রান্নার জন্য বেছে নেবেন কোন তেল?
ভেজাল তেলের বাজারে স্বাস্থ্যকর ভোজ্য তেল খোঁজা এক বিরাট ঝক্কির ব্যাপার। তার পর যদি থাকে তেল কোম্পানির বিজ্ঞাপন আর সুপার মার্কেটের পসরা, তাহলে তো কথাই নেই। ক্রেতারা গিয়ে ঠেকেন ‘দশ চক্রে ভগবান ভূত’ দশায়। তবুও জীবনের তাগিদে অপেক্ষাকৃত কম ক্ষতিকর তেলটিই কিনতে চান স্বাস্থ্যসচেতন ক্রেতারা। বিভ্রান্তি থেকে উদ্ধারে এবার একদল ব্রিটিশ গবেষককে সাথে নিয়ে এগিয়ে এসেছে বিবিসি।
লেস্টারের ডে মন্টফোর্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের গবেষকদের সহায়তায় বিবিসির ‘ট্রাস্ট মি, আই অ্যাম আ ডক্টর’ শিরোনামের অনুষ্ঠানটির পরিচালিত গবেষণাটির মূল লক্ষ্য ছিল কয়েকটি ভোজ্য তেলের উপাদানগুলোর তুলনামূলক বিচার করা।
ভোজ্য হিসেবে তেল বা চর্বিই ব্যবহৃত হয়ে থাকে। অনেকেই ভাবেন, উদ্ভিজ্জ তেলের রান্না বেশ স্বাস্থ্যকর। অথচ চর্বি অথবা মাখন দিয়ে রান্না করা খাবার স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। আসলেই কী তাই?
উত্তর জানতে গবেষণা দল লেস্টার শহরবাসীর বিভিন্ন ধরনের চর্বি এবং তেল সরবরাহ করেন। গবেষণায় স্বেচ্ছা অংশগ্রহণকারীদের সেসব ভোজ্য তেল বা চর্বি রোজকার রান্নায় ব্যবহারের অনুরোধ করা হয়। রান্নার পর বেঁচে যাওয়া পোড়া তেল রেখে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করা হয় অংশগ্রহণকারীদের। সেগুলো পরে পরীক্ষা করে দেখা হয়।
খাবার তেল ও চর্বি মূলত একই ধরনের পদার্থ। স্বাভাবিক তাপমাত্রায় যা তরল থাকে, তাকে বলা হয় তেল, আর যা অর্ধ জমাট বা জমাট থাকে, তাকে বলা হয় চর্বি। এসব তেল বা চর্বি সম্পৃক্ত [স্যাচুরেটেড], একক-অসম্পৃক্ত [মনোআনস্যাচুরেটেড] এবং বহু-সম্পৃক্ত [পলিআনস্যাচুরেটেড] ফ্যাটি অ্যাসিডের যৌগ। তবে প্রাণিজ তেলে কোলেস্টেরল থাকলেও উদ্ভিজ্জ তেলে থাকে না। থাকলেও খুবই কম পরিমাণ। এ কারণে অনেকে মনে করেন, উদ্ভিজ্জ ভোজ্য তেল স্বাস্থ্যের জন্য ভালো, কিন্তু প্রাণিজ তেল ক্ষতিকর। এ ধারণা নিয়ে কাজ করেছেন বিবিসির ‘ট্রাস্ট মি, আই অ্যাম এ ডক্টর’ অনুষ্ঠানের গবেষকরা।
গবেষকরা ভোক্তাদের সূর্যমুখী তেল, উদ্ভিজ্জ তেল, ভুট্টার তেল, ক্যানোলা তেল [এক ধরনের সরিষা জাতীয় তেল], জলপাই তেল (পরিশুদ্ধ ও পুরোপুরি রাসায়নিক মুক্ত), মাখন, হাঁসের চর্বি ইত্যাদি সরবরাহ করেছেন। রান্নার পর সেসব তেল এবং বেঁচে যাওয়া তেলগুলো ডে মন্টফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেখানে অধ্যাপক মার্টিন গ্রুটভেল্ড এবং তাঁর দল তেলগুলো নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। এ দলটি কার্যত একই ধরনের আরেকটি গবেষণা চালাচ্ছিলেন। তাঁরা তেলগুলোকে বিভিন্ন তাপে জ্বালিয়ে, সেগুলোর পরিবর্তন লক্ষ করছিলেন।
