সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন
‘দুরন্ত ভাবনায় মন উঠাপড়া করে!’
চক্ষের পানির অজোর ধারায় ভাইস্সা যাইতে থাকে ইসুফ মিয়ার দিনদুনিয়া। এই তো সেয়, তাগো পুবের ঘরের বারিন্দার পাটিতে একলা পড়া। আশপাশে একটা মনিষ্যির চিন্ন নাই। কোন আগে তারে থুইয়া মায় গেছে রান্ধনঘরে। সেয় অখনও ফিইরা আসে নাই। বারিন্দার চালাটার নিচে একলা পড়া ইসুফ মিয়ায়। একলা! লগে থাকার মধ্যে আছে খালি বৈশাখ মাইস্যা তুফাইন্না মেঘ-বিষ্টির ঢলটা।
তুফান উঠছিল। তুফান থামছে। শিল-পড়াও থামছে কোন আগে! তারবাদে নামছে জোর বিষ্টি। সেই বিষ্টির ঢল অখনও নামতাছে। তেজি তালে নামতাছে। বাইরের সকলটা- উঠান-পৈঠান, আসমানে-জমিন ঢাকা পইড়া গেছে অই ঢলের তলে!
এদিগে দেখ নামা ধরছে আরেক ঢল। সেই ঢল ইসুফ মিয়ার চক্ষে। এই যে এমুন বিমার-ভোগা, আধামরা অখন ইসুফে! তার চক্ষের তেনে যে ঢল নামতাছে; সেয় ক্যান দুবলা-দাবলা,কাহিল-কাতর না! সেয় এত জোর তেজ পাইছে কেমনে !
সেয় য্যান তার তেজে আসমানের ঢলখানরে শরম দিতাছে! আবার কারবার দে! দোনো ঢলই পাল্লা দিয়া ঝরতে আছে,ঝরতে আছেই। কমাকমির নাম নাই। য্যান কোনোদিন তারা বিরাম নিবো না। য্যান আর তাগো থামোনের কোনো ঠেকা নাই! তারা আর থামব না।
সেই চৈত মাসেও কী আর কোনোদিন যাইব ইসুফ মিয়ার জিন্দিগির তেনে! অই যে মাঘ মাস গিয়া আইলো ফাগুন মাস। ফাগুনও গিয়া আইলো চৈত। সেই মাসে জুলেখায় নাই হইয়া গেল! সেই চৈত মাস, সেই সর্বনাশের দিন, চিরকালের লেইগা খুঁটা-গাইড়া বইছে না অর কইলজায়! যুগ-জনোমের লেইগা খুঁটা গাইড়া বইছে! কত মাস আইব দুনিয়ায়,কত মাস যাইবও গা! ইসুফ মিয়ার দিনদুনিয়ায় খালি বিরাজ করব এক সর্বনাইশ্যা কাল ! এক চৈত মাস।
ভালা হইছে! ভালা হইছে- উয়ে যে নাই হইয়া গেছে! মানীর মান আল্লায় রাখে না? আল্লা জুলির মান রাখছে। সেয়ই সোনার পরতিমাখানরে ছিদ্দত পাইতে দেয় নাই! নাইলে কত কুকথা না গাইত মাইনষে, অরে দোষ দিয়া দিয়া! সেই মিছা-কলঙ্কের ভাগী হইয়া উয়ে লোকের-মেলে কেমনে থাকত! কিছু না কইরা,কিছু না জাইন্না, বিনা দোষে দুষী হওন লাগত অরে! অর মায়-বাপে অরে আস্তা রাখত! এইটাই ভালা হইছে! অরে কোনো জ্বালা পোয়াইতে হয় নাই! ইসুফ মিয়ার দোষের শাস্তি অরে ভোগ করোন লাগে নাই! বহুত ভালা হইছে।
আরো ভালা হইছে ইসুফ মিয়ার নিজের! খুব ভালা হইছে। নিজের চোখ দিয়া জুলির পরের বাড়িতে যাইতে দেখতে অয় নাই তার! নিজের কইলজা ছিঁড়া আরেক মাইনষের হাতে দেওনের গরদিশ,তারে ভোগ করতে হয় নাই! ভালা করছ বিধি! খুব ভালা! এইবার ইসুফে যাইব গা! যাইব গা। আর তো কোনো ঠেকা নাই! অখন সেয় বাঁচলে কী,গেলে কী!
