আদিবাসী পুরাণ
মৃত্যু ও ভূমিকম্প নিয়ে ওঁরাও কাহিনী
গ্রামের নাম বহবলদিঘি। স্থানীয়দের ভাষায় ‘বগলদিঘি’। এই গ্রামেই বসবাস করছে নানা জাতির আদিবাসীরা। তাদের মাঝে আজ টানটান উত্তেজনা। একটি কবরস্থানকে দখলমুক্ত করতে তারা জোটবদ্ধ হয়েছে।
যুবক বয়সীরা হাতে তুলে নিয়েছে তীর-ধনুক। চারদিকে থমথমে পরিবেশ। খবর পেয়ে স্থানীয় প্রশাসন, চেয়ারম্যান আর সাংবাদিকরা চলে আসেন ঘটনাস্থলে। সকলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে কবরস্থানটিকে তাৎক্ষণিকভাবে দখলমুক্ত করে নেয় আদিবাসীরা। আনন্দ আর বিজয়ের স্বাদ নিয়ে ফিরতে থাকে তারা।
পশ্চিম আকাশে তখন সূর্যটা হেলে পড়েছে। স্নিগ্ধ লাল আলোর কমল ছোঁয়ায় বদলে যাওয়া পরিবেশ। ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে চারদিকে। কবরস্থানের পাশের একটি খোলা মাঠে বসে আছেন এক বৃদ্ধ। বয়স নিদেনপক্ষে নব্বই। কবরস্থানের দিকে তাকিয়ে এক দৃষ্টিতে কী যেন ভাবছেন তিনি। আমরা এগোতে থাকি তাঁর দিকে। গ্রামের নৃপেন টিগ্গাও আমাদের সঙ্গী হন।
এখানকার ওঁরাও গোত্রের মহত নৃপেন। তিনি জানালেন, বৃদ্ধটিও তাঁদের গোত্রের। সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি তিনি। নাম তাঁর শংকর টিগ্গা। গোত্রপ্রধান নৃপেন হলেও শংকরের পরামর্শ তাঁদের কাছে সব সময় অগ্রাধিকার পায়।
শংকর টিগ্গার সঙ্গে আমার আলাপ জমাতে এগিয়ে যাই। টের পেয়ে তিনিও মুখ তুলে তাকান। তাঁর চামড়া ভাঁজ খাওয়া। পরতে পরতে যেন ইতিহাস লুকানো। আমাদের দিকে মুচকি হেসে কাঁপা কাঁপা গলায় তিনি বলেন, ‘আমাদের সমাজে কোনো মৃত্যু ছিল না।’ তাঁর কথায় আমাদের চোখ স্থির হয়ে যায়। কিন্তু নৃপেন বেশ স্বাভাবিক। আপন মনেই তিনি বলতে থাকেন মৃত্যুরহস্য নিয়ে ওঁরাওদের নানা বিশ্বাসের কথা।
কোনো এককালে ওঁরাওদের জীবনে কোনো মৃত্যু ছিল না। শিশু, যুবক, বৃদ্ধ কেউ-ই মৃত্যুবরণ করত না। এভাবেই চলছিল। বেশ কিছুদিন পর মৃত্যু না থাকায় অসুবিধা দেখা দিল থুড়থুড়ে বৃদ্ধদের নিয়ে। বৃদ্ধদের চলাফেরা, খাওয়া-দাওয়া সবকিছুর জন্য তখন আরেকজনের সহায়তা লাগত। ওঁরাও বৃদ্ধ সমাজ তখন চিন্তা করল, এ রকম কষ্ট আর অন্যের সাহায্য নিয়ে বেঁচে থাকার কোনো অর্থ হয় না। এরচেয়ে মৃত্যুই ভালো। সমাজের সকলেই এ ব্যবস্থায় একমত হলেন।
ওঁরাওদের ভগবানের নাম ধার্মেশ। ওঁরাওদের কাছে ধার্মেশ সৃষ্টিকর্তা, রক্ষাকর্তা ও পালনকর্তা। সকলে একত্রে তখন ভগবানের কাছে গেল।
আকুতি জানিয়ে ধার্মেশকে বললেন, ‘ভগবান, আমাদের মাঝে মৃত্যু দাও।’ ধার্মেশ বললেন, ‘তোমরা কি সকলের জন্যই মৃত্যু চাও।’ উত্তরে সবাই বলে, ‘না, যারা বৃদ্ধ, তাদের জন্য শুধু মৃত্যু দাও।’ দেবতা ধার্মেশ তাদের আবেদন মঞ্জুর করেন। ওঁরাওদের বিশ্বাস, সে থেকেই পৃথিবীতে মৃত্যুর আবির্ভাব হয়েছে।
তাহলে অন্য বয়সীদের কেন মৃত্যু হয়?
