সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন
‘ও মাগ্গো মা!’ চুপেচাপে আলগোচ্ছে দেওভোগ গেরামের সকলে ফিসফিসায়। জমিদার-বউয়ের ব্যাদনায় তাগো পরান জ্বলে – এই কথা সত্য। কিন্তু তার চলা-চলতি দেখে চোখ য্যান কটকটায়! তার চলোন-চলতি জানি কেমুন! জমিদারের পুরীতে কেমুন জানি নিয়ম-ছাড়া কাণ্ড-কারবার চলতে দেখে তারা। হইলো নাইলে বড়ো মাইনষের ঘরের বিধবা! কিন্তু রাঁড়ি-বেওয়া তো ! তার তো সাদা কাপড়খান কোনোরকমে অঙ্গে ধারণ করণের কথা!
কিন্তু সেয় সাদা কাপোড় পিন্ধে না। পিন্ধে পাইড়-অলা রঙিন কাপোড়! জমিদার-বউয়ের পিন্ধনে সদাসর্বদা দেখা যায় নানান বাহারি শাড়ি-কাপোড়! সোয়ামী থাকতে যেমন আছিলো সেয়, রাঁড়ি-দশায়ও তেমনই আছে। অঙ্গের অলংকার অঙ্গজোড়া- ঝলমল করে ঝলমল করে! মাথার চুলের ঢল যে মাথায়ই আছে, সেও সকলের নজরে পড়ছে। বিধবার এমন বেশবাস দুনিয়ায় কে কবে দেখছে!
‘এইটা কিমুন কিত্তি! কামটা য্যান অনায্যি হইতাছে!’ সকলে কওয়াবুলি করে; খালি কওয়া-বুলি করতে থাকে ভিতরে ভিতরে। বিধবা নারীর এমুন বেভার! এমনটার কথা এই গেরামের কেউ কোনোদিন শোনছে! শোনে নাই জিন্দিগিতে। এমুন তারা কোনোদিন দেখে নাই! সেয় তাইলে এইটা কী করতাছে! মাথায় নি জমিদার-বউয়ের কোনো দোষ পড়ছে! হের মাতা-খারাপ হইয়া যায় নাই তো!
‘না গো মা-সগল, মাতায় তার দোষ পড়ে নাইক্কা! হেয় সতী লক্ষ্মী নারী; তার তেজের সামনে চান্দসুরুজে ইস্তক খাড়াইতে পারবো না!’ ঠাকুরনী দিদিয়ে ভেদের কথা ভাঙতে বসে একদিন; ‘ভেদের কতা সগল-জোনেরে কওন নিষেদ। কিন্তুক তোমরা হইলা নিদানের বান্ধব। তোমাগো কাছে কওনে দোষ হইব না। এই যে জমিদার-বৌদিদির এমুন সধবার বেশ, এর পিছে কারোন আছে।’
কী সেই কারোন!
‘একদিন হইছে কি- সন্ধ্যাকালে, সুরুজ পেরায় ডোবেডোবে সময়ে, জমিদারে আইসা হের বউরে কয়- কথা আছে, এদিগে আহো। বউয়ে আশ্চিয্যি হয়। এইটা হইলো সন্ধ্যা-আন্নিকের বেলা। জপতপ থুইয়া এমুন সোমে তার সোয়ামী তার লগে কোনোকালেও কথা কইতে বসে নাই! আউজকা কী হইলো! আর, সেই কথা কওয়ার জন্য কিনা পূজার ঘরে নিয়া যায় তারে! বউয়ের পরান কিছু না বুঝেই ধকপক ধকপক করতে থাকে। ওদিগে দেখো, বাম চোখখানও আতকা ফড়কানো ধরে। বিধি! কোন অমঙ্গল আইতাছে! ও কপালরে! কী কথা শোনবো সেয় আজকা!
জমিদারের চক্ষু য্যান বউয়ের অন্তরের ডর স্পষ্ট দেখতে পায়। সেয় কয়, বউ ডরাইও না। যা কই, ভালা কইরা মাথায় রাখো। আমার যাওনের দিন আইয়া পড়ছে। আর বড়ো দূরে নাই। তয়, এইটা হইবো আমার কায়া বদল, মিত্তু না!