ভাজা বা রান্নার জন্য বেশি তাপমাত্রা (১৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা কাছাকাছি তাপমাত্রায়) ব্যবহার করলে, তেলের স্বাভাবিক কাঠামো পরিবর্তিত হয়ে যায়। এ প্রক্রিয়াকে বলা হয় অক্সিডেশন বা বাতাসের অক্সিজেনের সঙ্গে বিক্রিয়া। অক্সিজেনের সঙ্গে ফ্যাটি অ্যাসিড পুড়ে তৈরি হয় অ্যালডিহাইড এবং লিপিড পার অক্সাইড। ঘরের স্বাভাবিক তাপমাত্রাতেও একই ধরনের ঘটনা ঘটে। তবে খুব ধীরে ধীরে। লিপিড পচে যাওয়ার সময়ও অক্সিজেনের সঙ্গে বিক্রিয়া হয়।
যেকোনো অ্যালডিহাইড খুব সামান্য পরিমাণে খেয়ে ফেললে বা নিঃশ্বাসের সঙ্গে গ্রহণ করলে, তা ভয়াবহ স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। হৃদরোগ বা ক্যানসারের মতো রোগও হতে পারে অ্যালিডিহাইউ থেকে।
অধ্যাপক মার্টিন গ্রুটভেল্ড বলেন, ‘দেখি কি, ভুট্টা বা সূর্যমুখীর তেলের মতো যেসব তেলে বহু-অসম্পৃক্ত ফ্যাটি অ্যাসিডের পরিমাণ বেশি, সেগুলো উচ্চমাত্রার অ্যালডিহাইড তৈরি করে।’ তিনি আরো বলেন, ‘অবাক হয়েছি। সবসময় ভাবতাম সূর্যমুখী তেল স্বাস্থ্যকর। ... ভাজা বা রান্নার মতো বেশি তাপমাত্রার কাজে ব্যবহার না হওয়া পর্যন্ত সূর্যমুখী বা ভূট্টার তেল নিরাপদ। একটি নিরাপদ উপাদান সামান্য জ্বালেই রাসায়নিক ক্রিয়া-বিক্রিয়ায় ক্ষতিকর হয়ে উঠতে পারে।’
অপরদিকে, জলপাই বা ক্যানোলা তেল খুব সামান্য অ্যালডিহাইড উৎপাদন করে। মাখন ও হাঁসের চর্বির ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। এর কারণ হলো এসব তেলে সম্পৃক্ত ও একক-অসম্পৃক্ত ফ্যাটি অ্যাসিডের পরিমাণ থাকে বেশি। উচ্চ তাপমাত্রাতেও এগুলোতে তেমন কোনো রাসায়নিক পরিবর্তন হয় না। সত্যি বলতে কি, সম্পৃক্ত তেলে অক্সিডেশন বিক্রিয়া হয় না বললেই চলে। অর্থাৎ এটি বাতাসের অক্সিজেনের সঙ্গে বিক্রিয়া করে না।
ভাজা বা রান্নার ক্ষেত্রে অধ্যাপক গ্রুটভেল্ডের প্রথম পছন্দ জলপাই তেল। তিনি বলেন, ‘প্রথমত [এই তেলে জ্বাল দিলে, বিক্রিয়ার ফলে] যেসব উপাদান তৈরি হয়, সেগুলোর মধ্যে ক্ষতিকর উপাদান খুব কম। দ্বিতীয়ত উৎপাদিত উপাদানগুলো মানবদেহের জন্য খুব বেশি ক্ষতিকর নয়।’
গবেষকরা বলছেন, রান্নায় সূর্যমুখী বা ভূট্টার তেল ব্যবহার না করে সম্পৃক্ত প্রাণিজ চর্বি ব্যবহার করা ভালো।
গ্রুটভেল্ড বলেন, ‘প্রাণিজ চর্বি (লার্ড) বা বহু-অসম্পৃক্ত ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ তেলের মধ্যে বেছে নিতে হলে, আমি প্রাণিজ চর্বিকেই নেব।’
ভোজ্য তেল বিষয়ে অধ্যাপক গ্রুটভেল্ডের পরামর্শ হলো :
১. খাবারকে যথাসম্ভব কম ভাজতে চেষ্টা করুন। উচ্চ তাপমাত্রা পরিত্যাজ্য। যদি ভাজতেই হয়, তবে যথাসাধ্য কম তেল ব্যবহার করুন। সম্ভব হলে টিস্যু বা শোষক কাগজ দিয়ে ভাজা খাবারের বাইরে সেঁটে থাকা তেল মুছে নিন।