যার ভালাবুরার চিন্তায় একখান কদমও দিতে পারে নাই মউতের দরজার দিগে ইসুফ মিয়ায়, সেয় নিজেই তারে রেহাই দিয়া গেছে! আর কী লাগে!
চক্ষের দরদরা ধারা নামতে নামতে আঁতকা জোর ডাক দিয়া ওঠে য্যান! আপাইয়া-ফোঁপাইয়া-আছড়াইয়া ইসুফ মিয়ারে চেতনশূন্য কইরা ফালাইতে থাকে য্যান ক্ষণে ক্ষণে। আহহারে! মাইনষের জীবন! কতখোন লাগে তোমার অচল-টেমরা-টেপ খাওয়া-খুঁতা মাল হইতে! কতোখোন লাগে!
ওদিগে রান্ধন ঘরের দরোজার সামনে খাড়াইয়া ঢল কমুনের লেইগ্যা মায়ে বার চাইতে চাইতে কাতর হইয়া যায়। এই বুঝি ধরে এট্টু ঢলটা,এই বুঝি এট্টু বিরতি দেয় – এই আশায় থাকতে থাকতে মেলাক্ষণ পার হয়। আর তো ঢল কমুনের আশায় বার চাওন যায় না। অসুইক্ষা ছেড়ায় একলা পড়া খোলা বারিন্দায়। ঠাণ্ডা বাতাসের ঝটকাটি তো গেছেই অর উপর দিয়া। অখন আবার বিষ্টির ছোলাগিলিও যাইতাছে! বুকে না ঠাণ্ডা লাইগ্গা যাইব!
আঁচল দিয়া ভালামতোন তালশাঁসের পিরিচটারে ঢাকা দিয়া, মায়ে, পানি ছপছপ্পা উঠানে তুরুত নাইম্মা আসে। আর দেরি করোন যায় না! এমনে একলা নি রাখতে আছে এত্তবড় অসুইক্ষা রুগীরে!
আধা ভিজা মায়ে আইসা খাড়ায় পুতের পাওয়ের কাছে। যেমন নিঃসাড়-পড়া দেইক্ষা গেছে মায় ইসুফ মিয়ারে, সেই একই রকমে নিঃসাড় পড়া অখনও তার পুতে। দেহখান নিঃসাড় ঠিক, কিন্তুক দেখ পুতের চোখ! বাইরের দুনিয়ায় আর কী এমুন মেঘ-বিষ্টি ঝরতাছে! তার পোলার চোখ তেনে নামতাছে সেই ঢলের থেইক্কা আরো গহন ঢল!
আহ! আহরে কিসমত! মায়ের অন্তর হায় হায় কইরা ওঠে। আল্লা! এইটারে নি কান্দন কওন যায়! পুতের চক্ষে এইটা কি কান্দন? কান্দন না,কান্দন না! ইসুফ মিয়ার পরানটাই য্যান গইল্লা গইল্লা ছলক-ধলক দিয়া পড়তাছে! পড়তাছে চক্ষের পানির রূপ ধইরা! ও মাবুদ!
মায়ে আর নিজেরে সামলানি দিতে পারে না! এত দিন পুতের বিমার-বালাই দুই হাতে ঘাটছে মায়। যে যেমনে কইছে তেমনেই পোলারে যতন করছে মায়ে। করছে নিজের জান-পরানের দিগে কোনো হুঁশ না রাইক্ষা। কী দিন কী রাইত- কোনোসোম- এক দণ্ডের লেইগা নিজেরে আজাইর দেয় নাই মায়ে। ক্যান দেয় নাই? ক্যান দেয় নাই? ক্যান দেয় নাই!
