সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন
![](https://ntvbd.com/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2015/04/29/photo-1430285822.jpg)
‘মন যদি পাগল হয় রে বন্ধু কি করিব কুলে!’
জুলেখারে বিয়া কইরা বাড়িতে নেওনের বাসনাখান ইসুফ মিয়ার অন্তরে জাগনা দেয়, না, তার দুনিয়াদারি আরো বিষ তিতা হওনের রাস্তাখান পরিষ্কার হয়! চিন্তায় চিন্তায় তার অন্তর দগ্ধাইয়া আংড়া হইতে থাকে। হায়রে! কোন পোথে যাইবো ইসুফ মিয়ায়!
বাড়িতে সেয় কেমনে নিজের মোখে নিজের বিয়ার কথা তুলবো! তাগো গেরামে নিজের বিয়ার কথা নিজে তোলার কোনো রেওয়াজ নাই। কোনোকালেই নাই। হউক সেয় পোলা! দেওভোগ গেরামে বেটা-মাইনষেরও নিজের বিয়ার কথা নিজে কওন হইলো গা মস্তো এক শরমের বিষয়!
এই বেশরমা কারবার, এই অখনকার আমলে, দশগেরামের কোনো বেটা-মাইনষে কোনোদিন করে নাই। দাদা-পরদাদার আমলেও কোনোজনে করছে, এমুন কথা কেউ শোনে নাই! ইসুফ মিয়ায় তাইলে অখন কী করে! সেয় তো বেলাজ, বেশরম পোলা না! সেয় তাইলে অখন, এমুন শরমের কথাখান ঘরের মাইনষের কাছে, নিজে, তোলে কী প্রকারে!
পরদাদাগো আমল তেনেই, দেওভোগ গেরামে একটা বান্ধা নিয়মে বিয়াশাদি করানি-দেওয়ানির কর্ম চলতাছে। সকল লোকে পোক্ত রকমে সেই নিয়মে পালন কইরা যাইতাছে। কেউই কোনোকালে এর অন্যথা করে নাই। অন্যথা করে না। করার কোনো দরকারও পড়ে না।
সকলে জানে, বিয়াশাদি আল্লার হাতে। কিন্তু খোদার দুনিয়ায়-মাইনষের সংসারে, সেই বিষয়রে সিজিল-মিছিলটা করবো কেটায়? করবো বাড়ির ময়-মুরুব্বিয়ে। দেওভোগের লোকে এই বিধানরে অক্ষরে অক্ষরে মানে। এইখানে মাইয়ার বিয়া দেওয়ার বেবস্থা-বন্দোবস্ত যেমুন মুরুব্বিরা করে, বাড়ির সিয়ান পোলার বিয়ার বেবস্থাও করার মালিক খালি তারাই।
তাগো বিচারে যেসুম মোনে হয়, তাগো পোলারে বিয়া করান লাগবো—সেইসোমই পোলার বিয়া নিয়া লড়ালড়ি শুরু করে তারা। ঘটকরে খবর দেয়। বা নিজেরা নিজেরা ইষ্টি-কুটুমের চিন-পরিচয় ধইরা নানান জায়গায় সম্বন্ধ বিছরাইতে যায়। একের পর এক মাইয়া দেখতে থাকে।
মাইয়া দেখে, বংশ দেখে, মাইয়ার সুলক্ষণ-কুলক্ষণ যাচাই-বাছাই করে, মাইয়ার মাথার চুলের ভালা-বুরা বিষয়ে কথা কয়। বিয়াতে পোলা-মাইয়ারে দেওয়া-থোওয়া স্থির করে, দিন-তারিখ ধার্য করে। সব করে মুরুব্বিরা।
এইসগল কাম তারা তারাই শেষ করে। কইরা তারবাদে পোলারে জানানো হয় যে, তার বিয়া ঠিক হইছে! পারতে কোনো বাড়ির পোলায় মাইয়া দেখতে যায় না। যাওয়ার হুকুম পায় না। ক্যান! পোলার আবার মাইয়া দেখার কী আছে! মুরুব্বিরা দেখছে না? তারা ভালা-বুরা বেশি চিনে, না; সেইদিনের এই ড্যাকরা জুয়ানে বেশি চিনে! মুরুব্বিরা যারে আনতাছে, ভালা বুইজ্জাই আনতাছে! তোমার কাম হইতাছে অখন খুশি-দিলে শান্তি হালে সংসার করা। সেইটা করো।
বিয়ার সম্বন্ধ যে স্থির হইছে, সেই কথাও পোলারে মায় বা বাপে নিজের মোখে জানাইতে যায় না। তোবা তোবা! ময়-মুরুব্বির মোখ দিয়া পোলারে এই কতা কওয়ার মতোন শরম আর আছে নি!
