‘সুবোধ তুই পালিয়ে যা, তোর ভাগ্যে কিছু নেই!’
‘সুবোধকে তুই পালিয়ে যা, এখন সময় পক্ষে না’, ‘সুবোধ তুই পালিয়ে যা তোর ভাগ্যে কিছু নেই’ কিংবা ‘সুবোধ এখন জেলে! পাপবোধ নিশ্চিন্তে করছে বাস মানুষের হৃদয়ে’ -এই কথাগুলো এখন লেখা দেখা যাচ্ছে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানের দেওয়ালে।
কে এই সুবোধ? কেন তাকে পালিয়ে যেতে বলা হচ্ছে? এই শহর থেকে নাকি সময় থেকে তাকে পালাতে বলা হচ্ছে? কিংবা কারাই বা এসব বলছে সুবোধকে?
এসব কোনো প্রশ্নেরই অবশ্য উত্তর মেলেনি এখনো। রাজধানীর দেয়ালে দেওয়া আঁকা সুবোধ বা তার সৃষ্টিকর্তার পরিচয় এখনো জানা যায়নি। গোটা বিষয়টাই হয়ে আছে রহস্যময় বিষয়। কে বা কারা এসব আঁকছেন, কী তাদের উদ্দেশ্য, এর মাধ্যমে কী প্রচার করতে চাইছেন সেসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে ফিরছেন আগ্রহী অনেকেই।
শহরের বিভিন্ন দেয়ালে দেয়ালে আঁকা এসব গ্রাফিতিতে দেখা যাচ্ছে, কখনো একজন লোক ছুটে যাচ্ছে, কখনো সে বন্দি আছে, কখনো দাঁড়িয়ে আছে খাঁচা হাতে, সেই খাঁচার ভেতর টকটকে লাল সূর্য। আর এই লোকটির নামই সুবোধ। গ্রাফিতিতে সুবোধের ছবির পাশে লেখা থাকে দু-একটি লাইন।
সুবোধের এসব ছবি এখন শুধু দেয়ালেই সীমাবদ্ধ নেই। এসব দেয়ালের ছবি ছড়িয়ে পড়েছে ফেসবুকে। ঘুরছে ফেসবুক ব্যবহারকারীদের প্রোফাইলে। এমনকি সুবোধের নামে এবং এই ছবি দিয়ে খোলা হয়েছে ফেসবুক আইডি ও পেজ। শহর ঘুরে সুবোধের ছবি তুলে ফেসবুকে ফটো অ্যালবামও সাজিয়েছেন অনেকে। কেউ আবার প্রোফাইল ছবি বা কভার ছবি হিসেবে ব্যবহার করছেন সুবোধের ছবি। ছবির কথাগুলোও স্ট্যাটাস হিসেবে দিচ্ছেন অনেকে।
শহরের দেয়াল থেকে উঠে আসা সুবোধ এখন ভার্চুয়াল জগতেও এক পরিচিত নাম। কে বা কারা আঁকছে এই সুবোধকে, তা নিয়ে কৌতুহলও কম না।
চলুন এবার খুঁজে ফিরি সুবোধকে।
ঘুরে ঘুরে সুবোধের প্রায় সব ছবিই তুলে সংগ্রহে রেখেছেন যে কজন তাদেরই একজন আনহা এফ. খান। তিনি জানান, মিরপুর থেকে শাহবাগ যাওয়ার পথে পুরান এয়ারপোর্টের দেয়ালে ( বিমান বাহিনীর সংরক্ষিত এলাকা) প্রথম তিনি একটি গ্রাফিতি দেখতে পান। ওই গ্রাফিতিটিতে লেখা ছিল, ‘সুবোধ তুই পালিয়ে যা, তোর ভাগ্যে কিছু নেই।’ ওই ছবিটি অনেকদিন পর তিনি ফেসবুকে পোস্ট করলে অনেকেই ছবিটি নিজেদের অ্যাকাউন্ট থেকে শেয়ার করেন। এরপর আগ্রহী হয়ে তিনি আরো কিছু গ্রাফিতির ছবি সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করেন। এসব ছবি ফেসবুকেও পোস্ট করেন।
আগারগাঁও থেকে শ্যামলীর শিশুমেলায় যাওয়ার পথে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কাছে একটি গ্রাফিতির দেখা মেলে। সেখানে কথা হয় স্থানীয় নার্সারিতে কাজ করা নূর মহম্মদের সঙ্গে। ছবিগুলো কে আঁকছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কারা আঁকছে দেখি নাই। এগুলো পোলাপানে রাতের অন্ধকারে আইসা আইক্যা গেছে মনে হয়।’