এ রকম প্রশ্নে নৃপেনের উত্তর, ‘মানব সমাজে পাপের কারণে আত্মার পবিত্রতা নষ্ট হয়। আর এই অপবিত্র আত্মা তখন দেবতা ধার্মেশের কাছে চলে যায় এবং মৃত্যু কামনা করে। ফলে তখনই মানুষের শরীরে রোগব্যাধি দেখা দেয় এবং দেহের মৃত্যু ঘটে।’
আমরা বেশ অবাক হয়ে শুনতে থাকি নৃপেনের কথাগুলো। আদিবাসী ওঁরাওরা তাদের মৃত পূর্বপুরুষদের শক্তিতে বিশ্বাস করে। ওঁরাও ভাষায় এটি ‘পাকবলার’। এর অর্থ ‘অশরীরী আত্মা’। এদের বিশ্বাস পূর্বপুরুষদের আত্মার এই শক্তিই তাঁদের ভালো আদিবাসী এবং আদর্শ ঐক্যের পথে শক্তি জোগায়। বেঁচে থাকা ওঁরাওদের জন্য মৃতরা তাদের আশীর্বাদ রেখে যায়। তাই এরা মৃতদের ভক্তি করে। ভাত খেতে বসে এরা ভাতের কিছু অংশ পূর্বপুরুষদের নামে উৎসর্গ করে। কখনো কখনো নবজাতকের নাম রাখা হয় পূর্বপুরুষদের নামে, যাতে তাঁর আশীর্বাদ পাওয়া যায়।
নৃপেন এবার বলেন ভূমিকম্প নিয়ে ওঁরাওদের প্রচলিত বিশ্বাসটির কথা। তারা মনে করে, পৃথিবী একটি কচ্ছপের পিঠের ওপর। কেঁচো পাতাল থেকে মাটি তুলে কচ্ছপের পিঠে ফেলে মই দিয়ে ওই মাটি সমান করে দেয়। এ কারণে পৃথিবীর কোথাও সমতল, কোথাও বা পাহাড়-পর্বত। কচ্ছপের মুখের সামনে নাগিনী সাপ ফণা তুলে বসে থাকে, যাতে কচ্ছপ নাড়াচড়া না করতে পারে। কচ্ছপ নাড়াচড়া করলেই ভূমিকম্পের সৃষ্টি হয়।
ফোকলা হাসির শংকর টিগ্গা বলে, ‘আমরা তো বানর গোত্রে’র লোক। কথাটি শুনেই সকলের দৃষ্টি এক হয়ে যায়। শংকরও তখন মজার সব তথ্য জানাতে থাকে।
ওঁরাওদের কাছে গোত্র মহামূল্যবান। তাঁদের কাছে একই গোত্রের সকলেই ভাইবোন। ফলে এক গোত্রের মাঝে বিয়ে সম্পন্ন নিষিদ্ধ এবং পাপের সমতুল্য। ওঁরাওদের রয়েছে ২০টি গোত্র। নানা প্রাণী ও বস্তুর নামেই নামকরণ হয়েছে গোত্রগুলোর। যেমন : টিগ্গা অর্থ বানর, বান্ডো অর্থ বনবিড়াল, বাড়া অর্থ বটগাছ, বাঁড়োয়া অর্থ বন্যকুকুর, বাখলা অর্থ এক প্রকার ঘাস, বেক অর্থ লবণ, কেরকোটা অর্থ চড়ুই পাখি, কিন্ড অর্থ এক প্রকার মাছ, কিসপট্রা অর্থ শূকরের নাড়িভুঁড়ি, কুজুর অর্থ এক প্রকার লতাজাতীয় গাছ, লাকড়া অর্থ বাঘ, মিঞ্জি অর্থ এক প্রকার মাছ, পান্না অর্থ লোথা, তির্কী অর্থ এক জাতীয় মাছ, টপ্প অর্থ এক জাতীয় পাখি, খাখা অর্থ এক জাতীয় কাক, খালখো অর্থ এক জাতীয় মাছ, খেস অর্থ ধান। শংকর বেশ আগ্রহ নিয়ে বলতে থাকে ওঁরাওদের পূর্বপুরুষদের সময়কার সামাজিক ব্যবস্থার কথা। আমরাও বেশ অবাক হয়ে শুনছিলাম সবকিছু।
