার ভিতরেও যুদি উয়ে পলায়, তাইলে মানতে হইবো যে, অইই নসিবের লেখা!
ওম্মা! গদিতে গিয়া কী সোন্দর কামের নিয়মে কাম করতে থাকে ইসুফ মিয়ায়। দেইক্ষা-বুইজ্জা বাপের কইলজাটা শান্তিতে পুরা শীতল হইয়া যায়। এমনে এমনে বছর ঘুইরা যাইতে থাকে গা। কো, পলানির নামও তো নেয় না পুতে! সোন্দর বাপের লগে লগে যায় গদিতে, সোন্দর মতোন বাপের লগে লগে বাইত আহে! তয়, মাঝে মইধ্যে আঁতকা য্যান অর ঠেঁটা, হারামি খাছলতখান ঘুরুত কইরা মাথা-চাড়া দিয়া ওঠে! ক্যান যে ওঠে, তার কারোন তো বাড়ির কেউ বিছরাইয়া পায় না! ক্যান করে এমুন নিদয়া কর্ম!
একদিন হইছে কী, বৈকাল বেলা; সেইদিন বাপেরে কইয়া-বুইল্লা রাজি করাইয়া বৈকালেই বাড়িতে আহে ইসুফে। বাড়ির পুত যহন মোনে লইবো বাড়িত থাকবো, তাতে দোষের কী! অম্মা, উয়ে বাড়িত আইয়া মোখে এট্টু পানিও দিয়া সারে নাই, কই জানি হাঁটা দেয়! কিরে! এট্টু কিছু খা! মায় পিছের তেনে ডাক পাড়তে থাকে; পুতের কানে সেই ডাক গেলে তো!
এই না কই জানি গেলো, আবার দেখো কই ত্থেইক্কা জানি ফিরতিও আইলো তগ-নগদ! মায়ে ভালা কইরা নজর দিলে ঠিকই দেখতো যে, যেই আশাভরা পাওয়ে পোলায় বাড়ির তেনে যায়, সেই আশাভরা পাও নিয়া সেয় বাইত ফিরে না।
ফিরে য্যান কেমুন মরা-মাইনষের লাহান পাও-হাত নিয়া। হিম ঠান্ডা, রক্ত নাই হইয়া যাওয়া মোখে সেয় বাইত আহে। তার বাদে, মোন অইতে থাকে যে, বাড়িত ইসুফে আইছে ঠিকই; কিন্তুক বাড়িত আইয়া য্যান কী করবো, দিশা পাইতাছে না সেয়! সেইসোম বান্ধা কামলাগো একজোনে গরুরে ফেন দিতাছিলো। নিত্যি কামে ভুল-চুক কতো অয়! অতো তারে গেরাজ্জি করলে চলে! চলে না।
কিন্তুক কামলার হাতের তেনে আধাটা ফেন ক্যান মাটিত ছলকাইয়া পড়লো, এই দোষে সেয় কামলাটারে করে কী, গরু বান্ধনের খুঁটার লগে নিয়া ঠুয়া দিতে থাকে। জোররকম ঠুয়া। একবার দেয়, দুই বার দেয়, তিনবার দেয়। শেষ কাটালে নি ফুবুরে লৌড় দিয়া আইয়া কামলারে বাছাইতে অয়, অই পোলার হাত তেনে! কামলা ছেড়ার কপাল ফাইট্টা ফিনকি দিয়া লউ বাইর হইয়া শেষ! কী গজবের কাম করে এইটা পুতে! অল্প দোষে এমুন দণ্ড নি দেয় কেউ!
পরানের ভিতরে নাই-আগুনের পোড়ানি নিয়া ইসুফে মায়ের গাইল খাইতে থাকে। দেউক গালি মায়! কইলজা খুইল্লা গাইল্লাক সেয়। ইসুফের অন্তর-পোড়ানি যুদি অই গালির ঝাপোটে এট্টু শীতল অইতো! এট্টু শীতল! জুলির লেইগা গঞ্জের তেনে একমুঠ চুড়ি কিন্না আউজকা আগে বাইত আইছিলো ইসুফ মিয়ায়। চুড়িটি যুদি কোনোপ্রকারে আউজকাই অরে দেওন যায়! আইছে এই আশায়! না, আশা পুরে নাই। দেওন যায় নাই! জুলিরে আউজকাও কারা বোলে দেখতে আইছে!