২. খাবারে ক্ষতিকর অ্যালডিহাইডের পরিমাণ কমাতে এমন তেল বেছে নিন, যাতে একক-অসম্পৃক্ত বা সম্পৃক্ত ফ্যাটি অ্যাসিডের পরিমাণ বেশি। অর্থাৎ তেলে দুই উপাদানের যেকোনো একটির পরিমাণ ৬০ শতাংশ কিংবা দুটি মিলিয়ে ৮০ শতাংশের বেশি। বহু-অসম্পৃক্ত ফ্যাটি অ্যাসিডের পরিমাণ হতে হবে ২০ শতাংশের নিচে।
৩. রান্নার আদর্শ তেল হলো জলাপাই। এতে একক-অসম্পৃক্ত ফ্যাটি অ্যাসিডের পরিমাণ ৭৬%, সম্পৃক্তের পরিমাণ ১৪% এবং বহু-অসম্পৃক্তের পরিমাণ মাত্র ১০%। বহু-অসম্পৃক্ত ফ্যাটি অ্যাসিডের চেয়ে একক-অসম্পৃক্ত এবং সম্পৃক্ত ফ্যাটি অ্যাসিড বহুগুণে অক্সিডেশন প্রতিরোধী।
৪. জলপাই তেল ব্যবহারের ক্ষেত্রে সেটি পুরোপুরি রাসায়নিক মুক্ত [এক্সট্রা ভার্জিন] নাকি কিছু পরিমাণ রাসায়নিক যুক্ত [সাধারণ জলপাই তেল], তা বিবেচনা করে লাভ নেই। কারণ যেকোনো জলপাই তেলে জ্বাল দিয়ে একই পরিমাণ অক্সিডেশন হয়।
৫. তেল সবসময় আলমারিতে অন্ধকারে রাখুন। কোনো তেলই দ্বিতীয়বার ব্যবহারের চেষ্টা করবেন না। কারণ নতুন বিক্রিয়ায় তাতে আরো বহু নোংরা বিষাক্ত উপাদান তৈরি হয়।
তেল, চর্বি এবং তাতে ফ্যাটি অ্যাসিডের পরিমাণ :
জেনে রাখুন
- বহু-অসম্পৃক্ত ফ্যাটি অ্যাসিড বা চর্বিতে থাকে কার্বন-কার্বনের দুই বা ততোধিক দ্বিবন্ধন। বাদাম, শস্যবীজ, মাছ বা শাক হিসেবে খাওয়ার সময় এটি বেশ উপকারী। তবে সূর্যমুখী বা ভুট্টার তেলে অনেক বেশি পরিমাণ বহু-অসম্পৃক্ত ফ্যাটি অ্যাসিড থাকলেও তার উপকারিতা নিশ্চিত করে বলা যায় না।
- একক-অসম্পৃক্ত ফ্যাটি অ্যাসিডের রাসায়নিক গঠন হলো কেবল একটি কার্বন-কার্বন দ্বিবন্ধন। সরিষার তেল, নাশপাতি জাতীয় আভোকাডো, জলপাই, জলপাইয়ের তেল, কাঠবাদাম, পশু চর্বি বা হাঁসের চর্বিতে পাওয়া যায় এ ধরনের চর্বি। জলপাই তেলের ৭৬% একক-অসম্পৃক্ত ফ্যাটি অ্যাসিড। ভূ-মধ্যসাগর অঞ্চলের দেশগুলোতে হাজার বছর ধরে জলপাই তেলের বহুল ব্যবহার আছে। এ অঞ্চলের মানুষের হৃদরোগের পরিমাণও খুব কম। যাঁরা পরিশ্রম কম করেন, তাঁদের জন্য একক-অসম্পৃক্ত ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ তেল উপযুক্ত। বাংলাদেশে সরিষার তেলে সম্পৃক্ত ফ্যাটি অ্যাসিডের পরিমাণ ৬-১০%, একক-অসম্পৃক্ত ফ্যাটি অ্যাসিডের পরিমাণ ৬৫-৭২% এবং বহু-অসম্পৃক্ত ফ্যাটি এসিডের পরিমাণ ২০-২৬%। তবে এ তেলে অধিক মাত্রায় ইরুসিক অ্যাসিড এবং অ্যালাইল আইসোথায়োসায়ানেট (যার জন্য সরিষার তেলের তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধ হয়) থাকায় এ তেল ভোজ্য হিসেবে খুব বেশি গ্রহণযোগ্য হয়নি। তবে বীজের জিনে পরিবর্তন ঘটিয়ে কম ইরুসিক অ্যাসিড সম্পন্ন তেল বীজ উৎপাদন করা হয়েছে। এমন বীজকে বলা হয় র্যাপসিড। এর তেলকে বলা হয় ক্যানোলা।
- সম্পৃক্ত তেলের পরমানুগুলোর মধ্যে কোনো দ্বিবন্ধন নেই। এতদিন প্রাণিজ তেল-চর্বি খাওয়াকে অনুৎসাহিত করা হলেও, এর ক্ষতিকর দিক নিয়ে শক্তিশালী প্রমাণের অভাব রয়েছে।