ওঁরাও গ্রামের নানা বিবাদ ও শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য যে গ্রাম সংগঠন ছিল, তাকে বলা হতো ‘পাঞ্চেস’। গ্রামের বয়স্ক সাত-আটজনকে নিয়ে গঠিত হতো পাঞ্চেস। প্রতিটি গ্রামে একজন হেডম্যান বা মাহাতো এবং একজন পুরোহিত বা নাইগাস থাকত। পাঞ্চেসের ওপরের সংগঠনের নাম ছিল পাঁড়হা। পাঁড়হা সাধারণত সাত থেকে বারোটি গ্রাম নিয়ে গঠিত হতো। এসব গ্রামের হেডম্যানদের পক্ষ থেকে একজন পাঁড়হা প্রধান নিযুক্ত হতো। তাকে বলা হতো পাঁড়হা রাজা। কোনো অভিযোগকারী যদি পাঞ্চেসের বিচারে সন্তুষ্ট না হয়, তবে সে পাঁড়হায় আপিল করতে পারতেন।
এরই মধ্যে পাশে এসে বসেন রবাট। তিনি অনেক দিন ধরে কাজ করছেন আদিবাসীদের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য। তিনি বলেন এ অঞ্চলে ওঁরাওদের আগমনের নানা তথ্য।
ওঁরাওরা এ উপমহাদেশের ভূমিজ সন্তান। এদের উৎপত্তি সম্পর্কে দুটি মতবাদ প্রচলিত আছে। ওঁরাওদের আদিস্থান দক্ষিণ ভারতের ডক্কানের কংকা নদীর তীরে। শরৎচন্দ্র রায়, পি দেহান ও কর্নেল ডালটন এই মত প্রকাশ করেন। তাঁদের মতে, ওঁরাওরা বসতি স্থাপনের লক্ষ্যে কংকা নদীর উপকূল থেকে যাত্রা শুরু করে এবং কনাটকায় কিছুকাল বসবাস করে। পরে পশ্চিম অববাহিকা হয়ে ওঁরাওরা অমরকণ্টক ফরেস্ট রেঞ্জে এসে পৌঁছায়।
ওঁরাওদের লোককাহিনীতেও এই তথ্যের সত্যতা মেলে। আবার মহলি লিবিন তির্কীর মতে, খ্রিস্ট জন্মের ৩৫০০ বছর ওঁরাওরা সুতলেজ নদীর অববাহিকায় হরপ্পা অঞ্চলে বাস করত। খ্রিস্ট জন্মের ১৭৫০ বছর আগে হরপ্পা থেকে ওঁরাওরা শাহাবাদের রোহটাস অঞ্চলে চলে আসে, যা বর্তমানে হরিয়ানা এবং যমুনার সমতলভূমি হিসেবে পরিচিত। সে হিসেবে বলা যায়, ওঁরাওরা বর্তমানে আজমগড়ে এবং মির্জাপুরে বসতি স্থাপন করেছে। শারীরিক গঠন ও ভাষাগত বিচারে ওঁরাওরা দ্রাবিরিয়ান গোষ্ঠীভুক্ত। দক্ষিণ ভারতের তামিল, তেলেগু, মালায়লাম, কানারিজ সবই দ্রাবিরিয়ান গোষ্ঠীর লোক।