লোকের মুখে এই নিয়া কত ব্যাখ্যান! কত না ধন্ন ধন্ন ! এমুন দরদি মাওয়ের কথা বোলে খালি পরস্তাবে কয়! ঘরে-সংসারে বোলে হেগো দেখা পাওন যায় না। লোকে এতকাল পরস্তাবে শোনছে, আর, এই পরথম নিজ চক্ষে দেখতাছে সেই দরদি মায়রে!
মায়ে লোকের কথা এককান দিয়া শোনছে, আরেক কান দিয়া লগে লগে বাইর কইরা দিছে। লোকে কী জানে! কী জানে! কিচ্ছু জানে না! কেউ কিচ্ছু জানে না! খালি ইসুফ মিয়ার মায়ে জানে নিজের ভেদের খবর। তার মোনে খালি জানে তার পাপ।
সেয় একদণ্ড আজাইর থাকে নাই ক্যান! আজাইর থাকতে পারে নাই সেয়। পারে নাই। পারব কেমনে? অন্তরে অন্তরে যে বহুত ঘিন লাগছে তার নিজেরে। নিজের দিগে নজর দিতে ডর লাগছে। পলে পলে নিজেরে বড়ো পাতকী, বহুত পাপীতাপী লাগছে তার। যখনই আজাইর আর একলা থাকনের একপল ফুরসত পাইছে ইসুফ মিয়ার মায়ে; অমনেই তার অন্তররে,তার শইলরে কামড়ানি দেওয়া ধরছে ঘিন-ডর-লাজে! কামড়াইতে কামড়াইতে তারে ছন্নভন্ন কইরা দিতে থাকছে।
কী আজাব! কী গজব! না না না! ইসুফ মিয়ার মায়ে অই আজাবের ভার আলগাইতে পারব না। পারব না! আজাইর না থাকলেই সেয় দেখছে,অই লাজ-ঘিনে তারে কামড়ানি দেওনের ফাঁক পায় না। কোনো ফাঁক পায় নাই। তাইলে নিজের হাত সেয় কেমনে ফাঁকা হইতে দেয়!
না না! এট্টুও দিব না! হাত সেয় আজাইর হইতে দিবই না কোনো প্রকারে। আজাইর হইলেই তো নিজের লগে তার নিজের একলা খাড়ানের সুযোগখান আইয়া পড়ব। নিজের সামনে খাড়ানের কোনো হিম্মত তার নাই। আর নাই।
তাও তো দেখ কারবারখান! এত যে পুতের যতনের কর্মে থাকছে ইসুফ মিয়ার মায়ে- তাও নি তার অন্তর তারে চিমটানি-খোঁচানি-চাবানি দেওয়া বন্ধ রাখছে! রাখে নাই। নিজের অন্তর তারে ঘুমের মিদে তরি উচিত কথা কইতে ছাড়ে নাই। খালি ডাক দিয়া কইছে, এতসগল অনিষ্টি আইত না সংসারে! আইত না! আইছে খালি অই এক মায়ের কারণে!
তার তেনে বড় জালেম মা আর সংসারে জনম নেয় নাইক্কা! মায়ে নিজ হস্তে মারছে নিজের পোলারে। মায়ে যুদি পুতের বাঞ্ছাখানরে অমুন এক ফুঁ দিয়া না নিভাইয়া দিত! অমুন কুইদ্দা-রুইক্ষা যুদি না খাড়াইতো মায়ে! অমুন তছনছ কারবারখান না করত যুদি সেয়! তাইলে, তাইলে এমুন গজবের তলে পড়তে হইত না! পুতের জিন্দিগি এমুন ছারেখারে দশায় যাইত না!
