গান কথা গল্প
আমি একজন কণ্ঠশ্রমিক : কনকচাঁপা
ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের বছর। ওই বছরের ১১ সেপ্টেম্বর ঢাকার হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে মা মোমেনা জাহানের গর্ভে জন্ম নিল এক কন্যাশিশু। সবাই তাকে আদর করে ডাকত কণা। এদিকে, বড় দুই বোন ও ছোট দুই ভাইয়ের মাঝখানে হওয়ায় সব আদরের মধ্যমণি হয়ে বেড়ে উঠতে লাগলেন কণা। যিনি বড় হয়ে বাংলা সংগীতের এক জীবন্ত কিংবদন্তি কণ্ঠশিল্পী হয়ে উঠলেন, তিনি আমাদের দেশের ‘সুরের মায়াবিনী’ কণ্ঠশিল্পী কনকচাঁপা। পুরো নাম রুমানা মোর্শেদ কনকচাঁপা। বাবা আজিজুল হক মোর্শেদের কাছেই প্রথম সংগীতের হাতেখড়ি। তার পর বাংলা সংগীতের মহারথী প্রয়াত সংগীতশিল্পী বশীর আহমেদ এবং স্বনামধন্য সুরকার (স্বামী) মইনুল ইসলাম খানের কাছে সংগীতে তালিম নিয়ে নিজেকে সমৃদ্ধ করেন এই সুরের পথিক। চলচ্চিত্র, আধুনিক গান, নজরুলসংগীত, লোকগীতিসহ প্রায় সব ধরনের গানে তিনি সমান পারদর্শী। এ পর্যন্ত তিনি চলচ্চিত্রের তিন হাজারের বেশি গানে কণ্ঠ দিয়েছেন। একজন গায়িকা নয়, বরং নিজেকে আপাদমস্তক ‘কণ্ঠশ্রমিক’ মনে করা এই গুণী শিল্পীর অনেক জনপ্রিয় বাংলা গানের স্মৃতিকথা প্রথমবারের মতো তুলে ধরা হলো শ্রোতা দরবারে। ফেরদৌসী রহমান, শাহনাজ রহমতুল্লাহ, রুনা লায়লা, সাবিনা ইয়াসমিন হয়ে যে সংগীতের ধারা বহমান, সে ধারায় নিজেকে যোগ্য শামিল করে বাংলা সংগীত, বিশেষ করে বাংলা চলচ্চিত্রের গানকে নিজ কণ্ঠে গড়ে তুলেছেন এই আমাদের ‘কণ্ঠশ্রমিক’ কনকচাঁপা।
যে প্রেম স্বর্গ থেকে এসে জীবনে অমর হয়ে রয়
এটি ‘প্রাণের চেয়ে প্রিয়’ চলচ্চিত্রের গান। আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল ভাইয়ের সংগীত পরিচালনায় আমি আর খালিদ হাসান মিলু ভাই গেয়েছিলাম। গানটির গীতিকার ও সুরকার ছিলেন বুলবুল ভাই। এ গান গাওয়ার দিন আমি শ্রুতি স্টুডিওতে ২০ জনের জন্য খাবার রান্না করে নিয়ে গিয়েছিলাম। কারণ, সেদিন বুলবুল ভাই আমার রান্না খেতে চেয়েছিলেন। মনে আছে, রেকর্ডিংয়ের সময় খালিদ হাসান মিলু ভাইয়ের স্বর্ণময় কণ্ঠে বারবার আপ্লুত হয়ে যাচ্ছিলাম। এ এক অদ্ভুত অনুভূতি। তার পর তো আজ সব ইতিহাস।
চোখের ভেতর স্বপ্ন থাকে, স্বপ্ন বাঁচায় জীবনটাকে
২০০৪ সালে ‘অপেক্ষায় থাকো’ অ্যালবামের গান এটি। গানটি লিখেছিল জুলফিকার রাসেল, সুর বাপ্পা মজুমদারের। সহশিল্পী হাসান আবিদুর রেজা জুয়েল। এই গান খুবই জনপ্রিয়তা পায়। যেকোনো অনুষ্ঠানে গানটি আমাকে প্রায়ই গাওয়ার জন্য অনুরোধ আসে। যদিও ‘চোখের ভেতর স্বপ্ন থাকে’ এই গান গাওয়ার দিন আমার গায়ে ১০৪ ডিগ্রি জ্বর ছিল। এত জ্বর ছিল যে গানটি গাইতে গিয়ে খুবই কষ্ট হচ্ছিল। এমনকি গানটি গাইতে গাইতে একপ্রকার ঘোর তৈরি হয়ে যাচ্ছিল। কোনটা মাইক্রোফোন আর কোনটা লিরিক স্ট্যান্ড, কোনোভাবেই বুঝতেই পারছিলাম না। মনে আছে, স্টুডিওতে কোনোমতে গানটি গেয়ে শেষ করে বাসায় এসে পড়ে গেলাম।
কিছু কিছু মানুষের জীবনে ভালোবাসা চাওয়াটাই ভুল