দাদি-নানি থাকলে তারা কয়; নাইলে পোলার কাছে অই কথাখান তোলে হয় পোলার কোনো ভাউজে। বা যুদি পোলার দুলা মিয়াভাই থাকে, তোলে সেই দুলা মিয়াভাইয়ে। সেই ভাউজ আপনা বড়ো ভাইয়ের বউও হইতে পারে, নাইলে পাড়া-পড়শি দূর-সম্পর্কের কেউও হইতে পারে! দুলা মিয়াভাইও তেমুন আপনা পর যেইই হউক—ক্ষতি নাই; সম্পর্কে দুলা হইলেই হয়। তারা পোলারে খালি বিয়ার সংবাদখানই দেয় না, মুরুব্বিগো কাছেও পোলার অন্তরের হাউশ-আল্লাদের কথারে আইন্না হাজির করে। মুরুব্বিরা তওফিকে কুলাইলে পোলার সেই হাউশ মোতাবেক বেবস্থা করে।
আবার উল্টা আরেক বিত্তান্তও হয় কোনো কোনো বাইত। মুরুব্বিগো লড়াচড়ির আগেই, কোনো পোলার মোনে বিয়ার হাউশ জাগনা দিতে পারে। যুদি কোনো পোলার মোনে বিয়ার বাই চাগড়া দিয়া ওঠে, সেয় তখন সেই হাউশখানরে মুরুব্বিগো কানে পাঠানের বেবস্থাও করে অই ভাউজ নাইলে কোনো দুলামিয়াভাইরে দিয়া। পোলায়, এমুনকি নিজের বিয়া করোনের হাউশের কথা দাদি-নানির কানেও তোলে না। শরম!
সেই কথা তারা তোলতে পারে কেবল ভাউজ বা দুলামিয়াভাইয়ের কানে। তারা তখন করে কী; পোলার কথাখানরে খোলাসা কইরা শোনে। শুইন্না পোলার লগে ভালামতোন বোঝে; তারবাদে যায় ময়-মুরুব্বিগো কাছে কথাখান তুলতে। এমুন যহন কোনো বেপার থাকে; তহন, ভাউজ নাইলে দুলামিয়াভাইয়েরা, মুরুব্বিগো মোখের উপরে, জিন্দিগিতেও ভাইঙ্গা কয় না যে, পোলার বিয়া করার সাধ হইছে! এমুন কওয়ার কোনো বিধিই নাই এলাকায়। যেয় পাঁচ আঙুলে ধইরা ভাত খায়, সেয় নি পারবো এমুন বেলাজ কারবার করতে!
তাইলে তখন ভাউজ বা দুলামিয়াভাইয়ে কী করে? তারা করে কী, মুরুব্বিগো লগে পান খাইতে খাইতে হুদামিছাই বিয়ার গপ তোলা দেয়। এই বিয়া সেই বিয়ার গপ কইতে কইতে, আঁতকা য্যান তাগো মোনে আহে যে, এই বাড়িতে বিয়ার যুগ্যি একটা সিয়ান পোলা আছে! তহন হাসি-মশকারি করতে করতে মা নাইলে দাদিরে জিগায়; ‘কিগো অমুক, আপনেগো পোলার বিয়ার দাওয়াত কবে পামু! পোলারে বিয়া করাইবেন আর কবে? ঘরে লক্ষ্মী আনেন গো!’