ওই এলাকাতেই রিকশা চালান তরুণ পিপুল। তাঁর সঙ্গে কথা হয়। জানালেন, তিনি এই এলাকাতেই নিয়মিত রিকশা চালান। এমন আরো ছবি বিভিন্ন জায়গায় দেখেছেন।
এরপর পিপুল এই ছবিগুলো ( সুবোধের সিরিজ ছবি) কোথায় কোথায় দেখেছে জানালেন। পিপুল বলেন, ‘আমি দেখছি অনেক জায়গায়। কিন্তু কারা আকছে তা কইতে পারমু না। দেখি নাই। গোপনে আকছে মনে হয়।’
মূলত মিরপুর এলাকাতেই সুবোধের গ্রাফিতিগুলো দেখা গেছে। এসব ছবির কোনো কোনোটিতে দেখা গেছে, সুবোধ তুই পালিয়ে যা, মানুষ ভালোবাসতে ভুলে গেছে, কোনটিতে লেখা ‘সুবোধ তুই পালিয়ে যা তোর ভাগ্যে কিছু নেই’, সুবোধকে কারাগার বন্দি হিসেবে আকা ছবিতে লেখা ছিল, ‘সুবোধ এখন জেলে! পাপবোধ নিশ্চিন্তে করছে বাস মানুষের হৃদয়ে’ এমন নানা ধরনের লেখা দিয়ে সুবোধের ছবি আঁকা। আর ছবির নিচে লোগো আকারে দেখা গেছে- HOBEKI (হবেকি) লেখা।
এই লোগো সংবলিত একটি ছবি দেখা গেছে মিরপুর সাড়ে ১১তে পূরবী সিনেমা হলের কাছে। ওই গ্রাফিতিটিতে দেখা যায়, দুটি কাক কিছু নিয়ে উড়ে যাচ্ছে, নিচে কিছু হতদরিদ্র মানুষ হাত পেতে আছে। সেখানে লেখা ছিল- ‘ওদের জীবনে দাও কিছু সুখ।’
এ বিষয়ে সংবাদকর্মী আতিয়া ফেরদৌসি চৈতী বলেন, ‘সুবোধ সিরিজের গ্রাফিতি দেখে একদম প্রথমেই আমার মাথায় ব্যাংকসির কথা এসেছে। যদিও ব্যাংকসি এ রকম কোনো নির্দিষ্ট একটা চরিত্র নিয়ে কাজ করেনি, কিন্তু সুবোধের আর্টিস্টদের চিন্তার ধরন কেন জানি তার কথাই মনে করিয়ে দেয়। এই মুখ দেখানোর যুগে নিজেদের পরিচয় গোপন করে কাজ করে যাওয়াটা তো বিরল। সুবোধ সিরিজের পরবর্তী গ্রাফিতি দেখার অপেক্ষায় আছি।’
সুবোধ চরিত্রটি এবং তার আঁকিয়েরা একটি রহস্যময় আবহ তৈরি করেছে অনেকের কাছেই। সুবোধকে নিয়ে এই গ্রাফিতিকে মাথায় রেখে গান আর কবিতাও লেখা হচ্ছে।
সুবোধকে নিয়ে একটি কবিতা স্ট্যাটাস হিসেবে দিতে দেখা গেছে অনেককে। তবে নাম জানা যায়নি মূল লেখকের। কবিতার কয়েক লাইন এ রকম, ‘সুবোধ তুই পালিয়ে যা/ বড় নষ্টদের এই শহরটা/ এখানে জারুল ফুলের দিনে /কেউ তোর হাত ছুঁয়ে হাঁটবে না। ’
সুবোধের গ্রাফিতিগুলো খুঁজতে খুঁজতে সময় তখন প্রায় সন্ধ্যা। আইডিবি ভবনের পাশে দাঁড়িয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। সারাদিনে কেউ তথ্য দিতে পারেনি কারা এঁকেছে এই সুবোধের গল্পগুলো। কিংবা আঁকতে দেখেছে এমনও কাউকে পাওয়া যায়নি। এসব ভাবতে ভাবতেই তাকাই পশ্চিম আকাশে। টকটকে লাল সূর্যটাকে দেখে চট করে মনে পড়ে গেল আইডিবি ভবনের কাছে আঁকা সুবোধের গ্রাফিতিটির কথা। যেখানে খাঁচার ভেতর লাল সূর্য নিয়ে দৌড়ে যাচ্ছে সুবোধ।