সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন
সেইটা তখন জষ্ঠি মাইস্যা বিয়ানবেলা। ইসুফ মিয়ার মায়ে ভিটির ঢাল বাইয়া উঠতে উঠতে জুলেখাগো বাড়ির ভিতর তেনে অনেক মাইনষের গলার আওয়াজ পাইতে থাকে। তার মোনে হইতে থাকে যে, এগো বাড়িতে য্যান কেমুন কাইম-কাইজের লড়াচড়ি চলতাছে!
বিষয় কী! বাড়ির ভিতরে কী হয়! গেলো তিন বছর ধইরা সেয় পেরায় নিত্যিই আইতাছে জুলেখাগো বাইত! আহে এই দুক্ষিনী, মাইয়া-খোয়ানি মাওটারে দুই-চাইরখান সুখদুক্ষের কথা কইতে! এই বাড়ি আউজকা তিন-তিনটা বছর ধইরা এই বাড়ি পইড়া রইছে নিঃসাড়, হিম। য্যান মুর্দা! সকাল কি আর সন্ধ্যা কি—সকল সোমে যেই বাড়ি থেবড়াইয়া পইড়া রইছে পুরা একটা মরার লাহান; আউজকা হেই বাড়িতে নানান গলার কথা য্যান শোনা যায়!
ইসুফ মিয়ার মায়ে একটু তাজ্জুব অয়। কী হইলো অগো বাইত আউজকা! এই এতাটি বছর ধইরা ইসুফ মিয়ার মায়ে জুলেখার মাওরে সচল করোনের চেষ্টা তো কম করে নাই! কতো গুঁতাইয়া কতো ঠেইল্লাও যেই বাড়িরে একদণ্ডের লেইগা তাজা করোন যায় নাই, সেই বাড়ি আউজকা জাগনা হইয়া উঠছে কিয়ের গুণে! নাকি ইসুফের মায় কানে ভুল হোনতাছে!
তরাতরি পাওয়ে উঠানে আইসা খাড়ায় ইসুফ মিয়ার মায়ে! ওম্মা! হাছাই তো জুলেখাগো বাড়িভরা মানুষ! সেয় জলদি হাতে মাথার কাপোড়খান সামনের দিগে আরো টাইন্না নামায়। বাড়িভরা এত্তা বেগানা বেটা! কী করে হেরা জুলেখাগো উঠানে! অই যে উত্তরের ভিটায় তারা করতাছে কী!
এই বাড়ির ভিটার উত্তর কিনার তো এতো যুগ-জনম ধইরা খালিই তো পইড়া আছিলো। ইসুফ মিয়ার মায়ে দেখে, সেইদিগের একটা জায়গায় মাটি ফালাইয়া উঁচা করা হইছে! ঘরের ভিটির সমান উঁচা। অখন তিন চাইরজোন কামলায় অই মাটিরে ভাও মতোন বসানের লেইগা দুরমুজ-পিটা করতাছে।
পাক্কা মোনে হইতাছে য্যান বেটারা ঘরের ভিটি বান্ধতাছে! নাকি অন্য কিছু করতাছে? কী করে? ইসুফ মিয়ার মায়ে ঘোমটার ফাঁক দিয়া কড়ড়া চক্ষে চায়। হ! সেয় তো ভুল দেখতাছে না! অইনে নয়া ঘর তোলোনের আঞ্জামই ত্তো চলতাছে! অই যে ছৈয়াল আর জোগালি বেটারা বইয়া বইয়া কাম করতাছে! হেরাও তিনজোন। তাগো একজোনে দাও হাতে মুলি বাঁশ চাঁছতাছে, একজোনে বাঁশেরে চিরতাছে, আরেকজোনে বাঁশের চিররে মাটিতে ফালাইয়া নানমতে বেড়া বানাইতাছে।
এইটা নয়া ঘর তোলোনের আঞ্জাম না—তয় কী! জুলেখার বাপে নতুন ঘর বান্ধতাছে! হেরা অখন নয়া ঘর দিয়া কী করবো! দুইজোন মাইনষের বসত করতে কয়খান ঘর লাগে!
