কোমর ব্যথার কারণ কী?
![](https://ntvbd.com/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2018/03/17/photo-1521284815.jpg)
কোমর ব্যথা প্রচলিত একটি সমস্যা। জীবনের কোনো না কোনো সময় কোমর ব্যথায় ভোগেননি, এমন মানুষ পাওয়া মুশকিল।
কোমর ব্যথা কেন হয়, এ বিষয়ে এনটিভির নিয়মিত আয়োজন স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ৩০৩০তম পর্বে কথা বলেছেন ডা. মো. ইউসুফ আলী। বর্তমানে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থোপেডিক বিভাগে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত।
প্রশ্ন : কী কী কারণে কোমর ব্যথা হয়?
উত্তর : আসলে অর্থোপেডিক্স যেসব সমস্যা রয়েছে, এর ভেতরে যদি ভোগান্তির দিক থেকে তুলনা করি, তাহলে উচ্চ মান দিতে হবে কোমর ব্যথাকে। কোমর ব্যথায় ভোগে না এমন কোনো লোক খুঁজে পাওয়া যাবে না। বলা হয়েছে, জীবদ্দশায় সবাই কোনো না কোনো সময় কোমর ব্যথায় ভুগে থাকেন। সেটা হতে পারে মাইল্ড (কম), মডারেট (মধ্যম) বা সিভিয়ার (বেশি)। এমনকি কোমর ব্যথার এমন কিছু কারণ রয়েছে, যার জন্য মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
এগুলোকে ভাগ করলে কিছু জিনিস রয়েছে কনজেনিটাল। বাংলাতে বললে জন্মগত। আর কিছু হলো অ্যাকুয়ার্ড। পরে বিভিন্ন কাজ বা সেডেন্টারি কোনো কারণে হয়। প্রভাবকে বাড়িয়ে দেয় এ বিষয়গুলো।
কোমরের যে হাড় সেখানে পাঁচটা লাম্বার ভার্টিব্রা থাকে। কারো কারো চারটা থাকে, কারো কারো ছয়টা থাকে। এই জিনিসগুলো জন্মগতভাবে হয়ে থাকে। যখন লাম্বার ভার্টিব্রা সেক্রামের সঙ্গে, নিচের হাড়ের সঙ্গে মিলে যায়, তখন আমরা একে বলি সেকরালাইজেশন।
মেরুদণ্ডকে নড়াচড়া করানোর জন্য ডিস্কগুলো খুব কার্যকর। এই ডিস্ক যখন একটা কমে গেল, তখন তার নড়াচড়া কমে গেল। তখন দেখা যায় অন্য যে চারটি ডিস্ক রয়েছে সেগুলোর ওপর প্রেশার পড়ে যায়। আবার যদি ছয়টা হয়, তাহলে দেখা যায় সেকরামের দিকে একটি ভার্টিব্রা কমে গেল। আরো কিছু জন্মগত সমস্যা রয়েছে, স্পাইনের পেছনে যেই আর্টস থাকে, এখানে জন্মগত ত্রুটি থাকে। আমরা একে বলি স্পাইনা বাই ফিডা। এসব সমস্যা যাদের থাকে, তাদের জন্মগতভাবে কোমরব্যথা থাকে।
প্রশ্ন : এটা কি জন্মের পর পরই শুরু হয়?
উত্তর : জন্মের পর পরই শুরু হয় না। পরবর্তীকালে হয়। তবে একজন সুস্থ লোক, আর জন্মগতভাবে যার একটু সমস্যা রয়েছে, তার আগে শুরু হবে। আর যারা সুস্থ তাদের অন্যান্য কারণে পরে সমস্যা হতে পারে।
আরো কিছু জন্মগত সমস্যা না বললেই নয়, আমাদের দেশের মানুষ সঠিক চিকিৎসার অভাবে কবিরাজের কাছে বা বিভিন্ন জায়গায় যায়। আপনি দেখবেন কিছু কিছু বাচ্চা রয়েছে যারা বাঁকা হয়ে যায়। এই বাঁকাটাও কিন্তু একটি জন্মগত সমস্যা। এই ভার্টিব্রাগুলো যদি একটির সঙ্গে আরেকটি লাগানো থাকে, একপাশে লাগানো রয়েছে, আরেক পাশে খোলা রয়েছে, মেরুদণ্ডটা বড় হয়, তখন হয় কি, বৃদ্ধি হয়, একদিকে ক্ষয় হচ্ছে, আরেকদিকে বাড়ছে- এভাবে মেরুদণ্ড বেঁকে যায়। মেরুদণ্ড যখন বাঁকা থাকে আমাদের ওজন ট্রান্সমিশন যে লাইন থাকে, শরীরের ওজন যেভাবে গ্রেভিটির জন্য মাটিতে যায়, সেটা পরিবর্তন হয়ে যায়। এটি হলে যে জায়গায় বেন্ডিং থাকে, সেখানে চাপ বেশি পড়ে। বেশি করলে ডিস্ক, ভার্টিব্রা প্রত্যেকটা জায়গায় পরিবর্তন আসে। এই পরিবর্তনের কারণে তখন সেখানে ব্যথা শুরু হয়। এই পরিবর্তনের কারণে তখন সেখানে ডিস্ক প্রোলাপস হতে পারে। এই পরিবর্তনের কারণে সম্পূর্ণ একটি হাড় সরে গিয়ে মেরুদণ্ডের পেছনে ক্যানেল দিয়ে মস্তিষ্ক থেকে কর্ড যায়। এই কর্ড চালিকা শক্তি। মেরুদণ্ডের যেকোনো জায়গায় যদি এটি বাধাপ্রাপ্ত হয়, তার নিচে প্যারালাইসিস হয়। এসব সমস্যার জন্য ব্যথা থেকে শুরু করে প্যারালাইসিস পর্যন্ত হতে পারে। প্যারালাইসিসের পরে আরো জটিলতা হয়। মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
