আমি নেতা হবো
নেতার মূল্যায়ন ভক্তরাই করুক
যেকোনো সিনেমা মুক্তির আগে ইউটিউবে গান ছড়িয়ে দেওয়াটা বর্তমানে বেশ জনপ্রিয় রীতি। নিশ্চয়ই এই প্রক্রিয়ার পেছনে সিনেমার পরিচালক, প্রযোজক ও নেপথ্যের কারিগরদের ব্যবসায়িক কৌশলই মুখ্য ভূমিকা পালন করে। এ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে কেউ মুহূর্তেই লাভবান হচ্ছে, আবার কারো কারো ক্ষেত্রে হচ্ছে হিতে বিপরীত! বিশ্ব ভালোবাসা দিবস উপলক্ষে গত ১৬ ফেব্রুয়ারি দেশের সিনেমাপ্রেমীদের উদ্দেশে উত্তম আকাশ পরিচালিত ‘আমি নেতা হবো’ চলচ্চিত্রটি মুক্তি দেওয়া হয়। তবে এই সিনেমাটি মুক্তি আগেই ইন্টারনেট ব্যবহারকারী দর্শকরা কিঞ্চিৎ পরিমাণ হলেও জানতে পান। কারণ, শাকিব-মিম অভিনীত ‘আমি নেতা হবো’ সিনেমার একটি গান ইউটিউবে ভাইরাল হয়।
গানটি দেখে দর্শকদের মধ্যে নানা ধরনের আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়। তবে যে উদ্দেশ্যে গানটি ভাইরাল করা হয়, সে ক্ষেত্রে অনেকটাই সফল হন সিনেমাটির সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। ইউটিউবে গানটি ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হাজার হাজার দর্শক গানটি দেখেন এবং ‘আমি নেতা হবো’ সিনেমাটি দেখতে আগ্রহী হন। এ কারণেই সিনেমাটি মুক্তির শুরুর দিকে হলমুখী দর্শকদের ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো। তবে সপ্তাহ শেষে উত্তম আকাশের সিনেমাটি খুব সুবিধা করতে পারছে কি না, সেই বিচার দর্শকদের হাতে থাকল।
বাংলাদেশে বর্তমানে সবচেয়ে জনপ্রিয় চিত্রনায়ক শাকিব খান। শাকিবের অভিনয় পারদর্শিতার কারণে অনেক গুরুত্বও রয়েছে সিনেমাপাড়ার পরিচালক ও প্রযোজকদের কাছে তাঁর। এ জন্য দেশে শাকিব খানের নিজস্ব কিছু ভক্ত-দর্শক তৈরি হয়েছে। যাঁরা শুধু হলে গিয়ে শাকিবের সিনেমাই দেখেন। ‘আমি নেতা হবো’ সিনেমাটি দেখতে শাকিবের নিজস্ব দর্শক ছাড়াও অনেক নতুন দর্শক হলমুখী হয়েছেন। তার কারণ, এরই মধ্যে আলোচনা হয়েছে ইউটিউবে সিনেমার শাকিব-মিম জুটির আবেদনময়ী গান ভাইরালের বিষয়টি।
‘আমি নেতা হবো’ সিনেমার পাত্র-পাত্রী নির্বাচন দেখলে মনে হবে, নিশ্চয় বড় বাজেটের চলচ্চিত্র এটি। শাকিব-মিম ছাড়াও বাংলা চলচ্চিত্রের অনেক গুণী শিল্পীর উপস্থিতি ছিল উত্তম আকাশ পরিচালিত ‘আমি নেতা হবো’ সিনেমায়। এর মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য ওমর সানী, মৌসুমী, কাজী হায়াৎ, সুপ্তি শেখ, ডিজে সোহেল, সাদেক বাচ্চু, সেলিম খান, সিবা শানু, কাবিলা প্রমুখ।
