ঐতিহ্য
বাংলাদেশের শীতল পাটি এখন বিশ্বের গর্ব
বাঙালির রোজকার জীবনে শীতল পরশ-বোলানো শীতল পাটি এখন মৃতপ্রায় শিল্প। হারিয়ে গেছে এই পাটি বানানোর প্রধান অনুষঙ্গ ‘বেত’, ‘মুর্তা’ বা ‘মোস্তাক’ গাছ। ‘পাটিয়ারা দাস’, ‘পাটিয়াল’ বা ‘পাটিকর’রাও এখন আর এই শীতল পাটি বানিয়ে তাদের জীবন-জীবিকার রসদ খুঁজে পান না। দিন বদলাচ্ছে আর ক্রমান্বয়ে হারাচ্ছে আমাদের হাজার বছরের পুরোনো বাঙালি ইতিহাস ও ঐতিহ্য। তারপরও আশাজাগানিয়া এসব ইতিহাস ও ঐতিহ্যের স্বীকৃতি আদায়টা কিন্তু ফসকাচ্ছে না। বাঙালির শীতল পাটি এখন বিশ্ব ঐতিহ্য।
একটা সময় ছিল, কোনো ঘামঝরানো চৈত্রের দুপুরে শণের ঘরের বারান্দায় খেজুর পাতা অথবা বেতে বানানো পাটিকে মাদুর বানিয়ে সেখানে বসে দুদণ্ড জিরিয়ে নিত মানুষ। সেই মহামূল্যবান পাটি পৌঁছাত গ্রাম থেকে নগরে বড় সাহেবদের ইট-পাথরের ঘরের বিছানায় কিংবা সম্রাটের রাজপ্রাসাদে। ওই পাটির আসনেই আপ্যায়িত হতেন বাঙালি অতিথিরা। আধুনিক এই যান্ত্রিক যুগে সুসজ্জিত বুননে মাস ধরে একটা পাটি বানিয়ে বাজার ধরবে এমন কারিগর যেমন পাওয়া যাবে না, তেমনি বেতবনের সেই সবুজ ঝোপঝাড়ও মিলবে না। মেশিনে কৃত্রিম প্লাস্টিক ঢেলে দিলে ‘সিনথেটিক’ পাটি মেলে মিনিটে কয়েক ডজন। পাওয়া যায় ফুটপাথ থেকে দামি শোরুমে। দামও সাধারণের নাগালের মধ্যে। প্লাস্টিকের পাটিতে থাকুক স্বাস্থ্যহানির আশঙ্কা তবু কোথায় পাব বেতের পাটির মতো অনন্য প্রাকৃতিক মাদুর?
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় সিলেটের ঐতিহ্যবাহী শীতল পাটি মোগল শাসনামলে সম্রাট আওরঙ্গজেব এবং ব্রিটিশ আমলে রানি ভিক্টোরিয়ার রাজদরবারে উপঢৌকন হিসেবে গিয়েছিল এবং রাজরাজারা যারপরনাই প্রীত হয়েছিলেন। জানা যায়, ১৯১৯ সালে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমন্ত্রিত হয়ে সিলেটে সেখানকার বেত ও বাঁশের বানানো চেয়ার টেবিল, ব্যাগ ইত্যাদি দেখে অভিভূত হয়ে কয়েক ফর্দ কিনে নিয়ে শান্তিনিকেতনে ব্যবহার করেছিলেন।
সেই সিলেটের ঐতিহ্যগত কুটির শিল্প শীতল পাটি এখন জাতিসংঘের ইউনেসকো স্বীকৃত বিশ্ব ঐতিহ্য। আজকাল এই পাটির দাম আকাশচুম্বী হয়ে যাওয়ায় এখন আর গ্রামীণ মানুষের মাদুর বা চাদরের পরিবর্তে ব্যবহৃত হয় না। এখন এটা শহুরে সামর্থ্যবানদের আবাসঘর সাজসজ্জার অনুষঙ্গ হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
মুর্তা বা বেত নামের গুল্মজাতীয় উদ্ভিদের ছাল থেকে এই পাটি তৈরি হয়। সিলেটের একজন ইতিহাসবিদ ও বৈষ্ণব সাহিত্যের পণ্ডিত অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধি রচিত ১৯২০ সালে প্রকাশিত ‘শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত’ ইতিহাস গ্রন্থের প্রথম খণ্ডের চতুর্থ অধ্যায়ে শীতল পাটির বর্ণনা পাওয়া যায়। ইতিহাসবিদ লিখেছেন, ‘ইহা শীতল, মসৃণ ও আরামজনক বলিয়া সর্বত্র আদৃত। বঙ্গদেশের অন্য কোথায়ও এই রূপ উৎকৃষ্ট পাটি প্রস্তুত হইতে পারে না। পাটির বেত্র রঞ্জিত ক্রমে পাশা, দাবা প্রভৃতি বিবিধ খেলার ছক ইত্যাদি চিত্রিত করা হয়। পাটির মূল্য গুণানুসারে ১০ আনা হইতে ১০ টাকা পর্যন্ত হইতে পারে। বেত্র যত চিকণ হয়, মূল্য ততই বর্ধিত হয়। পূর্বে নবাবের আমলে ২০-২৫ টাকা হইতে ৮০-৯০ টাকা, এমনকি শত-দ্বিশত টাকা পর্যন্ত মূল্যের পাটি প্রস্তুত হইত বলিয়াও শুনা যায়।’
