দীর্ঘমেয়াদি ব্যথার চিকিৎসায় করণীয়
আমাদের মধ্যে অনেকেই দীর্ঘদিন ধরে শরীরের বিভিন্ন অংশের ব্যথা-বেদনায় ভুগে থাকেন। এগুলোর মধ্যে রয়েছে ঘাড় ব্যথা, কোমর ব্যথা, হাঁটু ব্যথা, সোল্ডার জয়েন্ট এ ব্যথা।
দীর্ঘমেয়াদি এই ব্যথার বিভিন্ন কারণ রয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম কারণ ডিজেনারেটিভ ডিজিস বা বয়সজনিত হাড় ক্ষয়ের কারণে ব্যথা। যেমন—সারভাইক্যাল স্পনন্ডাইলোসিস, লাম্বার স্পনডাইলোসিস, অস্টিওআর্থ্রাইটিস ইত্যাদি। এ ছাড়া আরো কিছু কারণ রয়েছে। যেমন—রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস, অ্যানকাইলোজিং স্পনডাইলাইটিস বা স্পনডাইলো আর্থ্রোপ্যাথি ইত্যাদি ।
স্পনডাইলোসিস
এটি মেরুদণ্ডের কশেরুকাগুলোর ক্ষয়জনিত রোগ। এখানে কশেরুকাগুলোর ক্ষয় হয়, পাশাপাশি কিছু ছোট নতুন হাড়ের বৃদ্ধি হয়। একে মেডিকেলের পরিভাষায় অস্টিওফাইট বলা হয়। স্পনডাইলোসিসে দুই কশেরুকার মধ্যবর্তী স্পেস বা গ্যাপ কমে যায়। এতে নার্ভ রুটের ওপর চাপ পড়ে এবং রোগী নার্ভের ডিস্ট্রিবিউশন অনুযায়ী ব্যথা অনুভব করে। যখন এটি মেরুদণ্ডের ঘাড়ের অংশে হয়, তাকে মেডিকেল ভাষায় সারভাইক্যাল স্পনডাইলোসিস বলে। আর যখন মেরুদণ্ডের কোমরের অংশে হয়, তখন একে লাম্বার স্পনাডাইলোসিস বলা হয়।
অস্টিওআর্থ্রাইটিস
এটিও একটি ডিজেনারেটিভ ডিজিস বা বয়সজনিত জয়েন্টের অভ্যন্তরীণ গঠনের ক্ষয় রোগ। এই রোগে জয়েন্টের ভেতরে অবস্থানরত কার্টিলেজগুলোও জয়েন্ট সারফেজের ক্ষয় হতে থাকে। জয়েন্টের অভ্যন্তরীণ সাইনোভিয়াল ফ্লুইডগুলোও কমে যায়। এতে জয়েন্টের ভেতরের স্পেস কমে যায়। তখন আক্রান্ত রোগীর জয়েন্ট নাড়াতে কষ্ট হয়। হাঁটুতে অস্টিওআর্থ্রাইটিস হলে রোগী নিচে বসতে পারে না, নামাজের মতো বসতে পারে না, টয়লেটে বসতে কষ্ট হয়, সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করতে পারে না—এসব সমস্যা দেখা দেয়।
রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস
এটি একটি অটো-ইম্যুন ডিজিস। এটি মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার নিয়ন্ত্রের বাইরে। এই রোগে আমাদের হাত ও পায়ের ছোট ছোট জয়েন্ট আক্রান্ত হয়ে থাকে, জয়েন্টে ব্যথা করে। এতে বিশেষ করে সকালে ঘুম থেকে ওঠার সময় রোগীর ব্যথা অনেক বেড়ে যায়। কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করলে কিছুটা কমে আসে।
অ্যানকাইলোজিং স্পনডাইলাইটিস
এটিও একটি মেরুদণ্ডের বাত রোগ। এটি প্রথমে মেরুদণ্ডের নিচের অংশে আক্রমণ করে। পরে ধীরে ধীরে মেরুদণ্ডের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে। এই রোগটির সবচেয়ে খারাপ দিক হলো এটি মেরুদণ্ডের স্বাভাবিক আকৃতি নষ্ট করে মেরুদণ্ডকে শক্ত করে ফেলে। এতে আক্রান্ত ব্যক্তিটি ঘাড় ও কোমরের অংশ ঘোরাতে পারে না, সামনের দিকে ঝুঁকতে পারে না—এসব সমস্যা দেখা দেয়।
রোগ নির্ণয়
উপরোক্ত রোগগুলোর ক্ষেত্রে রোগ নির্ণয়ের জন্য রোগীর উপসর্গ, চিকিৎসকের ক্লিনিক্যাল এক্সামিনেশনের পাশাপাশি কিছু কিছু প্যাথলজিক্যাল ও রেডিওলজিক্যাল টেস্ট করানোর প্রয়োজন পড়ে। যেমন—স্পনডাইলোসিস ও অস্টিওআর্থ্রাইটিসের ক্ষেত্রে আক্রান্ত স্থানের এক্স-রে করতে হয় এরং রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস ও অ্যানকাইলোজিং স্পনডাইলাইটিসের ক্ষেত্রে এক্স-রের পাশাপাশি কিছু বিশেষ পরীক্ষা করতে হয়। যেমন—আর এ টেস্ট, সিআরপি, অ্যান্টিসিসিপি, এইচএলএবি ২৭ ইত্যাদি।
চিকিৎসা
উপরোক্ত ডিজিস বা রোগগুলো দীর্ঘমেয়াদি রোগ। যেমন : স্পডাইলোসিস বা অস্টিওআর্থ্রাইটিস হলো বয়সজনিত হাড়ের ক্ষয় রোগ। অতএব, এটাকে সম্পূর্ণ নিরাময় করা সম্ভব নয়। তবে চিকিৎসার মাধ্যমে রোগীর কষ্ট কমানো সম্ভব। পাশাপাশি কিছু নিয়ম মেনে চললে ও চিকিৎসকের নির্দেশিত কিছু ব্যায়াম করলে রোগী ভালো থাকবেন। তেমনিভাবে রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস ও অ্যানকাইলোজিং স্পনডাইলাইটিস রোগে দুটিও একেবারে নিরাময়যোগ্য রোগ নয়। এ ক্ষোত্রেও রোগীকে কিছু ওষুধ সেবনের পাশাপাশি ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা ও নির্দিষ্ট কিছু থেরাপউটিক এক্সারসাইজ করতে হবে।
এই রোগগুলো যেহেতু দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসার প্রয়োজন পড়ে, তাই এর চিকিৎসার ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন ব্যথানাশক ওষুধ সেবন করা যাবে না। কারণ, দীর্ঘদিন ব্যথানাশক ওষুধ সেবনের কারণে বিভিন্ন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। তাই এ ধরনের রোগীদের চিকিৎসায় ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা খুবই উপকারী এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীন একটি চিকিৎসা পদ্ধতি। তবে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা নেওয়ার ক্ষেত্রে অবশ্যই একজন বিশেষক্ত ফিজিওথেরাপি চিকিৎসকের তত্ত্বাবধায়নে চিকিৎসা নিতে হবে।
লেখক : বাত, ব্যথা ও প্যারালাইসিস রোগে ফিজিওথেরাপি বিশেষজ্ঞ, কনসালট্যান্ট ও বিভাগীয় প্রধান, প্রো-অ্যাকটিভ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, চিফ কনসলট্যান্ট, ঢাকা সিটি ফিজিওথেরাপি হাসপাতাল ধানমণ্ডি, ঢাকা।