‘ওরে আমার নসিবরে! ক্যান এমুন খুন উইট্টা যায় অর মাতায়!’ ইসুফ মিয়ার মায়ে কাইন্দা-কাইট্টা লায়-লুট হইতে থাকে। ফুবুর মোনে অয় যে, এইর পিছে তাবিজ-কবজ-কুফরি কালামের ঘটনা আছে। সম্ভব, ইসুফ মিয়ার মামুরা কিছু করছে! অই যে, তাগো বাড়া ভাতে ছাই দিয়া বাড়ির পোলা বাড়িতে নিয়া আসছে বাপে-মায়ে। অখন, কোরোধের মাথায় মামুরাই করছে এই কুকাম! করছে য্যান অই পুতের মাতাখান যায়! মাথা-খরাপের আও-ভাও চক্ষে পড়ে কিনা? চক্ষে পড়ে।
অহনে এই পোলারে বাছানের উপায় কী! উপায় হইলো উল্টা তাবিজ করোন। ফুবু আর মায়ে মিল্লা পাঁচ পাঁচখান তাবিজ করে। এমনে যুদি আলা ইসুফ মিয়ারে বাছান যায়! অল্প কালের ভিতরেই তাবিজের বড়ো সুফল ফলে। কী আগুইন্না তাবিজ! একমাস যায়, দুই মাস যায়, ইসুফের মাথা-গরমের বাইটা চাগাড় দেয় না।
তিন মাসের মাথায় আবার একখান কুকর্ম সাধন করে ঘাউরা ছেড়াটায়! তবে এইটার সন্ধান আর গেরামের দশজোনে পায় না। জানে কেবল দুইজোনে : এক জুলি, আরেক ইসুফ মিয়ায়। জুলিরে যে অগো বাড়ির কোনোদিগে দেখা যাইবো, এমুন আশা সেদিন করে নাই ইসুফে। আইজকাল তারে থাকতে হয় গদির কাম নিয়া, থাকতে হয় বাপের চক্ষের উপরে। ফাঁক বলতে পায়ই না ইসুফ মিয়ায়।
কিন্তু যেমনেই হোক, এট্টু ফাঁক ইসুফে বাইর কইরা নেয়ই জুলিগো বাড়ির ঘাটা দিয়া ঘুরান দেওয়ার লেইগা। তেঁতইয়ের বিত্তান্ত ঘটানের পর জুলেখার মাও কী বাপের সামোনে পড়ার কথা মাথায়ও আনতে পারে না ইসুফে। বাইরে যতোই কিনা বেটাগিরি দেহাইতে থাকে সেয়, কিন্তুক ভিতরে ভিতরে লাজে খানেখান হইয়া যাইতে থাকে। কোন কারোনে সেয় এমুন আমাইনষের লাহান খরাপ কামটা করলো অইদিন! ধিক তারে!
এইসব লাজ-শরম নিয়া অখন সেয় ঘাটা দিয়া চলাচলতি করে একদম আলগোচ্ছে। জুলিরে দেখা যাউক বা না যাউক—সেইটা আর কোনো বিষয় থাকে না অর কাছে। এট্টু খালি অগো বাড়ির ঘাটা বেইড়া ঘুরান দিয়া আইলেও পরানটা শান্তি লাগে ইসুফের! ফাঁক পাইলেই ইসুফে অই বাড়ির সগলমুড়া দিয়া একটা ঘুরান্তি দিয়া ফালায়ই।
সেদিনও জুলির দেখা পাওনের কোনো আশা অন্তরে না রাইক্ষায় একটা ঘুরানি দিতে যায় সেয়। বিয়ান বেলা। তয়, বেইল বাড়োনের দিগে যাইতাছে। বাজানেরে গোছলে যাইতে দেইক্ষা সেয় বোঝে যে একটা ঘুরানি দেওনের একখান ফাঁক সেয় পাইবো অখন।
জোরতে পাওয়ে ঘুরানি দিলে, বাজানে খাইতে বওনের আগেই সেয় বাড়িতে ফিরতি আইতে পারবো। এই চিন্তা মোনে নিয়া জুলেখাগো ভিটির পুবদিগে সেয় খালি গেছে, দেখে জুলিয়ে সেই তেঁতই তলে খাড়া। উইয়ে এমুন সোমে এইনে কী করে!