এখনকার দিনে স্বল্প পরিসরে মান বুঝে ৫০০ টাকা থেকে শুরু করে ১০ হাজার টাকা মূল্যের শীতল পাটি বাজারে পাওয়া যায়। এই সময়ের অর্থমূল্যের তুলনায় শতবর্ষ আগে এই পাটির দাম সোনার দামের চেয়েও বেশি ছিল তা অনুমান করাই যায়। সিলেটের বালাগঞ্জ উপজেলার তেঘরিয়া চানপুরন, শ্রীনাথপুর, আতাসন, গৌরীপুর, লোহামোড়া, খুজগীপুর, কোয়ারগাঁও, হরিশ্যাম, টেকামুদ্রা, কলমপুর, আলগাপুরসহ আরো বেশ কয়েকটি গ্রামের কয়েক হাজার লোক একসময় এই দামি শীতল পাটিশিল্পের সঙ্গে জড়িত ছিল। সিলেট অঞ্চলের অন্যান্য এলাকায় শীতল পাটি তৈরি হলেও বালাগঞ্জের শীতল পাটির মান সবচেয়ে ভালো। ঔপনিবেশিক আমলে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, রাশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শীতল পাটি রপ্তানি হতো। ভিনদেশিরা বাংলাদেশে এলে স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে মসলিন কাপড়ের সঙ্গে শীতল পাটিও সংগ্রহ করে নিয়ে যেতেন। এ দেশের জমিদাররাও ভিনদেশি অতিথিদেরকে এসব ঐতিহ্য উপহার দিয়ে তুষ্ট করতেন।
গেল বুধবার দক্ষিণ কোরিয়ার জেজু দ্বীপে ইউনেসকোর ‘ইনটেনজিবল কালচারাল হেরিটেজ’ (আইসিএইচ) কমিটির ১২তম অধিবেশনে বিশ্বের নির্বস্তুক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ২০১৭ (দি ইনটেনজিবল কালচারাল হেরিটেজ অব হিউম্যানিটি) হিসেবে শীতল পাটিকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এর আগে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সহায়তায় বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর ২০১৬ সালে শীতল পাটিকে ইউনেসকোর ‘ইন্টারগভর্নমেন্টাল কমিটি ফর দ্য সেফগার্ডিং অব দি ইনটেনজিবল কালচারাল হেরিটেজ’-এর ১২তম অধিবেশনে বিশ্বের নির্বস্তুক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য প্রস্তাবনা উত্থাপন করে।
আবহমান বাংলার লোক-ঐতিহ্যের অনন্য স্মারক এই শীতল পাটি। লোককবিদের কাব্যগানেও রয়েছে শীতল পাটির আলাদা স্থান। শীতল পাটির পরশে প্রাণ জুড়ানোর কাল হয়তো আমরা পেরিয়ে এসেছি, এসি বা ফ্যানের বাতাসেই এখন আমরা গরমে আরাম খুঁজি। তারপরও শীতল পাটির আবেদন আমাদের স্মৃতিকাতর মন থেকে হারাতে পারেনি।
আমাদের আশার কথা এই যে, দিন দিন বাংলাদেশের নানা ঐতিহ্য ও ইতিহাস এখন বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্যের স্বীকৃতি পাচ্ছে। প্রত্ননিদর্শন হিসেবে পাহাড়পুরের বৌদ্ধবিহার ও বাগেরহাটের ষাটগম্বুজ মসজিদ, ম্যানগ্রোভ বন হিসেবে সুন্দরবন এবং বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্যের স্বীকৃতি পেয়েছে। এবার এই তালিকায় নাম উঠল সিলেটের শীতল পাটিরও।
আমরা যদি বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বেত গাছের চাষ সম্প্রসারণ করতে পারি, পাটিয়ালদের ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করতে পারি তবে বিশ্ব ঐতিহ্যের আবেগি পরশ আমাদের নতুন প্রজন্মকেও নিশ্চয় দিতে পারি। সরকারি বা বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় আবার ফিরুক শীতল পাটির অনুপম শিল্প। ঐতিহ্যের আতিশয্যে কাটুক বাঙালি জীবন।
লেখক : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন