প্রসূতি মায়ের ব্যথা ও নিরাময়
সন্তান জন্মদানের সময় প্রসূতি মায়ের তীব্র ব্যথা-বেদনা হওয়ার বিষয়টির সঙ্গে আমরা অপরিচিত নই। তবে এই ব্যথা নিরাময় করণীয় কী, এই বিষয়ে এনটিভির নিয়মিত আয়োজন স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ৩০৪৭তম পর্বে কথা বলেছেন ডা. সিনহা আবুল মনসুর।
বর্তমানে তিনি নিউইয়র্কের নাসাউ ইউনিভার্সিটি মেডিকেল সেন্টারে ফ্যাকাল্টি হিসেবে কর্মরত।
প্রশ্ন : প্রসূতি মায়ের ব্যথা-বেদনা নিরাময় সম্পর্কে পরামর্শ কী?
উত্তর : প্রসূতি মায়ের ব্যথা-বেদনাকে যদি আমি মেডিকেল সাইন্সে ব্যাখ্যা করতে চাই, ব্যথা বেদনার একটি স্কেল রয়েছে। আমরা বলি আউট অব টেন। ১০ হচ্ছে সর্বোচ্চ। শূন্য হচ্ছে নিম্নতম। গর্ভাবস্থায় যে ব্যথা- বেদনা হয়, এটা কতটা হতে পারে। এটা হলো দশে দশ। তীব্র ব্যথা। আমরা যখন একজন স্বাভাবিক রোগীকে দেখি, স্বাভাবিক রোগী আর গর্ভাবস্থার রোগীর যে ব্যথাটি হয়, দুটো দুই ধরনের ব্যথা হতে পারে। দুই ধরনের ব্যথাতে কিন্তু আপনি এক ধরনের ব্যথানাশক ওষুধ দিয়ে ঠিক করতে পারবেন না। কেন পারবেন না, এর কারণ রয়েছে। প্রসূতি মায়ের ব্যথা বেদনার বিষয়টি আলাদা। এটা প্রধান কারণ। দ্বিতীয় কারণ হলো, উনি তো গর্ভবতী। তাকে আপনি যে ওষুধটাই দেবেন, এই ওষুধটি প্লাসেন্টা পেরিয়ে গিয়ে বাচ্চার শরীরে চলে যাবে। বাচ্চার শরীরে গেলে সমস্যা কী? সমস্যা হলো ওই বাচ্চার ওপরে এর একটি প্রভাব পড়বে। এখন মাকে আপনি যে ডোজটা দিচ্ছেন, এটা মায়ের জন্য হয়তো এমন কিছু নয়। মায়ের যে ওজন, বয়স সে তুলনায় কিছু নয়। তবে এসব ওষুধের জন্য বাচ্চা তো খুব ছোট, ওই ওষুধের একটু পরিমাণ যদি যায়, সে হয়তো একে সহজভাবে নিতে পারবে না। ওর শরীরের যে বিপাক ক্ষমতা বা ওষুধকে আত্মীকরণের যে প্রক্রিয়া, সেটি কিন্তু পরিপূর্ণভাবে তৈরি হয়নি। অনেক জিনিস সে সহজভাবে নিতে পারবে না। ওটা একটা সমস্যা। এই জন্য আমরা যেকোনো ধরনের ওষুধ বাচ্চার মাকে দিতে পারি না। সেখানে একটা সীমাবদ্ধতা রয়েছে।
প্রশ্ন : কী কী ধরনের ওষুধ সেখানে ব্যবহৃত হয়?
