থ্যালাসেমিয়া কী?

থ্যালাসেমিয়া রক্তের একটি জটিল রোগ। এ রোগের বিষয়ে এনটিভির নিয়মিত আয়োজন স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২৯৮১তম পর্বে কথা বলেছেন ডা. এ বি এন ইউনুস।
বর্তমানে ডা. এ বি এন ইউনুস বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের হেমাটোলজি বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত।
প্রশ্ন : থ্যালাসেমিয়া রোগটি কী এবং কেন হয়?
উত্তর : থ্যালাসেমিয়া আসলে আমাদের দেশের জন্য একটি প্রচলিত সমস্যা। এটি স্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে খুব গুরুত্বের সঙ্গে দেখা উচিত। আমাদের দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১০ ভাগ এই থেলাসেমিয়ার জিন বহন করে। আপনি যদি ১৬ কোটি লোকের মধ্যে ধরেন, তাহলে এক কোটি ৬০ লাখ লোক এই রোগের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এর মধ্যে কিছু রোগীর নিয়মিত চিকিৎসার প্রয়োজন। আর কিছু রয়েছে যাদের হালকা চিকিৎসার প্রয়োজন। থ্যালাসেমিয়া হলো একটি বংশগত রক্তস্বল্পতাজনিত রোগ।
একটি শিশু তার অবয়ব কেমন হবে, তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য কেমন হবে, এগুলো নির্ভর করে তার বংশের যে জিন, তার ওপর। ঠিক অনুরূপভাবে তার রক্ত কেমন তৈরি হবে, সেটিও নির্ভর করে তার বাবা-মা বা বাবা-মায়ের রক্তের কম্পোজিশন কেমন ছিল, বিশেষ করে হিমোগ্লোবিন তৈরির ক্ষেত্রে জেনেটিক যে কম্পোজিশন সেখান থেকে। সেখান থেকে একজোড়া জিন নিয়ে, বাবার থেকে একটি, মায়ের থেকে একটি, দুটো জিন পেয়ে তার হিমোগ্লোবিন তৈরির প্রক্রিয়াটা সম্পন্ন হবে।
এখন কোনো বাবা অথবা মা তার রক্তে যদি থ্যালাসেমিয়ার জিন থাকে এবং সেখান থেকে বংশ পরম্পরায় এটি যদি সন্তানের মধ্যে সঞ্চারিত হয়, তাহলে কিন্তু ওই সন্তানেরও থেলাসেমিয়ার জিনের কারণে রক্তের হিমোগ্লোবিন তৈরির ক্ষেত্রে একটি বিপত্তি ঘটবে। যেমন বাবা মায়ের ছিল, ঠিক সেটি আসবে।
এখন তাহলে এই জিনটা কী করে? আমরা জানি, রক্তের লাল অংশ যেটুকু হিমোগ্লোবিনের কারণে রক্তের রং লাল, এই হিমোগ্লোবিনের মধ্যে দুটো অংশ থাকে, একটি হলো হিম আরেকটি হলো গ্লোবিন। এই গ্লোবিন তৈরির ক্ষেত্রে পলিপ্যাপটাইল পরিবর্তন থাকে। আলফা চেইন ও বিটা চেইন। দুটো আলফা চেইন ও দুটো বিটা চেইন। এই দুই জোড়া চেইনের সমন্বয়ে গঠিত হয় গ্লোবিন। তার সঙ্গে হিম মিলে হয় হিমোগ্লোবিন। যাদের থেলাসেমিয়া রয়েছে, তারা হয়তো আলফা চেইন অথবা বিটা চেইন, একেবারেই তৈরি করতে পারে না। অথবা কম তৈরি করে। এতে তার হিমোগ্লোবিনের ঘাটতি হয়ে যাচ্ছে। যেটুকু তৈরি হচ্ছে সেটি ত্রুটিপূর্ণ। ত্রুটিপূর্ণ হলো এই কারণে যে জিন দিয়ে যে গ্লোবিনের চেইনটা তৈরি হয়, সেই গ্লোবিন যদি কম পরিমাণের হয়, একটি চেইন যদি কম হয়, তাহলে সে প্রতিস্থাপন করার জন্য কাছাকাছি যারা রয়েছে তার সঙ্গে সমন্বয় করবে। সমন্বয় হয়ে যে হিমোগ্লোবিন তৈরি হয়, সেই হিমোগ্লোবিনের জীবন বেশি দিনের হয় না। এটি ১২০ দিন স্বাভাবিকভাবে থাকার কথা। তবে আগেই ভেঙ্গে যাচ্ছে। এই থেলাসেমিয়া আক্রান্ত রোগীদের লোহিত কণিকা ১২০ দিনের পরিবর্তে ৩০/ ৪০ দিন বা ৫০ দিনেই ভেঙ্গে যাচ্ছে। তাহলে একটি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। শিশু বয়সে বোনমেরু, যেখান থেকে হিমোগ্লোবিন তৈরি হয়, এর উৎপাদন ক্ষমতা কিছুটা বাড়তি থাকে। ছয় থেকে ১২ গুণ বেশি থাকে। এতে সে যদি কিছু হিমোগ্লোবিন কম তৈরি করেও, বোনমেরু কিন্তু তখন বেশি বেশি কাজ করে। আস্তে আস্তে যখন বয়স বাড়তে থাকে, যারা বিশেষ করে থেলাসেমিয়া মাইনর বা ক্যারিয়ার, তাদের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তৈরির ক্ষমতা কমতে থাকে। একটি সময়ে এসে কিন্তু তাদের রক্তস্বল্পতা হয়।
পক্ষান্তরে যারা থ্যালাসেমিয়া মেজর, বা ইন্টারমিডেয়েট, তাদের যে হিমোগ্লোবিনটা তৈরি হয় এটি আসলেই খুব কম এবং ত্রুটিপূর্ণ। ছোট বয়স থেকেই কিন্তু সে রক্তস্বল্পতায় ভোগে। এসব রোগীর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তারা যেহেতু তাদের শরীরে নির্দিষ্ট পরিমাণ রক্ত তৈরি করতে পারে না, তাই অন্যের রক্ত ট্রান্সফিউশন নিয়ে তাদের জীবন চালাতে হয়।