বিষয়টা চক্ষে দেখে ইসুফ মিয়ার মায়, তবে সেয় কিছুই পরিষ্কার বোঝে না। আঁতকা কী এমুন বিত্তান্ত ঘটলো যে, এই বাড়িতে নয়া ঘর ওঠোনের ঠেকা পড়লো! নয়াঘর বান্ধন তো খুশির বিষয়। গেরামের কেউই তো সেই খুশিরে দশজোনের লগে ভাগ না কইরা কাম শুরু করে না কোনোকালে।
হয় তারা লোকের বাড়ি বাড়ি বাটি ভইরা বাতাসা পাঠায়, নাইলে যে পারে ফিন্নি রাইন্ধা বাড়ি বাড়ি দেয়। আর লোকের দোয়া নেয়। তার বাদে নয়া ঘরের কাম শুরু করে। এমুনই ত্তো চলতাছে এই দেশে! এই বাড়ির খুশির কথাখান কি লোকে হোনছে? না তো!
জুলেখাগো বাড়িতে নয়া ঘর ওঠতাছে—এই কথা গেরামের কোনো জোনের জানা নাই। দেওভোগ গেরামের একজোন কোনো মানুষ তো দূরের কথা—একটা কাউয়া-কুলি তরি সেই খোশ-খবরির কিছুই জানে না! ইসুফের মায়েও তো জানে না কিছু!
জুলেখার মাও-বাপে ভালা কইরাই জানে তো যে, এই বাড়ির খুশির কথা হোনলে তার তেনে দিল-খোশ আর কেউ হইবো না! তাইলে তারেও দেহি জানাইলো না এই বাড়ির কোনো জনেও!
এইটা ঠিক যে, গেলো দশ-পোনরো দিন ইসুফ মিয়ার মায়ে এই বাড়িতে একটা পাড়া দেওনের ফুরসতও পায় নাই। আওনের কোনো ফাঁক পায় নাই সেয়। একে, এইর মিদে তাগো বাড়িতে একটা গাইয়ে বিয়ানি দিছে; তার উপরে আবার ইসুফ মিয়ার অসুইক্ষা বৌয়ের অসুখ গাড়াইয়া গিয়া তার শইল হইয়া গেছে বেজাহানি রকম খারাপ। এই দুই গ্যাঞ্জামরে একলা হাতে সামলানি দিতে দিতে এই বাড়ির দিগে আর পাও বাড়াইতে পারে নাই ইসুফ মিয়ার মায়। আবার, সবকিছু ফালাইয়া বাড়ির বাইরা হইতেও তার অন্তর সায় দেয় নাই! এই কারোনেই না এই কয়দিন ধইরা জুলেখাগো বাড়ির কোনো খোঁজটা রাখা হয় নাই তার!
ইসুফ মিয়ার বউটার চিন্তায়ই মায়ে বড়ো পেরেশানি পাইতাছে। আউজকা পেরায় দেড় বছর হয় পোলারে বিয়া করাইছে বাপে-মায়ে। সেইটাও কী কোনো সুখের বিয়া! সেইটা এক ছিদ্দতের বিয়া! না-করাইয়া উপায় আছিলো না!
শীতলা মায়ের দয়ার তেনে ভালা হইয়া উইট্টা পোলায় জানি কেমুন অইয়া যাইতাছিল! গদিতে গেলে যায়, নাইলে বাড়িতে পইড়া পইড়া ঝোমে। খালি ঝোমে। দেখলেই বোঝা যাইতাছিলো যে, দুনিয়ার কোনো কামের লেইগাই অর টান-টান্ডা কিচ্ছু নাই।
অর চিত্তে য্যান আর হাউস-আল্লাদ-সাধ বলতে নাই! ওদিগে দেখো সেয় কোনো কথা কানে লয় না। কোনো কথা কইতে চায় না। সগলতে ফিসাফিসি করতে থাকে, এই লক্ষণ তো ভালা না! ইসুফ মিয়ার চলাচলতি তো ভালা দেহায় না! কিছুয়ে আছর করে নাইক্কা তো ছেড়ারে!
মায়ে-বাপে বোঝে যে আলা তরাতরি ঘরে বৌ আনতে হইবো। বৌয়ে যুদি অখন আইয়া পোলাটারে সংসারে ফিরায়! মায় ঠারে-ঠোরে পোলারে এই নিয়া কতো কথা কয়; কতোভাবে কতো বুঝানি দেয়! মায় তো জানে পুতের বেদনা। কিন্তু কপালের ফেরে অন্তরের সেই বেদনা দূর করোনের কোনো উপায় আর লোকের হাতে নাই! কী জানি খোদার এইটা কেমুন লীলা!