উত্তর : ব্যথা নিরাময়ের জন্য আমাদের কিছু ব্যবস্থা রয়েছে। খুব লো ডোজের কিছু ওষুধ রয়েছে, সেটা মাকে দেয়া যেতে পারে। যেখান থেকে ব্যথাটা শুরু হয়েছে, যেমন মেরুদণ্ডে আমাদের যে স্পাইনাল কর্ড রয়েছে, এখান থেকে আমাদের স্নায়ুগুলো বের হয়ে আসছে, যা ব্যথাকে নিয়ন্ত্রণ করছে, আমরা যদি সেই স্নায়ুগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি, ওষুধ দিয়ে, তখন আমরা ব্যথা কমিয়ে নিয়ে আসতে পারি। এ ধরনের একটি কনট্রলিং মেকানিজম হলো এপিডুয়াল এনেসথেসিয়া। এটা উন্নত বিশ্বে খুব ভালোভাবে প্র্যাকটিস করা হচ্ছে। গর্ভবতী যখন আসবেন, তখন আমরা তাকে এপিডুয়াল এনেসথেসিয়া দিয়ে দেই। দিয়ে দিলে দুটো বিষয় ঘটে। একটি হলো ব্যথার বিষয়টা কমে যায়, বাচ্চার মা খুব শিথিল থাকে। এর মধ্যে ব্যথাটা আস্তে আস্তে বাড়বে, বাচ্চা হওয়ার প্রক্রিয়াটা শুরু হয়ে যাবে। কিন্তু ব্যথা বেদনা অতটা অনুভূত হবে না।
প্রসবের পুরো প্রক্রিয়াটা তিন/ চার ঘণ্টা থেকে শুরু করে, এটা অনেক সময় একদিনও লেগে যায়। একদিন যদি লেগে যায়, এটি দীর্ঘ একটি সময়। এই সময় এই ব্যথা অনেক সময় অসহনীয় অবস্থায় চলে যায়। আমরা ছোট একটি ক্যাথেডার পরিয়ে দেই। এই ক্যাথেডার চলে যায় একটি ব্যাগে। ওই ব্যাগ থেকে ওষুধটি খুব ধীর ডোজে শিশুর শরীরে যায়।
ওই ওষুধের ক্ষেত্রে খুব হালকা ডোজ দিই, হালকা ডোজের লোকাল এনেসথেটিক দিই। ব্যথা বেদনার যে বিষয়গুলো রয়েছে আমাদের মেরুদণ্ডে সেগুলো অবশ হয়ে যাবে। তখন সে ব্যথা অনুভব করতে পারবে না। কিন্তু এর বিষয়টি এত কম, যে সেটা বাচ্চাকে প্রভাবিত করবে না। সেটি হলো আমাদের প্রধান লক্ষ। আমরা যে ব্যথার ওষুধ দিচ্ছি , সেটি বাচ্চাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে না। কোনো কারণে যদি বাচ্চার মায়ের সিজারিয়ান সেকশনে যেতে হয়, আমরা সেই অ্যানেসথেসিয়াটা ব্যবহার করব।
প্রশ্ন : এপিডুয়াল এনেসথেসিয়ার উপকারিতা কতখানি?
উত্তর : আমরা যেটা দেখেছি যুত্তরাষ্ট্রে ৫০ ভাগেরও বেশি রোগী, এই অপশনটা নেয়। এতে ব্যথা বেদনার বিষয়টা থাকে না। বাচ্চার সঙ্গে যে সংযোগের বিষয় সেটি সহজ হয়। শুধু শুধু তো অসহ্যকর ব্যথার মধ্য দিয়ে যাওয়ার কোনো মানে হয় না। আমরা হয়তো গত শতকে এগুলোর মধ্য দিয়ে গিয়েছি। গত শতকে অনেক কিছু হয়েছে, তবে এই শতকে তো ওষুধের উন্নতি হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রে গর্ভবতী মায়েরা যখন গাইনোকলোজিস্টের কাছে যাচ্ছেন, তখন যদি গর্ভাবস্থার সময় বাড়ে, হয়তো দেখা গেল সাত মাস হয়ে গেছে, নয় মাস হয়ে গেছে, একটি সময় গাইনোকোলজিস্ট তার সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করে। ব্যথা ব্যবস্থাপনার যে অপশনটা রয়েছে, সেটি তার সঙ্গে বলে। তার সঙ্গেও আলাপ করতে পারে। সোজা কথা তাকে সচেতন করা। চূড়ান্ত সীদ্ধান্ত মা নেবে।
প্রশ্ন : বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে আপনার কী পরামর্শ থাকবে?
উত্তর : বাংলাদেশে যে বিষয়টি হচ্ছে, মেডিসিন তো আগাচ্ছে। বিভিন্ন হাসপাতালে আমি যাই, আমার বন্ধুদের সঙ্গে আলাপ হয়। অন্যান্য সেক্টরে কিন্তু ভালো কাজ হচ্ছে। এখানে এখন হার্টের অস্ত্রোপচার ভালো হচ্ছে। নিউরোসার্জারি হচ্ছে, কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট হচ্ছে। এগুলো ভালো, সফলভাবে হচ্ছে। কিছু কিছু সেন্টারে তো খুব ভালো কাজ হচ্ছে। আমি মনে করি, এদের এসব সেন্টারে এপিডুয়াল অপশন থাকা উচিত। এটা সময়ের দাবি। আমি মনে করি এটি একটি অপশন। যারা পছন্দ করছে নেবে, যারা পছন্দ করে না, নেবে না।