এমনে মশকারির মশকারিও হয়, ভিতরের কথাখান জানানি দেওনও হয়। তহন ঘরের মাইনষে পোলার বিয়ার লৌড়ালৌড়ি আরাম্ভ করে।
এই দেশে এমুনই হইলো বিয়া-শাদির রীতি-নিয়ম।
এদিগে দেখো ইসুফ মিয়ার কপালখান, সেইখানে ভালা কিছু লেখা হয় নাই! এমনই তার ফাটা কপাল—তার কোনো ভাউজ নাই। দূর-সম্পর্কের ভাউজ তো দূরের কথা, অড়শি-পড়শি ভাউজও নাই। গুষ্টির মধ্যে বড়ো পোলা বলতে সেয়। নিজের বড়ো বইন আছে একজোন। তার হউর-বাড়ি এইই কাছেই—বাবুরাইল গেরামে। কিন্তু তার খসম কর্ম করে দূর বৈদেশে। গোয়ালন্দে।
আওন-যাওনে গ্যাঞ্জাম অয়, আবার টেকাও খরচা অয়; সেই কারোনে ইসুফের দুলামিয়াভাইয়ে ছয় মাসে একবারও বাড়িত আহে কি না সন্দেহ! সেই দুক্ষে বইনের মিজাজ খোদার তিরিশটা দিনই খ্যাটখ্যাটা হইয়া থাকে। কোনো একটা ভালা কথার জবও সেয় কোনোসোম ভালামোখে দেয় না।
তারে নিজের এই জ্বালার কথা কইয়া ইসুফ মিয়ার কোনো ফায়দা হইবো না। সেয় কানেই নিবো না! আর, দুলামিয়াভাইরে যে কইবো, তারই বা উপায় কী! সেয়, কবে কোন দিনে বাড়িতে আইবো, কেউ নি জানে! এই এক দুলামিয়াভাই ছাড়া আর একটাও কোনো আপনা বা পর দুলামিয়া নাই; যারে কামে লাগাইতে পারে ইসুফ মিয়ায়।
তাইলে সেয় নিজের বিয়ার কথাটা তোলে কেমনে, আর তোলেই বা কার কাছে!
কয়দিন, দিন-রাইত এই চিন্তায় চিন্তায় ইসুফ মিয়ার জান-পরান ঝুঁরতে থাকে, ঝুঁরতে থাকে। সমাধানের পোথ আর সেয় বিছরাইয়া পায় না! কী করে কী করে সেয়! চিন্তায় চিন্তায় যহন তার হাড়-মাস পেরায় কালি-কালি, তহন আচমকা তার অন্তর তারে জানান দেয় যে, আর কিছু না! এই কাম তার নিজেরেই করোন লাগবো! দশ গেরামের কেউ যা জিন্দিগিতে করে নাই; সেই কর্ম আউজকা করোন লাগবো ইসুফ মিয়ারেই। শরম-হায়ার মাথা খাইয়া তারে নিজ মোখেই, মুরুব্বিগো, জানান লাগবো নিজের বিয়ার কথাখান!
আইচ্ছা, করলো নাইলে সেয় সেই কর্ম! নিজের জান বাঁচানের লেইগা বেহায়া-বেশরম নাইলে হইবো ইসুফে! কিন্তু বাড়ির কার কাছে এই কথারে তোলবো উয়ে! কার কাছে! বাপেরে এই কথা কওনের হিম্মত তার কোনোকালেও অইবো না। জিন্দিগিতে সেয় জবানও খোলতে পারবো না বাপের মোকাবিলায়!
ফুবু আছে বাড়িতে। তয়, ফুবুরে কওন আর একটা গাছেরে কওন একই কথা! তাইলে হেয়ও বাদ। বাকি থাকে খালি তার মায়ে। মায়েরে নিয়া ইসুফে চিন্তা করে করে করে, অন্তর তার তুফান টলমলো হয় হয় হয়। এমনে চলতে চলতে একসোম ইসুফ মিয়ায় বোঝে—খালি অই মায়েই বোঝবো পুতের দর্দ! খালি অই মায়েই। সেয় ছাড়া দুনিয়ার অন্য কেউই বোঝবো না ইসুফ মিয়ার অন্তরের পোড়ানি! তাইলে তাইই সই। মায়ের কানেই তাইলে তোলবো ইসুফে কথাখান!
তোলবো চুপেচাপে। একলা খালি মায়ের কাছেই কইবো সেয় যে, জুলেখার লগে য্যান মায়ে ইসুফের বিয়ার সম্বন্ধখান করোনের বেবস্থা নেয়। অন্তরে অন্তরে ইসুফ মিয়ায় জানে, তার মায়ে কেমুন বুঝদার মাতারি! সেই মায় বোঝবোই বোঝবো যে, কোন দুক্ষে তার পুতে, লাজ-শরমের মাথা খাইয়া নিজের মোখে, আউজকা মায়েরে কইতাছে নিজের বিয়ার কথা!