যারে খোদায় নিছে গা, তার লেইগা কান্দুক পুতে! জনম ভইরা কান্দুক! আর, তার লেইগা দুই হাত তুইল্লা দোয়া করুক। কিন্তু যার কোনো হদিসই মিললো না; হের লেইগা তো ইসুফ মিয়ার জিন্দিগি ভাসাইয়া দেওনের কিছু নাই!
লোকের জীবন তো এমনে এমনে গাঙ্গে ভাসাইয়া দেওনের লেইগা দেয় নাই খোদায়! সংসারে মাও-বাপের হক আছে না! মাইনষেরে মাও-বাপের হকও তো পুরা করতে হইবো! নাইলে তারে খোদার কাছে ঠেকা থাকতে হয়! আউজকা ইসুফ মিয়ায় বিয়া কইরা বাপ-মাওয়ের হক পুরা করুক!
মায়ে এইমতে পোলারে কতো প্রকারে বুঝায়; আর কাইন্দা জারে জার হয়। কিন্তুক কিছুতেই কিছু হয় না পোলার। সেয় বিয়ার নামও কানে নিতে চায় না। তার বড়ো বইনে আইয়া খোসামদ করে; ফুবুয়ে কতো তোষামদ করে, পোলায় গেরাজ্জিও করে না। বিয়ার লায়েক পোলা! তারে সংসার দেওন তো মায়-বাপের ফরজ কাম! অখন কী উপায়!
তখন ইমাম হুজুরে আইয়া ইসুফ মিয়ারে কয়, ‘যা একদিন হইছে, হইছে! তারে তো আর ফিরানের উপায় নাই। অখন, যা আর ফিরা আইবো না, তার লেইগা বৈরাগী অইলে কী দুনিয়া চলবো! বাজি! অন্তরেরে দুক্ষু অন্তরে চাপা দিয়া তুমি বাপ-মায়ের হুকুম তামিল করো। তাগো পাওয়ের নিচে কইলাম পোলাপাইনের বেহেশত! নাইলে খোদায় নারাজ হইবো!’
হুজুরের বুঝ আলা ইসুফ মিয়ার অন্তরে গিয়া কী কাম করে সেইটা মুর্শিদে কইতে পারে; তবে বাড়ির সগলতে দেখে যে, বিয়ার বিষয়ে য্যান ইসুফ মিয়ায় আর অরাজি না!
শুক্কুর আলহামদুলিল্লাহ! তরাতরি বিয়ার দিন-তারিখ ঠিক করে পোলার বাপে-মায়ে। মাইয়া তো আগে ঠিক করা আছিলোই। ইসুফ মিয়ার মামাতো বইন, বড়ো মামার মাইয়া—খুদি বিবির লগে আশ্বিন মাসের শুক্কুরবারে দিন ধার্য হয়।
সবই শোনে ইসুফ মিয়ায়; কোনো ওজর-আপিত্তি কিচ্ছু করে না। তারে খুশিও দেহায় না, বেজারও দেহায় না। সেইটা দেইক্ষা মায়ের কইলজা ধুকপুকানিটা ক্রমে ক্রমে থামে। পোলায় ওদিগে আছে, থাকে, গদিতে যায়; সব করতে থাকে ঠায়ঠান্ডা রকমে। সব মোনে হইতে থাকে এক্কেবারে ঠিক। কিন্তু দেহো ইসুফ মিয়ার মোনে কী আছে! যেই না তেলাইয় দেওনের দিনটা আহে, ওম্মা! সেই দিনই সেয় বাড়ির তেনে পলাইয়া যায়!
বাড়ি ভইরা সেই দিন লোকে লোক্কাকার! এতো বড়ো বাড়ির পইল্লা পুতের বিয়া! সেই বিয়ার আইয়ুরি-নাইওরী কী কম হইতে পারে! আর ধুমধাম নি কম হওনের কোনো উপায় আছে! সগলতে একদিগে হলদি-মেন্দি বাটোন নিয়া, উঠানে পোলার তেলাইয়ের জায়গা করোন নিয়া আর তেলাইয়ের দিনে লোকের পাতে দেওনের খাওন রান্ধন নিয়া ধুমাধুমি পেরেশান, আরেকদিগে সগলতের চক্ষের উপরে দিয়া, কোন ফাঁকে ইসুফ মিয়ায় বাড়ির তেনে নাই হইয়া যায়! কোনসোম যে যায়, কেউ কইতেই পারে না।
খোঁজ খোঁজ খোঁজের উপরে খোঁজ! একরাইত একদিন যায় গা! কোনো সন্ধান পাওয়া যায় না। সগলতের অন্তর চিপা খাইয়া যায়। মাইয়াগো বাড়ির লোকের তেনে আর বুঝি বিষয়খানরে গোপন রাখা যায় না! বিয়া বুঝি না ভাইঙ্গা দিয়া আর রক্ষা নাই!