ভারতবর্ষ ভাগের পূর্বেও দিনাজপুরে বহু সংখ্যক ওঁরাও বসবাসের প্রমাণ পাওয়া যায় বিভিন্ন দলিলে। অথচ নানা কারণে আজ শুধু দিনাজপুর নয়, গোটা দেশেই আদিবাসী ওঁরাওদের সংখ্যা কমে গেছে প্রবলভাবে। ফলে ধীরে ধীরে আমরা হারিয়ে ফেলছি একটি জাতিকে। হারিয়ে যাচ্ছে একটি ভাষা আর সংস্কৃতিগুলো।
ওঁরাও জাতি বেশ স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধসম্পন্ন। তারা চায় গোত্রের সকলেই সমান থাকুক এবং কেউ যাতে আরেকজনকে পেছনে ফেলে বড় না হয়। পূর্বপুরুষদের সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থার প্রভাব এখনো রয়েছে ওঁরাওদের মধ্যে। এ বিষয়ে ওঁরাওদের মধ্যে প্রচলিত আছে একটি কাহিনী। নৃপেন টিগ্গা জানালেন কাহিনীটি।
ওঁরাও সমাজ প্রবীণদের দ্বারা গণতান্ত্রিকভাবে পরিচালিত হতো। কিন্তু একটি দেশ পরিচালনার জন্য তো কাউকে না কাউকে রাজা নির্বাচন করতে হবে। তাহলে তো সাম্যবাদরীতি থাকবে না। সে সময় তারা এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিল। বাইরের একজনকে তারা রাজা বানাল। তার নাম ফনি মুকুট রায়। তিনি ছিলেন নাগবংশী সম্প্রদায়ের এবং আদিবাসী (রাজা নিয়োগের ক্ষেত্রে মুন্ডা এবং অন্য আদিবাসীদেরও ভূমিকা ছিল)। তবে তিনি রাজা ছিলেন নামমাত্র। প্রজারা উপহার হিসেবে যা দিতেন, তাই তিনি নিতেন। আদিবাসীদের কোনো কাজে তিনি হস্তক্ষেপ করতেন না। দীর্ঘদিন স্বাধীনভাবেই চলছিল ওঁরাওদের পাঞ্চেস ও পাঁড়হাগুলো। কিন্তু পরবর্তী সময়ে রাজা বাধ্যতামূলক করপ্রথা চালু করেন। ফলে ওঁরাও সমাজে হিন্দু ও বাইরের প্রভাব জোরদার হতে থাকে। রাজার সঙ্গে ওঁরাওদের সম্পর্কের অবনতি ঘটতে থাকে চরমভাবে। এ অবস্থা চলে প্রথম শতাব্দী থেকে ষোলো শতাব্দী পর্যন্ত।
ওঁরাওদের নানা ইতিহাস আমাদের মন ভুলিয়ে দেয়। এরই মধ্যে সূর্য হেলে পড়েছে পশ্চিম আকাশে। চারপাশে নামছে অন্ধকার। ক্রমাগত ডেকে যাচ্ছে ঝিঁঝিঁ পোকার দল। আসর ভেঙে আমরাও তখন ফিরতি পথ ধরি। মনে তখন ঘুরপাক খায় ওঁরাও বিশ্বাসের নানা কাহিনী।