চলচ্চিত্রে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের ভালো অভিনয় করার পেছনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে মানসম্মত পাণ্ডুলিপি। সিনেমার গল্প দুর্বল হলে বাঘা বা জাঁদরেল মানের অভিনেতাও দর্শক থেকে দূরে সরে যায়। তাই একটি ভালো চলচ্চিত্রের পূর্বশর্ত হলো একটি সুন্দর পাণ্ডুলিপি। ‘আমি নেতা হবে’ চলচ্চিত্রে পূর্বশর্তের ঘাটতি লক্ষ করা যায়। তবে যে খুব হতাশ হয়েছে দর্শক, তা-ও বলা যাবে না। সিনেমাটির গল্পটি দর্শকের কাছে খুব পরিচিত। সৎ আর অসৎ নেতার লড়াই। নির্বাচন জয়লাভ করে অসৎ নেতা, তবে হার মানার মানুষ নয় সৎ প্রার্থীর শুভাকাঙ্ক্ষীরা। এই দ্বন্দ্বের ওপর ভর করে প্রায় আড়াই ঘণ্টা দর্শকদের হলে বসিয়ে রাখা চাট্টিখানি কথা নয়! কারণ, এ ধরনের কাহিনীর সিনেমা হুবহু দর্শক না দেখলেও খুব কাছাকাছি গল্পের সিনেমা দেখতে অভ্যস্ত বাংলাভাষী সিনেমাপ্রেমীরা।
তবে ‘আমি নেতা হবো’ সিনেমার অভিনেতাদের প্রাণবন্ত অভিনয় দর্শদের কিছুটা হলেও বিনোদন দিতে পেরেছে। কারণ শাকিব খান এরই মধ্যে তাঁর অভিনয় দিয়ে দর্শকের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন। তবে সিনেমা গল্পের গাঁথুনি ও কাহিনীর দুর্বলতার কারণে কিছুটা মাইনাস নম্বর পেয়েছে বাংলাদেশের এই সুপারস্টার। বিদ্যা সিনহা মিমের উপস্থিতি পর্দায় খুব একটা ছিল না। এ জন্য তাঁর অভিনয় নিয়ে তেমনটি বলারও নেই। তবে ওমর সানী ও মৌসুমী তাঁদের নামের প্রতি কিছুটা হলেও সুবিচার করেছেন। তাঁরা পার্শ্ব-অভিনেতা হলেও পর্দায় তাঁদের উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো ছিল এবং ভালো অভিনয় করার চেষ্টা করেছেন তাঁরা। অসৎ নেতা বা খলচরিত্রে রূপদানকারী অভিনেতা সাদেক বাচ্চু প্রাণবন্ত অভিনয় করার চেষ্টা করেছেন, তবে পাণ্ডুলিপির ঘাটতি উতরে ওঠা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি। আর অন্য অভিনেতাদের কথা না বলাই ভালো।
‘আমি নেতা হবো’ সিনেমার গানের সুর ও কথা দর্শকরা আগ্রহভরে গ্রহণ করেছে। গানের দৃশ্যয়নের ক্ষেত্রে রোমান্টিকতা ও যৌন আবেদন ছিল। গানের দৃশ্যের লোকেশনগুলো ছিল নান্দনিক। এই ছবির গান লিখেছেন ভারতের জনপ্রিয় গীতিকার সুদীপ কুমার ও প্রিয় চট্টপাধ্যায়। গানের সুর ও সংগীত করেছে আহম্মেদ হুমায়ুন, আকাশ ও প্রীতম। গানে কণ্ঠ দিয়েছে বাংলাদেশ-ভারতের শান, মনালী ঠাকুর, আকাশ, দিনাত জাহান, জেমি ইয়াসমিন প্রমুখ যৌথ শিল্পী।
সিনেমার লোকেশন সিলেকশনে আরো মনোযোগ দেওয়া উচিত ছিল। পোশাক পরিকল্পনায় খুব বেশি অসংগতি লক্ষ করা যায়নি। তবে মেকআপ বা রূপসজ্জায় ঘাটতি ছিল ষোলোআনাই। সিনেমার গল্প, সময়, বয়স, আবহাওয়া সঙ্গে সাংঘর্ষিক ছিল মেকআপ পরিকল্পনা বা প্রয়োগের। তবে ক্যামেরা ও সম্পাদনা অনেক ক্ষেত্রে প্রশংসাই পাবে।
মুক্তির শুরুতে হলগুলোতে ‘আমি নেতা হবো’ দেখতে দর্শকের ভিড় চোখে পড়ার মতো ছিল। তবে সপ্তাহ শেষে হলমুখী দর্শকদের ভাটা ছিল বলতেই হবে। দর্শক হয়তো মুখ ফিরিয়ে নিত না, যদি গল্পের দুর্বলতা না থাকলে। সিনেমা মেকিং ভালো ছিল, এ ধরনের গল্প দিয়ে আড়াই ঘণ্টা দর্শকের মনোযোগ ধরে রাখা কঠিন পরীক্ষা বটে। তবে পরিচালক উত্তম আকাশ চেষ্টা করেছেন সাধ্যমতো। তিনি কতটা সফল, এই বিচার দর্শকের হাতেই ছেড়ে দিলাল। ‘আমি নেতা হবো’ সিনেমা নেতার মূল্যয়ন দর্শকই করুক।