মোহাম্মদ রফিকুজ্জামান ভাইয়ের লেখা আর আলাউদ্দীন আলী ভাইয়ের সুরে এই গান গেয়ে আমি ধন্য। সিনেমার নাম ছিল ‘স্বপ্নের বাসর’। তো, গানটি গাওয়ার পর একদিন গাজীপুরে এক অনুষ্ঠানে গান করতে গেছি। হঠাৎ খবর পেলাম, গানের স্থায়ী অংশটুকু কী করে যেন মুছে গেছে! পরে কী আর করা! বিরাট কসরত করে অনুষ্ঠান বাদ দিয়ে একটানে গাজীপুর থেকে ঢাকা এসে বাকিটুকু গাইলাম! উফ... ভয়ংকর এক অভিজ্ঞতা।
কত মানুষ ভবের বাজারে
এই গানটির গীতিকার-সুরকার আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল ভাই। প্রযোজকের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বাজি ধরে আমাকে দিয়ে এই গান গাইয়েছিলেন। গাওয়ার সময় এই বাজি ধরার কথাটি আমাকে বলেছিলেন তিনি। বুলবুল ভাই বললেন, ‘ভাবি, মানসম্মান রাখবেন কিন্তু।’ আমি বোধ হয় তাঁর সম্মান রাখতে পেরেছিলাম। কারণ, এই গানের জন্য আমি প্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাই। পাশাপাশি গানটি তখন শ্রোতাপ্রিয়তা পেয়েছিল। সিনেমার নাম ছিল ‘লাভস্টোরি’।
তুমি আমার এমনই একজন, যারে একজনমে ভালোবেসে ভরবে নারে মন
১৯৯৭ সাল হবে। গানটি সালমান শাহ অভিনীত ‘আনন্দ অশ্রু’ সিনেমার। এই গানেরও গীতিকার ও সুরকার ছিলেন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল ভাই। মনে আছে, গানটি গাইতে গিয়ে খুবই আবেগাপ্লুত হয়ে গিয়েছিলাম। একপর্যায়ে আমার প্রচণ্ড কান্না চলে আসছিল। কিন্তু কাঁদলে গলা বসে, তাই কাঁদিনি; অনেক কষ্টে আটকে রেখেছিলাম। দ্বিতীয় অন্তরার পুরোটা টেক-এ কেঁদেছি, কিন্তু সেটাও ছিল অন্তর্গত কান্না, যা আমি ছাড়া আজ অবধি কেউ জানতে পারেনি। আজই বললাম।
একদিন তোমাকে না দেখলে বড় কষ্ট হয়
মজার বিষয় হলো, এই গান গাইতে আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল ভাইয়ের প্রচণ্ড বকা খেয়েছিলাম। সেদিন আমার গলা ওপরের দিকে যাচ্ছিল না। একটা কথা বলি, আমাদের বুলবুল ভাই হাসিমুখে একটাও খারাপ শব্দ ব্যবহার না করে কঠিন করে বকতে পারেন। বুলবুল ভাই মধুর ভাষায় বকে যাচ্ছিলেন আর আমি বেকুব হয়ে যাচ্ছিলাম। গানটি ‘কাজের মেয়ে’ সিনেমার গান। এই গানের গীতিকারও ছিলেন বুলবুল ভাই।
বাজারে যাচাই করে দেখিনি তো দাম, সোনা কিনিলাম নাকি রুপা কিনিলাম
গানটি ‘তোমাকে চাই’ ছবির। এই ছবি মূলত গানপ্রধান ছবি। আর সবকটি গানই গেয়েছিলাম আমি। এই সিনেমায় প্লেব্যাকটাই আমার জীবনের টার্নিং পয়েন্ট বলতে পারি। দারুণ ভালোলাগার একটা অনুভূতি ছিল সেদিন। এর পরে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি বলা উচিত; কিন্তু আমি রোজ দিন পেছনেই ফিরে তাকাই। আর দেখি কতদূর এলাম, কতদূর যাব। কত পথ বাকি। পথ যেন বেঁকে না যায়। ফেলে আসা পথ যেন ভুলে না যাই।
এলোমেলো চুল এ ললাটের ভাঁজ
এই গান আমার প্রথম গান। এই গানের মধ্য দিয়েই আমার সংগীতের প্রথম পদচারণ। তাই এই গানের প্রতি ভালোবাসা অসীম। এই গানের গীতিকার হলেন সেজান মাহমুদ। সুরকার আমার স্বামী ময়নুল ইসলাম খান। আজ থেকে প্রায় ৩১ বছর আগে গানটি আমি গেয়েছিলাম। যা কিছু প্রথম, সবকিছুই মানুষ ভুলতে পারে না। ঠিক সে রকমই এই গানের কথা আমি আজীবন ভুলতে পারব না।
আমার প্রেমের তাজমহল