পুতের এই গুপ্তি কথারে দশকান কইরা পুতেরে শরমের তলেও ফালাইবো না মায়ে। যা করার করবো সেয় বুঝ মতোন।
চিন্তায় চিন্তায় অনেক উল্টা-পাল্টি খাইয়া, ইসুফ মিয়ায় মায়েরে নিজের বিয়ার খায়েশখান ব্যক্ত করোনের বিষয়ে মত স্থির করে। সেয় বোঝে যে, কইতেই যুদি লাগে; তাইলে হুদামিছা দিন নষ্ট কইরা লাভ নাই। কইলে কওন দরকার তরাতরি। নাইলে বিপদ ঘটতে পারে যেকোনো দিন! বিরাট বিপদ!
এই যে নানান দুনিয়ার তেনে, ধুইচ্চা, জুলেখার বিয়ার সম্বন্ধ আসতাছে—তার যেকোনো একটা লাইগ্গা যাইতে পারে যেকোনো দিন। জুলেখার বিয়ার সম্বন্ধ ঠিক হইয়া যাইতে কতখোন! সম্বন্ধ লাইগ্গা গেলে আর ফিরানের রাস্তা থাকবো না। এই কারণেই অক্ষণ অক্ষণ মায়ের কানে কথাটা তোলনের বহুত ঠেকা তার।
মায়ের কানেই কথাখান তোলবো ইসুফ মিয়ায়। তয়, সেই কথা তোলোন লাগবো একলা খালি মায়ের কাছেই। মায়-পুতে নিজেরা দোনোজোনে খালি জানবো কথাখান! আর একটা কাউয়া-কুলিরও কানে য্যান না যায়!
তামানটা দিনে মায়েরে একলা পাওয়া দুষ্কর। সগল সোমে তার লগে মানুষ আছেই আছে। দিন ভইরা থাকতাছে অড়শি-পড়শি-ইষ্টি-কুটুম-মায়ের সই—কী সইয়ের বিয়াইন—কী সইয়ের মাইয়া—এগো-তাগো আনাযানা। দুনিয়ার মাইনষের দুনিয়ার কাম পইড়া থাকে ইসুফের মায়ের লগে! তার কাছে দুনিয়ার সগলতের ঠেকা আর ঘোরাফিরা লাইগ্গাই থাকে। মাইনষে য্যান দুনিয়ায় আর কেউরে চক্ষে দেখে না! খালি দেখে ইসুফ মিয়ার মায়েরে!
রাইতেও যে মা-র লগে এমুন গোপন কথাটা কইবো ইসুফে, তারও কোনো ফুরসত নাই। মায়ে তহন সংসারের সগল কথা লইয়া বয় বাপের বরাবর। বাপেরে তরিজুত কইরা একের পর এক পান বানাইয়া দেয় একদিগে, আরেকদিগে সংসারের হাবিজাবি নানান কথা সারতে থাকে দোনোজোনে। তাইলে কোনসোম! কখন!
অনেক ভাবনা-চিন্তার পরে ইসুফ মিয়ায় বোঝে যে, এই কথা কওনের মোক্ষম ক্ষণ আছে খালি একটা। সেইটা হইতাছে দুপুইরা কালে খাইতে বওনের সময়খান! তাগো মায়ের এক বহুত আচানক খাসলত আছে! সেয় কি না দুপুইরা খাওনের সোমে, ভাত পাতে বাইড়া দিয়া পোলাপাইনের সামোনে বইয়া থাকে।
সামোনে বসা দিয়া, পরিপাটি কইরা সবটি পোলাপাইনের খাওন সমাধা করে মায়। তারপর তার অন্য কামে লড়ালড়ি! এই নিয়া জাল-ননদ-ননাস-অড়শি-পড়শি বৌ-ঝিরা কতো হাঁকাহুঁকি করে, কতো নিন্দা-মান্দা করে, কতো কুকথা কয়! কয় যে, পোলাপাইনরে খাইতে দিয়া সামোনে বওয়া দিয়া থাকোন! এইটা কিয়ের মায়া! এইটা হইতাছে কুয়ারা! ঢঙ!
আর আর বাড়ির মায়েরা পাতে ভাত-সালুন দিয়া এই কাম সেই কাম করতে যায়। তাগো হাত এত্তা আজাইর থাকে না যে, বইয়া বইয়া পোলাপাইনের মোখে গেরাস ওঠোন্তি গোনবো! তারা পোলাপাইনেরে খাইতে দিয়া নিজেরা যায় গা নিজেগো অন্য কামে। ঠেকা যদি লাগে, তহন, আবার আইয়া ভাত-সালুন দিয়া যায়। কিন্তু ইসুফ মিয়ার মায়ে নিজে বইয়া থাইক্কা সবটি পোলাপাইনরে খাওয়ানি শেষ করবো রোজ, তবো লড়বো অন্য কামের দিগে। নাইলে বোলে তার আশান্তি লাগে!