না! বড়ো আচানক একখান কারবার করতাছে অখন জুলেখায়! কী করে!
সেয় মুড়ি খায়, আবার কাউয়াগোও বিলায়। ইসুফে দেখে জুলেখার হাতে ধরা গোলগাল, ছোটো একখান কাঠা। একহাতে কোনোরকমে ধরা সেই কাঠার তেনে হালকা-পাতলা দুগা মুড়ি নিজের মোখে তোলে একবার, একবার তার সামোনের মাটিতে দুগা ছিটায়।
আশপাশের মাটিতে, ফারাকে ফারাকে বসা দিয়া আছে দুই-তিনটা পাতি-কাউয়া। জুলি মুড়ি ছিটাইতাছে, আর একেকটা কাউয়ায় ফাল দিয়া দিয়া মুড়ির কাছে আসতাছে; খপ্পর কইরা ঠোকর দিয়া মুড়ি মোখে দিতাছে, আবার ফাল দিয়া দূরে যাইতাছে গা। জুলি মুড়ি খায়, না বিলায়! কাউয়ার লেইগা মায়া হয় মাইয়ার, এই পোলাটার লেইগা হইতে পারে না?
মোনে মোনে হাজারবার এই কথা জুলিরে জিগাইতে থাকে ইসুফ মিয়ায়, কিন্তু সেই কথা মোখে আনতে পারে না। মোখে কয়, ‘কিরে ঢেপি! আউজকা তরে দেখতে আহে নাই?’
‘মিয়াভাই!’ গোস্বার একটা চিক্কুর দেয় জুলিয়ে, তয় দেয় আস্তে। ‘আপনে খালি এটি কইয়া আমারে জ্বালান্তি দেন! দেখতে আইলে আমি কী করমু!’
‘ক্যা! খেদাইয়া দিবি হেই মাইনষেগো!’ ইসুফে কয়। কইতে কইতে সেয় জুলির বেনীত ধইরা জোর টান মারে! এমুন জোরতে টান দেয় মাইনষে! জুলির চোখ দিয়া আউলা-পাথারে পানি ছোটে! হায়! হায়! দুক্ষু পাইছোস! আমি বুঝি নাই, জুলি! বুঝি নাই!
ও রে বাপ্পুইস রে! দোনোজোনে গলা নামাইয়া, এই-তাই নিয়া, এট্টুক কথা খালি কওয়া ধরছে কী ধরে নাই, ভিতর বাড়ির তেনে জুলেখার মায়ের ডাক পাড়োন শুরু হইয়া যায়! জুলি করে কী—কোনোরকম একমুঠ মুড়ি ইসুফের হাতে গুইজ্জা দিয়া বাড়ির ভিতরে যাইতে লৌড় দেয়। আর অদিগে, ইসুফে তরাতরি পাওয়ে গিয়া খাড়ায় আজদাহা তেঁতই গাছখানের আউইলে। জুলি আগে ইসুফের চক্ষের সামোনের থেইক্কা অদিশ্যি হইবো, তয় সেয় লড়বো এই জায়গার তেনে।
যাইতে যাইতে জুলি এক ঝলক ঘাড় ফিরানি দেয় ইসুফ মিয়ার দিগে; আর দেখো কিছুর মিদে মিদে কিছু না; জুলি কিনা উষ্টা খায়! হুদামিছি উষ্টা খায়। যাহা তাহা উষ্টা না, জোর উষ্টা! আহারে! কিমুন চোটটা না জানি পাইলো উয়ে, পাওয়ে! পরানটা হায় হায় করন্তি শুরু করে ইসুফ মিয়ার!