আর যেগুলো প্রচলিত কারণ, অ্যাকোয়ার্ড যেগুলো সেগুলো হলো, ম্যাকানিক্যাল পেইন। প্রায় ৮০ ভাগ লোক এই রোগে ভুগে থাকে। যেমন আপনি বসে আমার সঙ্গে কথা বলছেন, কাত হয়ে বসে থাকছেন অনেকক্ষণ ধরে। এই আরামই ব্যারাম তৈরি করে। আপনি মনে করেন কম্পিউটারে কাজ করছেন বা ফেসবুক দেখছেন, একই অঙ্গবিন্যাসে থাকলে পেশি অবসন্ন হয়ে যায়। অবসন্ন হয়ে গেলে ব্যথা শুরু হয়। আমাদের সমাজের বেশিরভাগ লোক এসব সমস্যায় ভোগে।
ইদানীং কিছু স্কুল বা কলেজগামী ছেলেমেয়েরা আমাদের চেম্বারে আসে। তারা বলে স্যার আমি তো কোমর ব্যথায় ভুগছি। তখন আমি বলি তুমি কি চেয়ার টেবিলে পড়। না অন্য কোথাও পড়। তখন তারা জানায়, বিছানায় হেলান দিয়ে অথবা দেয়ালের সঙ্গে হেলান দিয়ে আরাম করে বুকের নিচে বালিশ নিয়ে পড়ে। অঙ্গবিন্যাস যে পরিবর্তন হয়, এর কারণে পেশি অবসন্ন হয়ে যায়। এরপর বিশেষ করে নিচু হয়ে ঘর মোছা বা কাপড় কাঁচা- এসব বিষয়গুলো বিজ্ঞানভিত্তিকভাবে যদি না করা হয়, তাহলে ব্যথা হয়।
আরো প্রচলিত যেটি, সেটি হলো, আমাদের দেশের তরুণ প্রজন্ম, যারা হোন্ডা চালায়, বাইক চালানোর সময় যখন বাঁকা হয়ে বসে, ধনুকের মতো, এই অবস্থায় যখন লং ড্রাইভ করতে থাকে, তখন তার মেরুদণ্ডের ডরসাল এবং লাম্বার যেই বান্ডেল, যেখানে বেশি বাঁকা হয়, সেই জায়গায় চাপ পড়ে। পেশিগুলো অবসন্ন হয়ে সেখানে ব্যথা হয়। এস কারণ প্রতিরোধযোগ্য। আমরা যদি একটু সচেতন হই, তাহলে এই সমস্যা থেকে রেহাই পেতে পারি।
এ ছাড়া আরো কিছু কারণ রয়েছে যেগুলো রোগ সম্পর্কিত একোয়ার্ড। যেমন আঘাত জনিত কারণে হতে পারে। কোনো রোগের কারণে হতে পারে। আমরা সাধারণত টিবি বলতে বুঝি ফুসফুসের যক্ষ্মা। এ ছাড়া মেরুদণ্ডে টিবি হয়। মেরুদণ্ডে টিবি হলে প্রথমেই শুরু হয় ব্যথা দিয়ে, এরপর টিবির যেসব লক্ষণ সেগুলো থাকতে পারে। সঙ্গে জ্বর থাকতে পারে, ওজন কমে যেতে পারে। ক্ষুধামান্দ্য হতে পারে।
এরপর আরেকটি কারণ হলো ডিস্ক প্রোলাপস। মেরুদণ্ডের তরুনাস্থি, এটা মোবাইল সেগমেন্ট। এটি যখন কাজ না করবে, যখন অবসন্ন হয়ে যাবে, তখনই ব্যথা শুরু হয়। সাধারণত আমাদের বয়সের সঙ্গে সঙ্গে ডিস্কের যে কোমপোনেন্ট থাকে, সেখানে অনেক উপাদান থাকে, হলো প্রধান ৬০-৮০ শতাংশ। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে কাজের জন্য দেখা যায়, পানিটা আস্তে আস্তে শুকিয়ে যায়। যখন এটি শুকিয়ে যায়, তখন আমরা একে বলি ডিস্ক ডেসিকেশন।
গরমকালে গ্রামে কী হয়? মাটি ফেটে চৌচির হয়ে যায়। দেখা যায় মাটি ফেটে যায়। ঠিক এখানে যখন পানিশূন্যতা দেখা যায় ডিস্ক ফেটে চৌচির হয়ে যায়। ফেটে গেলে সেখানে দুর্বল পয়েন্ট তৈরি হয়। আর আমরা যখন ব্যান্ড হয়ে কাজ করতে যাই, দুর্বল পয়েন্টের ভেতরে যে তরুনাস্থির মজ্জাটা থাকে, সেটা বের হয়ে আসে। বের হয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে পেছনে থাকছে নার্ভ। নার্ভের ওপর যখন চাপ দেয়, তখন দেখা যায় ব্যথা পায়ের দিকে যেতে থাকে। হাঁটতে পারে না। রোগীরা এসে বলে, ‘ স্যার আমার তো পাঁচ মিনিট হাঁটার পর ব্যথা শুরু হয়। বসলে আরাম পাই বা শুয়ে থাকলে আরাম পাই। দাঁড়াতে পারি না।’ এসব জটিলতার জন্য কোমরের ব্যথা হতে পারে।