প্রতিক্রিয়া
রোবটের ওড়না আর আমাদের সমাজ
শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র কদিন আগে একটা স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন ফেসবুকে। তিনি ঢাকায় এসে দেখেন মেয়েরা ওড়না পরে না। তো তিনি খুব আমোদিত এবং উত্তেজিত হয়ে লিখলেন, ‘আজকাল কি ওড়নার চল উঠে গেল?’ এই ধরনেরই ছিল স্ট্যাটাসটা। তো এই স্ট্যাটাস নজরে এনে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়েরই অন্য বন্ধুরা প্রতিবাদ করল। তখন তাঁর পরিচয়ে জানা গেল তিনি একটি সাহিত্য সংসদ বা ক্লাবের পরিচালক।
তো এই সবে অবাক হওয়া ছেড়ে দিয়েছি। বছরখানেক আগেও আমাদের পরিচিত সোসাইটি, যাদের সঙ্গে গল্প করি, খাই, আড্ডা দেই, সেলফি তুলি—তারাই, সেই সমাজই যে কতটা নারীবিদ্বেষী তা আবিষ্কার করে কষ্টে বেদনায় ট্রমাটাইজ হয়ে যেতাম। এখন সেসব কিছু হয় না। শুধু একেকবার একেকটা ধাক্কার মতো আসে সেটা সামলাই। তাই রোবটের গলায় ওড়না পেঁচানো নিয়ে কেন জানি খুব বিস্ময় কাজ করেনি আমার। এইটা কেন স্বাভাবিক নয়? যে দেশে পাঠ্যবইয়ে ‘ও’ তে ‘ওড়না’ পড়ানোর নিয়ম চালু হয়, যেদেশে গর্ব করা জিডিপি গ্রোথে অর্ধেক সমান অবদান রাখার পরও প্রতিনিয়ত কর্মক্ষেত্রে, গণপরিবহনে নারীকে হয়রানির শিকার হতে হয়, নিজেকে ‘কাভার্ড’ করতে করতে যে দেশের গ্রামের, শহরের মেয়েরা ক্রমাগত মমিতে পরিণত হয়, সে দেশে রোবটের গলায় ওড়লা নিয়ে কী বলার থাকতে পারে আমি জানি না।
নারীর পোশাকের রাজনীতি এক জটিল এবং আগ্রহ-উদ্দীপক সাবজেক্ট আমার কাছে। নারীর শরীরকে এ দেশে এমন ট্যাবু করে দেখা হয় যে তা অবিশ্বাস্য ঠেকে। নারীর শরীরকে স্রেফ শরীর হিসেবে গ্রহণ করার মানসিকতা এত বছরেও গড়ে ওঠেনি আমাদের দেশে। এটা সর্বস্তরের মানসিকতা। আমরা আধুনিক বলে যাদের অ্যাডোর করি, যাদের শ্রদ্ধা করি এমন মানুষ থেকে শুরু করে রাস্তায় কনুই দিয়ে বুকে ধাক্কা মারা পুরুষ— সবাই প্রায় একই মানসিকতা পোষণ করেন। আমাদের দেশেই বড় বড় বিলবোর্ডে ভারতীয় বা পশ্চিমা দেশের প্রয়োজন অনুযায়ী কাপড় পরা মডেল যাঁরা দেখছেন সহজভাবে, তাঁরাই রাস্তায় ওড়না ছাড়া একটা মেয়ে দেখে বিকৃতির চোখে তাকাচ্ছেন।
আমরা এইটার নাম দিয়েছি, ‘আমাদের সমাজ’। আমাদের সমাজের বাস্তবতায় এই চলে না, ওই চলে না, ওদের দেশের বাস্তবতায় চলে—এরকম কথা বলতে আমরা ভালোবাসি। আমাদের সমাজে ওড়না ছাড়া কোনো মেয়ে চলে না কিন্তু ধর্ষণ চলে, বউ পেটানো চলে, নারী এক মজার, নেড়েচেড়ে ঘেঁটে দেখে ওই যে দাউদ হায়দাররা যে ভাষাতে বলেন সেই ভাষায় যদি বলি রেত:ক্রিয়া করার একটা বস্তুমাত্র। মা-বোনের বাইরে যে কোনো মেয়েই যৌনবস্তু। দিনে দিনে নানা কায়দায় আমরা এই সমাজ সৃজন করেছি। এর থেকে মুক্তির উপায় খুঁজতে আমরা চেষ্টা চরিত্র চালালেও অবস্থা দিনদিন খারাপই হচ্ছে।
রোবটটিকে ওড়না পরানো আমাদের সাধারণ সমাজব্যবস্থার একটা ছবি। অ্যাট আ গ্লেন্স আমাদের সমাজে নারীর অবস্থান বোঝাতে ওড়না পরা রোবট একটা ইতিহাস হয়ে থাকবে।
ব্যক্তিগত একটা ব্যাপার শেয়ার করি। আমরা কয়েক বন্ধু এমনিতে ওড়না টড়না পরি না। কিন্তু ব্যাগে একটা স্কার্ফ রাখি। ভিড়ে-ভাট্টায় বা যেখানে চোখের দৃষ্টি সহ্য করা অসম্ভব হয়, সেখানে ব্যাগ থেকে বের করে পরে ফেলি। আমরা এটাকে বলি ‘সোসাইটি গলায় ঝুলানো’। তো নারী সে মানুষ হোক বা রোবট তারে ‘সোসাইটি’ গলায় ঝোলাতেই হবে। মুক্তি নাই।
লেখক : সাংবাদিক, ডিবিসি