সেই কারণে তোমারে বিধবার সাজপোশাক পিন্ধতে আমি নিষেদ দিয়া যাইতাছি। যতো জীবন বাঁচবা, ততো কাল সধবার বেশে বাঁচবা। কিন্তুক, এই গুপ্তি-কথারে দশকান কইরো না বউ! সোয়ামীর সেই হুকুম পালনি না কইরা কি বউয়ে পারে! জমিদার বৌদিদি চলতাছে পতির কথা মান্যি কইরা। অহন, মা-সগলেরা এই হইলো ভেদের কথাখান।’
ঠাকুরনী দিদি ভেদের কথাখান বলে, না য্যান সকলের চিত্তিরে ডর ঢুকাইয়া দেয়! যুগী-ঋষিরা যে কায়া বদল করে সেই কথা এতোকাল শোনছে তারা; অহন দেখো চক্ষের সামোনে, নিজেগো জমিদারের জিন্দিগিতেই সেই ঘটনা ঘটে গেছে! তারা চিরকাল শুনে আসছে যে, যুগী-সন্ন্যাসীরা সেই কোন পাহাড়-পর্বতের মুল্লুকে থাকে। তারা থাকে তাদের সাধন-ভজনের কর্ম নিয়া। সেই সব করতে করতে একদিন তাগো নজরে আসে যে, তাগো দেহখানা য্যান মলিন মলিন দেখায়! পুরান ত্যানা ত্যানা য্যান লাগে দেহরে! যেই তারা বোঝে যে, পুরান কায়ারে দিয়া আর কর্ম চলবো না; তক্ষণ তক্ষণ তারা কায়া বদল করে নেয়।
দেওভোগ গেরামের লোকেরা যেমুন দরকারে কাপোড় বদল করে, অই মুনি –ঠাকুরেরাও ভজন-সাধন করতে করতে একদিন নিজের পুরান দেহখান ফালাইয়া দেয়। দিয়া, নতুন কায়া নেয়। তারা মরে না। কায়া বদল করে। সেই শোনা জিনিস আজকা দেখো চক্ষের সম্মুখে ঘটে গেছে কোন সময়! নিজেগো জমিদারে তো তাইলে খালি রাজা-রাজড়া মানুষই আছিলো না! আছিলো আসোল যুগী-ঋষি!
সেয় যে সাধন-ভজনে আছিলো সেইটা রায়তরা জানে, কিন্তুক সেয় যে এতো বড়ো যুগী আছিলো তা তো তাগো গোচরে আসে নাই কোনোদিন! জানা থাকলে নিত্যি ত্রিসন্ধ্যা তারা কি জমিদারের পায়ের ধূলি মাথায় না ঠেকাইয়া থাকতো? থাকতো না। গ্রামের পুরুষপোলারা সেই কর্ম না করতে পারার আফসোসে ছটফটানি খাইতে থাকে। ওদিগে, ঘরে ঘরে মাতারিগো অন্তরে, অন্য কথা লড়েচড়ে। তারা সগলতে বড়োই ডর খাইয়া যায়!
তাগো সকলেরই শোনা আছে যে, অইসব কায়া-বদল-করা যুগীরা যখন ইচ্ছা তখন- তার পুরান জিন্দিগির বসতভিটায় আসে, দরকারের ক্রিয়া-কর্ম সারে, শেষে যায় গা! যখন তখন আসা-যাওয়া করে তারা! তয়, সকলে তারে দেখতে পায় না। সকলরে সেয় দেখা দেয়ও না। কেবল যারে অন্তর দিয়া মহব্বোত করে, তারে দেখা দেয়। কথা কয়। তারেই সংসারের বুঝ-ব্যবস্থা দেয়, ভালা-মন্দ আগাম জানায়।
তাইলে তো তাগো জমিদারেও তার বউয়ের কাছে আসছে, গেছে কতোবার! এহনও না জানি কতো আইতাছে যাইতাছে সেয়! তার মধ্যে কি কোনোদিন গেরামের বৌ-ঝিরা তার সামনা-সামনি পইড়া যায় নাই! সেয় তো তখন থাকছে অদিশ্যি, কাজেই তারে কেউই দেখে নাই। এদিগে কিনা সেয় সগলতেরে দেখেছে, কথাবার্তা শোনছে।
রায়ত মাতারি হইয়া নি তারা এমুন যখন-তখন লড়তে-চড়তে পারে জমিদারের সামনে! পারে না। সেইটা বেয়াদ্দবি। তুক্ষার বেয়াদ্দবি! তবে বেয়াদবির কথাটা ছাপিয়ে তাদের মনে আসে আরেক কথা। অদিশ্যি থেকে যে তাদের দেখছে, সেয় তো কায়া-বদলানি দেওয়া একজন। সেয় কি মানুষ? মানুষ নি সেয়! মানুষ না।
এই কথা মনে আসে তাগো,আর শরীর কাঁটা দিয়া উঠতে থাকে। মা-মা-মা! কি অশৈলী কারবারের মধ্যে গিয়া পড়ছে তারা! কিয়ের তেনে না জানি কি হইয়া যায়! আর, নিজেগো কথা যেমুন তেমুন, তাগো সকলেরই ঘরে না পোলাপান আছে! তাগো উপরে যুদি কিছুর কুদিষ্টি লাগে! তো এমন-তেমন নানান কথা মনে কইরা কইরা তারা ডরাইতে থাকে, বেধুম ডরাইতে থাকে। ঘরে ঘরে মাতারিরা ডরাইতে থাকে, পুরুষ-পোলারা ডরাইতে থাকে। কেউ আর জমিদারবাড়ির দিগে পাও বাড়াইতে চায় না। ঠাকুরনী দিদি একদিন দেখে, দুইদিন দেখে, শেষে তিনদিনের দিন নিজেই আইসা হাজির হয়।
‘গুপ্ত কথাখান ভাইঙ্গা দিয়া কি পাপের ভাগী হইলাম নি গো মা-সগল!’ ঠাকুরনী দিদি বেজার মোখে জিগায়। ‘কেউ একজোনও যে কয়দিন ধইরা পাও দিলা না জমিদারবাড়িতে!’