এমুন কালে, সন্ধ্যা হয় হয় সোমে; ইমাম হুজুরের এক পীরভাইয়ে খবর নিয়া আসে যে, ইসুফ মিয়ারে দেখা গেছে কদমরছুল মাজারের ফকিরগো ঝুপড়িতে!
সেয় আল্লার রাস্তায় দিওয়ানা হইতে সংসার ছাড়ছে! আউজকা রাইতেই অন্য ফকির বাবাগো লগে মেলা দিবো সেয় ফকির কাল্লু শাহ বাবার মাজারের দিগে! সেইনে গিয়া চল্লিশ দিন চিল্লা কইরা তার বাদে সেয় থাকবো ফকিরির দুনিয়ায়। বাইত আর ফিরা আইবো না।
খবর পাইয়া বাপে মায়ে নি আর এক দণ্ড নষ্ট করে! তারা দোনোজোনেই বোঝে যে, এইযাত্রা পুতেরে ফিরাইতে একলা বাপের গেলেও চলবো না, বা একলা মায়েরে গেলেও হইবো না। একলগে থাকোন লাগবো তাগো দোনোজোনেরে।
অখন মাঝি-মাল্লারা যেমনে পারে তেমনে তাগো উড়াইয়া লইয়া যাউক পুতের কাছে! বেদিশা বাপ-মাওয়ে উতলা মাথায় পুতের সন্ধানে উড়াল দেয়। তাগো শায়-শান্তি হালেই যাইতে দেয় ইমাম হুজুরে। কিন্তু সেয় বোঝে যে, একলা অই দুইজোনে অখন তাগো পুত ইসুফ মিয়ারে ফিরান্তি আনতে বিফলও হইতে পারে! যেই পইখ উড়াল চিনছে, তারে খাঁচায় আনোন কী আর সোজা-সহজ কাম নি! কী হয় কওন যায় না!
সেই চিন্তা মাথায় নিয়া ইমাম হুজুরে করে কী, ইসুফ মিয়ার মাও-বাপের নাওয়ের পিছে পিছে সেয়ও নাও ভাসায়। তয় সেয় একলা যায় না। বুদ্ধি কইরা গেরামের সাত-আট জোন জুয়ান পোলারেও তার লগে নিয়া নেয়। আরো নেয় দড়ি-কাছি। কী জানি যুদি অরে বাইন্ধা আনোনের দরকার অয়!
সামোনে খাড়া বাপ-মাওয়ের কাতর মোখ দেইক্ষাই হউক, কী তারে ঘের দিয়া খাড়া হওয়া আট-দশটা জুয়ান পোলার লগে জোরে পারবো না—এই চিন্তা কইরাই হউক; ইসুফ মিয়ায় বাড়িত ফিরতি আহে। আবার তারে সোন্দর মতোন বিয়া করাইয়া বৌও ঘরে আনে ইসুফ মিয়ার বাপে মায়ে।
নে আলা পোলা! এইবার তুই বউয়ের শিকলি কাইট্টা কই যাবি যা!
খুদি বিবিরে পোলার লেইগা আইন্না কোনো ভুল করে নাই ইসুফ মিয়ার মায়ে-বাপে। এই ত্তো সোন্দর সংসার করতাছে পোলায়! বাপের লগে গদিতেও যায়, হাটের তেনে পেরায় পেরায় বউয়ের লেইগা জিলাপিও কিন্না আনে। খালি দোষের মিদে এই যে, হাসে না। বলতে হাসে না। বউটার লগে হাসি-তামশাটা করে না, কথাও য্যান কয় না-পারতে!