রোজই সবটিরে একলগে খাওয়াইতে বহানি দেয় মায়ে। তবে কোনোদিন কোনোটারে যুদি দেরিতে আইয়া পাতে বইতে অয়, সেইটারে মায়ে করে কী; কতখোন আউল্লা-পাতাইল্লা গাইল্লায়। গালি দেয়, আর আঁতিপাতি তরিজুত কইরা, পাতে, একে একে দিতে থাকে ভাত-সালুন-লুন। অন্য সগল কাম ফালাইয়া মায় তখনও, ঠায় সামোনে বইয়া থাকে যে থাকেই।
অই হইতাছে একটা খালি ফাঁক, মায়েরে একলা পাওনের। তবে এইনেও ঝামেলা আছে একটা! দোপোরে, খাওনের কালে, মায়ে নাইলে থাকতাছে তখন একলা; কিন্তু খাওনের অই কালে তো ইসুফে খালি একলা খাইতে বয় না! অন্য ভাই-বইনটিও তো লগে বয়। অই পোলাপাইনটির সামোনে সেয় এই কথা মা-রে কইবো কোন মোখে! শরম না! অগো সামোনে এই কথা কওন আর নিজেরে রাস্তায় লেংটা কইরা খাড়া কইরা দেওনের মিদে কী কোনো ফারাক থাকবো! থাকবো না।
তাইলে করোন কী! এট্টু চিন্তা কইরা, শেষে, একটা পোথও ঠিকঠিকই ইসুফ মিয়ায় বাইর কইরা ফালায়। তাইলে করতে হইবো কী—কোনো প্রকারে ইসুফ মিয়ারে দোপোরে খাইতে বইতে হইবো একলা। সগলতের শেষে যুদি সেয় খাইতে আহে, তাইলেই খালি মায়েরে একলা নিজের সামোনে পাওনের উপায়টা থাকে তার! তাইলে খালি তহনই সেয় শান্তিহালে সগলকথা মায়রে ভাইঙ্গা কইতে পারে! এই একলা খাইতে বসোনের রাস্তাটাই বাইর করোন লাগবো অখন ইসুফ মিয়ারে!
হইতে পারে সেয় বেটা-মানুষ, কিন্তুক তার চক্ষেও শরম-হায়াখান তো আল্লায় দিছে! কপালের ফেরে নাইলে নিজের মোখেই নিজের বিয়ার কথাখান তারে কইতে হইতাছে! কিন্তু সেই কথাটারে সেয় একবারে বগবগাইয়া মায়ের কাছে কইয়া ফালাইতে পারবো নি! পারবো না।
তারে তো অই কথাখানরে এট্টু ভাঙচুর করা লাগবো, এট্টু তার দম নেওন লাগবো, এট্টু কায়দাকৌশল করোন লাগবো; তয় তো শেষ করোন যাইবো বিষয়টা! তাইলে অনেকখোন মায়রে একলা পাওন লাগবোই তো ইসুফের।
তয় ইসুফে জানে, তার মায়ে বড়ো কামেলদার মাতারি। লা কইতে লাকড়ি বুইজ্জা ফালানের বুদ্ধি ধরে সেয়! ইসুফে এট্টু খালি মোখ খোলবো, মায় পুরা বিত্তান্তখানই বুইজ্জা ফালাইবো। দুনিয়ায় পুতের দর্দ মায় ভিন্ন আর কেটায় বোজে! কেউ না।
এই বুদ্ধি স্থির করোনের পরদিন; বাজানরে ইসুফ মিয়ায় কয় যে, আউজকা সেয় বাইত থাইক্কা গোয়াইল ঘরটারে সাফ করাইবো। গরুটিরে ভালামতোন গোছল দেওয়ানিরও কাম! বহুতদিন গরুরা ভালা একটা সাফ-সাফানি পাইতাছে না!
বাজানে কয়, ‘যা করতে চাস কামলাগো দিয়া করা, কিন্তুক কামলা-মুনির শইল্লে য্যান হাত তুলিস না!’
ইসুফে কয়, ‘আইচ্ছা!’
