অভিমত
আশা-নিরাশার সার্চ কমিটি
নির্বাচন কমিশনে কারা থাকবেন, এমন ব্যক্তিদের খুঁজে তাঁদের একটি তালিকা তৈরির জন্যই মূলত সার্চ কমিটি গঠন করা হয়। নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে আমাদের সংবিধানে যেহেতু সুনির্দিষ্ট কোনো আইন নেই, এ জন্য বিগত বছগুলোতে এই প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে দেখা গেছে। গত সংসদ নির্বাচন কেমন হয়েছে, সেটি সবাই জানি। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) যখন এবার বেশ আগেভাগেই সংবাদ সম্মেলন করে তাদের একটি পরিপাটি প্রস্তাবনা জাতির সামনে তুলে ধরে, সবার মধ্যে তখন আশার সঞ্চার হয়েছিল যে মহামান্য রাষ্ট্রপতি সংলাপের মাধ্যমে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন কমিশন গঠনের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবেন।
বাংলাদেশের গণমানুষের প্রতিনিধিত্বকারী একটি বড় রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির অধিকার রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলোর সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত করার। সে কথাটি বিবেচনায় নিয়ে বিএনপি একটি প্রস্তাবনা দেয়, যেখানে কেমন হবে সার্চ কমিটি, কারা কারা আসতে পারেন নির্বাচন কমিশনে ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে বিস্তারিত প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে। বিএনপির প্রস্তাবনাটি পড়ে মনে হয়েছে, কিছুটা কষ্টসাধ্য হলেও এভাবে যদি একটি নির্বাচন কমিশন গঠন করা যায়, তবে সত্যিকার অর্থেই সেই কমিশন দিয়ে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব। উল্লিখিত প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিতে বিএনপি সংলাপের আহ্বান জানিয়েছিল। আমরা দেখেছি, মহামান্য রাষ্ট্রপতি দ্রুততম সময়ের মধ্যে সংলাপ আয়োজন করে দায়িত্বশীল দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিয়েছেন। মোটামুটি সব রাজনৈতিক দল সেখানে তাদের নিজস্ব মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছে। সংলাপ শেষে রাষ্ট্রপতি অবশ্য রাজনৈতিক দলগুলোকে নিজেদের মধ্যে সংলাপ অনুষ্ঠানের তাগিদ দিয়েছিলেন, যদিও বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক পরিবেশ দলগুলোকে একত্র করতে পারেনি।
শেষ পর্যন্ত বুধবার সন্ধ্যায় সার্চ কমিটি গঠন-সংক্রান্ত একটি প্রজ্ঞাপন জারি হয় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে, ছয় সদস্যের সমন্বয়ে গঠন করা হয়েছে এ কমিটি। আপিল বিভাগের বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বে ছয় সদস্যের এই কমিটিতে রয়েছেন হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি ওবায়দুল হাসান, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক মাসুদ আহমেদ, সরকারি কর্মকমিশনের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাদিক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য শিরীন আখতার। এ কমিটি এখন নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য নাম প্রস্তাব করবে এবং রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ কমিটি মনোনীত ব্যক্তিদের মধ্য থেকে অনধিক পাঁচ সদস্যের একটি নির্বাচন কমিশন গঠন করবেন।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, আওয়ামী লীগের পছন্দের লোকদের নিয়ে এই কমিটি গঠন করা হয়েছে, এখন এই সার্চ কমিটির কাজ কী হবে তা স্পষ্ট হয়ে গেছে। বিএনপির দাবি ছিল, যারা অবসরপ্রাপ্ত এবং লাভজনক পদে নেই এমন ব্যক্তিদের নিয়ে একটি সার্চ কমিটি গঠন, অথচ নবগঠিত সার্চ কমিটিতে যাঁরা স্থান পেয়েছেন, তাঁদের প্রত্যেকেই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। এবং দুঃখজনক হলেও সত্য, এঁদের প্রত্যেকেই আওয়ামী ঘরানার আমলা বা বুদ্ধিজীবী হিসেবে পরিচিত। এখন বিএনপি যদি এই কমিটি নিয়ে হতাশা প্রকাশ করে, তবে আগামী সংসদ নির্বাচন নিয়েও অনিশ্চয়তা থেকে যায়। ন্যূনতম একটি সমঝোতায় পৌঁছানো এখন সময়ের দাবি, নয়তো যেভাবে একের পর এক গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো ভেঙে পড়ছে, তাতে আগামী দিনের বাংলাদেশ নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হবে।
আওয়ামী লীগ অবশ্য হতাশ না হতে আহ্বান জানিয়েছে, অর্থাৎ এই সার্চ কমিটি তাদের পছন্দ হয়েছে। বিএনপির এই ক্ষোভ এবং হতাশা মহামান্য রাষ্ট্রপতি কীভাবে প্রশমন করেন, সেটিই দেখার বিষয়। বিএনপি সার্চ কমিটি গঠনের যে প্রস্তাব দিয়েছিল, সেই প্রস্তাবের ভিত্তিতে ১০ জনের একটি তালিকাও রাষ্ট্রপতির কাছে হস্তান্তর করেছিল বলে গণমাধ্যমের বরাতে জানা গেছে। সবচেয়ে ভালো হতো, যদি আমরা রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে এই প্রথম স্তরটির কাজ সমাধা করতে পারতাম। অথচ দেখা যাছে, শুরুতে এসেই হোঁচট খেতে হচ্ছে। তবু আশা থাকবে, রাষ্ট্রের অভিভাবক হিসেবে রাষ্ট্রপতি ভেবে দেখবেন, কীভাবে সব পক্ষকে একটি সমঝোতার মধ্যে নিয়ে আসা যায়, এখনো সম্ভাবনা শেষ হয়ে যায়নি। আমরা কেউ চাইব না যে, দেশ আবারও সংঘাতময় পরিস্থিতির দিকে ধাবিত হোক। জিইয়ে থাকুক বাংলাদেশের সব সম্ভাবনা।
লেখক : অধ্যাপক, গণিত বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।