দেইক্ষা মায়ের কইলজা ছ্যাত ছ্যাত কইরা ওঠে একেকবার! আবার লগে লগে মোনেরে মায়ে বুঝ দেয় যে, কালে এওও ঠিক হইয়া যাইবো। এউগ্গা-দুগা নাতি-নাতকুড় বউটার কোলে আইলেই বিবাগী বাপের মোন ঘোরবো। সংসারে পুরা মন বইবো তখন ইসুফ মিয়ার!
কিন্তু ইসুফ মিয়ার মায়ের এমনই ফাটা-কপাল! তার নসিবে কোনো সোম পুরা সুখ নাই! পোলার বউয়ে পোয়াতি হইলো ঠিক মতোনই, কিন্তু জন্ম দিলো একখান মরা মাইয়া! কেমনে তার আশা-পাতে ছাই পড়ে দেখো! কই দাদীয়ে তার নাতিনরে নিবো কোলের ভিতরে! না, তারে দিয়া দিতে হইলো মা-খাকীরে। কব্বরের ভিতরে চির জন্মের লেইগা শোয়াইতে হইলো!
কী সোন্দর ঢকে-গড়নে হইছিলো মাইয়াটা, য্যান একটা চিনির পুতলা! কিন্তু তাগো নসিবে নাই নাতিপুতির সুখ ভোগ করোন। ছাওই হইলো মরা! আইচ্ছা! আল্লায় কিসমতে যা লেখছে, তাইই ত্তো আইবো লোকের পাতে!
কিন্তু ইসুফ মিয়ার কপালের গরদিশ য্যান আর অরে ছাড়তে রাজি না! গরদিশে য্যান ইসুফের লগে লগে বসত করোনের নিয়ত করছে! সেইটায় অখন বাড়িতে আইয়া পিঁড়া পাইত্তা বইছে য্যান লাগে! মরা মাইয়া জন্ম দিছে, দিছে; তার বাদে তো বউটায় ভালা হইবো! হয় নাই।
কী হইছে? না, সুতিকা বেরামে ধরছে বউটারে! আয় হায় হায়! কবিরাজ আইন্না, দাওয়াই খাওয়াইয়া, পথ্যি দিতে দিতে পেরেশান হইতাছে ঘরের মাইনষে! লগে লগে নানা পদের বনাজি-টোটকা তো চলতাছেই। কিন্তু কিছুতেই কিছু হইতাছে না। বেমার কমোনের কোনো আলামত নজরে আইতাছে না কেউর!
সেই সুতিকার প্রকোপটা কয়দিন আগে আরো বাড়ার দিগে গেছিলো গা! বেসামাল দশা। তারলগে আবার গাইও বিয়াইছে য্যান জোড়া বাইন্ধা। এই দুই খাবা-জাবারর মিদে এমুন এট্টু ফুরসত পায় নাই ইসুফ মিয়ার মায়ে যে, একটাবার আইয়া জুলেখাগো বাড়িত খালি এট্টু ফুচকি দিয়া যায়!
আউজকা এই এতোদিনের মাথায় একটু আজাইর পাইছে ইসুফ মিয়ার মায়। পাইয়া আর দেরি করে নাই সেয়। আইসা খাড়াইছে জুলেখার মায়েরে দেখতে। আহহারে, কেমনে না জানি দিন পার করতাছে সন্তান-শোকী মাওটায়!
কিন্তু আইসা তো দেহি ইসুফ মিয়ার মায়ের বেতোবা হইয়া যাওনের দশা হইছে! চক্ষের উপরে দেখতাছে নয়া-ঘর বান্ধনের হুড়াধুরি! কী হইলো আবার এই বাড়িতে! কোন খুশিতে নয়া ঘর বান্ধতাছে এই বাড়ির লোকে!
ইসুফ মিয়ার মায়ের এই সওয়ালের জব দিতে পারে একজোনে। হেয় জুলেখার মায়ে। জুলেখার মায়ে কো?
মাইয়া খোয়ানি যাওনের পরে জুলেখার মায়ে তাগো বড়োঘরে থাকে কোনোরকমে ঠেকার কাম সারতে। অখন বোলে তার খালি ভালা লাগে রান্ধনঘরে পইড়া থাকতে। সেই কারোনে কাম থাকুক আর না থাকুক—সেয় থাকে রান্ধন ঘরে। হয় বহা দিয়া থাকে, নাইলে আঞ্চল পাইত্তা মাটিতে কাইত হইয়া থাকে। এমনে এমনেই যাইতাছে তার দিন।
নিত্যি সকল সোমে ইসুফ মিয়ার মায়ে আইয়া জুলেখার মায়েরে পায়—রান্ধন ঘরের দুয়ার বরাবর বওয়া। আউজকা দেখা যায় রান্ধনঘরের দুই কপাট নিপাটে ফাঁক করা; কিন্তু জুলেখার মাওয়ের ছেমাটাও তো দরজা বরাবর দেহা যায় না! কই গেলো সেয়?