ঠাকুরনীদিদির কথার জব দেয় এমুন শক্তি কারো থাকে না। সগলতের মোখে য্যান কুলুপ লাইগ্গা যায়! কতোখোন পরে গেরামের কোনো একজোনে কোনোমতে মোখ খোলে, ‘কইলজায় কুলায় নাইক্কা গো দিদি!’ সেয় এই জবখান দেয়। তার কথা দিদিয়ে শোনে কি শোনে না বুঝা যায় না, তবে সগলতে দেখে দিদিয়ে অঝ্ঝোর ধারায় কান্দতাছে। দেখো দেখি, কিছুর মধ্যে কিছু না, ঠাকুরনী দিদিয়ে কান্দে! আয় হায় দিদি! কান্দেন ক্যান! কান্দেন ক্যান! মন্দ তো কিছু কই নাই গো বইন আপনেরে!
হাতের কাজকাম ফালাইয়া থুইয়া সগলতে তখন যে যেমনে পারে, দিদিরে সামলাইতে আহে। এই কথা সেই কথা বলে, সেইসবের সঙ্গে সঙ্গে নিজেগো পরানে জাগনা দেওয়া ডরের কথাখানও ক্রমে ক্রমে খোলসা করতে থাকে; একেকজনে। সেই কথা শুনতে শুনতে দিদি দেখো একবার কান্দে একবার হাসে! এইটা কী কারণে!
‘হাসি আহে তোমাগো বেবুঝ কথা হুইন্না।’ দিদিয়ে কয়, ‘আর কান্দি কপালের ভোগের কথা স্মরণে আইন্না।’
সকলে মুখ কাচুমাচু কইরা শরমাইতে থাকে; কিন্তু কেমনে বেবুঝ হইলো তারা, সেইটা কেউই বুঝতে পারে না।
‘যেয় কায়া বদলের কর্মখান করতে পারে, সেয় কি তোমার আমার লাহান তুচ্ছি মানুষগো মা-সগল?’ দিদিয়ে সগলতেরে জিগায়।
সকলে বোঝে, কথাখান তো সত্য!
‘অমুন পুন্নিঅলা মাইনষে কি অন্য মাতারিগো দিগে চাইবো? কোনো কারোনেই চাইবো না। চাওন নিষেদ থাকে তাগো। তাতে পুন্নি নষ্ট হয়। সাধনের রাস্তা পিছলা হইয়া যায়। আগ্গান যায় না আর। সেই কারোনে গুরুর হুকুম থাকে - হয় দিষ্টি থাকবো তোমার মাটির দিগে, নাইলে থাকবো চক্ষু বোজা। জমিদার-ঠাকুরে তো কায়া বদলের আগে এমুনই আছিলো! জমিদারির কর্মটুক খালি কোনোমতে পালন করতো সেয় চোখ খোলা দিয়া; বাকি সময় তো থাকতো বন্ধ চক্ষে। থাকতো সেয় ধ্যানে!’
‘হায় হায় গো দিদি! আমরা জমিদার ঠাকুরের চরিত্র লইয়া কথা কমু! এই ছোটো মোখে এতো বড়ো সাহস হয় নাই গো দিদি!’ ডরে আর শরমে গেরামের মা-বইনের কইলজার পানি নাই হইয়া যায়। হায় হায়! ঠাকুরনী দিদিয়ে এটি কি কয়!
তাগো কথা দিদিয়ে য্যান গ্রাহ্যিই করে না। সেয় আপনা মনে আপনা কথা কইয়াই যাইতে থাকে; ‘কায়া বদলির পর, জমিদার ঠাকুরে অহন নিত্যি নিশিকালে আহে। তোমাগো সেয় পাইলোই কই; আর দেখলোই কই, কও? তোমরা কোনোজোন কি নিশিকালে গেছো ঠাকুর-বাড়িত? যাও নাই। তাইলে কোন পরানে এমুন পুন্নিমানরে কুকথা কইতাছো? সেয় কি ভূতপেরেত –যে সেয় অমঙ্গল দিবো তোমাগো? ’
সকলে বোঝে যে, কথা একেবারে সত্য! আর দেখো তারা কেমুন বুদ্ধিনাশা! এমুন ভালা জিনিসেরে ভালা চক্ষে দেখার খ্যামতাখানও তাগো নাই! এমুন বুদ্ধির কপালে মুইড়া পিছা!
(চলবে)