আমি ‘প্রেমের তাজমহল’ সিনেমার এই গানের জন্য দ্বিতীয়বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছিলাম। সহশিল্পী ছিলেন মনির খান। তিনিও জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান এই গানের জন্য। আর এই ‘প্রেমের তাজমহল’ গাইতে গিয়ে মনির খানের কণ্ঠ শুনে বুঝতে পারি, নতুন কণ্ঠ পাকাপোক্ত হয়েই এলো...মাশাআল্লাহ। এই গানও আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল ভাইয়ের কথা ও সুর করা। পরে কবির বকুলের কথা এবং শওকত আলী ইমনের সুরে ‘এক টাকার বউ’ সিনেমার ‘ভালোবাসা থেকো তুমি দূরে’ গানটির জন্য তৃতীয়বারের মতো ‘জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার’ লাভ করি।
অনেক সাধনার পরে আমি পেলাম তোমার মন
এটি শাবনূর-রিয়াজ অভিনীত ‘ভালোবাসি তোমাকে’ সিনেমার গান। এই গানের বেশ মজার একটি ঘটনা আছে। আমি গানটির ব্রিজলাইনের একটা জায়গায় যখন ‘ভালোবাসি, ভালোবাসি, ভালোবাসি তোমাকে’ গাইছিলাম, তখন বুলবুল ভাই বকা দিয়ে বললেন, ‘কী ব্যাপার! প্রেম করেননি? মইনুল না... প্রেমাস্পদকে ভেবে এ লাইনটা গেয়ে দেন।’ আমি তো হেসেই মরি। পরে দেখি, খালিদ হাসান মিলুভাই ঠিকঠাকই গেয়ে দিলেন! বুলবুল ভাই তখন বললেন, ‘দেখছেন! মিলু আগেই অন্য কাউকে ভেবেছে,’...হাহাহাহাহা।
অনন্ত প্রেম, তুমি দাও আমাকে
‘লুটতরাজ’ ছবির গান। লিপে ছিলেন প্রয়াত নায়ক মান্না ও মৌসুমী। ‘অনন্ত প্রেম’ এই গানও বুলবুল ভাইয়ের লেখা ও সুর করা। সহশিল্পী ছিলেন আইয়ুব বাচ্চু। তো, আইয়ুব বাচ্চুকে নিয়ে কোনো চিন্তার সুযোগ ছিল না! তবে আমি পারব কি না, এটা নিয়ে আমার স্বামী ছিলেন চিন্তায় অস্থির! আমি বলি, ‘এত চিন্তা কিসের?’ কে শোনে কার কথা! ছবির গানের এক্সপ্রেশন নিয়ে আমার নিজের ক্ষমতা সম্বন্ধে আমার সম্যক ধারণা আছে পরিষ্কার। এটা অহংকার নয়, আত্মবিশ্বাস। পরে গানটি ব্যাপক জনপ্রিয় হয়।
যে দেশেতে শহীদ মিনার
গানটি রেকর্ডিংয়ের সময় কিছু বুঝিনি। এখন যতবার যতখানে যাই, আমি কাঁদতে থাকি। এই গানের সুর আমার শ্বাস-প্রশ্বাসের মতো। কথা যেন হৃদয়ের রক্তক্ষরণ। গানটি গেয়ে আমি ধন্য। কবির বকুলের অপূর্ব কথা এবং মইনুল ইসলাম খানের হৃদয়স্পর্শী সুরে করা গানটি যে দেশে যখনই যাই, দর্শক অশ্রুসজল চোখে দাঁড়িয়ে পড়েন। আমাকে নয়, গানটিকে সম্মান করতেই দাঁড়িয়ে পড়েন তাঁরা।
জেনে রাখা ভালো, আমি গায়িকা নই, আমি একজন কণ্ঠশ্রমিক। আমি কণ্ঠশ্রমিক কারণ, এটা আমার জীবিকা এবং কাজ, তা আমি একজন নিমগ্ন শ্রমিকের মতো করেই সম্পাদন করি। আমি যখন গান গাই, তখন সত্যি সত্যিই মাথার ঘাম পায়ে পড়ে। এ দেশের সব শ্রমিকের সঙ্গে একাত্মবোধ করেই আমি আমাকে একজন কণ্ঠশ্রমিক ভাবতে গর্ববোধ করি। আসলে আমি একজন মনেপ্রাণে শিল্পী, যে শুধু গান নয়, ঘুম থেকে জেগে উঠে এবং আবার ঘুমানোর মাঝখানের সময়টিকে পুরোটাই শিল্পিত করে তুলতে চায়। যেহেতু এটা আমার জীবিকা, তাই তৃণমূল মানুষকে গান শোনানোই আমার আসল উদ্দেশ্য। আমি একজন চিন্তাশীল মানুষ, একজন লেখক, একজন চিত্রকরও বটে। এ জন্য গানের বাকি সময় আমি ছবি আঁকি, কবিতা লিখি, প্রতিবাদ করি, বাগান করি, কৃষিকাজ করি। কোনো ভুল কাজ যেন না করি তার জন্য সাধনা করি। এবং স্রষ্টাকে স্মরণ করি, তাঁর কাছে নতিস্বীকার করি। তবে আমি একজন পরিপূর্ণভাবে কৃষক হতে চাই।