এই সগল দোষের ভাগী একলা কেবল মায়ে। ইসুফ মিয়ার মায়ে। এইটা কেমুন মা সেয়! মা না ডাইন এইটা সেয়! ধিক তারে! শত ধিক! ঘিন লাগে তার নিজেরে। বহুত ঘিন।
অন্তরের জ্বালা আর কান্দনের ধাক্কারে আউজকা আর মায়ে নিজে নিজে সামাল দিয়া থুইতে পারে না। সেয় হুড়মুড় গিয়া পড়ে বিমাইরা পুতটার মাথার কাছে। ‘বাজান! বাজান! তুই আমারে মাফ দে!’ ডুকরাইতে ডুকরাইতে কোনো রকমে কয় মায়; ‘সগল সব্বনাশের মূলে তর মা-ডাইনেরে বাজান! তর জিন্দিগি বরবাদের পিছে দায়ী তর মায়ে। আমি ক্যান এমুন রুইক্ষা ওঠলাম! কোন শনিয়ে পাইছিল আমারে! অমুন ভালা মাইয়াটারে বিষ-নজরে ক্যান দেখলাম আমি! বাজান,তর মায়ের দোষে এই কষ্ট আউজকা তর রে! আমারে মাফ দে। মাফ দে।’
পুতের মাথা জাবড়াইয়া মায়ে কান্দে একদিগে, মায়ের কোলের ভিতরে পইড়া দেহ পুতে কান্দে আরেক দিগে। আর দেহ,তাগো লগে কান্দতে থাকে দেওভোগ গেরামের আসমান-জমিন। কান্দে কান্দে কান্দে!
কে কয় যে কান্দলে মনের দুক্ষু কমে? যে কয় হেয় মিছা কয়। এই যে মা-পুতে কাইন্দা জারেজার হইতাছে,অন্তর তো তাগো ঠাণ্ডা হয় না! পোড়ানি তো কমে না! কান্দতে কান্দতে কাহিল হইতাছে চোখ, কিন্তু ভিতরের ফাতফাতানি আর পোড়ানি- যেমুনকারটা তেমুনই তো দেহি আছে! তার নিভনের কোনো লক্ষণ নাই রে! কোনো লক্ষণ নাই।
প্রিয় পাঠক, এইভাবে কাঁদতে কাঁদতে ক্রমে একসময় ইসুফ মিয়া আবার এসে দাঁড়াবে দেওভোগ গ্রামের মুখোমুখি। ক্রমে,ধীরে শুরু করবে নিত্য জীবন। সেই জীবন কোনোরকমেই আর আগের মতো থাকবে না। জীবন আর আগের মতো থাকবে না ঠিকই; কিন্তু হয়ে উঠবে অন্য আরেক রকম। খোঁড়াবে জীবন। কিন্তু চলবে। হেঁচড়ে হেঁচড়ে চলবে।
আশা হাসবে না অন্তরে,তবু হাসিমুখ করে এরে তারে কুশল জিজ্ঞেস করে যাবে ইসুফ মিয়া। এভাবে কাঁদতে কাঁদতে ক্রমে, এক সময়, ইসুফ মিয়ার চোখেরা শুকিয়ে যাবে। তারা ভুলে যাবে- এক দিন তারা ভিজে উঠতে জানত! খরখরা, খটখটা শুকনা চোখ নিয়ে চলতে চলতে একসময় বহু চেষ্টাতেও আর সেই চোখকে ভেজাতে পারবে না সে। কোনোরকম আধাভেজাও করা হবে না আর তার চোখ কোনোদিন। আর কোনো দিন নয়।
কাঁদতে কাঁদতে ক্রমে একদিন ইসুফ মিয়ার মায়ের চোখেরও কান্না শেষ হবে। সংসারের আরো দশ দরকার সামাল দেওয়া নিয়ে তাকে ব্যতিব্যস্ত হয়ে যেতে হবে অনেক। কিন্তু তার অন্তরে অন্তর-পোড়ানি থাকবে একই রকম জ্যান্ত। একই রকম গনগনা। সেই পোড়ানিকে কোনো প্রকারে নেভানোর কোনো নিদানের খোঁজ কখনো পাওয়া হবে না তার।
এখন,আপাতত তারা কাঁদতে থাকুক।
(চলবে)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ২৬)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ২৫)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ২৪)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন(কিস্তি ২৩)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন(কিস্তি ২২)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ২১)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ২০)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১৯)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১৮)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১৭)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১৬)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১৫)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১৪)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১৩)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১২)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১১)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১০)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ৯)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ৮)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (সপ্তম কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (ষষ্ঠ কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (পঞ্চম কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (চতুর্থ কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (তৃতীয় কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (দ্বিতীয় কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (প্রথম কিস্তি)