দেখো অদিগে কী কু-কামখান হইয়া সারছে! আহহারে! জুলি নিজেই খালি তার পাওয়ের আঙুলে দুক্ষু পায় নাইক্কা; উষ্টার চোটে অর হাতের কাঠাখান ছিটাকাইয়া মাটিতে পইড়া, মুড়ি ছিট্টা-ভিট্টা নাশ হইছে! চিল্লানি দিয়া জুলির দিগে অর মায়ের আওয়ার আওয়াজ পায় ইসুফ মিয়ায়। আর কেমনে সেয় এমনে খাড়া দিয়া থাকে! অর মায় দেখলে দুনিয়া ফাইড়া ফালাইবো না !
তরাতরি পাওয়ে, পাতরে নাইম্মা বাড়ির রাস্তা ধরে ইসুফ মিয়ায়। কতাখানি দুক্ষু পাইছে জুলি! উষ্টাটা তো জোর উষ্টা আছিলো! আঙুল থেঁতলাইয়া যায় নাইক্কা তো অর! এই যে দুক্ষু-বিষ-বেদনা পাইলো জুলেখায়, তার ভালা-বুরা কিছুই তো জানোনের হক নাইক্কা ইসুফের! চক্ষের দেহাটা তরি দেহোনের হক নাই অর! আরে, হালায়! এইটা কিমুন ফেরের তলে পড়ছে সেয়! হাঁটতে হাঁটতে গোস্বায় ভিতরটা বলক দিতে থাকে তার! টগবগাইয়া বলক দিতে থাকে। আরে হালার! অদিগে বাজানে না আবার অরে বিছরানি দিতাছে, এইর মিদে!
একদিগে বাজানের ডর, আরেকদিগে জুলির চিন্তা! চেতটা যে কিমুন অয় ইসুফের! অন্যসোম এমুন চেত নিয়া, দুনিয়াদারিরে ফালি দেওনের রোখখান ভিতরে নিয়া, ইসুফে যেমুন মোনে লয় তেমুন নষ্ট-বুরা কাম কইরা থোয়। করলেই শান্তি। কিন্তুক সেই দিন, কোরোধ শান্তি করোনের লেইগা কোনো বুরা কাম ক্যান জানি করতে মোন চাইতে থাকে না! সেয় নিজের কোরোধ নিজের পরানে নিয়া হাঁটতে থাকে হনহন।
কোরোধরে অন্তরে নিয়া হাঁটতে হাঁটতে, আঁতকা, একটা আচানক বাসনা ফাল দিয়া ওঠে তার ভিতরে! বাসনাখান ফাল দিয়া উইট্টা ইসুফ মিয়ারে কাঁপানি-কুপানি দিতে থাকে। ঝাঁকানি দিতে থাকে। উড়াইয়া কই জানি লইয়া যাইতে থাকে!
দেখো আঁতকা ইসুফ মিয়ার অন্তরে কোনকথা জাগনা দেয়! জাগনা দেয় এই কথাখান যে; আরে, এই ছেড়িরে উয়ে বিয়া করতে পারে না? বিয়াই তো করতে পারে অরে! ঘরের বউ কইরা নিজের বাইত নিয়া থুইলেই তো আর এমুন জ্বালাজ্বালা অওন লাগে না ইসুফ মিয়ারে! তাইলেই ত্তো এমুন খালি চুরিচারি করোনের দরকার পড়ে না! তাইলেই ত্তো এতো লুকি-ছাপি দিয়া, খালি চক্ষের দেহাটা দেখোনের আশটা মিটান লাগে না! কেমুন বেকুব ইসুফে! ক্যান, এমুন কামের কথাখান এতোদিন তার মাথায় আহে নাই! ইসুফে বেকুব না তো বেকুব কেটায়!
(চলবে)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ২৪)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন(কিস্তি ২৩)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন(কিস্তি ২২)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ২১)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ২০)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১৯)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১৮)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১৭)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১৬)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১৫)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১৪)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১৩)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১২)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১১)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১০)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ৯)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ৮)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (সপ্তম কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (ষষ্ঠ কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (পঞ্চম কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (চতুর্থ কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (তৃতীয় কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (দ্বিতীয় কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (প্রথম কিস্তি)