পাঠাভ্যাস
ক্লাস রুমের পাশেই বইমেলা
এখনকার প্রজন্ম ফেসবুক আর হোয়াটস অ্যাপ নিয়ে বুদ হয়ে থাকে। বই তারা পড়তেই চায় না। বই বলতে পাঠ্যবই নয়। পাঠ্যবইয়ের বাইরের বই- গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, অনুবাদ অন্যান্য। কিন্তু বই না পড়লে কি চলবে? বই না পড়লে এ প্রজন্ম মনের আলোয় কীভাবে আলোকিত হবে? এ রকম অবস্থার জন্য দায়ী আসলে কারা? প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা নাকি আমরা?
প্রশ্নটি কিন্তু থেকেই যায়। ভালো রেজাল্টের দাবি ছাড়া আমরা কি কখনো তাদের সামনে তুলে ধরেছি ভালো কিছু? ভালো বই, ভালো চলচ্চিত্র, সব ভালো। উত্তরটি অনেকাংশে ‘না’। তাহলে আমাদের ছেলেমেয়েরা কি জঙ্গিবাদে যুক্ত হবে? তাদের হাত দিয়েই কি ঘটবে গুলশানের হলি আর্টিজানের মতো সন্ত্রাসী ও ঘৃণ্য ঘটনাগুলো? জাতি হিসেবে আমরা আসলে কী রেখে যাচ্ছি পরবর্তী প্রজন্মের জন্য?
বছর খানিক আগের কথা। সমাজের একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে সাংবাদিকতার বাইরে তুষার আব্দুল্লাহর মনের ভেতরও এ প্রশ্নগুলো ঘুরপাক খেত। সে সময় একই চিন্তার সমমনা কয়েকজন প্রকাশকও যুক্ত হন তাঁর সঙ্গে। কী করা যায়? কৈশোর তারুণ্যের বই থাকবে ক্লাস রুমের পাশে। সেখানে ছাত্রছাত্রীরা বই দেখবে, বইয়ের গন্ধ নেবে, বই পড়বে আবার পছন্দ হলে বই কিনে নিতেও পারবে। সবকিছু ঘটবে তাদের ইচ্ছে মতো। বই নিয়ে আলোচনাও চলবে তাদের সঙ্গে।
এমন চিন্তা থেকেই শুরুটা। প্রথম বইমেলার আয়োজন চলে উত্তরা রাজউক মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজে। অংশ নেয় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, প্রথমা, অনুপম, অ্যাডন, সময়, জাগৃতি, অনন্যা, কাকলী, ইউপিএল, ইকরিমিকরি, বেঙ্গল পাবলিকেশনস প্রভৃতি প্রকাশনী প্রতিষ্ঠান।
এভাবেই শুরু কৈশোর ও তারুণ্যের বইমেলার। এরপর বইমেলা চলে ঢাকার বিএন স্কুল, ধানমুণ্ডি বয়েজ, মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুল এবং ঢাকার বাইরে ময়মনসিংহ, পাকশী, বগুড়া, রাজশাহী, বরিশাল, ফেনী, চাঁদপুর জেলার বিভিন্ন স্কুলে। এ পর্যন্ত মোট ২৫টি বইমেলার আয়োজন হয়েছে। শুধু তাই নয় ‘কৈশোর ও তারুণ্যে বই’ এই স্লোগানটাই এখন রূপ নিয়েছে সংগঠনে। দশ সদস্য বিশিষ্ট কমিটির আহ্বায়ক তুষার আব্দুল্লাহ এবং যুগ্ম আহ্বায়ক অ্যাডর্ন পাবলিকেশন্সের মালিক সৈয়দ জাকির হোসেন।
‘কৈশোর ও তারুণ্যে বই’ সংগঠনের উদ্যোগে চার দিনব্যাপী বইমেলার শুরু হয়েছে ৩০ জুলাই থেকে, ধানমণ্ডির ছায়ানটে নালন্দা বিদ্যালয়ে। সংগঠনের বর্ষ পূর্তি উপলক্ষে ওইদিনই সকাল ১১টায় বইবন্ধু সম্মিলনেরও আয়োজন করে তারা।
এমন চমৎকার উদ্যোগ দেখতে আমরাও পা রাখি ছায়ানট ভবনে। ‘আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে বিরাজও সত্য সুন্দরও’ গানের সঙ্গে নালন্দা বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সম্মিলিত পরিবেশনায় শুরু হয় বইমেলাটি।
ছায়ানটের তৃতীয় ও চতুর্থ চলায় বেশ ভিড়। বিদ্যালয়ের শিশুরা দেখছে নানা বিষয়ের বইগুলো। কেউ কেউ বইয়ের লিস্ট তৈরি করছে ডায়রিতে। ছোট্ট ছোট্ট শিশুরা আয়েস করে জটলাবেঁধে দেখছে ইকরিমিকরির বইগুলো। শিশুদের বই নিয়ে এমন লুটোপুটি দেখতে এসেছিলেন সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানী, বিশেষজ্ঞ ও কথাসাহিত্যিক আনোয়ারা সৈয়দ হক, অধ্যাপক হাসান সফি, লেখক আনিসুল হকও।