তারবাদে সেয় কামলা-মুনিগো নিপাটে গোয়াইলঘর সাফের আও-ভাও দেখায়। গরুগো ভালা নিয়মে সাফ-সাফা করোনের কায়দাগিলি বুঝায়। বুঝাইয়া দিয়া তাগো ফরমাইশ করে তাগো কর্ম করতে। আর সেয় আরেকদিগে, নিজের কামখান শুরু করে!
বিয়ানের রইদ তখন মাথার উপরে ওঠে ওঠে অবস্থা। মাঘ মাইস্যা দিন। দুপুর হয় নাই যদিও, কিন্তু দেখো রইদের কী তেজ! শীতল বাতাস আছে সবখানে। তাও তেজি রইদে চড়বড় করতাছে আসমান-জমিন। ইসুফ মিয়ায় বড়শি আর আধাইর নিয়া মাছ ধরতে মেলা দেয়!
ভিটির নামায়ই তো নিজেগো বড়ো পুষ্কুনীটা। সেইটাতে নি মাছ ধরাবো অখন ইসুফ মিয়ায়? না তো! সেয় দেখি ছিপ আর মাছ-ধরার চাইর নিয়া হাঁটা ধরছে দেড়ক্রোশ তফাতের বাবুরাইল গেরামের দিগে। বাবুরাইলে তার বইনের হউরবাড়ি। সেই বাড়িতে আছে পাঁচ শরিকের বিরাট পুষ্কুনীখান। সেইদিন সেইটাতেই মাছ ধরোনের লেইগা তার জান-পরান উতালা হইয়া যায়।
‘এমুন রইদ মাথায় কইরা কই যাস! অই ভাদাইম্মা!’ মায় রান্ধনঘর তেনে ডাকতে থাকে।
‘বাবুরাইল যাই। মাছ ধরতে যাইতাছি বুজিগো পুষ্কুনীত!’ আস্তে-ধীরে চলতে চলতে জব দেয় ইসুফে।
‘হায় কপালরে!’ পিছের তেনে মায়ের চিল্লানি আইতেই থাকে, ‘বাবুরাইল কী বাড়ির কাছে! মাছ ধরতে যাওন লাগবো কুটুম বাইত! ক্যা! নিজেগো পুষ্কুনীর মাছেরা আসমানে উড়াল দিছে?’
‘দুগা পুঁটিমাছ ধইরা আনি গা গো!’ ইসুফ মিয়ায় জব দেয়। তারবাদে সেয় মায়রে ঠান্ডা করোনের দাওয়াই ঢালে, ‘কতো দিন তুমি পুঁটিমাছ ভাজো না মা!’
ইসুফ মিয়ার মোখের তেনে কথাটা পইড়া সারে না, মা-র পরানখান ছাৎ কইরা ওঠে। দ্যাখছো! পুঁটিমাছ ভাজা খাইতেই যুদি মোনে লইছে অর, কইতে পারে নাই কতাটা মায়রে? কতাটা ভোর-বিয়ানে কইলেই তো অইতো! অখন, এই রইদ মাথায় নিয়া নি পুতে গিয়া বইতাছে মাছ ধরতে!
‘ও রে বাজান!’ মায় পিছের তেনে খোদার দোহাই দিতে থাকে, ‘পুঁটিমাছ কাউলকা বিয়ান বিয়ান কামলাগো দিয়া ধরামু নে রে! আউজকা খ্যামা দে বাবা! কই রে! এই রইদ মাতায় নিয়া এত্তা রাস্তা যাওনের কাম নাই অখন! রইদ বড়ো তুক্ষার রে! ইসুফ মিয়া। যাইস না!’
‘এই যামু আর আমু! তুমি এতো বেদিশা অইয়ো না তো!’ মোখে মোখে মায়েরে এই কথা কয় ইসুফ মিয়ায়; কিন্তুক তার অন্তর কইতে থাকে অন্যকথা! চুপে চুপে তার অন্তর মায়েরে কয়; ‘মাগো! এই ছেড়ির লেইগা রইদ কী, মেঘ কী,আর মাঘ মাইস্যা জার কী! কিছুরেই আমার গোনায় ধরলে চলবো না গো মা!’
(চলবে)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ২৫)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ২৪)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন(কিস্তি ২৩)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন(কিস্তি ২২)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ২১)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ২০)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১৯)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১৮)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১৭)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১৬)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১৫)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১৪)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১৩)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১২)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১১)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১০)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ৯)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ৮)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (সপ্তম কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (ষষ্ঠ কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (পঞ্চম কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (চতুর্থ কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (তৃতীয় কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (দ্বিতীয় কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (প্রথম কিস্তি)