দোনোমোনো পাও নিয়া ইসুফ মিয়ার মায়ে রান্ধন ঘরের ভিতরে ঢোকে। ‘কই গো তুই, জুলেখার মা?’ আন্দাজেই ডাক দেয় সেয়।
কোনো জব দেয় না কেউ। গেলো কই! কথাটা খালি চিন্তা কইরাও সারে নাই সেয়, অমনেই তার চোখ যায় দরজার ডাইন কপাটের দিগে। কপাটের আউইলে বহা দেখি জুলেখার মায়ে! ‘কিগো, জুলির মা; তুই এইনে এমনে বওয়া দিয়া আছস! বওনের আর জায়গা পালি না? ডাকতাছি, হুমুইর দেস না ক্যান! কিগো?’
কথা জিগাইতে জিগাইতে নজর খাড়া কইরা জুলেখার মায়ের মোখখানের দিগে চায় ইসুফ মিয়ার মায়। অম্মা! মোখখান দেহি অর কাইল্লা থুকথুকা পাতিলের তল হইয়া রইছে! দেইক্ষাই কওন যায়, এই কালি পুরা শোকের কালি না! এইটা আরেক নয়া শোকের কঠিন কালি! পুরান শোকের উপরে লাপটাইয়া পড়ছে নয়া আরেক শোকে!
সেই মোখের দিগে নজর দিয়া চোখ কাইপ্পা ওঠে ইসুফ মিয়ার মায়ের! এমুন ঘোটঘুইট্টা, কাইল্লা আন্ধার দেহায় ক্যান অর মোখ! জ্যাতা মাইনষের মোখ এইটা!
তরাতরি কোনোরকমে বেঁকাতেরা হইয়া বহে ইসুফ মিয়ার মাওয়ে, জুলেখার মাওয়ের সামোনে।
‘কী হইছে? কী হইছে বইন?’ ইসুফ মিয়ার মায় হরদিশা পরানে জিগায়।
জুলেখার মাওয়ে কোনো জব দেয় না। খালি বোবা চক্ষে চাইয়া থাকে।
‘কথার জব দেস না ক্যান? না কইলে আমি কেমনে বুঝমু? আঁতকা আইছি না? ক! কী হইছে ক!’
পাতিলের তলের লাহান থুপথুইপ্পা কালা ডাইন গালে দরদরাইয়া নাইম্মা আহে পানির ধারাখান। জুলেখার মাওয়ের বাও চোখখান দেখো শুকনা কটকটা! সেই চক্ষে পানির নাম-নিশানাও নাই।
‘কী হইছে বুজিরে ভাইঙ্গা কবি না? ক!’ ইসুফ মিয়ার মাওয়ে জুলেখার মাওয়ের হাত দুইটা জাবড়া দিয়া ধরে। সেই হাত এমুন ঠান্ডা হিম যে, ধরলে শইল্লে কাঁটা দেয়! য্যান জ্যাতা মাইনষের হাত না! ‘কী হইছে বইন?’
কিছু অয় নাই! জুলেখার বাপে আবার বোলে বিয়া করবো! সামনে আইতাছে আষাঢ় মাস! আষাঢ় মাইস্যা পইল্লা শুক্কুরবারে সেয় নয়া বউ বাইত তোলবো।
(চলবে)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ৩০)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন(কিস্তি ২৯)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ২৮)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ২৭)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন(কিস্তি ২৬)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ২৫)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ২৪)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন(কিস্তি ২৩)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন(কিস্তি ২২)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ২১)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ২০)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১৯)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১৮)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১৭)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১৬)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১৫)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১৪)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১৩)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১২)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১১)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১০)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ৯)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ৮)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (সপ্তম কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (ষষ্ঠ কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (পঞ্চম কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (চতুর্থ কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (তৃতীয় কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (দ্বিতীয় কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (প্রথম কিস্তি)