কথা হলো সাংবাদিক তুষার আব্দুল্লাহর সঙ্গে। আশার কথা শোনালেন তিনি, ‘প্রথম মেলাতেই অবাক হলাম। শিশুরা বই দেখছে, বই নিয়ে কথা বলছে, নিজের পছন্দের বইও কিনছে। স্কুলের শিশুদের বই নিয়ে ঝাপাঝাপিটাই আমাদের উৎসাহ ও সাহস জোগায়। আমাদের ভুল ভাঙ্গে। এ প্রজন্মের শিশুরা শুধু ফেসবুক বা হোয়াটস অ্যাপে বুদ হয়ে থাকে না। তাদের কাছে বই নিয়ে যেতে পারলে তারা অবশ্যই বই পড়ে।’
কথায় কথায় অ্যাডর্ন পাবলিকেশন্সের মালিক সৈয়দ জাকির হোসেনও জানালেন তাঁর অনুভূতি। বইমেলায় প্রকাশক হিসেবে কে কত বই বিক্রি করল এটা কিন্তু মুখ্য বিষয় থাকে না। আমরা দেখি শিশুদের আগ্রহের দিকটা। বই নিয়ে তার আনন্দটা। শিশুদের বইপড়ুয়া হিসেবে গড়ে তোলাই আমাদের সংগঠনের মূল উদ্দেশ্য।
ফেব্রুয়ারির বইমেলায় বিশাল আয়োজন হয়। সেখানে বই বিক্রির প্রক্রিয়া আছে। কিন্তু সে প্রক্রিয়াতে কোনো পাঠক তৈরি হয় না। পাঠক তৈরিতে আমাদের কোনো উদ্যোগও নেই। আমাদের যারা শিশু-কিশোর, তাদেরই সঠিকভাবে গড়ে তুলতে হবে। তাদের হাতে তুলে দিতে হবে মানসম্পন্ন বই। ভবিষ্যৎ পাঠক তৈরিতে এ ধরনের মেলা অনন্য ভূমিকা রাখবে বলে মনে করেন সময় প্রকাশনের মালিক ফরিদ আহমেদ। আয়োজনকারীদের একজনও তিনি।
ক্লাস রুমের পাশে এ ধরনের বইমেলা শিশুকিশোরদের বইয়ের প্রতি কতটুকু আগ্রহী করে তুলছে? এমন প্রশ্নটি ছিল নালন্দা বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ তানিয়া আক্তারের কাছে। তাঁর উত্তরটি আরেকটু আশাবাদের ইঙ্গিত দেয়। তিনি বললেন, ‘স্কুলে স্কুলে শুধু বইমেলার আয়োজন করলেই চলবে না, শিশুকিশোরদের জন্য তৈরি করতে হবে মান সম্পন্ন ভালো বই। ভালো বইয়ের মেলাই শিশুদের চিন্তার জগৎকে আলোকিত করবে।’
কিন্তু এ ধরনের মেলা নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের ভাবনাটি কেমন?
আগ্রহী হয়ে কথা বললাম নালন্দা বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির টুকটকি, নিলয়, সুমাইয়া ও অবন্তির সঙ্গে। তাঁদের সবার উত্তর প্রায় একই: ‘বইমেলায় যখন যাই তখন অভিভাবকদের পছন্দে বই কিনতে হয়। তা ছাড়া ফেব্রুয়ারির পরে ভালো কোনো বই আমরা কোথায় গিয়ে কিনব? নিজের পছন্দে, নিজের মতো করে বই ঘেঁটে আমরা বই কিনতেও পারছি মেলায়, এটা অনেক ভালো উদ্যোগ। সব স্কুলে এ ধরনের মেলার আয়োজন সারা বছরই হওয়া উচিত। আমরা যদি নিজের পছন্দে বই কিনতে পারি তাহলে সবাই তো নিজ পছন্দে বই পড়ব।’
বইবন্ধু সম্মিলনে অনেকেই কথা বললেন। পাঠ্যপুস্তকে রসবোধ নেই। পাঠ্যপুস্তক থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জসিমউদদীন আর হুমায়ুন আজাদের লেখা বাদ দেওয়া নিয়ে হতাশা প্রকাশ করলেন অনেকেই। সিলেবাসের বাইরে বই পড়তে অভিভাবকরাও ছেলেমেয়েদের উৎসাহিত করে না বলে অভিযোগ ওঠে। প্রশ্ন ওঠে তাহলে আমরা আমাদের সন্তানদের কী শিখাচ্ছি?
হতাশা কাটিয়ে সামনে এগিয়ে চলার সাহসের কথা বললেন কামাল লোহানী। তবুও কাজ করে যেতে হবে। ক্লাসরুমের পাশে বই— এটি অসাধারণ কাজ। ‘কৈশোর ও তারুণ্যে বই’ এ সংগঠনটি প্রত্যেকটি স্কুলের শিশুদের মাঝে যেন বাঙালির ঐতিহ্য, বাঙালির সংস্কৃতি, বাঙালির ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অসাম্প্রদায়িক চিন্তাকে ছড়িয়ে দিতে পারে সে আশাই করছি।’
‘কৈশোর ও তারুণ্যে বই’ সংগঠনটি তাদের বইমেলার কার্যক্রমকে অব্যাহত রাখার পাশাপাশি সামনের দিনগুলোতে শিশুকিশোরদের সঙ্গে লেখক, প্রকাশক ও প্রচ্ছদ শিল্পীদের মতবিনিময়, শিশুদের জন্য মানসম্পন্ন বইয়ের ক্যাটালগ তৈরি এবং বই বিষয়ক আরও প্রতিযোগতামূলক কার্যক্রম হাতে নিবে। আমরাও আশাবাদী। বই নিয়ে এমন উদ্যোগগুলো চলতে থাকুক সারা দেশে। বই নিয়ে কথা, বইয়ের জন্য কথা আর বইয়ের কথাতেই আলোকিত হোক আমাদের সন্তানরা।
লেখক : গবেষক